কাল রাতের ভয়ঙ্কর ব্যাপারটাকে ভুলে থাকার জন্য নিজেকে যেভাবেই হোক ব্যাস্ত রাখতে হবে। আবীর বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে। তার হাতে রবি ঠাকুরের বই। ‘রাহু’ এসে আবারও তার মাথায় ভর করেছে। এই রাহু যদি ভুতের ভয় কিছুটা কাটিয়ে দিতে পারে। সে গুনগুন করে আবৃতি করে যাচ্ছে –

‘সামনে দাঁড়াবে পেছনের কেউ
পেছনে রবে ভয়,
হাঁটিতে থাকিবে দিবস রজনী
আঁধারের সংশয়।
একাকীত্বের ঘোর তামাশায়
ডাকিব কেবলি তোরে,
চারপাশ জুড়ে ফেলিবোরে শ্বাস
জগৎ আধার কো’রে’

রোবেন পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালাল। আবীর তুই ঠিক আছিস? আবীর বইটা নামিয়ে রেখে বলল, হ্যা! কিন্তু তোকে এমন অস্থির লাগছে কেন? কি হয়েছে?
নাহ! কিছু না। আই’ম ফাইন।
আবীর আর কিছু বলল না। কারন সে জানে রোবেন কোন ব্যাপারে খুব বেশী চিন্তা করলে এমন অস্থির হয়ে থাকে। সে নিশ্চয় এখন কিছু একটা নিয়ে ভাবছে।
রোবেন তার হাতের সিগারেটটা ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, ইয়েস! আমি পেয়েছি। আবীর! আমি এখন একটা কাজে যাব। যদি সন্ধ্যার ভেতর ফিরে না আসি। তবে তুই আজ রাতেই ঢাকায় ব্যাক করবি। আর যদি আমি ফিরে আসি তাহলে হয়তো আমরা দুজনই ব্যাক করব। সেই পর্যন্ত তুই সাবধানে থাকিস। আর হ্যা! যদি মনে হয় এখানে একা থাকতে পারবিনা। তাহলে তাথৈয়ের বাড়িতে চলে যাস। আমি যাচ্ছি।
আবীর আর কিছুই বলার সুযোগ পেলনা। তার আগেই রোবেন দ্রুত ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। মিশনে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে হবে। যেমন দুইটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চলাইট। যাতে একটা সমস্যার হলে অন্যটা কাজে আসে। নিতে হবে বিশ-পচিশ হাত লাম্বা দড়ি। তাছাড়া আরো কিছু জিনিস সাথে নিতে হবে। যেমন একটা ম্যাচবক্স, দু-একটা মোমবাতি আর একটা ছুরি। মাঝারি ধরনের দুইটা আয়নাও সাথে নেয়া যেতে পারে। কখন কোন কাজে আসে বলা যায়না। রোবেন একে একে সব কিছু ব্যাগের ভেতর গুছিয়ে নিতে শুরু করল।

ড্রয়িং রুমে সিংহাসনের সামনে এসে দাঁড়াল রোবেন। কাঁধের ব্যাগটা নীচে নামিয়ে রাখল সে। এখন সিংহাসনটাকে আগে সরাতে হবে। এটা দেখে যতটা কষ্ট হবে সরাতে ভেবেছিল। ঠিক ততটা কষ্ট হলনা। রোবেন খুব সহজেই এটাকে পেছনে সরিয়ে নিল। এটা সরাতেই চারকোণা লোহার একটা ডাকনা বের হল। এই ডাকনাটা তুলেতেই নীচে নামার সিড়ি দেখা যাচ্ছে। এই সিড়ি দিয়ে নেমে গেলেই হয়তো সকল রহস্যের জট খুলে যাবে। রোবেন ব্যাগ থেকে একটা টর্চ বের করল। এখন আস্তে আস্তে নীচে নামতে হবে। রোবেন ব্যাগ কাঁধে নিয়ে একটা একটা করে সিড়ি নেমে যাচ্ছে। আর একটু একটু করে অন্ধকার বাড়ছে।
সিড়িটা শেষ হতেই একটা সরু রাস্তা শুরু হয়েছে। রোবেন টর্চের আলো ফেলে সাবধানে এগিয়ে যেতে লাগল। এভাবে প্রায় ১০মিনিট যাওয়ার পর সামনে একটা দরজা পড়ল। লোহার একটা দরজা। রোবেন হালকা করে ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। এই অন্ধকারে টর্চের আলো; এখন আর যথেষ্ট মনে হচ্ছে না তার কাছে। টর্চের আলো যেখানে পরছে। শুধু সেই যায়গাটাই দেখা যাচ্ছে। অথচ তাকে দেখে নিতে হবে পুরো জায়গাটা। তবে এটা যে একটা ঘর তা বুঝা যাচ্ছে। রোবেন ব্যাগ খুলে পাঁচটা মোমবাতি বের করল। তারপর একটা একটা করে মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখল ঘরের চার কোনায় চারটা। আরেকটা রাখল মাঝখানে। এখন মোমের মৃদু আলোয় পুরো ঘরটাই দেখা যাচ্ছে। চোখে পরার মত এখানে তেমন কিছুই নেই। শুধু একটা ‘Bookshelf’ দেখা যাচ্ছে। সেখানে বেশ কটা বইও আছে। রোবেন সেদিকে এগিয়ে গেল। বইগুলোর উপর ধুলো জমায় কোনটা কোন বই বুঝা যাচ্ছে না। তবে ‘Bookshelf’ এর শেষ মাথায় একটা বই দেখা যাচ্ছে। এটা এখনো ঝকঝকে তকতকে। তার মানে এই বইটা এখনো কেউ পড়ে। কিন্তু কে পড়ে?
রোবেন বইটা হাতে নিয়ে কয়েকটা পৃষ্টা উল্টালো। ভেতরের লেখাগুলো কোন ভাষার সে ধরতে পারছেনা। তবে বইয়ের কভার পেজটা দেখে এটাকে খুব সাধারণ কোন বই বলে মনে হচ্ছে না। আবীর বেশ কটা ভাষায় লেখতে ও পড়তে জানে। ও নিশ্চয় এই বইয়ের লেখাগুলো পড়তে পারবে। রোবেন বইটা ব্যাগের ভেতর নিয়ে নিল।

‘Bookshelf’ এর সামনে থেকে সরে আসতেই রোবেনের মনে হল এর পেছনে কিছু একটা আছে। সে ‘Bookshelf’ এর পেছনে গিয়ে দেখল হ্যা! এখানেও একটা লোহার দরজা। রোবেন খুব সাবধানে এই দরজা খুলে ভেতরে গেল। ব্যাগ থেকে আরো কয়টা মোমবাতি জ্বালিয়ে মেঝেতে রাখতেই দেখল, এই ঘরটা অন্য সব ঘরের মত চারকোনা না। এটাকে একটা বৃত্তের মত করে বানানো হয়েছে? আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে পুরো ঘরে দেয়ালের অংশটায় এক হাত সমান জায়গা ফাঁকা রেখে এক একটা দরজা বসানো হয়েছে। সব মিলিয়ে এই ঘরে দরজা দেখা যাচ্ছে ২২টা। কিন্তু একটা ঘরে এত দরজা দেয়ার কারণ কি? তাছাড়া সবগুলো দরজা দিয়েই কি আলাদা আলাদা কোন ঘরে যাওয়া যায়? রোবেন ব্যাগ থেকে দুইটা আয়না আর টর্চলাইট বের করল। আয়না দুইটা ঘরের দু-মাথায় রেখে টর্চ দুইটা জ্বালিয়ে দিল। আয়না আর টর্চ দুইটা এমনভাবে রাখল, যাতে পুরো ঘরটাতেই আলো পড়ে। মোমের মৃদু আলোর চেয়ে এই মুহুর্তে টর্চের আলোটাই বেশী কাজে দেবে।

এখানকার দরজাগুলো সব কাঠের। রোবেন হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে ধীরে ধীরে একটা দরজার কাছে এগিয়ে গেল। এই দরজার কয়েকটা অংশে গুনে ধরেছে। রোবেন দরজাটা ধরে টান দিতেই ভেতর থেকে হঠাৎ করে কিছু একটা এসে তার মাথায় পড়ল। তৎক্ষণাৎ কপালের বা পাশটা ফেটে রক্ত পড়তে শুরু করেছে। রোবেন নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করে উঠে দাঁড়াতেই দেখল দরজার ভেতরটা একটা আলমারীর মত। এবং এর ভেতর থেকেই একটা কঙ্কাল এসে তার মাথায় পড়েছিল। এই অবস্থায় হঠাৎ যে কেউই ভয় পাবে। রোবেনও খানিকটা ভয় পেয়েছে। তবে এখন ভয় পেয়ে বসে থাকলে চলবে না। আরো অনেকটা পথ এগুতে হবে। তবে তার আগে কপালের রক্ত পরাটা বন্ধ করতে হবে। রোবেন ব্যাগ থেকে ছুরিটা বের করল। তারপর পাঞ্জাবী একটা কোনা কেটে কপালে বেঁধে নিল।

একে একে বাকী দরজাগুলোও সাবধানে দেখতে লাগল রোবেন। সবগুলোই আলমীরার মত। এবং ভেতর থেকে হয় কঙ্কাল বের হচ্ছে। নাহয় ভেতরটা ফাঁকা থাকছে। এভাবে দেখতে দেখতে ২০টা দরজা খুলা হয়ে গেছে। সবগুলোতেই এমন। শেষ দরজাটা খুলতেই আরো একটা ঘরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। রোবেন তার হাতে ঘড়িটার দিকে একবার তাকাল। দুপুর ৩টা ৭মিনিট। তার মানে হাতে সময় আছে আর মাত্র ঘন্টা তিনেক। রোবেন আয়না টর্চ গুছিয়ে নিয়ে তৃতীয় নাম্বার রুমে গেল। এই ঘরে তেমন কিছুই নেই। তবে দেয়াল জুড়ে বেশ কিছু লেখা রয়েছে। খুব সম্ভবত লেখাগুলো সংস্কৃত ভাষায়। কিন্তু রোবেন এই লেখাগুলোও পড়তে পারছেনা। সে ব্যাগ থেকে খাতা কলম বের করল। আপাদত লেখাগুলো খাতায় লিখে নিয়া যাক। এসব লেখার অর্থ বের করতে একমাত্র আবীরই ভরসা। ও নিশ্চয় এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে।
রোবেন আরেকটু সামনে আগাতেই দেখল; এ ঘর থেকে বের হবার জন্য আরো একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। এটা আবার লোহার। আগে একবার অসাবধানতারবশে কপাল ফেটেছে। এখন আর সেই ভুল করা যাবে না। রোবেন খুব সাবধানে দরজাটা টেনে খুলল। এখান থেকে কিছুদূর যাওয়ার পর আবার তিন দিকে তিনটা সরু রাস্তা শুরু হয়েছে। এই রাস্তাগুলো দিয়ে কোনরকম পাশাপাশি দুজন যেতে পারবে। এমনভাবে রাস্তা তিনটা বানানো হয়েছে। কিন্তু রাস্তা তিনটার শেষ কোথায়? তাছাড়া তিনটা রাস্তাই একটা পয়েন্টে গিয়ে শেষ হয়েছে? নাকি আলাদা আলাদা?
রোবেন হাতে ঘড়িটা আবারও দেখল। সন্ধ্যা হতে এখনো প্রায় দুই ঘন্টার মত বাকী। কিন্তু এই সময়ের ভেতর কি তিনটা রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে আবার ফিরে আসা সম্ভম? ধরা যাক, একটা রাস্তা ধরে শেষ মাথায় যেতে সময় লাগল আনুমানিক ২০মিনিট। এবং ফিরে আসতে ২০মিনিট। তাহলে একটা রাস্তায় সময় ব্যায় হচ্ছে ৪০মিনিট। আর তিনটা রাস্তায় ১২০মিনিট। তারমানে প্রায় দুই ঘন্টা। এই সময়ে তিনটা রাস্তা দেখে আসতে পারলে ভালো। আর যদি একটা রাস্তাই ২০মিনিটের অধিক সময় লেগে যায় তখন? রোবেন ভাবতে লাগল। ভেবে দ্রুত কিছু একটা সিদ্ধান্ত যেতে হবে।

চলবে…

৪র্থ পর্ব – http://sonelablog.com/archives/30245

৮৮৮জন ৮৮৮জন
0 Shares

৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ