একঃ
পাটিগণিত –
জীবন যদি কাব্যকথা হয় তাহলে সেখানে জটিল আর দাঁতভাঙা শব্দ ব্যবহার করে সে কাব্যকথাকে কুটিলতার পর্যায়ে নিয়ে যাবার পক্ষপাতী আমি নই। সহজ সরল ভাষায় রচিত কাব্যকথা পড়তেও যেমন সুন্দর, ভালোলাগার রেশটুকুও মনে থেকে যায় আমৃত্যু। জগত-সংসারের কুটিলতাগুলিকে আমি প্রশ্রয় দেইনা। অন্যকে ভালোর পথের রাস্তা দেখাতে গিয়ে নিজেই ছোট হয়েছি অনেকবার তবে দমে যাইনি।
অল্প সময়ের একটাইতো জীবন। একে সুন্দরভাবে উপভোগ করে যেতে চাই।
দুইঃ
যাপিত সায়ানাইড –
একজন মানুষ হয়ে আমার যাপিত জীবনের শেষ একফোঁটা রসকেও আমি অন্য মানুষের কল্যানে বিলাতে চাই। এটা এমন কোন বড় বিষয় নয় তবে এই চিন্তাকে কাজে রুপান্তরিত করার মানসিকতা নিজের মধ্যে ধারণ করা সবসময় কি সম্ভব?
ধরুন, বাসার সামনে রাস্তার ধারে একটি বটগাছ লাগাবো। একসময় আমি যখন থাকবোনা তখন ঘর্মাক্ত দেহের ক্লান্ত পরিশ্রান্ত পথিকেরা একটু শীতল পরশ পাবার আশায় সেই বটগাছ তলায় বসে শরীর জুড়োবে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠে বলবে – আহা! কতইনা ভালো মানুষ ছিলেন তিনি যিনি এই গাছ লাগিয়েছিলেন।
এর থেকে বড় প্রাপ্তি একজন মানুষের জীবনে আর কিছু আছে কি? মনে হয়না।
তিনঃ
অবিনশ্বরবাদ-
মানুষ বেঁচে থাকলে রঙ বদলায়, আর মরে গেলে অমর হতে চায়। এটা আমাদের হোমোসেপিয়ান বৈশিষ্ট্য। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। তবে গ্লানির অনলে পুড়ে যে ভাবনাটি আমার মনে বার বার আসে – আমি মরে গেলে কি আর কারও জীবন অপূর্ণ থেকে যাবে? কে কে কাঁদবে আর কার কার মনে আমার জন্য বর্তমানের এই ভালোবাসা অম্লান থাকবে? এমন কি কেউ আছে? আদৌ কি কেউ থাকে?
আমি আজও এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইনি। আপনিও কি আমার মত করে কখনো ভেবেছেন?
চারঃ
নিউরনের জ্যামেতিক ষড়ভুজ-
মানুষের মস্তিষ্ক এক বৃত্তকার ষড়ভুজের কেন্দ্রের মত। অনুরণনের ব্যাসার্ধ, পরিধি, জ্যা সবকিছুই পুঙ্খানুরুপে মাপতে পারাটা অসম্ভব। আর্কিমিডিস যেদিন ইউরেকা ইউরেকা বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন সেদিন তিনি নিজেও কি জানতেন তার মস্তিষ্ক চৌবাচ্চার পানি এত পছন্দ করে? তা না হলে তার সেই ঐতিহাসিক সূত্র অন্য সময় মাথায় না এসে স্নানকার্যের সময়েই কেন আসলো? বিছানায় শুয়ে কিংবা গবেষনার টেবিলেওতো আসতে পারতো। একেবারে স্নানের সময়! মনুষ্য মস্তিষ্ক আসলেই এক আশ্চর্য বস্তু তাইনা?
এই দেখুন, মস্তিষ্ক নিয়ে বলতে গিয়ে ভুলেই গিয়েছি- বৃত্তাকার ষড়ভুজ কখনো হয়? জীবনে পড়েছেন বা শুনেছেন? দেখলেনতো আমার মস্তিষ্কও জটিলতার ঊর্ধে নয়।
পাঁচঃ
বক্রতার সীমারেখা-
আঁকা-বাঁকা পথের সীমানা পরিমাপ করার ভুল প্রয়াসই একজন বেদুঈনের যবনিকাপাত করে ঠিক মরুভূমির ক্যাকটাসের মতন। সারাদিন রাত্রির উচ্ছ্বল তপ্ততার ব্যাঘাত ঘটায় একপশলা বৃষ্টি। জীবন যেন তপ্ততায় অবগাহন করতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। শান্তিকে সিরিয়া আর প্যালেস্টাইনে সমাহিত করে নিজেদের মিথ্যে অহমিকা ঢাকতে এর নাম দিয়েছি বিগব্যাং থিউরি। কি অদ্ভুত!
আমিও মহাশুন্যে অন্তত একবার হাইপার ডাইভ দিতে চাই। ব্লাক হোলের বক্রতার দেয়াল স্পর্শ করে জানতে চাই সৃষ্টির আদি রহস্য।
দেখুনতো কান্ড! এসবতো সহজসরল ভাবেও বলা যেত। প্যাঁচানো গুরুগম্ভীর তত্ত্বকথা ক’জনা বোঝে?
ছয়ঃ
হিজল তমালের স্বপ্ন-
স্বপ্ন সাদাকালো এটা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। তবে আমার স্বপ্ন সবসময় রঙিন। আমি মকরক্রান্তিবৃত্তে সমুদ্রের নীলে সাদা মেঘের ভেলা বানিয়ে পাড়ি দেই কর্কটক্রান্তি রেখা। প্লাঙ্কটন জমা পুকুর জলের ধূসর ঢেউ ছুঁয়ে যাওয়া লাল ঠোঁটের মাছরাঙাগুলি খেলা করে আমার স্বপ্নে। লাল সবুজের বুকে আমি খালি পায়ে হেঁটে বেড়াই সদর্পে। এলার্জি জনিত রাজাকার শব্দেটির বর্ণমালায় আমার জন্মের স্বাক্ষর রেখে যেতে চাইনা। আমি ভালোবাসি মা মাটি দেশ। তাইতো স্বপ্ন নিয়ে রথী মহারথীদের কপচানো উপদেশকে আমি তুচ্ছ করে যাই বারংবার।
হিজল তমালের সাতরঙা আলোয় ভর করে আমার স্বপ্নে আসে বায়ান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর, পঁচাত্তর, নব্বই, দুই হাজার তেরো…। সাদাকালো দুঃস্বপ্নে অনেকগুলি শব্দের একটি বর্ণ ‘ক’- কে কলঙ্কিত করা কসাইটাকে জনতার মঞ্চে সফলভাবে মাটিতে পুঁতে ফেলেছিলাম সেদিন প্রথমবার – কাদের মোল্লা।
সাতঃ
দার্শনিক বোহেমিয়ান-
“সুর্য আমি- ঐ দিগন্তে হারাবো। অস্তমিত হবো, তব ধরণীর পরে স্মৃতিচিহ্ন রেখে যাবো।”
জীবনের দর্শনকে আমি মাত্র এই দু’লাইনেই ব্যাখ্যা করতে শিখেছি। এর গভীরতার ব্যাপ্তি খুঁজে পেলে সৃজনশীল ম্+আ+ন্+উ+ষ্+অ এর কাতারে আপনাকে স্বাগতম।
২২টি মন্তব্য
মাসুদ চয়ন
আমিও মহাশুন্যে অন্তত একবার হাইপার ডাইভ দিতে চাই। ব্লাক হোলের বক্রতার দেয়াল স্পর্শ করে জানতে চাই সৃষ্টির আদি রহস্য।প্রতিটি কাহনই গভীর বোধ সম্পন্ন।
তৌহিদ
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ভাই।
শাহরিন
গনিত একটি কঠিন ও অপছন্দের বিষয় আমার কাছে, তার পরেও করতে হয়। আমার কাছে বইয়ে পড়ার অংক আর জীবন অংক দুটোই এক মনে হয়। এক এক জনের সমাধানের চেষ্টা একেক রকম। কোন একটি ভূল হলেই সব শেষ।
তৌহিদ
দারুন বললেন আপু। জীবনের অংক মেলানোই কঠিন। সমাধানের চেষ্টা করে এগিয়ে যাওয়াই আসলে উত্তম।
শুভকামনা জানবেন।
জিসান শা ইকরাম
আমরা বলার সময় খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলতে পারি,
বাস্তবে এটি করা কঠিন।
বিস্তারিত মন্তব্য করবো আপনার পোস্টে।
পোস্ট ভাল হয়েছে খুব।
তৌহিদ
হ্যা ভাই, মুখে মুখে অনেজ কিছু বলি কিন্তু মন থেকে করি ক’জনা?
মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম। ভালোবাসা অবিরাম।
ছাইরাছ হেলাল
“জীবন যদি কাব্যকথা হয় তাহলে সেখানে জটিল আর দাঁতভাঙা শব্দ ব্যবহার করে সে কাব্যকথাকে কুটিলতার……”
এখানে দাঁত ভঙ্গা শব্দের সাথে কুটিলতার যোগসূত্র কিন্তু খুঁজে পাচ্ছি না।
জীবনকে দেখার দৃষ্টি ভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন হতেই পারে, আর হওয়াটাই স্বাভাবিক।
জীবনান্দ দাশের কবিতায় জটিল/কঠিন শব্দ-ঝঙ্কারে তো মাথা আউলা হয়ে যায়। কুটিলতার মত নেতিবাচক শব্দ দিয়ে তো কিছুই মেলানো যায় না।
তৌহিদ
যখন আপনাকে ইচ্ছেকৃত কেউ খোঁচা মেরে কথা বলবে আর আপনি অন্যায় জেনেও মুখ বুঝে সহ্য করে যাবেন সেটাই হচ্ছে জটিলতা। অনেকে মনে করেন উপদেশ দেবার ক্ষেত্রে কঠিন সব শব্দ ব্যবহার করলে সামনে থাকা মানুষটির কাছে নিজের ভাবগাম্ভীর্য প্রকাশ পাবে যা আদতেই ভুল। এটাই কুটিলতা।
এবার আসি কবিতায়- আমি পাঠক হিসেবে যেসব শব্দের অর্থ বুঝতে পারি সাবলিলভাবে সে কবিতা আমার কাছে বোধগম্য মনে হয়। তাই বলে কবিতা খারাপ তা কিন্তু নয়। সমস্যা হচ্ছে আমার জানার পরিধি কম। যে পাঠক যত বেশি পড়বেন তার শব্দভাণ্ডার ততই সমৃদ্ধ হবে।
ঠিক তেমনি যিনি আমাকে কথা শোনাচ্ছেন কঠিন কথায় তার জ্ঞানের পরিধিও কম। এটাই বুঝিয়েছি। আশাকরি বোঝাতে পেরেছি। আর হ্যা, জীবনবাবুর কঠিন শব্দও কিন্তু শ্রুতিমধুর। কারন তিনি ভালোবেসে সাহিত্য রচনা করেছিলেন বলেই এমন।
শুভকামনা জানবেন ভাই।
আরজু মুক্তা
আসলেই পৃথিবীর বুকে নিজের কিছু কাজ রেখে যেতে হবে! সবাই মনে রাখবে। তবে কাজটা জনকল্যাণ মূলক হলে ভালো হবে।
তৌহিদ
অবশ্যই আপু, অন্যের উপকারে নিজের সামান্য ত্যাগ আমাদের মহিমান্বিত করে তোলে।
রেহানা বীথি
আমার স্বপ্নগুলোও রঙিন। জটিল জিনিস ভয় পাই, কবিতাও। লেখাটা ভালো লাগলো ভীষণ।
তৌহিদ
স্বপ্ন রঙিন হওয়াই ভালো আপু। অল্প ক’দিনের পৃথিবীতে আলোকিত মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার নামই জীবন।
ধন্যবাদ জানবেন।
মনির হোসেন মমি
আপনি বরাবর ভিন্ন ধারার লেখা লিখে যান।আমি পড়ি আর ভাবি ভাইটিতো আমার মনের কথাগুলোই বলে দিল কিন্তু জানলো কি করে?প্রথম বোধগম্য নয় এমন কোন কিছুইতেই আমি ইন্টারেষ্টেড নই তাই সহজ সরল লেখাই আমার প্রিয়।
যাপিত সায়ানাইড – এ বিষয়টি আমার সামর্থ্যে যতটুকু সম্ভব করছি।
অবিনশ্বরবাদ- এই বিষয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহ নেই কারন মরে গেলে পৃথিবী কিংবা অন্য ভুবনে আমার কি দরকার!
নিউরনের জ্যামেতিক ষড়ভুজ- এ ক্ষেত্রে আমার মস্তিষ্ক ভরা গোবর।
সবশেষে
দার্শনিক বোহেমিয়ান-
“সুর্য আমি- ঐ দিগন্তে হারাবো। অস্তমিত হবো, তব ধরণীর পরে স্মৃতিচিহ্ন রেখে যাবো।”
এখানে আমার লোভ কাজ করে খুব।
চমৎকার একটি লেখা সেয়ারের জন্য ধন্যবাদ।
তৌহিদ
বাহ! আপনার আমার মনের কত্ত মিল দেখেছেন!! ☺☺
তবে আপনার মন্তব্যে আপনার নিজের সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানতে পারলাম। এটাই হচ্ছে দর্পণ। প্রতিটি মানুষের নিজের সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারনা থাকতে হয়।
মন্তব্যে অনেক ভালোলাগা। ধন্যবাদ জানবেন।
হাফেজ আহমেদ রাশেদ
আপনি লিখেন না ভাই,বলবো পাঠকের কথা গুলোই যেন বলে যান,,আর এটাই আমার কাছে লেখকের সার্থকতা, ভালো লাগলো লেখাটি
তৌহিদ
লেখাটি পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাই। শুভকামনা জানবেন।
সাবিনা ইয়াসমিন
ব্যক্তি জীবনকে গণিত, বিজ্ঞান, জ্যামিতি, দর্শন, প্রকৃতি সব কিছু দিয়ে ব্যাখ্যা করলেও জীবনের প্রকৃত ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব না। জীবনবোধ একেক জনের কাছে একেকরকম।
কুটিলতা কে জবাব দিতে হতে দাঁতের মায়া ত্যাগ করতেই হবে। কুটিলতা ও দাঁতভাঙা জবাব পরস্পর সাংঘর্ষিক।
শুভ কামনা 🌹🌹
তৌহিদ
ঠিকই বলেছেন আপু। জীবন দর্শন আসলে ব্যক্তিভেদে একেকরকম। একে লিখে প্রকাশ করা সম্ভবপর নয়। আমরা অতি সাধারণ মানুষ, মহামানব নই। কাজেই যে কোন ভুল ত্রুটিকে সংশোধন করে চলার মাঝেই আমাদের স্বার্থকতা।
তবুও কিছু সময় দাঁত হাড়ানোর ভয় থাকলেও অনেক কিছু বলতে হয়। না হলে আমি একজন মানুষ এটা অন্যেরা বুঝবে কি করে?
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানবেন।☺
রেজওয়ান
তাই হয়তো খুব ভয়ংকর রকমের কুআলোচনায় না পরলে তর্কে যাই না! অনেকদিন পরে আসলাম ভাল লাগছে পড়ে😇
তৌহিদ
আপনাকে দেখে ভালো লাগছে ভাই। সমালোচনা, তর্ক এসব এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম।
শুভকামনা জানবেন ভাই।
সিকদার সাদ রহমান
এমিন একটা বিষয় নিয়ে লিখলেন যেখানে সারাজীবন ৩ আর ১৩ পেয়ে ফেল করেছি। বরাবরই ভয়ের বিষয় গনিত!
তৌহিদ
এর থেকে জীবনের গণিত শিক্ষা করাই শ্রেয়। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।