মৃত্যুতে বিষ্মিত হবার কিছু নেই, বেঁচে থাকাটাই পরম বিষ্ময়…..মুক্তিযুদ্ধের পরে দৈনিক বাংলার বানী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এই লাইনটি। কিন্তু কথাটা বড্ড অদ্ভুত লাগছে তাইনা ? কি মনেহচ্ছে ! হয়তো কথাটির কোথাও ভুল রয়েছে। নাহ্ ! নেই, ঠিকই বলছিলো তাঁরা, বেঁচে থাকাটাই তখন ছিল পরম বিস্ময়! কয়েকটা ঘটনা বলি তাহলেই বুঝবেন কথাটা কেন বলা হয়েছিলো।
ঘটনা-০২ঃ মৃত্যুতে বিষ্মিত হবার কিছু নেই, বেঁচে থাকাটাই পরম বিষ্ময়…..
মাটির দেয়াল ঘেরা ঘর। ১৮ হাত লম্বা হবে প্রায়। এক ইঞ্চিও জায়গা শুঁকনো নেই। চাক চাক রক্ত… কোলের বাচ্চাটিকে শোয়ানোর জায়গা খুঁজছে সখিনা খাতুন।রক্ত পরিষ্কার করে বাচ্চাটাকে শোয়ানোর জন্য একটু জায়গা করে নিলেন সে। বড় আদরের বাপজান, নাড়িছেড়া বুকের মাণিক তাঁর।কিন্তু সখিনা তাকাচ্ছে না তাঁর বাচ্চাটার দিকে। বাচ্চাটার অস্তিত্ব অনুভব করেই পরম প্রশান্তিতে আছে সে। তবুও কেন যেন তাকাল মাণিকটার দিকে। ও-মা!! এ যে একটা রক্তপিণ্ড!!দুই ঊরুর মাংস ছিঁড়ে গেছে।হাঁটুর নিচেও মাসলসহ হাড্ডি আলাদা। একটি স্পিন্টার ভেদ করে গেছে ছোট্ট বুকটাকে। তাও মা সন্তানকে ছাড়ছে নাহ্। নাড়ি ছেঁড়া মাণিক যে…
বাপ মায়ের অনেক আদরের ছেলে রব্বান।গ্রামে তখন হানা দেয়নাই পাকিরা। এরপরেও মনে ভয় কখন যেন সব শেষ হয়ে যায় !! একদিন গঞ্জে যাবার পথে দক্ষিণ দিক থেকে আওয়াজ আসে “মিলিটারে আইয়ে…” । প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে সে। ভাবে- “হায় আল্লা, আমার আব্বা-আম্মারে যদি ধইরা ফালায়!” অবশেষে বাবা মাকে নিয়ে নিরাপদে নৌকায় উঠে সে। রব্বান প্রাণপণে বৈঠা নাড়ছে-মিলিটারি আসার আগে বাবা মাকে ঐ পাট ক্ষেতটার পেছনে নিয়ে যাওয়া চাই। ঐখানে লুকাইলে আর ওরা খুইজা পাবে নাহ্। রব্বানের মা একটা বাটি দিয়ে নৌকায় জমা পানি ফেলতেছে। এইতো তাঁরা চলে আসছে ক্ষেতটার কাছে। আর মাত্র ২ হাত… রব্বানের বাবা অনুভব করলো নৌকা হঠাৎ থেমে গেছে।“আল্লাগো… আমার পোলা…”-গগণবিদারী চিৎকার রব্বানের মায়ের। রব্বান নাই। পানির রং লাল… রব্বাব নাই, রব্বান তাঁর মায়ের ডাক শুনে নাই। দূর থেকে ছুটে আসা একটা মাত্র বুলেট রব্বানের সেই ক্ষমতা কেড়ে নিছে।
এইটাই হল সবার উপরের কথাটার অর্থ। ১৯৭১ এ বেঁচে থাকাটাই হয়ে উঠেছিলো পরম বিস্ময়ের জিনিস। তখন কেউ কাউরে “ভালো আছিস” জিজ্ঞেস করতো না, জিজ্ঞেস করত-“কিরে তুই বাইচা আছিস!!”
ঘটনা-০৩ঃ রক্তের ফসল ফলবে এখানে…
“রক্তের ফসল ফলবে এখানে…” মুক্তিযুদ্ধের পরে এই শিরোনামে একটি কর্মসূচি পালন করেছিলো বাংলাদেশ কনজিউমারস সাপ্লাইস করপোরেশন। উদ্দেশ্য ছিল- যুদ্ধ পরবর্তী একটি দেশের “অবশিষ্ট থাকা মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া” মানুষগুলোকে একটু প্রাণের স্পন্দন দেয়া,তাঁদের অনাহারী মুখগুলোতে একটু খাবারের যোগান দেয়া মানে বেঁচে থাকার মতো করে বাঁচার সুযোগ করে দেয়া।
যাহোক, মূল প্রসঙ্গে আসি, “রক্তের ফসল ফলবে এখানে…” এই কথাটি কেন বলা হয়েছিলো? এর ব্যাখ্যায় যাবার আগে কিছু উদ্ধৃতি দেখি-
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চুকনগর গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে জনকণ্ঠের রিপোর্টার ফজলুল বারী লিখেছিলেন-
“লাশের উপর লাশ, মায়ের কোলে শিশুর লাশ, স্বামীকে বাঁচাতে স্ত্রী জড়িয়ে ধরেছিল। বাবা মেয়েকে বাঁচাতে জড়িয়ে ধরেছিল। মুহূর্তেই সবাই লাশ হয়ে যায়। ভদ্রা নদীর পানিতে বয় রক্তের বহর, ভদ্রা নদী হয়ে যায় লাশের নদী।কয়েক ঘণ্টা পর যখন পাকিস্তানিদের গুলির মজুদ ফুরিয়ে যায় তখন বেয়ানেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো মানুষগুলোকে।”
৮ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত সাংবাদিক আনিসুর রহমান শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমি প্রসঙ্গে বলেছিলেন-
“…অথবা যদি না যেতাম সেই শিয়ালবাড়িতে তাহলে দেখা হতো না ইতিহাসের বর্বরতম অধ্যায়কে। অনিসন্ধিত্সু হিসেবে যা দেখাও কোনো মানুষ উচিত নয়। ওখানে না গেলে গায়ে ধরতো না এমন দহন জ্বালা। সহ্য করতে হতো না ভয়, ক্রোধ, ঘৃণামিশ্রিত এমন অনুভূতি, যা বলে বোঝানোর নয়। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয়েছে ভয়ে বুঝি হার্টফেল করব। ধ্বংসস্তূপের মাঝে কতক্ষণ পরপরই চোখ বুজতে হয়েছে। না না এ সত্যি নয়, এ স্বপ্ন বলে দৃষ্টি আকাশের দিকে উত্থাপিত করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আর দেখতে চাই না বলে মাটি— ভুল বললাম, মানুষের হাড়ের ওপর বসে পড়তে হয়েছে। পুরো এলাকায় মানুষের হাড় ছাড়া অবিমিশ্র মাটি কোথায়।”
পাহাড়তলি গণহত্যা সম্পর্কে একজন গ্রামবাসীর কথা-
“এ হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস পরেও সংলগ্ন খালে মাছ ধরতে গিয়ে জালে উঠে এসেছিল মানুষের কঙ্কাল।”
সিডনি শনবার্গ এর ডেটলাইন বাংলাদেশে উল্লেখ রয়েছে যে, ২৭ মার্চ ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া এক ছাত্র পাগলের মতো চিৎকার করে বলতে থাকে-
“হায় আল্লা, হায় আল্লা- ওদের সবাইরে মাইরা ফালাইছে, এইখানে আইনা জবাই কইরা মাইরা ফালাইছে…”
মিরপুর জল্লাদখানায় আমি দেখেছিলাম সেখানে ৪৯৯ টি জল্লাদখানার নাম রয়েছে এবং সব শেষে লেখা ছিল “অসম্পূর্ণ” । বিভিন্ন উৎস হতে যা জানলাম, প্রতি বধ্যভূমিতে প্রায় ৫ হাজার থেকে ২৫ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এবার তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কেন বলা হয়েছিলো “রক্তের ফসল ফলবে এখানে…” কথাটি। হ্যাঁ রক্তের ফসলই ফলেছে এই দেশে, এখনো ফলে। যেই মাটি পরম স্নেহে আপনাকে আগলে রেখেছে সেই মাটির প্রতিটি কণায় এখনো ৩০ লাখ শহীদের রক্ত মিশে আছে…
৩০টি মন্তব্য
খেয়ালী মেয়ে
অনেক অজানা তথ্য জানা হলো আপনার পোস্টের মাধ্যমে–ধন্যবাদ..
যেই মাটি পরম স্নেহে আপনাকে আগলে রেখেছে সেই মাটির প্রতিটি কণায় এখনো ৩০ লাখ শহীদের রক্ত মিশে আছে (y) …বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই সকল শহীদদের…
ফাতেমা জোহরা
বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই সকল শহীদদের প্রতি… (y)
লীলাবতী
৭১ এর সেই নির্মমতার কথা ভাবলে গা শিউরে ওথে।ঘটনা ২.৩ থেকে আরো গনহত্যা সম্পর্কে জানলাম আপু।আপনাকে ধন্যবাদ শেয়ারের জন্য।
ফাতেমা জোহরা
আপনাকেও ধন্যবাদ লেখাটি পড়ার জন্য 🙂
ছাইরাছ হেলাল
জানতে পেরে ভাগ্যবান ভাবছি।
ফাতেমা জোহরা
আমারও ভালো লাগছে কথাটা জেনে।
সঞ্জয় কুমার
প্রতিটি লেখা এক একটা দলিল
ফাতেমা জোহরা
হুম সেটাই।
জিসান শা ইকরাম
কত অপ্রকাশিত কান্না থেকে গিয়েছে বাংলার আনাচে কানাচে।
ফাতেমা জোহরা
এদেশের প্রতিটি ধূলিকণা একেক ফোঁটা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত 🙁
মোঃ মজিবর রহমান
আপনার লেখায় অনেক অনেক জানতে পারি এবং আরও ঘৃণা জাগে রক্ত ক্ষরণ হয় হৃদয়ে,
আপনাকে শুভেচ্ছা অবিরত।
ফাতেমা জোহরা
আপনার জন্যও শুভকামনা রইলো 🙂
কৃন্তনিকা
ঘৃণা বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে-জানা নেই। তবে এই ঘৃণাতে বোধহয় বিধাতাও খুশি হবেন, ভালবাসবেন আমাদের…
বাকি পর্বের অপেক্ষায়…
আপনার জন্য ভালবাসা রইল (3
ফাতেমা জোহরা
কৃতজ্ঞতা রইলো আপু -{@ (3
নুসরাত মৌরিন
আপু প্রতিটা পর্ব পড়ছি আর বেশ কিছুক্ষন স্থানুর মতো বসে রইছি।
চোখের কোণে জল এসে যাচ্ছে,ঘৃনায় মুখ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে,শিউরে উঠছি আতঙ্কে।
এত ঋণ কি করে শোধ করবো?এ যে রক্তঋণ। 🙁
ফাতেমা জোহরা
এ ঋণ শোধ হবার নয়… 🙁
ব্লগার সজীব
৭১ এ নির্যাতিতা সমস্ত মা বোনদের এবং শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা।আপনার কাছে কৃতজ্ঞ এমন পোষ্টের জন্য।
ফাতেমা জোহরা
ধন্যবাদ রইলো 🙂
শুন্য শুন্যালয়
রক্তের ফসল যে আমরা শোধ করতে পারছিনা। এতো ত্যাগ, এতো রক্ত যে দেশে মিশে আছে, তাতে এখনো লক্ষ বিভাজন।
কতো কিছু অজানা রয়েছে অলিগলিতে, আপনার জন্য জানতে পারছি এজন্য কৃতজ্ঞ আপনার কাছে।
ফাতেমা জোহরা
//রক্তের ফসল যে আমরা শোধ করতে পারছিনা। এতো ত্যাগ, এতো রক্ত যে দেশে মিশে আছে, তাতে এখনো লক্ষ বিভাজন।//…………… এটাই সবচাইতে বড় আক্ষেপ আপু 🙁
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
লিখতে থাকুন প্রকৃত ইতিহাস -{@ আমাদের অজানা অনেক ঘটনাই জানতে পারছি আপনাকে বিশেষ ধন্যবাদ -{@
ফাতেমা জোহরা
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ 🙂
রিমি রুম্মান
পড়ি। অতঃপর কিছুটা সময় চুপ হয়ে থাকি। যেন চোখের সামনে দেখতে পাই।
ফাতেমা জোহরা
স্তব্ধ হয়ে যাই আপু 🙁
শিশির কনা
এত অত্যাচার,এত পৈচাশিকতা পড়তে গিয়ে শিউরে উঠছি আপু।
ফাতেমা জোহরা
এখানে যা আছি, আমরা যা পড়ছি তা খুবই সামান্য !!
মামুন
রক্তের ফসলই ফলেছে এই দেশে, এখনো ফলে। যেই মাটি পরম স্নেহে আপনাকে আগলে রেখেছে সেই মাটির প্রতিটি কণায় এখনো ৩০ লাখ শহীদের রক্ত মিশে আছে… – সকলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো।
ফাতেমা জোহরা
সকলের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রইলো (y)
বন্দনা কবীর
এসব যতই পড়ি,আতংক যন্ত্রণা অনুভব করি নিজের মাঝেও।প্রথম পর্ব পড়ে জানলাম আপনার এই প্রচেষ্টার কথা।শুভ কামনা।এগিয়ে যান সামনের দিকে।
ফাতেমা জোহরা
কৃতজ্ঞতা রইলো আপু 🙂