‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটি বাংলা ভাষায় বীর নারী বা বীর্যবতী নারীর বিশেষণেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশের পর ‘বীরাঙ্গনা’ শব্দটি ভিন্ন তাৎপর্য ধারণ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম আঘাত আসে নিষ্পাপ অসহায় নারীদের ওপর। স্বৈরশাসক ইয়াহিয়ার প্রথম আক্রোশের আগুনে দগ্ধ হয় বাঙালি নারীরা। ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালে সরাসরি বাঙালিদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য পাকিস্তান আর্মিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।যশোরে ছোট্ট একদল সাংবাদিকের সাথে কথা বলার সময় তিনি এয়ারপোর্টের কাছে জড়ো হওয়া একদল বাঙালির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলেন যে,
” আগে এদেরকে মুসলমান বানাও ”
এই উক্তিটিরর তাৎপর্য সীমাহীন। এর অর্থ হচ্ছে যে, উচ্চ পর্যায়ের সামরিক অফিসারদের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে বাঙালিরা খাঁটি মুসলমান নয়। এই ধারণার সাথে আরো দুটো স্টেরিওটাইপ ধারণাও যুক্ত ছিল।বাঙালিরা দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি নয় এবং তারা হিন্দু ভারতের সাথে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ।ইয়াহিয়া খানের এই উক্তিতে উৎসাহিত হয়ে পাকিস্তান আর্মি বাঙালিদেরকে মুসলমান বানানোর সুযোগ লুফে নেয়। আর এর জন্য সহজ রাস্তা ছিল বাঙালি মেয়েদেরকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে তাদেরকে দিয়ে সাচ্চা মুসলমান বাচ্চা পয়দা করানো।পাকিস্তানি সৈন্য এবং তার এদেশীয় দোসররা শুধু যত্রতত্র ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি।জোর করে মেয়েদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ধর্ষণ ক্যাম্পে। দিনের পর দিন আটকে রেখে হররোজ ধর্ষণ করা হয়েছে তাদের। পালাতে যাতে না পারে সেজন্য শাড়ী খুলে নগ্ন করে রাখা হতো তাদেরকে। সিলিং এ ঝুলে আত্মহত্যা যাতে করতে না পারে তার জন্য চুল কেটে রাখা হতো তাদের। পাকিস্তান আর্মির দোসর রাজাকার এবং আলবদরেরা জনগণকে বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়কে সন্ত্রস্ত করে দেশছাড়া করে তাদের সম্পত্তি এবং জমিজমা দখলের জন্য ধর্ষণকে বেছে নিয়েছিল।
Sujan Brownmiller তাঁর ” Against Our Will: Men, Women and Rape “ গ্রন্থে লিখেছেন-
“একাত্তরের ধর্ষণ নিছক সৌন্দর্যবোধে প্রলুব্ধ হওয়া কোন ঘটনা ছিলনা আদতে; আট বছরের বালিকা থেকে শুরু করে পঁচাত্তর বছরের নানী-দাদীর বয়সী বৃদ্ধাও স্বীকার হয়েছিল এই লোলুপতার। পাকসেনারা ঘটনাস্থলেই তাদের পৈচাশিকতা দেখিয়েই ক্ষান্ত হয়নি; প্রতি একশ জনের মধ্যে অন্তত দশ জনকে তাদের ক্যাম্প বা ব্যারাকে নিয়ে যাওয়া হতো সৈন্যদের জন্য। রাতে চলতো আরেক দফা নারকীয়তা । কেউ কেউ হয়ত আশিবারেও বেশী সংখ্যক ধর্ষিত হয়েছে ! এই পাশবিক নির্যাতনে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, আর কতজনকে মেরে ফেলা হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা হয়ত কল্পনাও করা যাবে না ।(Brownmiller, p. 83)”
পাকিস্তান আর্মির উচ্চ পদস্থ অফিসাররা যে ব্যাপকহারে ধর্ষণের ব্যাপারে জানতেন এবং তাদের যে এ ব্যাপারে প্রচ্ছন্ন সম্মতিও ছিল তাতে সেটা বোঝা যায় নিয়াজীর করা এক মন্তব্য থেকে। নিয়াজী একাত্তরে সংগঠিত র্ধষণের ঘটনা স্বীকার করার সাথে সাথে একটি অসংলগ্ন উক্তি করেছিলেন –
” আপনি এরূপ আশা করতে পারেন না যে, সৈন্যরা থাকবে, যুদ্ধ করবে এবং মুত্যু বরণ করবে পূর্ব পাকিস্তানে আর শারীরবৃত্তীয় চাহিদা নিবৃত্ত করতে যাবে ঝিলামে !”
দেশ স্বাধীন হবার পর যুদ্ধে নির্যাতিত নারীদেরকে ” বীরঙ্গনা ” বলে ভূষিত করা হয়। কিন্তু পরিবারের সম্মানের কথা ভেবেই নিজেদেরকে লুকিয়ে ফেলেছিলেন বীরাঙ্গনা নারীরা। এই নিষ্ঠুর সমাজের কাছে কোন চাওয়া-পাওয়া ছিল না তাঁদের। নিয়তির কাছে সপে দিয়েছিলেন তাঁরা নিজেদেরকে। একাত্তরে যে দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাঁদেরকে তার যাতনা ভুলে থাকা রীতিমত অসাধ্য ছিল তাঁদের জন্য। কিন্তু নিজের সমাজও তাদেরকে গ্রহণ করেনি সহজভাবে। বীরাঙ্গনা নামের উপাধি তাদের সম্মানের চেয়ে অসম্মান হয়ে এসেছিল বেশি । কোন কিছুর প্রত্যাশাই তারা আর করেনি আমাদের কাছ থেকে। শুধু মাঝে মাঝে আক্ষেপ করেছে এই ভেবে যে, যেই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য তাঁরা নিজেদের সবটুকু উৎসর্গ করে দিয়েছে আজ সেই দেশের মানুষই তাঁদের কোন রকম খোঁজ খবর রাখে না এমনকি তাঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকুও তাঁদেরকে দেয়া হয় নাহ্। নীলিমা ইব্রাহিমের ” আমি বীরাঙ্গনা বলছি ” গ্রন্থে বীরাঙ্গনা রীনা তার আকাঙ্খা প্রকাশ করেছেন এভাবেঃ
“একটি মুহূর্তের আকাঙ্খা মৃত্যু মুহূর্ত পর্যন্ত রয়ে যাবে। এ প্রজন্মের একটি তরুণ অথবা তরুণী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, বীরাঙ্গনা আমরা তোমাকে প্রণতি করি, হাজার সালাম তোমাকে। তুমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, ঐ পতাকায় তোমার অংশ আছে। জাতীয় সংগীতে তোমার কন্ঠ আছে। এদেশের মাটিতে তোমার অগ্রাধিকার। সেই শুভ মুহূর্তের আশায় বিবেকের জাগরণ মুহূর্তে পথ চেয়ে আমি বেঁচে রইবো।”
নির্যাতিতা এসব নারীদের প্রতি উন্নত সামাজিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী পোষণের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকার তাদের ‘বীরাঙ্গনা’ বিশেষণে সম্মানিত করলেও পুরুষ প্রধান ও ধর্মপীড়িত সমাজ এতে কোন তাড়না বোধ করেনি। বঙ্গবন্ধু নিজে এদের বিয়ে করার আহ্বান করেও সফলতা পাননি।বরং এ খেতাব তাদের এক অদৃশ্য শ্রেণীতে পরিণত করেছিল। সমাজ জীবনের স্বাভাবিক স্রোতধারায় মিশে যাওয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর অনেকে তাদের নিয়ে যেন এক ধরনের জুয়া খেলায় নেমেছিল কেউ টাকার লোভে বিয়ে করে পরবর্তীতে তালাক দিয়েছে কেউ বা এদের নাম ব্যবহার করে কিছু লোভী ব্যবসায়ী বাজারে ছেড়েছে এমন সব বই যেগুলোতে সাহিত্যের মূল্যের চাইতে বেশি ছিল অশ্লীলতা তথা এক ধরনের বিকৃতি।
যুদ্ধপরবর্তী ১৯৭২ সালে, এসব নারীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে জাতীয় পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন ছাড়াও গঠিত হয় কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা যদিও পুনর্বাসন নামে কিন্তু কার্যত : অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের গর্ভের এসব অনাকাঙিক্ষত শিশুদের ভ্রুণেই হত্যা বা জন্ম নেওয়া সন্তানদের দত্তকের ব্যবস্থা এ সংস্থার মাধ্যমে করা হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে এর পরিণতিও হয়েছিল দুঃখজনক। অনেক মায়েদের অকালে মৃত্যুবরণও করতে হয়েছিল। এক্ষেত্রে সহায়তা দিয়েছিল International planned parent hood, the International Abortion Research and training center. আর একই সাথে এসব ‘শত্রু শিশুদের’ গর্ভেই হত্যা দত্তকের জন্য সারাদেশে সেবাসদনও খোলা হয়েছিল। নিরপরাধ এ শিশুদের এদেশ গ্রহণ করেনি বরং দত্তক হিসাবে তাদের পাঠানো হয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা,নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।আর বীরাঙ্গনাদের জীবনে নেমে এসেছে নিঃসঙ্গতার অবহেলার এক দুঃখময় অধ্যায় তাদের পরিত্যাগ করেছে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও সমাজ। শতকের শেষ দিন পর্যন্ত তারা যেন করুণা অথবা ঘৃণার পাত্রী ‘সতীত্ব’ হারানো এসব নারীরা স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার পরিবর্তে বরং এক বিকট অর্ধঃস্তনতার শিকারে পরিণত হয়েছেন।
১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মত বিটিভিতে ড. নীলিমা ইব্রাহিমের উপস্থাপনায় ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়েছিল এবং সেই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরো জাতি সম্ভবত প্রথমবারের মতো বেদনাহত হৃদয়ে এসব নারীদের করুণ কাহিনী অনুধাবন করেছে। এরপরে ১৯৯৯ সালে ২৩ নভেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠে একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে ফেরদৌসী প্রিয় ভাষিনী সুদীর্ঘ আটাশ বছর পরে পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন।সেই প্রতিবেদনটির প্রতিবেদক তাসলিমার ভাষায়-
“২৮ বছর কেন অপেক্ষা করতে হয় একজন নারীকে তার নিপীড়নের কথা বলতে কিংবা যতটুকু বলেছেন তার জন্য আবার তাকে কতটা মাশুল দিতে হচ্ছে?”
ফেরদৌসী প্রিয় ভাষিনী আম্মার ভাষায়-
“৭১ এর নয় মাসের নির্যাতন আমার জীবনের সব অনুভূতিকে যেন ভোঁতা করে দিয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বরের পরে অনেক লাশ দেখেও আমার মনে তেমন পরিবর্তন আসেনি কারণ আমি নিজেই তখন এক জীবন্ত লাশ।”
তাকে কর্মস্থল থেকে বের করে দিয়ে সামাজিকভাবে এক ঘরে করে রাখা হয়েছিল এবং এমন কি গ্রামের অন্য মেয়েরাও তার সাথে কথা বলতো না। তারপরেও তিনি বেঁচে উঠেছেন শুধু নিজের প্রতি প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস ও অসম্ভব উদার ও সহযোগী একজন স্বামী পেয়ে। তিনি নিজেকে ‘বীরাঙ্গনা’ পরিচয় দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন এবং এখন নিজস্ব আলোতে উদ্ভাসিত কিন্তু একই সাথে একই সময়ে আবার যখন পত্রিকায় দেখতে হয় ‘তিনজন নারী নিজেদের নির্যাতনের কাহিনী প্রকাশ করায় সমাজ তাদের ত্যাগ করে একঘরে করেছে। তখন এক দ্বিমুখী ভাবনায় মন ভারাক্রান্ত হয়েছে।
এভাবে যখনই মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত মহান এই নারীরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে তখনই কোন না কোন ভাবে আমাদের এই সমাজ তাঁদের ঘুরে দাঁড়ানোর পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সবচেয়ে গর্বের ইতিহাস। কিন্তু গর্বের এই মুক্তিযুদ্ধে যেন অগৌরবের কাঁটা এদেশের লাখো ধর্ষিতা নারী। আমরা বলি প্রায় ৪ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধের স্মরণে আমরা গান গাই ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’। এই ফুল হলো নারী-দেশ-মা। আমরা নিপীড়িত নারীদের বলেছি ‘কতকুলের কুলঙ্গনা, নাম দিয়েছি বীরাঙ্গনা’। বীরাঙ্গনা মানে বীর নারী। অথচ সম্মান বাস্তবে কতোটুকু সম্মান তাঁরা পেয়েছে আমাদের কাছ থেকে !!!
একাত্তরে ন’মাসের যুদ্ধে দেশ স্বাধীন হয়েছে। ৩০ লাখ শহীদ আর ৪ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বাধীনতা। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত করা হলেও আমাদের বীরঙ্গনা মায়েদের সেই সম্মাননাটুকু পেতে সময় লেগেছে দীর্ঘ ৪৪ বছর। তবুও সান্ত্বনা তাঁরা তাঁদের যোগ্য সম্মানটুকু পেয়েছেন।
৩১টি মন্তব্য
নুসরাত মৌরিন
আপু এই বীরাঙ্গনা মায়েদের ঋণ কখনো শোধ হবার নয়।নতজানু হয়ে যদি প্রণাম করি তবু তাদের ত্যাগের প্রতি একবিন্দু শ্রদ্ধাও বুঝি দেখানো হবে না।দেশ মাতৃকার জন্য তাদের অপরিসীম যে ত্যাগ -সেটার বিনিময়ে আমরা জাতি হিসেবে তাদের কিছুই দিতে পারি নাই।কুন্ঠিত লজ্জিত লাগে…।
অনেক ভাল লেখা আপু।ধন্যবাদ আপনাকে।
ফাতেমা জোহরা
সহমত আপু। তাঁদের আমরা যদিও সম্মান দিতে পারিনি কিন্তু অপমানে একেবারে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছি… লজ্জা!
নীতেশ বড়ুয়া
“যুদ্ধপরবর্তী ১৯৭২ সালে, এসব নারীদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে জাতীয় পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশন ছাড়াও গঠিত হয় কেন্দ্রীয় মহিলা পুনর্বাসন সংস্থা যদিও পুনর্বাসন নামে কিন্তু কার্যত : অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের গর্ভের এসব অনাকাঙিক্ষত শিশুদের ভ্রুণেই হত্যা বা জন্ম নেওয়া সন্তানদের দত্তকের ব্যবস্থা এ সংস্থার মাধ্যমে করা হয়েছিল। অনেক ক্ষেত্রে এর পরিণতিও হয়েছিল দুঃখজনক। অনেক মায়েদের অকালে মৃত্যুবরণও করতে হয়েছিল। এক্ষেত্রে সহায়তা দিয়েছিল International planned parent hood, the International Abortion Research and training center. আর একই সাথে এসব ‘শত্রু শিশুদের’ গর্ভেই হত্যা দত্তকের জন্য সারাদেশে সেবাসদনও খোলা হয়েছিল। নিরপরাধ এ শিশুদের এদেশ গ্রহণ করেনি বরং দত্তক হিসাবে তাদের পাঠানো হয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা,নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।আর বীরাঙ্গনাদের জীবনে নেমে এসেছে নিঃসঙ্গতার অবহেলার এক দুঃখময় অধ্যায় তাদের পরিত্যাগ করেছে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও সমাজ। শতকের শেষ দিন পর্যন্ত তারা যেন করুণা অথবা ঘৃণার পাত্রী ‘সতীত্ব’ হারানো এসব নারীরা স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার পরিবর্তে বরং এক বিকট অর্ধঃস্তনতার শিকারে পরিণত হয়েছেন।”-ফাতেমা জোহরা
এই উপরের কিছু কথা পরিষ্কার করে দেয় ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি (!) প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা নারীদের জীবন কতটুকু নারকীয়তায় ডুব দিয়েছিল, কেননা তাঁদের জীবন যুদ্ধপরবর্তীতে কিসে আর কিভাব তা কেউই আর তুলে আনেননি। সেই গরজটুকুও ছিলো না যে!
“‘বীরাঙ্গনা নামের উপাধি তাদের সম্মানের চেয়ে অসম্মান হয়ে এসেছিল বেশি ।’ ‘এই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য তাঁরা নিজেদের সবটুকু উৎসর্গ করে দিয়েছে'”-ফাতেমা জোহরা
এই দুইটি লাইন বর্ণনা করে সবটুকুই। মাত্র দুইটি লাইন! যে নারী নিজের ইজ্জতের সবটুকু দেশের জন্য হারাতে বাদ্য হয়েও মুক্তযোদ্ধার খেতাব না পেয়ে বীরাঙ্গনা নামে আলাদাভাবে কলংকিত হয় সে মানুষ কি আর পেতে চাইবে বিনিময়ে! আজও আমরা বীরাঙ্গনা বলতে মাথায় আনি “পাকিস্থানী আর্মিদের দ্বারা ধর্ষিত নারী” কিন্তু প্রথমেই ভাবতে চাইনা ‘এই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য তাঁরা নিজেদের সবটুকু উৎসর্গ করে দিয়েছে’ যে সব মুক্তিক্সোদ্ধা নারীরা তারাই বীরাঙ্গনা।
আমরা কি সবসময়েই এমনই ছিলাম? আজও কেন তাঁদের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ও পরিচয়ের সাথে যুক্ত করা হয় না কেউ বলতে পারেন? কেন আজও তাঁরা শুধুমাত্র পাকি আর্মির ধর্ষিত বীরাঙ্গনা খেতাবধারী হয়েই বেঁচে আছেন!
বলা হয় এক মাত্র নারী সবচাইতে কষ্ট সহ্য করেন, দশমাসের গর্ভধারণের মতো কষ্ট আর সেই কষ্ট প্রসবের যন্ত্রণার সাথে আর কিছুর তুলনা হয় না অথচ সেই সব মুক্তিযোদ্ধা নারী তখন তাঁদের সেই কষ্টের যন্ত্রণার নাম পেলেন এইভাবেই…
আমি এ নিয়ে আপনার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ধারাবাহিকভাবে আপনি তা প্রকাশ করছেন। ধন্যবাদ লেখনীর জন্য। -{@
ফাতেমা জোহরা
পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা সেই সাথে আপনার সাথে সহমতও প্রকাশ করছি। আসলে আক্ষেপ করতে করতে, লজ্জায়, রাগে, দুঃখে আমার এখন আর এ ব্যাপারে কিছু বলতে ভালো লাগে না। লেখাগুলো ওয়ার্ড ফাইলে ছিল, সেদিন আপনি বললেন, এর আগেও কয়েকজন বলেছিলো, তাই দিয়ে দিলাম। এখনো, এখনো কতোটা নোংরাভাবে আমার মায়েদের ঐ পাকিদের রেখে যাওয়া কীটেরা অপমান করে, নিজ চোখে না দেখে, নিজ কানে না শুনে বিশ্বাস করতে পারবেন না। আমার প্রিয়ভাষিনী আম্মাকে ওরা এখনো মৃত্যু ভয় দেখায় ! ওরা জানেনা, কতো আগেই তিনি মৃত্যুকে জয় করে এসেছেন, আমার মায়েরা চিকিৎসার অভাবে মারা যায়, আমি অপদার্থ কিছুই করতে পারিনি।
একবার জল্লাদখানা থেকে ফেরার পথে রাআদ ভাইয়া বলেছিলো, “জানো, আমরা খুব ভুল সময়ে জন্মেছি, যদি আর ক’টা দিন আগে জন্মাতাম!…
” আহা! আসলেই যদি আর ক’টা দিন আগে জন্মাতাম কিছু হলেও করতে পারতাম, করার মতো সুযোগ-সামর্থ্য করে নিতে পারতাম। ভাল্লাগছে না আর কিছু লিখতে। খুব লজ্জা হয়, খুব!!
নীতেশ বড়ুয়া
আপনার মতো লজ্জা বা ঘৃণা ক’দিন আগেও আমার ছিলো। কি সময়ে আমরা আছি, কেমন এই প্রজন্ম ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঘুরে দেখি আপনাদের মতো কিছু আছেন যারা প্রজন্মকে প্রজন্মের ভুল শুধরে এগিয়ে আসার পথ বাতলে দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত! আমি অসহায় বোধ করি বিগত দিনের কথা ভেবে আর বর্তমানে কিছু মানুষের পথ বাতলে দেওয়ার আহ্বানে সত্যিই আশাবাদী।
আপনার লেখার ধরণ আর ইতিহাসকে ধারণের এই চেষ্টা দেখে আমি শুধু বলতে চাই আপনি লিখে রাখুন আমাদের মায়েদের কথা, আজ না হলেও সামনে কোন একদিন আপনার এই লিখে রাখা পাতাগুলো দলিল হিসেবে সামনে আসবে আমি নিশ্চিত। প্লীজ, থামবেন না।
আমার এখনো সময় আসেনি, যেদিন সময় আসবে সেইদিন আমি আপনার সাথে, উচ্ছ্বাসের সাথে আপনাদের সাথে অতি অবশ্যই যোগাযোগ করবো এই দলিল নিয়ে- কথা দিলাম।
অনুরোধ রইলো এই দলিলের কাজটুকু পরিপূর্ণ করুন যতদূর সম্ভব আপনাদের পক্ষে।
প্লীজ…
নীতেশ বড়ুয়া
এই দলিলের জন্য আমার একটি ক্যাপশন দিতে ইচ্ছে হচ্ছে-
“একাত্তরে মায়েরা-The unsung Heroes of 1971”
ফাতেমা জোহরা
অনুরোধ রাখার চেষ্টা করবো, দেখি কতদূর যেতে পারি 🙂
নীতেশ বড়ুয়া
আশা রাখলাম। -{@
ফাতেমা জোহরা
Unsung Hero দের নিয়ে আরেকটা কাজ হচ্ছে আমাদের 🙂
নীতেশ বড়ুয়া
তাইইইইইইইই 😀
খুব ভাল লাগছে…
(3 -{@ আপনাদের জন্য। আপাতত এইটুকুই :p
ফাতেমা জোহরা
🙂 ধন্যবাদ
নীতেশ বড়ুয়া
😀
ব্লগার সজীব
খারাপ লাগে খুব এসব ভাবলে,কবে আমাদের সমাজ বদলাবে জানিনা।হয়ত কোনদিন বদলাবেই না।
ফাতেমা জোহরা
হতাশ লাগে যদিও, তবুও আমি ক্যানো যেন একটু আশার আলোও দেখি। জানিনা কি হবে…
ব্লগার সজীব
আপনি অনেক আশাবাদী মানুষ বুঝতে পারছি।আমাদের সমাজ যতই শিক্ষিত হোক, একজন ধর্ষিতা মেয়ের যতই যোগ্যতা থাকুক, তাকে বিয়ে করার মানসিকতা সম্পন্ন পুরুষ খুব কম। মুখে আমরা অনেক কিছুই বলি।
আমরা আসলে শিক্ষিত হতেই পারিনি।
ফাতেমা জোহরা
এখানে দুইটা ব্যাপারকে মিলিয়ে ফেলছেন ভাই। হ্যাঁ ঘটনার ধরণ এক, তবে প্রেক্ষাপট ভিন্ন আবার পাবলিক রিঅ্যাকশন একই।
তবে আমি মনে করি যদি গোঁড়া থেকেই বীরাঙ্গনা মায়েদের সম্মান করার সংস্কৃতিটা চালু করা যেতো তবে, আজকে এই দিন আমাদের দেখতে হতো না।
নীতেশ বড়ুয়া
মডুদের প্রতি অনুরোধ রইলো এই পোস্ট এবং এ’সংক্রান্ত পরবর্তী ধারাবাহিক পোস্টগুলো এলে স্টিকি করে রাখার জন্য, যদি সম্ভব হয়।
জিসান শা ইকরাম
এনাদের মূল্যায়ন করলে রাজাকারদের মূল্যায়ন করবে কে?
লেখা চলুক……
ফাতেমা জোহরা
তা অবশ্য ঠিক। আবার মাঝের ক’টা বছর তো রাজাকার আর ওদের সাঙ্গোপাঙ্গদের হাতেই ছিল !!
জিসান শা ইকরাম
এখন তো আবার ফুল দিয়ে বুকের মাঝে বরন করা হচ্ছে
একই সাথে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি এবং রাজাকারদের সুযোগ্য উত্তরাধিকারদের বরন ……
কন্ট্রাষ্ট কালার কম্বিনেশন যেন
এমনটি বিশ্বে আর কোথাও দেখা যাবে না………
ফাতেমা জোহরা
//কন্ট্রাষ্ট কালার কম্বিনেশন যেন
এমনটি বিশ্বে আর কোথাও দেখা যাবে না………//
একমত (y)
নীলাঞ্জনা নীলা
এদের সম্মান দেবে সেই মানবিকতা আমাদের দেশের মানুষের কি আছে?
বরং রাজাকারদের সালাম জানানোর মানুষের অভাব নেই।
ফাতেমা জোহরা
এটা দেখলেই লজ্জায় মরে যাই আপু 🙁
স্বপ্ন
খুব কষ্ট লাগে এই সব মায়েদের কথা ভাবলে।
ফাতেমা জোহরা
সাথে নিজেদের বড্ড অকৃতজ্ঞও মনেহয় !
রিমি রুম্মান
তবুও আমার মনে হচ্ছে অনেক কিছুই হচ্ছে যা আমরা কখনোই ভাবিনি। রাজাকারদের বিচার হচ্ছে। বিরঙ্গনাদেরও সন্মানের সাথে স্মরণ করবে মানুষ একদিন। শুধু বেঁচে থাকতে সন্মানটুকু দিলো না কেউ, এই যা। আমরা তো সঠিক সময়ে সঠিক মানুষটিকে মূল্যায়ন করতে শিখিনি আজো। ভীষণ আক্ষেপ… 🙁
ফাতেমা জোহরা
একেবারে ঠিক কথা বলেছেন আপু। আমারো এটা ভেবেই আক্ষেপ লাগে, সঠিক সময়ে আমরা মায়েদের মর্যাদা দিলাম নাহ্ 🙁
লীলাবতী
কষ্ট লাগে,হতাশ হই,শিউরে উঠি এমন ইতিহাস জেনে।শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ আপু।
ফাতেমা জোহরা
পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা 🙂
শুন্য শুন্যালয়
তাদের মুক্তিযোদ্ধার সম্মানে ভূষিত করেছি আমরা, এ অনেক গর্বের। তবে খেতাবে কিছু পরিবর্তন হবেনা, তারা বীরাঙ্গনাই থাকবে, আমাদের মনমানসিকতার মতো জবুথবু হয়ে থাকবে।
আপনার লেখাগুলো আমাকে শ্রদ্ধা করতে শেখায় আপনাকে। কেউ তো পারছে, চেষ্টা তো করছে।
ধন্যবাদ অনেক আপনাকে ফাতেমা। লিখে যান নিয়মিত।
ফাতেমা জোহরা
অশেষ কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ রইলো আপু 🙂