বাংলাদেশ এখন শীতের তীব্র ঠান্ডা আবহাওয়া বিরাজ করছে। পৌষের এমন দিনে এক গ্লাস খেজুরের রস কিংবা রসে ভেজানো পিঠা খেতে সবারই ভালো লাগে। কিন্তু সাবধান! খেজুরের রস যখন খাবেন তখন সতর্ক থাকুন। কারণ এই সময়টাতেই খেজুরের রসের মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাস আক্রমণের তীব্রতা বেড়ে যায় যার ফলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই চলুন নিপাহ ভাইরাস সম্পর্কে জানি।
নিপাহ ভাইরাস কি?
নিপাহ ভাইরাস এক ধরনের জুনোটিক ভাইরাস। জুনোটিক ভাইরাস হচ্ছে সেই সকল ভাইরাস যা প্রাণী দেহ থেকে মানবদেহে রোগ ছড়াতে পারে। নিপাহ ভাইরাসের প্রাথমিক বাহক হচ্ছে বাদুড়। এ ছাড়াও শূকর, কুকুর, বেড়াল, ছাগল, ঘোড়া এবং ভেড়াও এই ভাইরাসজনিত রোগ ছড়ানোর মধ্যবর্তী বাহক হিসেবে কাজ করতে পারে।
১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মালয়েশিয়ায় নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রথম সনাক্ত করা হয়। এরপর ১৯৯৯ সালের মে মাসে সিঙ্গাপুরেও রোগটি সনাক্ত করা হয়। নিপাহ ভাইরাস হচ্ছে Paramyxoviridae গোত্রের অন্তর্ভূক্ত গণ Henipavirus এর অন্তর্গত।
এটি একটি আরএনএ ভাইরাস। মালয়েশিয়ার সুঙ্গাই নিপাহ গ্রামে প্রথম সনাক্ত করা হয় বলে ভাইরাসটির নামকরণ করা হয় নিপাহ ভাইরাস। ভাইরাসটি ড. কো বিং চুয়া আবিষ্কার করেন।
নিপাহ ভাইরাস কিভাবে ছড়ায়?
নিপাহ ভাইরাসের প্রাথমিক বাহক হচ্ছে বাদুড়। বাদুড়ের লালা, মলমূত্র, শ্বাস-প্রশ্বাস ও সংস্পর্শের মাধ্যমে এ রোগ বিস্তার লাভ করে। এছাড়া আক্রান্ত পশুর (কুকুর, বেড়াল, শূকর, ছাগল, ঘোড়া যা মধ্যবর্তী বাহক) সংস্পর্শ থেকেও নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ।
পাখি এবং বাদুড়ের আংশিক খাওয়া ফল থেকে এবং কাঁচা খেজুরের রসে যখন বাদুড় মুখ দেয় বা পান করে তখন নিপাহ ভাইরাস এই রসে ছড়িয়ে পড়ে যার মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করে। ফলে বাদুড়ের সংস্পর্শ পাওয়া খেজুরের রস খেলে এই ভাইরাস মানব দেহে আক্রান্ত হয়ে জটিল রোগের সৃষ্টি করে। আবার অসুস্থ মানুষ থেকে মানুষেও এই ভাইরাস ছড়ায়।
নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগের লক্ষণ–
নিপাহ ভাইরাস বাদুড়ের দেহে থাকার সময় বাদুড়ে কোন প্রকার রোগ লক্ষণ প্রকাশ পায় না। কিন্তু ভাইরাস মানবদেহ ও শূকরসহ অন্যান্য মধ্যবর্তী বাহকে প্রবেশ করলে ৭- ১৪ দিনের মধ্যে নানান রকম রোগ লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে থাকে। তার মধ্যে-
১. এক ইনফ্লুয়েঞ্জা সর্দি-জ্বরের উপসর্গ, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা।
২. বমি হওয়া এবং মাংসপেশির ব্যথা।
৩. শ্বাসযন্ত্রের মৃদু থেকে থেকে মারাত্মকভাবে প্রদাহ হয়ে শ্বাসকষ্ট এবং নিউমোনিয়া।
৪. মস্তিষ্কের কোষ ও কলায় প্রদাহ হয়। এর ফলে মাথা ঘোরা, অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং স্নায়ুবিক নানাবিধ উপসর্গ প্রকাশ পায়।
৫. পরিশেষে, এনসেপালাইটিস বা প্রদাহের কারণে রোগী ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোমায় গিয়ে মারা যেতে পারে।
নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধ পদ্ধতি-
এই রোগের কার্যকরী কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা বা প্রতিষেধক নেই। তাই প্রতিরোধ ব্যবস্থা মেনে চলাই উত্তম পন্থা। নিপাহ ভাইরাস প্রতিরোধে করণীয় উপায় গুলো হচ্ছে-
১. আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকা। এমনকি মৃতদেহ কবর দেয়া, গোসল করানো, সৎকার করা ও মৃত ব্যক্তিকে দেখতে যাবার সময়ও প্রচুর সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
২. সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এবং মাস্ক বা মুখোশ পরিধান করা উত্তম।
৩. গাছ হতে পাখির আংশিক খাওয়া ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪. খেজুরের রস ফুটিয়ে পান করতে হবে। রস ফুটিয়ে খেলে ও খেজুর রসের গুড়ে কোন সমস্যা নেই।
৫. খেজুরের রস সংগ্রহের হাড়ি ও পাইপ খোলা না রেখে ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়াও ফলমূল খাওয়ার পূর্বে ভালোভাবে ধুয়ে নেয়া এবং গৃহস্থলীর ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ঢেকে রাখতে হবে।
নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা-
সঠিক ব্যবস্থাপনা মেনে চলার পরেও নিপাহ ভাইরাসের লক্ষণ প্রকাশ পেলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা করে রাখতে হবে এবং তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র গ্লাভস পড়ে নাড়াচাড়া করতে হবে। যেহেতু এই ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকরী ঔষধ বা টিকা আবিষ্কৃত হয়নি তাই রোগের লক্ষণ দেখে সে অনুসারে কিছু ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এই ভাইরাস আক্রমণের মৃত্যুহার শতকরা ৭৯ ভাগেরও অধিক।
পরিবেশ বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের মতে, নিপাহ ভাইরাস ছড়ানোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কারন হচ্ছে বন ও গাছ ধ্বংস। গাছ কেটে ফেলে বন উজাড় করার ফলে বাদুড়ের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে বলেই এরা নতুন আবাসের জন্য এবং নিজেদের খাদ্য সংকট মেটাতে নতুন করে ফলফলাদীর গাছে আশ্রয় নিচ্ছে। যার প্রাদুর্ভাব পড়ছে আমাদের অর্থাৎ মানুষের উপর। তাই বাদুড়ের আবাসস্থল ধ্বংস করা মোটেই উচিত নয়।
বাংলাদেশে প্রায় প্রতিবছরই নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হবার কথা শোনা যায় যার প্রাদুর্ভাব এই শীতের সময়টাতেই বেশি হয়। মনে রাখবেন, আমাদের নিজেদের সচেতনতাই পারে নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত হবার হাত থেকে সকলকে দূরে রাখতে। তাই নিজের, সন্তানদের ও পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যের যত্ন নিন এবং অযাচিত বিপদ-আপদ থেকে মুক্ত থাকুন। এই শীতে শীতকালীন অন্যান্য রোগ যাতে আক্রমণ না করে সে বিষয়ে বই পড়ে কিংবা নেট ঘেটে স্বাস্থ্য বার্তা পড়ুন।
সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।
তথ্যসূত্রঃ Nipah virus outbreaks in the WHO South-East Asia Region
৩৭টি মন্তব্য
নুরহোসেন
সচেতনতা প্রয়োজন,
সরকারী পর্যায়ে সতর্কতা প্রচার করা উচিত।
তৌহিদ
হ্যা ভাই জনসচেতনতা অনেক জরুরী। পাঠকের সচেতনতার জন্যই এই পোস্ট। আর সরকারিভাবে থানা পর্যায়ে এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে সকল স্বাস্থ্যকর্মীরা সচেতনতার বিষয়ে কাজ করছেন।
ভালো থাকবেন।
সুরাইয়া পারভিন
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পোস্ট।
সেদিনই মনে মনে ভাবছিলাম খেজুর রস খাবো তাও কি না গাছে উঠে,,,,আর এমন চিন্তা মাথায় আনবো না বাবা
তৌহিদ
খেজুরের রস ফুটিয়ে খেতে সমস্যা নেই আর গাছি জানাশোনা হলে সেই রসের পাত্র ঢেকে রাখা হয়েছিল কিনা যাচাই করে খাবেন। কোন সমস্যা নেই।
সুপায়ন বড়ুয়া
ছেলেবেলায় অনেক খেয়েও সুস্হ ছিলাম
ধন্যবাদ আপনাকে । শুভ কামনা !
তৌহিদ
স্বাস্থ্য সচেতনতা জরুরী। আগেতো এত ডেঙ্গুরর প্রকোপ ছিলোনা কিন্তু এখন হচ্ছে। তাই সচেতন থাকছেন। ঠিক তেমনই বিষয়।
তাই খেজুরের রস সতর্কভাবে খান। বাকী আপনার ইচ্ছে।
ছাইরাছ হেলাল
আমাগো গাছ নাই, খাইও না।
নো চিন্তা। কিন্নাও খামু না, এই তো!
আচ্ছা, মেনে নিচ্ছি।
তৌহিদ
আমাদেরকেও রস কিনে খেতে হয়। তাই সচেতনতা জরুরী ভাইজান।
প্রদীপ চক্রবর্তী
সচেতনমূলক পোস্ট।
এ বিষয়ে আমাদের সকলের সতর্ক হওয়া অতীব জরুরী।
ধন্যবাদ দাদা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখার জন্য।
তৌহিদ
আপনাকেও ধন্যবাদ দাদা। সবাইকে বিষয়টি জানাবেন কেমন?
সুপর্ণা ফাল্গুনী
গুরুত্বপূর্ণ একটি পোস্ট শেয়ার করার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
তৌহিদ
আপনাকেও ধন্যবাদ আপু। সবাই সচেতন হলেই লেখাটি স্বার্থক।
জিসান শা ইকরাম
আমি খেজুরের রস খুবই পছন্দ করি,
প্রতিবছরই যেভাবে পাড়ি, দূর দূরান্ত থেকে হলেও খেজুরের রস এনে পান করি।
এই পোষ্ট পড়ার পরে তো আর কাঁচা খেজুরের রসই খাওয়া যাবেনা, জ্বাল দিয়ে খেতে হবে।
কি সমস্ত রোগ যে আসলো এই জগতে!
এইডস, ডেংগু, নিপাহ ভাইরাস- এসবের তো কার্যকরী কোন ঔষধই আবিষ্কার হলো না।
এমন সচেতনামূলক পোস্টের জন্য ধন্যবাদ ভাই।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আমার খুবই প্রিয় কিন্তু পাই না। অনেক বছর হলো খেজুরের রস খাইনা। ☹️☹️☹️☹️☹️
তৌহিদ
আমিও অনেকদিন খাইনি আপু। পাওয়াই যায়না। যদিওবা রাস্তাঘাটে দেখি কিন্তু পানি আর চিনি মেশানো তাই খাইনা।
তৌহিদ
রস খাবেন তবে ফুটিয়ে অথবা গাছি পরিচিত হলে নিয়ম মেনে রস সংগ্রহ করেছে কিনা শিওর হয়ে তবেই খাবেন। দিন যতই যাচ্ছে নানা রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে ইদানিং। তাই সচেতন হওয়াই উত্তম ভাই।
ইসিয়াক
জনসচেতনতামূলক পোস্টের জন্য ধন্যবাদ ভাই।
শুভকামনা রইলো।
তৌহিদ
আপনাকেও ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকবেন।
কামাল উদ্দিন
তাই বলে খেজুরের রস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পারবোনা।
তৌহিদ
জেনেশুনে বিপদ ডেকে আনা সমীচীন নয়। স্বাস্থ্য সচেতনতা জরুরী। বাকি আপনার ইচ্ছে।
কামাল উদ্দিন
হুমম, ফুটিয়ে খেতে হবে
মোঃ মজিবর রহমান
হ্যা কাক, পশু পাখির লালা থেকে হই। আমাদের দেশেও এর প্রভাব আছে, মেহেরপুরেও মনে হই দুই এক বছর আগে সনাক্ত হয়েছ্র ছিল। আমাদের জনসচেতনা বাড়ান দরকার।
তৌহিদ
হ্যা ভাই ঠিক বলেছেন। সচেতনতা জরুরী।
বন্যা লিপি
কাঁচা রস খাবার মজাই আলাদা। মনে পড়ে সেই ছোটবেলার কথা। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসতো এই রসের কলসি সহ খেজুর রসের কৃষক। বহুবছর আর পাইনা আর।
খুবই উপকারি সচেতনতা মূলক পোস্ট। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
তৌহিদ
জ্বী আপু, সচেতনতা জরুরী। নানান অসুখবিসুখ হচ্ছে এখন। তাই সবাই একে অপরকে সচেতন করবো আমরা।
সাবিনা ইয়াসমিন
সচেতনতা মুলক পোস্ট। এই সিজনেই এই ভাইরাসের পাদুর্ভাব বেশি হয়। যতবেশি প্রচার হবে, মানুষ ততই সতর্কতা অবলম্বন করতে পারবে।
শুভ কামনা 🌹🌹
তৌহিদ
জ্বী আপু, সচেতনতা জরুরী। চারপাশে নাম না জানা যত রোগবালাই হচ্ছে তাতে মৃত্যুহার বেড়ে যাচ্ছে।
সবারই সচেতনতা কাম্য। ভালো থাকবেন।
শাহরিন
ভাই তথ্য সমৃদ্ধ লেখা তবে শিরোনাম টি হুবহু পত্রিকারটা না দিলে বেশি ভালো হতো।
তৌহিদ
হ্যা, দেখলাম পত্রিকায় দিয়েছে খেজুরের রসে হতে পারে মৃত্যু। স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখার শিরোনাম মিলে যেতেও পারে। তবে পত্রিকায় এত বিষদ তথ্য নেই আমি নিশ্চিত, যদিও তাদের লেখাটি পড়িনি।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপু।
রেহানা বীথি
এত প্রিয় খেজুরের রস, অথচ এই ভয়েই খেতে পারি না এখন। জ্বাল দিয়ে খেলে মজাটাই থাকে না।
খুব ভালো পোস্ট ভাই।
তৌহিদ
তাই পরিচিত গাছির কাছে যারা নিয়ম মেনে রস সংগ্রহ করেন তাদের কাছ থেকেই নিবেন। আর সরকারি বেসরকারি সংস্থাগুলো যাদের খেজুর গাছ আছে তাদের সবাইকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এ বিষয়টি জানাচ্ছেন। এতে সবার মধ্যেই সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ইদানিং। তবু সচেতন থাকাই উত্তম।
মাহবুবুল আলম
গুরুত্বপূর্ণ এবং জনসচেতনতামূলক পোস্ট। শুভেচ্ছা রইলো!
তৌহিদ
জ্বী ভাই, সবার সচেতনতা জরুরী। ভালো থাকবেন ভাই।
মনির হোসেন মমি
উপকারী পোষ্ট।জানানোর জন্য ধন্যবাদ।
তৌহিদ
আপনাকেও ধন্যবাদ ভাই। সবাইকে বিষয়টি জানাবেন কিন্তু।
আরজু মুক্তা
আগে কতো চুরি করে রস খেতাম।
কে যে এই নাম আনলো,” নিপা”
সেদিন থেকে আর খাইনা
তৌহিদ
এখন নিত্যনতুন রোগ আসছে। তাই সচেতন থাকাই জরুরী।
ভালো থাকবেন আপু।