১০৯,পুরান ঢাকার আগা সাদেক রোডের পৈত্রিক বাড়ি মোবারক লজে ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করে এক শিশু। সেদিন হয়তো আগত এই অতিথি সম্পর্কে কারো কোন ধারণা ছিলো না কতোটা দেশপ্রেম অন্তরে লালন করে শিশুটি হয়ে উঠবে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ,দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও যে পিছপা হবে না।
প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী এই ছেলেটি ১৯৬১ সালে যোগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে। চাকুরী জীবনের শুরুতেই সাফল্যের সাক্ষর রাখা এই ছেলেটি ১৯৬৭ সালে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতিও লাভ করেন।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাত জন বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত বীর সৈনিকদের মধ্যে তিনি একজন।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান।
১৯৭১ সালের জানুয়ারী মাস। যুদ্ধ তখনও শুরু হয় নি। মতিউর রহমান দুই মাসের ছুটিতে জানুয়ারী মাসে করাচি থেকে সপরিবারে ঢাকায় এসেছেন।ইতিমধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটছে। মার্চের ৭ তারিখে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক আসে রেসকোর্স ময়দান থেকে। শোষণ – বঞ্চনার শিকার বাঙালিরা প্রস্তুতি নিচ্ছে মুক্তি সংগ্রামের। এরই মধ্যে বাঙলার বুকে নেমে আসে পাকিস্তানি হায়েনাদের থাবা ।২৫ মার্চ কাল রাতের ভয়াবতা স্তব্ধ করে দেয় পুরো দেশকে।ছুটি শেষ হয়ে গেলেও মতিউর রহমান তখনও দেশেই। পাকিস্তানিদের নির্মমতায় ক্ষত -বিক্ষত মন নিয়ে ভৈরবে গড়ে তোলেন একটি প্রতিরোধ বাহিনী।কিছু মুক্তিকামী জনতাকে ট্রেনিং দিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনা তখন মনে।
কিন্তু বারবার চাকুরী থেকে ডাক আসায়
০৯ মে তিনি ফিরে যান সপরিবারে করাচিতে।
অথচ মন পড়ে আছে দেশে। পরিকল্পনা করেছিলেন পাকিস্তান থেকে একটি বিমান হাইজ্যাক করে ভারতে এসে যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নেবেন। কিন্তু সুযোগ মিলছিলো না।
আগষ্টের ২০ তারিখ, শুক্রবার ,বেলা ১১.১৫ । করাচির মৌরিপুর বিমান ঘাঁটি ।
টি-33 বিমান নিয়ে রানওয়েতে এগোচ্ছে পাকিস্তানি পাইলট রশীদ মিনহাজ। এর আগেই তিনি রানওয়ের পূর্ব পাশে অপেক্ষমান। রশীদ মিনহাজ যখন রানওয়ে দিয়ে বিমান নিয়ে এগিয়ে আসছে মতিউর রহমান তখন এগিয়ে গিয়ে ইশারায় বুঝালেন বিমানের যন্ত্রাংশে সমস্যা আছে। সিগন্যাল পেয়ে বিমানটি থামায় রশিদ মিনহাজ। এই সুযোগে বিমানে উঠেই তিনি ক্লোরোফরম দেয়া রুমাল চেপে ধরেন মিনহাজের নাকে। অজ্ঞান করার জন্য। কিন্তু অজ্ঞান হবার পূর্বেই মিনহাজ রেডিওতে বলে ফেলে বিমানটি হাইজ্যাক হয়েছে। পাহাড়ের আড়ালে থাকায় বিমানটি দেখা না গেলেও কন্ট্রোল রুমে পৌঁছে যায় সেই বার্তা ।সাথে সাথেই চারটি জঙ্গি বিমান ধাওয়া করে মতিউর রহমানকে।রাডারকে ফাঁকি দেয়ার জন্য যদিও তিনি নিচু দিয়ে চালাচ্ছিলেন বিমানটি। এদিকে দ্রুতই জ্ঞান ফেরার পর রশীদ মিনহাজের সাথে বিমানের ভেতরেই চলছিলো ধস্তাধস্তি। এক পর্যায়ে মিনহাজ বিমানের ইজেক্ট সুইচ চাপলে বিমান থেকে ছিটকে পড়েন মতিউর রহমান। প্যারাসুট না থাকায় এবং ভাগ্য প্রতিকূল হওয়ায় তিনি নিজেকে আত্মরক্ষা করতে ব্যর্থ হন। শহীদ হলেন মতিউর রহমান। বিধ্বস্ত বিমান থেকে আধা মাইল দূরে সিন্দু প্রদেশে জিন্দাগ্রাম এলাকায় পাওয়া যায় মতিউর রহমানের মৃত দেহ।
গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য উল্লেখ না করলেই নয় । পাকিস্তানের এজেন্ট জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে ৩০ শে আগষ্ট রশীদ মিনহাজকে শহীদ মর্যাদা দিয়ে একটি কলাম প্রকাশ করে জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী। যেখানে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে ভারতের গুপ্তচর বলে উল্লেখ করা হয়!
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী মতিউর রহমানের মৃতদেহ মশরুর বিমান ঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের গোরস্থানে কবর দেয়। তাঁকে গাদ্দার বলে উল্লেখ করে এবং রশীদ মিনহাজকে শহীদ আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করে।
.
মতিউর রহমানের সাহসিকতা ও বীরত্বের সংবাদ তখন মুক্তিযোদ্ধাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ করে তোলে মুক্তি সংগ্রামে।
২০০৬ সালের ২৩ জুন , চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সেই কবরস্থান থেকে মতিউর রহমানের মৃত দেহাবশেষ
এনে পুনরায় দাফন করা হয় মীরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে। দেশের মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তিনি আমাদের মুক্তিসংগ্রামের একজন মহান নায়ক।
সংযুক্তিঃ- ফেসবুকের কল্যাণে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের একটি চিঠি আমরা পড়েছি , অনেকে শেয়ারও করেছেন টাইমলাইনে। মতিউর রহমানের সহধর্মিণী এক সাক্ষাতকারে জানান যে , চিঠিটি মতিউর রহমানের নয়। কেননা , মতিউর রহমান তখন পরিবার নিয়ে করাচিতেই থাকতেন। ২০ শে আগষ্ট তিনি পরিবারের সাথেই ছিলেন এবং বাসা থেকে বিদায় নিয়েই কর্মস্থলে যোগ দেন। তাই চিঠি লেখার কোন দরকার ছিলো না। তাছাড়া মতিউর রহমান যে চিঠিগুলো পাঠিয়েছেন আগে সেগুলো পাকিস্তান সরকারের কাছে রয়ে গেছে অন্যান্য জিনিসপত্রের সাথে। তাই তিনি এই চিঠিটি প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছিলেন সেই সাক্ষাতকারে।
আমাদের বীরশ্রেষ্ঠগণ এমনিতেই স্মরণীয় ও শ্রদ্ধা যোগ্য। তাই তাঁদের সম্মানের প্রতি আমরা যেন আরও সচেতন হ

৬৪৮জন ৬৪৬জন
0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ