পথভোলা পথিক তুমি আমায় “রাঙিয়ে দিয়ে যাও, যাও, যাও গো এবার যাবার আগে!”—বসন্তের শেষ দিন। প্রকৃতিকে রাঙিয়ে দিয়ে সে চলে যাচ্ছে। এইতো সেদিনকার কথা, বসন্ত উৎসব! নাহ বিশাল আয়োজন করে নয়, আমাদের বাসায় হ্যারিকেনের আলোয় হারমোনিয়মে মামনি আর তবলায় বাপি, আর ছোট্ট আমি গান গাইছি চোখ বন্ধ করে।
“ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল্, লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥”
তারপর আরও অনেক গান। তবে সবশেষ গান হতো,
“মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন-দিনের স্রোতে এসে
হেসেই বলে, ‘যাই যাই যাই।’
পাতারা ঘিরে দলে দলে তারে কানে কানে বলে,
‘না না না।’
নাচে তাই তাই তাই॥”—এ গানের সাথেই বসন্তকে বিদায় জানাতাম আমরা। বসন্ত ঋতুর শেষ দিনকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। আমার যতো আনন্দের স্মৃতি সব চা’ বাগানের জীবনে। বছর শেষ কিংবা শুরু সবকিছুতেই আনন্দ লেপে থাকতো। উৎসব কাকে বলে, কি এসব শিখিয়েছে বাগানের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব। একটা কথা এখনও অনেকের কাছেই শুনি, যারা চা’ বাগানে বড়ো হয় তারা নাকি খুব উদার এবং সহজ মনের হয়। তাদের মধ্যে জটিলতা-কুটিলতা ব্যাপারটা সেভাবে থাকেনা। নাহ নিজের বিজ্ঞাপন করছিনা। সময়ে সবাই পাল্টে যায়। আমিও গেছি। যে চৈত্র সংক্রান্তিতে অস্থির থাকতাম পরের দিনের জন্য, এখন কি আর তেমন থাকি?
যাক সেসব কথা। মনে পড়ে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে আমাদের বাসায় শিব-দূর্গা সেজে মানুষরা আসতো, নাচ-গান করতো। মামনি ওদেরকে টাকা দিয়ে দিতো, সাথে বিভিন্ন রকমের মোয়া(চিড়া, মুড়ি, খই), নারকেলের নাড়ু। কারণ ওই দিন আমরা নিরামিষ খেতাম। যখন থেকে জ্ঞান হয় আমি দেখেছি চৈত্র সংক্রান্তির দিনে মামনি পূজো দিতো রোজকার মতো নয়। সকালে উঠেই স্নান করে ঠাকুর ঘরে গিয়ে প্রণাম দিতাম। আর মামনিকে দেখেছি সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্নান সেরে ভেঁজা কাপড়ে পিতলের ঘটিতে জল ভরে তার ভেতরে নিমপাতা সাজিয়ে দিতো। সেই নিমপাতার উপর সিঁদুর লাগিয়ে জবা ফুল, কাঁচা হলুদ, আড়াই টুকরো লবঙ্গ রেখে মাথার ওপর ওই ঘটি নিয়ে শীতলা দেবীর পূজা দিতো। সাধারণত নদীর পাশে বসে এই পূজা করা হয়, কিন্তু আমাদের বাগানে ছোট্ট একটা ছড়া(খাল) আর একটা পুকুর ছিলো। মাঝে-মধ্যে মামনি ভৈরব মন্দিরের পুকুরে যেতো, কখনো ওই খালে। একই সাথে গঙ্গা পূজাও করতো মামনি। প্রথমে জলে ধান-দূর্বা ছেড়ে দিয়ে দেবী গঙ্গাকে বরণ করে নেয়া হতো। আর পানের ওপর তেল-সিঁদুর মাখিয়ে তার উপরে রাখা হতো খই, জবা ফুল, ধান-দূর্বা। তারপরে সেই পান জলে ছেড়ে দেয়া হতো। সবশেষে প্রদীপ ভাসিয়ে দিতো জলে। সত্যি বলতে কি আমার ভালোই লাগতো দেখতে।
পূজো শেষ করে বাসায় ফিরে এসে মামনি উপবাস ভাঙ্গতো চা খেয়ে। তারপর চুলায় রান্না বসতো। সকালে হতো সাবু দানার খিচুড়ি, দুপুরে সজনে ডাটা দিয়ে মুগ ডাল, কাঁচা আমের চাটনি, ঘি দিয়ে নিমপাতা ভাজা, শুক্ত তরকারী, ডালের বড়ি দিয়ে নিরামিষ আর সেদ্ধ চালের ভাত। হুম সেদিন কোনো আমিষ রান্না হতোনা। আরেকটা কথা না বললেই নয়, চৈত্র সংক্রান্তির দিনেই প্রথম কাঁচা আম খাওয়া হতো, তার আগে নয়। আমার জন্মের পর থেকে চৈত্র সংক্রান্তির এ রূপটি দেখে এসেছি দেশের বাইরে আসার আগ পর্যন্ত। একইরকম হলেও বিরক্তিকর হয়ে ওঠেনি। শুধু তখন নিরামিষ জিনিসটা মোটেও পছন্দ করতে পারতাম না।
খাওয়া-দাওয়া শেষ, পহেলা বৈশাখের প্রস্তুতি নেয়া হতো। নববর্ষের অনুষ্ঠানের জন্য রিহার্সেল আমাদের বাসাতেই হতো একমাস ধরে। চা’ বাগানের স্টাফ এবং তাঁদের সন্তানরা সবাই মিলে এই অনুষ্ঠান করতো শমশেরনগর চা’ বাগানের বিশপ ক্লাবে। প্রথম দিকে ছোট আকারেই শুরু হয়েছিলো। তবে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো আমাদের বাসা থেকেই। তার আগে বিশপ ক্লাবে শুধু স্টাফরা গিয়ে পহেলা বৈশাখের আলোচনা অনুষ্ঠান করে চলে আসতো। ১৯৮৫ সালে আমরা যখন শমশেরনগর চা’ বাগানে এলাম কানিহাটি ফাঁড়ি বাগান থেকে, তখন মামনি বাপিকে বলেছিলো পহেলা বৈশাখে বাচ্চাদের নিয়ে কেন অনুষ্ঠান হয়না? আমার স্পষ্ট মনে আছে চৈত্র সংক্রান্তির কয়েকদিন আগে খাবার টেবিলে বসে খাচ্ছি আমরা, তখন মামনি বলেছিলো বাপিকে, “পহেলা বৈশাখে কোথায় বাচ্চারা আনন্দ করবে, গান গাইবে, নাচবে। তোমরা শুধু আলোচনা অনুষ্ঠানই করো।” বাপি বলেছিলো কেউ কি আর এসবে অংশ নেবে? মামনি পরেরদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সব বাসায় বাসায় গিয়ে বলে আসলো স্টাফদের বাচ্চাদেরকে আমাদের বাসায় আসতে। শুধু বাচ্চা না, কিশোর-কিশোরী সবাইকেই। যাক তারপর দিন থেকেই বিকেলে শুরু হলো রিহার্সেল। মামনি সবাইকে শেখালো, “এসো হে বৈশাখ।” সেই যে শুরু হলো রিহার্সেল। ২০০৩ সাল পর্যন্ত আমি দেখে এসেছি। সংক্রান্তির দিনে হতো ফাইনাল রিহার্সেল। সে যে কি এক আনন্দ! তারপর মামনির যতো সাদা-লালপাড় শাড়ী আছে সব ঠিক করে রাখা হতো সবার জন্য। তারপর ঘুম, নতুন বছরের অপেক্ষা।
হ্যামিল্টন, কানাডা
১২ এপ্রিল, ২০১৭ ইং।
২২টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
শুভ নব বর্ষ দিদি।মামনি বাপিকে জানাই প্রণাম।অতীত কখনো ভুলা যায় না।যা গত তাই হয়তো ছিল শুভ আগত দিনগুলো তেমনি থাকুক এই কামনা। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
শুভ নববর্ষ মনির ভাই।
সবসময় ভালো থাকুন। -{@
বায়রনিক শুভ্র
মা যখন ছিলেন তখন আমাদের বাসায় চৈত্র সংক্রান্তি মানেই ছিল ধোয়া মোছা দিবস ।
নীলাঞ্জনা নীলা
আচ্ছা। মামনি এখনও করে, তবে সেভাবে পারেনা।
শুভ নববর্ষ।
ইঞ্জা
স্মৃতির পাতায় শৈশব মোর রইলনা আর রইলোনা, অনেক আনন্দের দিন ছিলো শৈশবের দিন গুলি, আপনার লেখাটি পড়তে পড়তে আপু ফিরে গিয়েছিলাম সেইসব দিনে, আপনার লেখা চিঠি “প্রিয় শমশের নগর চা বাগান” আমাকে পরিচিত করেছে আপনার শৈশবকে আর আজ জানলাম আরো অনেক কিছু, মার দেওয়া পুজা, বাড়ী বাড়ী সবাইকে বৈশাখ উদযাপনের আমন্ত্রন, সব কিছুই যেন নিজ স্মৃতির গভীরে প্রথিত হলো।
মা, বাবাকে আমার প্রণাম ও শুভেচ্ছা জানাবেন।
শুভ নববর্ষ আপু, অনেক শুভেচ্ছা,ও শুভকামনা রইল।
নীলাঞ্জনা নীলা
হ্যান্ডপাম্প ভাইয়া শৈশব আমাকে সেভাবে টানেনা। কারণ তখন খুব বেশি লক্ষ্মী আর ভালো মেয়ে ছিলাম তো! দুষ্টুমী মোটেও করতাম না। আর জানেন তো ভালোরা বোরিং হয়? :p
অনেক অনেক ভালো থাকবেন ভাইয়া। শুভ নববর্ষ।
ইঞ্জা
আপনি কতো লক্ষি পক্ষি ছিলেন তা আমরা বুঝি :p
শৈশব কেবা ভুলে যেতে পারে আপু?
আর আপনি বোরিং ছিলেন 😮 বাহ বাহবা বুঝতে একেবারেই অসুবিধা হচ্ছেনা। ^:^
নীলাঞ্জনা নীলা
না, না আসলেই সত্যি। ছোটবেলায় আমি এমন দুষ্টু ছিলাম না।
বড়ো হয়ে দুষ্টু হয়েছি।
এখন আমার কথার জ্বালায় সবাই বিরক্ত হয়। আপনার মতো মাথার চুল ছিঁড়ে। 😀
নীহারিকা
পুরোনো কথাগুলো শুনতে কি যে ভালো লাগে!!! পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো আমি চলে গিয়েছি সেই সময়ে।
খুব ভালো লেগেছে দিদি।
নীলাঞ্জনা নীলা
নীহারিকা আপু স্মৃতি এমন এক ভাইরাস, যা আমাদের সকলকেই মিষ্টি-মধুর যন্ত্রণায় আক্রান্ত করে।
শুভ নববর্ষ। অনেক ভালো থাকুন।
শুন্য শুন্যালয়
চৈত্র নিয়ে এতো মজার আয়োজন ছিলো! স্মৃতির কথা তুমি এতো বেশি বেশি লেখো যে, সেসব আর স্মৃতি নেই, সবই বর্তমান।
শুভ নববর্ষ নীলাপু। ভালো থেকো সারাক্ষন। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
শুন্য আপু আসলে এখন তো আমার কাজই হলো জীবনের সব সুন্দর মুহূর্তগুলোকে জড়ো করে রাখার। সেটাই করি।
ভালো রেখো প্রতিটি ক্ষণ। শুভ নববর্ষ তিলোত্তমা। -{@
আমির ইশতিয়াক
শুভ নববর্ষ
নীলাঞ্জনা নীলা
শুভ নববর্ষ।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার স্মৃতি-কথা-গুলো এমন প্রাণবন্ত থাকে যে মনে হয় পাঠক হয়েও যেন
সেখানে উপস্থিত থেকেই সব আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছি।
তবে এখনকার বাস্তবতা অন্যরকম, সবই আছে প্রাণের প্রাণটুকু ছাড়া।
বৈশাখি মনোরম শুভেচ্ছা,
এবং মিষ্টান্ন শুভেচ্ছা প্রথম হওয়ার জন্য!! ( আমাগো ফাডা কপাল)
নীলাঞ্জনা নীলা
আফনের ফাডা কপাল!!! ক্যাম্নে ফাডলো? আহারে! 🙁 হুনেন ফাডা জায়গায় মলম লাগাইয়া দিয়েন। মলমের রেসিপি দিলাম শুধুমাত্র আফনের লাইগ্যা। লাল মরিচের গুড়ার ভিতর কেরোসিন দিয়া গুলাইবেন, এরপর লাগাইয়া রাখবেন। জোড়া লাগবোই লাগবো। 😀
প্রথম হইছি আমি, আপ্নারে খাওয়ামু ক্যান? কই আপ্নে আমারে খাওয়াইবেন, পুরষ্কার দিবেন। কুবিরাজ ভাই আফনে আমারে কবে
গিফটো দিবেন? 😀
ছাইরাছ হেলাল
শিউর আপনি ফাডাইছেন, তা না হলে এই মলম অন্য কেউ দেবার কথা কইবে-না।
পুরস্কার পাইলে মুনের আনন্দে কত্ত কিছুই না করে!!
আপনারে গিফটো দিব-না তো আর কাকে দিবো।
খালি দ্যাশে আইয়া লন, সুস্থ তবিয়তে।
নীলাঞ্জনা নীলা
ক্যান দ্যাশে না আইলে বুঝি পাঠানো যায়না? পুষ্টোপিস কি বন্ধ হইয়া গেছে?
বিচারকগোর দোষ, আমি নিজেও জানিনা ক্যাম্নে পুরুস্কার পাইছি।
আনন্দ কই দেখলেন? যাওয়া হইবে কিনা সেইটাই ঠিক নাই। 🙁 ;(
মেহেরী তাজ
আপু গতবছর পর্যন্ত আমি অনেক কে চৈত্রসংক্রান্তির শুভেচ্ছা জানিয়েছি। পরের দিন পহেলা বৈশাখ এর। অথচ এবার নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়েছি হাতে গনা দু/ চার জন কে।
হ্যা আপু সময়ে সবায় পালটে যায়।
আপু যদিও দ্বিতীয় দিন তবুও নববর্ষের শুভেচ্ছা। 🙂 -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
পিচ্চি আপু সময়ে সব পাল্টে যায়, যদিও আমরা দোষটা সময়ের উপরেই দেই।
কিন্তু সময়টা তৈরী করি আমরা নিজেরাই।
অনেক ভালো থাকবেন। -{@
চাটিগাঁ থেকে বাহার
বর্ষবরণ এখনও আছে। তাতে আগের সেই প্রাণবন্ত অংশগ্রহণ কি আছে?
এনালগ থেকে ডিজিটালে রূপান্তরিত হবার পর থেকে সবকিছু যেন আর্টিফিশিয়াল হয়ে গেছ। সবসময় মনে হয় কোথায় যেন টান টান উত্তেজনা। পারস্পরিক হৃদ্যতা যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা হয়ে যাচ্ছি রবোট!
নীলাঞ্জনা নীলা
ঠিক বলেছেন। এখন সবকিছু যেনো দেখানো। মন থেকে সেই টানটাই আর কাজ করেনা। হৃদ্যতা শব্দটি আভিধানিক এখন।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।