রক্ত

সিকদার ৮ অক্টোবর ২০১৫, বৃহস্পতিবার, ০৭:৫১:৫১অপরাহ্ন গল্প, মুক্তিযুদ্ধ ১৭ মন্তব্য

11377105_1481887675458596_1528395859567539018_n

কক্সবাজারে আসার পরের দিনই চোখে পড়ল মহিলাকে।দেখলেই বোঝাই যায় বয়সটা পন্চাশের ঘর পেরিয়েছে অনেক আগেই, তবু এখনও খুবই সুন্দরী । বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে হাজারো নজর কারা সু্ন্দরীদের ভিড়ে পন্চাশর্ধো একজন মহিলা আমার কাছে যদিও আলাদা কোন অর্থবহন করে না । আমার বয়স মাত্র পচিশ বছর। তাই এই বয়সে এত বয়স্ক মহিলার প্রতি আমার কোন আগ্রহ থাকার কথা নয়। যেখানে প্রতিনিযত আশেপাশে ঘুরে বেড়াছ্ছে রুপসী নজর কাড়া উর্বশীরা ।

আমি ছোটখাট একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাছ্ছিলাম। মহিলা তার পুত্র- পুত্রবধুসহ হোটেলটার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে যেই না দেখলেন সাথে সাথে হতচকিত হয়ে দাড়িয়ে গেলেন। আমার দিকে কিছুক্ষন হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর চিন্তিত হয়ে মাথা নিচু করে কিছুদুর গিয়ে আবার ঘার ফিরিয়ে তাকালেন। কিছুক্ষন পর পর ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে দেখতে  চলে গেলেন। মহিলার আচরন দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
এরপরের দিন আমি হোটেলের সিড়ি দিয়ে  নামছি তখন দেখি মহিলা উঠছেন। বুঝতে পারলাম আমি আর মহিলার পরিবার একই হোটেলে অবস্থান করছি। আমাকে দেখেই তিনি থমকে দাড়িয়ে গেলেন। আমি কিছু না বলে মহিলাকে পাশ কাটিয়ে নেমে গেলাম। দৃষ্টি সীমার আড়াল হওয়ার আগে আমি কৌতুহল বশতঃ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, মহিলা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে।
ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কে এই মহিলা ? মনেত হয় না আমি কোথাও উনাকে দেখেছি। আমার চেনা জানা আত্মিয়ও নয়। তাহলে….কে ইনি ?
এরপর দিনও আবার দেখা হল। এবার আমি উপরে উঠছি, দেখি মহিলা দরজা খুলে দাড়িয়ে আছেন। আমাকে দেখে দরজা থেকে আরেকটু বেরিয়ে এলেন। আমাকে বললেনঃ বাবা একটু দাড়াবে, তোমার সাথে কথা বলব।
এ কয়দিনে মহিলার অদ্ভুত আচরনে আমিও বেশ কৌতুহলী হয়ে উঠেছি, তাই দাড়িয়ে গেলাম।
ঃ তোমার নাম কি বাবা ?
আমি নাম বললাম।
ঃতোমার বাড়ি কোথায় ?
কেন জানি মহিলাকে আমার বাড়ির ঠিকানা বলতে ইছ্ছা হল না। তাই নানার বাড়ির ঠিকানা বললাম।
এরপর মহিলা বলল ” এসো ভিতরে এস। বসে কথা বলি। ”

আমি ভিতরে এসে বসলাম।
মহিলা আমার সামনে একটা টুল নিয়ে বসল।
ঃতুমি আমার ছেলের বয়সি হবে তাই বাবা বলে ডাকছি, তুমি কিছু মনে করছনাত ?
ঃ না আমি কিছু মনে করছি না। তবে আপনি আমাকে সালাম বলে ডাকুন এটাই আমার ডাক নাম।
ঃতুমি হয়ত  আমার এ কয়দিনের  আচরনে অবাক হয়েছ তাইনা ?
ঃ হ্যা কিছুটা অবাক হয়েছি বটে । কিন্তু আপনার এ জাতীয় আচরনের কারণটা কি ?
মহিলা কিছুক্ষন চুপ থেকে নিজের আবেগকে সংয্ত করলেন । তবে পারলেন না , দেখলাম উনার শুকনো দুচোখ ভিজে গেল।
ঃবাবা সালাম, আমি তোমাকে যখন, প্রথম দেখি তখন ভীষন চমকে গিয়েছিলাম। কারন তোমার চেহারার সাথে আমার একজন প্রিয়, প্রিয় বললেও কম বলা হবে পরম প্রিয়জনের এতটা মিল যা আমাকে আবেগ প্রবন করে ফেলেছে।
আমিও মনে মনে এটাই ধারনা করেছিলাম। মহিলা বলতে লাগলেন।
ঃ ওর নাম ছিল রুপম। আসল নামটা আমার মনে নাই কারন মনে রাখার চেষ্টা করিনি। এই নামের একটা ইতিহাস আছে। আমার নাম রুপা। আমার সাথে তার গভীর সখ্যতা দেখে আমার বাবা আমার রুপা নামের সাথে মিলিয়ে তার নাম দিয়েছেন রুপম। ওর বাবা ছিলেন সরকারী চাকুরে। তিনি যখন বদলী হয়ে আমাদের শহরে আসলেন এবং যেখানে বাসা নিলেন, তখন আমার বাবা ছিলেন ঐ এলাকার চেয়ারম্যান। রুপমের বাবা ছিলেন থানার ওসি। খুব সৎ লোক ছিলেন। উনি থানার ওসি হওয়ায় আমার বাবার সাথে সম্পর্কটা ছিল গভীর। রুপমের সাথে যখন আমার পরিচয় , তখন সে পড়ত অষ্টম শ্রেণীতে আমি পড়তাম ষষ্ট শ্রেণীতে। আমাদের স্কুলে ছেলেমেযে একই সাথে পড়ত, তাই আমাদের দুই পরিবারের হৃদয়তার কারনে আমি আর রুপম এক সাথে আসা যাওয়া করতাম। এই যাওয়ার আসার মাঝে আমাদের পরস্পরের প্রতি ভালবাসা জন্ম নিল। তখন দুজন দুজনকে ছাড়া একদন্ডও থাকতে পারতাম না। একজন আরেকজনকে ভালবাসলে যা হয় আরকি। তোমাকে আর খুলে কি বলব। তুমিত যুবক  । তুমিও জান ভালবাসা কি জিনিস।
মহিলার ঠোটের কোনে এক চিলতে হাসি উকি দিয়ে হারিয়ে গেল। যেন বাদলা দিনে মেঘের আড়ালে সূর্য উকি দিল। এই বয়সেও মহিলার হাসিটা অপূর্ব। না জানি যৌবনে আরও কত সুন্দর ছিল। রুপমের ভাগ্য দেখে আমার একটু করে হিংসাই হল।
ঃআমাদের পরস্পরের প্রতি ভালবাসার কথা আমাদের পরিবারের লোকেরা জানত। এই ব্যাপারে দুজনের পরিবারের মৌন সম্মতি ছিল। তাই আমাদের মেলামেশাটা ছিল অবাধ এবং পবিত্র। একসময় রুপম কলেজে প্রবেশ করল। এই সময় আমার এক ফুপু বলেছিল আমাদের বিয়ের আকদটা করে ফেলতে। ফুপুর কথাটা দুই পরিবারে মেনে নিয়ে অনেক দুর অগ্রসর হয়েও, পরে ওর এক মামার আসম্মতির কারনে হয়নি। মামা যুক্তি ঠিক ছিল এখন যদি আকদ করে ফেলে তাহলে আমাদের দুজনের পড়ালেখার ক্ষতি হতে পারে। দুই পরিবারের যখন সম্মতি আছে, তখন রুপমের পড়ালেখা শেষ হওয়ার পর আকদ ও উঠানো দুই একসাথে করা যাবে। হায়রে ভাগ্য তখন কি আমরা কেউ জানতাম আমাদের এই আশা আর কোনদিনও পুরন হবে না। এর কয়েক মাস পরই শুরু হল স্বাধীনতা সংগ্রাম।যদিও আমরা ঢাকা শহর থেকে দুরে, তবুও আমাদের গ্রামে পকিস্তসানী সৈন্য আসতে বেশি সময় নিলনা। পকিস্তানীরা যেদিন এল সেদিন এলাকার গনমাণ্য সবাইকে নিয়ে মিটিং করল। মিটিং থেকে আমার বাবা ও রুপমের বাবা এক সাথে আমাদের বাসায় এলেন।আমার বাবা হাসিখুশি ছিলেন কিন্তু রুপমের বাবা ওসি সাহেব ছিলেন খুব গম্ভীর।
আমার এখনও মনে আছে বাবা রুপমের বাবার গম্ভীর মুখ দেখে বললেনঃ আরে এত চিন্তা করছেন কেন। মেজর খান সাহেব যা বলেছে খারাপ বলেন নাই। কথাটা সত্য কিছুদিনের মধ্যে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কেননা এই বিশাল বিশাল পাঠান সৈন্য আর অত্যাধুনিক অস্ত্রের কাছে বাংগালীরা বেশদিন টিকবে না। আপনি বাসায় যান দ্রূত শান্তি কমিটির লিষ্টটা করে ফেলেন।কালকে সকালেই জমা দিতে হবে।
এরপর রুপমের বাবা চলে গেলেন। তার পরদিন সকালে এলাকায় খবর হয়ে গেল ওসি সাহেব পরিবার পরিজন নিয়ে পালি্যেছেন। ওসি সাহেবের পালানোর খবর শুনে আমার বাবা বললেনঃ ওসি সাহেব কাজটা ঠিক করেননি। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে। কিছুদিনের ভিতর সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এলে পাকিস্তানী সরকার ওদের খুজে বের করে মারবে।
রুপমরা সেই যে গেল আর কোনদিনও এল না। যুদ্ধের সময় বাবার মুখে শুনেছিলাম রুপম আর রুপমের বাবা দুজনেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে।(মহিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।) এরপর আর কোনদিনও রুপমের সাথে আমার দেখা হয়নি। হয়ত যুদ্ধে মারা গেছে। তা নাহলে আমাদের যে গভীর প্রেম ছিল ও একদিন না একদিন অবশ্যই আমার কাছে আসত।
মহিলার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রূ গড়িয়ে পড়ছে। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি কি বলে উনাকে স্বান্তনা দেব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর মহিলা নিজেকে সংযত করে নিলেন।
ঃবাবা তোমার চেহারার সাথে সেই রুপমের চেহারার এতটা মিল যে হয়ত তোমাকে দেখলে ওর মাও মনে করত, তুমি উনার ছেলে রুপম।
মহিলা আবার মিষ্টি করে একটা হাসি দিল। আবার সেই অপূর্ব হাসি দেখলাম।
ঃতুমি একদিন ঢাকায় আমার বাসায় এস। রুপমের ছবি তোমায় দেখাব। ওর আর আমার কয়েকটা পারিবারিক ছবি এখনো আছে। আসলে খুশি হব।
আমার খুব কৌতুহল জাগল ছবিটা দেখার, তাই বাসার ঠিকানাটা নিলাম। কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফেরার কয়েকদিন পরই মহিলার বাসায় গেলাম। বিশাল জায়গার উপর আলীশান এক বাড়ি। মহিলা আমাকে দেখেই আনণ্দে আবেগ আপ্লুত। তিনি বলেই ফেললেনঃ তোমাকে দেখে মনে হছ্ছে আমার সেই রুপম যেন এসেছে।
আমি মহিলার আবেগ দেখে নিজেও কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়লাম। মহিলা আমার বিব্রত অবস্থা বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নিলেন। এস বাবা এ্‌স, আমার আচরণে কিছু মনে কর না। তোমাকে দেখে আমি অনেকটা নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়েছিলাম। আমি দুঃখিত।
ঃ না না আপনার আচরণে আমি কিছু মনে করি নি। এমন হওয়াটা স্বাভাবিক। আপনার জীবনের প্রথম প্রেম। প্রত্যেক মানুষ তার জীবনের প্রথম প্রেমকে কখনও ভুলতে পারে না।
মহিলা মাথা ঝাকিয়ে বললঃ ঠিক বলেছ আমি এখনও রুপমকে ভুলতে পারিনি। আর কখনও পারবোও না।
উনি এ্যালবাম বের করলেন। কয়েক পৃষ্ঠা উল্টানোর পর একটা পৃষ্ঠায় অনেক পুরানো কয়েকটা পারিবরিক ছবি দেখা গেল। মহিলা আমাকে দেখিয়ে দেওয়ার আগেই আমি দেখতে পেলাম হুবহু আমারই মত একজন দাড়িয়ে আছে এক তরুনীর পাশে।
আমি চমকে উঠলাম, আমার সারা শরীর কেপে উঠল। মহিলা আমার আচরন দেখতে পেয়ে বললঃ বাবা তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে ?
আমি কিছুই বললাম না।

সেদিন রাতেই বাবার রুমে গেলাম। বৃদ্ধ বাবা নানা রোগে জর্জরিত। তবে এখনও সোজা হয়ে হাটেন। ন্যায়ের ব্যাপারে চরম কঠোর ও আপোষহীন। আমার বাবা আমার কাছে আদর্শ , প্রথম আদর্শ নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাল্লাম। এমন বাবার সন্তান হতে পেরে আমি নিজেকে নিয়ে গর্ব বোধ করি।
তিনি টেবিলে বসে বই পড়ছিলেন। আমাকে ঢুকতে দেখে কিছুটা অবাক। আমি আরেকটা চেয়ার টেনে বাবার পাশে বসলাম।
ঃকিছু বলবি ?
আমি জানি আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। আমার দাদা ওসি সাহেব তিনিও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন ।  তিনি শহিদ হয়েছেন। কিন্তু বাবা যে এতবড় আত্মত্যাগী তা আমার জানা ছিল না। কিন্তু কেন ? কি কারনে এই আত্মত্যাগ তা আমাকে জানতে হবে।
ঃবাবা আপনাকে একটা প্রশ্ন করব, উত্তর দেবেন ?
ঃবল।
ঃআপনি রূপম নামে কাউকে চেনেন ?
বাবা এমন ভাবে চমকে উঠলেন যে, যেন ঘুমন্ত মানুষ হটাৎ জেগে উঠল। বাবার কন্ঠ ভারী হয়ে গেল। আবেগে নয় রাগে।
ঃতুই এই নাম কোথায় পেলি।
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।
ঃআমি এই নামকে কবর দিয়েছি আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। শুধু নাম নয় ওই নামের মানুষটাকেও কবর দিয়েছি। এই ব্যাপারে আমি আমার মা আর বাবা ছাড়া কেউ জানত না। আমি ছাড়া আর দুজনত আজ এই দুনিয়ায় নাই। তারপরও ঘটনাটা তুই জানলি কি করে ?
আমি ঘটনাটা বললাম। বাবা মন দিয়ে সম্পূর্নটা শুনে বললেনঃ তুই রুপার কাছে তোর পরিচয় প্রকাশ করেছিস ?
ঃ না বাবা আমি পরিচয় প্রকাশ করিনি।
ঃ ঐ অতিতকে আমি আর কখনো সামনে আনতে চাই না। কারন ঐ আতিত আমার কাছে কালো একটা অধ্যায়।
ঃ ওনার অপরাধ কি ছিল….।
বাবা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেনঃ ওর বাবা ছিল রাজাকার। ওর দেহে ছিল রাজাকারের নাপাক রক্ত। এই হল ওর অপরাধ।

৬৩৮জন ৬৩৮জন
0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ