প্র্যাকটিকাল খাতার ছবিগুলোও এঁকে দিয়েছিল বড় ভাইয়া। ছবি আঁকার হাত আমার আবার খুব ভাল কিনা! একবার চে’গুয়েভারার ছবি আঁকতে চেষ্টা করছিলাম। মনে হলো পারবো, কয়েকটা পয়েন্ট আছে সেগুলো ঠিক রাখা। ছবি আঁকা কী এমন কঠিন কাজ! শুধু চোখটা অাঁকতে পারলেই হলো। শুরু করলাম চোখ আঁকা। ডান চোখ খুব সুন্দর মতোই সমাপ্ত করলাম, এখন বায়ে। বাম চোখটা আর ডানের মতো হচ্ছে না। চোখ দুটো যদি দুই রকম হয় তবে ছবিটি কি হতে পারে তা অনুমেয়। আঁকিবুঁকি আমাকে দিয়ে হবেনা। দিলাম হাল ছেড়ে। যে নাকি গরু, ছাগল আর মাটির গর্তের চিত্রই আঁকিয়ে নেয় বড় ভাইকে দিয়ে সে আঁকবে চে’ গুয়েভারা!?
চিত্রটা সংগ্রহে নেই। অন্তত আঁকিবুঁকি, কাটিকুটিটা দিতে পারতাম এখানে।
২০১১-তে
কবিগুরুর সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম বন্ধু ক’জন। সেখানে জলছাপে আঁকা কবিগুরুর একটা ছবি দেখে মনে হল ছবিটি আঁকব আমি। সেই থেকেই আবার ভুত চাপলো ছবি আঁকার। জানি আমাকে দিয়ে হবে না। তবু মনে হলো পারবো।
কোন এক খেয়ালে আমার রুমের (ভাড়া বাসা) ঠিক টেবিলের পাশের দেয়ালে শুরু করলাম ছবি আঁকা। এবারের বিষয় কবিগুরু। এবারও শুরু চোখ থেকে। মুখের অবয়বটা আঁকার পরই চোখের কাজ ধরলাম। তবে এবার ডান নয়,বাম চোখ আগে আঁকব। ডানহাতি বলে আমাদের মস্তিষ্ক ডান দিকের কাজকে সাড়া দেয় ঠিকঠাক। তাই এবার মস্তিষ্ককে বোকা বানাতে বাম চোখে পূর্ণ মনোযোগ স্থাপন করলাম। মস্তিষ্ক কি আমার মতো বলদ যে আমি বোকা বানাব আর সে তা জানবেনা! যাই হোক শুরু করলাম আঁকা। বামচোখটা আঁকা সম্পন্ন হলো, এভাবে কবিগুরুর একটা অবয়ব দাঁড় করাতে সমর্থ হলাম। কী এঁকেছিলাম তা আপনারাই দেখে নিন।
আমার জীবনের প্রথম ও শেষ( তারপর অনেক চেষ্টা করেছি,এজন্যই শেষ বলছি)।
ছবিটা আঁকার পর যে ভালোলাগা বা অানন্দের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম তা মাটি হতে সময় লাগলো না, যখন মনে পড়ল জীবনের প্রথম আঁকা ছবিটা এঁকেছি ভাড়া করা এক বাসার দেয়ালে। নিজের আঁকা হলেও নিজের থাকবে না,বলতেও পারব না। একটা সময় পর ধরেও রাখতে পারবো না নিজের বলে।
২০১৫-তে
যখন ভাড়া বাসা চেঞ্জ করার কথা ভাবছি তখন ভয়ঙ্কর এক বেদনা আমায় ভর করলো। যতক্ষণ বাসায় থাকি ছবিটা ফেলে যেতে হবে ভেবে চোখটা জলে ভরে উঠত।
কি করব ছবিটা? রেখেই যাব এভাবে নাকি কালো কালিতে ঢেকে দিয়ে যাব ছবিটা। ওর চিন্তায় সারাক্ষণ মনটা উদাসিন থাকত। বাসায় আমার উদাসিনতার খবর জানতে পেরে সবাই আমাকে সান্তনা দিতে শুরু করলো, এর কি সান্তনা হয় কোনো? যেখানে নিজেই পারছিনা নিজেকে শান্ত করতে!
মনোস্তাত্মিক এক দ্বন্দ্বে কাটতো আমার দিন।
ছবিটার ভাগ্যে কি ঘটবে?
এই ভাবনাটা খুব ভাবাত আমায়। সেই ভাবনা থেকে– “‘তোর অথবা আমার “নামে
কয়েকটা লাইন লিখেছিলাম।
তোর প্রতি সবার অবহেলা
অথবা আমার নিষ্ঠুরতা।
কোনটা সহ্য হবে তোর?
আমিই বা সবার অবহেলা কতটুকু মানতে পারবো?
অথবা আমার নিষ্ঠুরতা!
মনে কর,তোকে কেউ রাঙিয়ে দিল নতুন কোনো
রঙে অথবা কালো কালির আস্তরণে ঢেকে দিল
তোর অবয়ব।
কতটা সহ্য হবে তোর!
অথবা আমার!
মনে কর, কেউ বিকৃত করলো তোকে।
মুখ, চোখ, নাক সবই বদলে গেলো তাতে।
কতটা সহ্য হবে তোর?
অথবা আমার?
স্রষ্টাই তো ক্ষমতা রাখেন ধ্বংসের।
তাই যদি হয় তবে আমার হাতেই হবে তোর ধ্বংস।
আমার হাতেই যে তোর জন্ম!
আমিই করব অবহেলা।
আমিই হব নিষ্ঠুর।
আমিই হব নির্দয় তোর প্রতি।
আমিই হব ধ্বংসকারী।
কতোটা সহ্য হবে তোর?
অথবা আমার!
লেখাটা দিয়েছিলাম ফেসবুকে।সেদিন বন্ধু আনিস কমেন্টে বলেছিল, তুমি পারবে না। ঠিকই পারিনি আমি,সত্যিই পারিনি। নিষ্ঠুর, নির্দয় হতে পারিনি আমি।
তবে আরো কিছু না পারায় রয়েই গেছে। সে না পারাগুলো কখনো পারা হবেনা আর।
২২টি মন্তব্য
ব্লগার সজীব
ছবি আকার চেস্টার কথা পড়ে হাসলাম খুব। শেষের দিকে এসে মন খারাপই হয়ে গেল। সৃস্টিকে আসলে স্রস্টা ধংস করতে পারেননা।
কবির ছিবিটা খারাপ হয়নি কিন্তু। চেস্টা চালু রাখুন।
ইকরাম মাহমুদ
চেষ্টার কথা বললেন তো? কবিগুরুকে আঁকার দঃসাহস থেকেই নজরুল আর বঙ্গবন্ধুকে আঁকার কাজটা হাতে নিয়েছিলাম। সমস্যা সেই একই। চোখ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারিনি। জাতীয় কবিকে আঁকতে গিয়ে যা হয়েছিল তা শুনলে যে কেউ গড়াগড়ি খাবে। আঁকার পর মনে হয়েছিল, এটা তাঁকে অপমানিত করছে। তাই নিজেকে বিরত রেখেছি।
ব্লগার সজীব
শুনতে চাই আপনার এমন অংকন কাহিনী 🙂
ইকরাম মাহমুদ
:D) 😀
শুন্য শুন্যালয়
আমি দিব্যি দেখতে পারছি সেই যন্ত্রণা, ফেলে রেখে যাবার যন্ত্রণা। কমপক্ষে একটা ছবি তুলে রাখতে পেরেছেন, যা ক্ষতকে হয়তো বাড়িয়েই দেয় আরো।
ছবি সুন্দর না হওয়া কিংবা একটু অন্যরকম হওয়া কিন্তু ছবির অপমান নয়, বরং চিত্রকর না হয়েও এইযে প্রিয় মানুষগুলোকে আঁকার চেষ্টা এ বরং অসামান্যই মনে করি।
ছবিটা অসম্ভব ভালো লেগেছে আমার, সাথে কবিতায় আপনার কষ্টটাও নাড়া দিলো। শেষ বলে কিন্তু কিছু নেই, সে শুরুই ঘুরেফিরে। আবার শুরু করুন ভাইয়া।
ইকরাম মাহমুদ
এ এমন এক যন্ত্রণা যা বারবারই ফিরে আসে, আরো কিছু যন্ত্রণা নিয়ে। তাই বিরত রাখি নিজেকে। ধন্যবাদ শূন্য, মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছেন। জানিনা আবার কখনো রং পেন্সিল ধরা হবে কিনা, শুরুর মতো আবার শুরু হবে কিনা, যদিও ধরি কবিগুরুকেই আঁকব। বারবার আঁকতে চাইব তাঁকে।
নীলাঞ্জনা নীলা
মন খারাপের কিছুই নেই। আমি খুবই ভালো ছবি আঁকতে পারি।
ছবি আঁকা প্রতিযোগীতায় কখনো যাইনি, কারণ অন্যরা হেরে যাবে।
ছোট্ট একটা সাজেশন দিতে পারি। যা পারিনা, তার জন্য মন খারাপ না করে, যা নিজেকে দিয়ে হয়, সেটাই করা উচিৎ।
এই যে আপনি কবিতা লিখতে জানেন, অনেকে তাও জানেনা।
প্রতিটি মানুষের কোনো না কোনো প্রতিভা আছে, যেমন আপনার আছে অক্ষর দিয়ে শব্দ তৈরীর খেলা।
ইকরাম মাহমুদ
সাজেশন গ্রহন করা হল। ঠিক, সবাইকে দিয়ে সব হয় না। ছবি আঁকা হোক আর না হোক ছবিটা যে আমার লেখার উপজীব্য হল!
ধন্যবাদ আপু। আমিও আর প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে চাই না। জানি, আমার মতো…… 😀
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি প্রাক্টিক্যালের খাতা ভাইকে দিয়ে আঁকিয়ে নিয়েছিলাম 😀
মিষ্টি জিন
আমি ছবি আঁকতে জানি না ..যে কোন হাতে আঁকা ছবি ই আমার ভাল লাগে। কবিগুরুর ছবিটা কিন্তু ভাল হঁয়েছে ।
নিজের সৃষ্টিকে ছেডে আসা কষ্টের।
সেই কষ্ট আপনার কবিতায় স্পষ্ট দেখতে পেলাম।
ইকরাম মাহমুদ
দেয়ালে ছবি যেই দেখতো সেই বলতো এমন কথা। কষ্টটা যে ওখানেই…..
আরেকটা সান্তনা খুঁজে নিলাম এবার নিজে থেকেই। কবিগুরুর ছবিটা এবার জায়গা পেলো সোনেলার ক্যানভাসে।
ইঞ্জা
ভাই আমিও আঁকার ক্ষেত্রে লবডঙ্কা কিন্তু নিজের সৃষ্টিকে বিসর্জন দিয়ে আসার কষ্টটা আমি অনুভব করতে পারছি।
ইকরাম মাহমুদ
কষ্টটা তখনই কমে যখন অপর কেউ তা বুঝতে পারে। সৃষ্টির প্রতি আমি অবহেলা করিনি। করতে চাইনি। খুব মনে হতো ছবিটা নিজের কাছে রাখতে না পারার অভিশাপে আমাকে জ্বলতে হবে সারাজীবন। আমার অনুভূতি অনুভব করতে পারছেন ভেবে নিজেকে অনেক হালকা লাগছে। ধন্যবাদ ইঞ্জা
ইঞ্জা
শুভকামনা
মৌনতা রিতু
স্কেচ করার কিছু নিয়ম আছে। আঁকিবুকি আমার তো মোটেও হয় না।
আমার দুই ছেলে চমৎকার আঁকে। স্কেচ ও করে সুন্দর।
হ্যাঁ, যদি কিছু ফেলে আসা জিনিস যদি মনে হয় কেউ তার মুল্যায়ন করবে না, তবে কষ্টটা বেশি হয় তখন। আমার এই বাসায় স্পাইডারম্যানের একটা ছবি এঁকেছিল আগে যে এই বাসায় ছিল সেই ভাবির বাচ্চা। তো ছবিটা এখনো আছে।
ইকরাম মাহমুদ
যা সন্দেহ করেছিলাম তাই হয়েছে। মাস তিনেক আগে গিয়েছিলাম ছবিটা দেখতে। ঐ বাসার বাচ্চারা অনেক আদরে ছবিটার অবয়ব বদলে দিয়েছে। কবিগুরুর দিকে তাকাতেই ভয় করছিল খুব। অবর্ণনীয় সেই আদরের ছাপ। চোখে জল ধরে রাখতে পারিনি সেদিন।
সেই ভালো ছিল,জানতাম না কি হয়েছে ওর। কেনো যে জানতে গেলাম!!
যতটা সম্ভব ভুলে থাকতে চেষ্টা করি সেই বাড়ি আর ছবিটির কথা।
দুঃখটা অনেকখানি লাঘব হয়েছে আজ। ভালোও লাগছে খুব। সোনেলার দেয়ালে সেঁটে দিয়েছি এবার। এখানে সবাই আমার রবিকে জায়গা দিয়েছে তাঁদের মনে ঠিক আমার মতো করে। ধন্যবাদ মৌনতা আপু।
আবু খায়ের আনিছ
এই ছবি, আর কিছু বললাম না।
ইকরাম মাহমুদ
তুমি নতুন কি বলবে আর? সোনেলার গ্যালারিতে এই ছবিটির একটা ঠাঁই হল।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
এইতো হয়ে গিয়েছিল…..সত্যি বলতে কি ছবি আকাঁ ইচ্ছে করলে শিখা যায় না এটা গড গিফর্ট চিন্তাশক্তি। -{@
ইকরাম মাহমুদ
এ ছবিটা আঁকতে ২ থেকে ৩ ঘন্টা লেগেছিল। এত অল্পসময়ে কিভাবে সম্ভব হল তা নিজেও জানিনা। সত্যিই অাল্লাহ প্রদত্ত না হলে এটা সম্ভব নয়।
গাজী বুরহান
মানুষের অসাধ্য কিছুই নাই। কবিগুরুর ছবিটা তো ভালোঈ হয়েছে। বেস্ট অফ লাক।
ইকরাম মাহমুদ
ধন্যবাদ ভাই।