এই রাসেল! এখনো উঠো নাই? ফজরের আজান হয়ে গেছে, জলদি উঠো! মসজিদে যেতে হবে। চোখ ডোলতে ডোলতে ঘুম ভাঙ্গা চোখে তাকিয়ে ছিলাম শ্রদ্ধেয় বড় ভাই “জাবের ভাইয়ের” দিকে। আমিই রাতে বলেছিলাম খুব সকালে ডাক দিবে,
মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়বো! আগেও দুই একবার গিয়েছি আব্বুর সাথে কিন্ত জাবের ভাইয়ের সাথে এখনো যাওয়া হইনি! এবারই প্রথম যাবো। সকাল কি হয়ে গেছে?
হ্যাঁ, আজান হয়ে গেছে। দ্রুত উঠো। উঠে অজু করে নাও।
আমারো অজু করা লাগবে?
হ্যাঁ, অজু না করলে তো নামাজ হবেনা! আসো আসো আমি অজু করাই দিচ্ছি।
আমাকে কোলে করে নিয়ে গেলো জাবের ভাই। সে অজু করছে আর আমার হাতে পায়ে পানি দিয়ে ডলাডলি করে দিচ্ছে। আমি ঘুমন্ত বালকের মত চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছি। প্রায় রাত্রে তাঁর কাছে ঘুমায়, জাবের ভাইয়া খুব ভালো গল্প জানে! তাই তাঁর কাছে শুতে বেশ লাগে। গল্প শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে যায়? আমি নিজেই টের পাইনা! ভুতের গল্প, শাঁকচুন্নির গল্প, পয়গম্বরদের গল্প, কত সুন্দর করে না গল্প গুলি বলে! মনে হয় আমার চোখের সামনে সব কিছু হচ্ছে!
অজু শেষ করে আমাকে কাধে তুলে ঘরে নিয়ে আসলো। গা থেকে গেঞ্জিটা খুলে দিয়ে ছোট পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দিলো। তখনো আমি ঠিক আগের মত চোখ বুজে পড়ে আছি।
আমাকে নাড়া দিয়ে একটু পর পর জাগিয়ে তুলছে জাবের ভাই। পায়ে স্যান্ডেল পরিয়ে দিয়ে আমার বাম হাতটা আলতো করে ধরে মসজিদের দিকে রওনা হলো জাবের ভাই। গত রাতে আমাকে ফিঙ্গে পাখির গল্প শুনিয়েছে। ফিঙ্গেরা নাকি পাখিদের রাজা! গল্প শুনে আমার ফিঙ্গে পাখি দেখার ব্যাপক ইচ্ছা জমলো মনে।
বরাবরের মত আমার
সেই পুরনো জেদ, আমাকে ফিঙ্গে পাখি দেখানোই লাগবে! না দেখালে কিছুতেই হবেনা! জাবের ভাই বলল, তুমিতো ভোর বেলাতে ঘুম থেকে ওঠোনা? ঘুম থেকে উঠলে তো তোমাকে অনেক ফিঙ্গে পাখিদের দেখাতে পারতাম! আমি বললাম,
কেন? অন্য সময় ফিঙ্গে পাখিদের দেখা যায়না? সারাদিনে ওরা কি করে?
জাবের ভাই: খুব ভোরে ছাড়া ফিঙ্গে পাখিরা বাহিরে বের হয় না! ওরা খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে। সকালেই বাহিরে বের হয় ওদের খাবারের সন্ধানে। আবার খুব দ্রুত নিজেদের খাদ্য সংগ্রহ করে ওদের বাসস্থানে ঢুকে যায়! সারাদিনে আর একবারও বের হয়না! এসব শোনার পর ফিঙ্গে পাখি দেখার আগ্রহ আরো এক ধাপ বেড়ে গেলো। জাবের ভাইয়াকে বললাম আমাকে যেনো খুব ভোরে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেই। ফিঙ্গে পাখি দেখতে যাবো। গত রাতে মনে করে সকাল সকাল তাঁর কাছে শুয়েছি। বেশী একটা গল্পও শুনিনি, কারন খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা লাগবে। দেরী করে ঘুমালে সকালে উঠতে পারবোনা!
মসজিদে এসে পৌঁছলাম। ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে নামাজ শেষ করলাম। জাবের ভাইয়ের হাত ধরে মসজিদ থেকে বের হলাম। সকালের আলো হালকা হালকা বের হয়েছে। হেমন্তের ভোর, চারিদিকে বেশ কুয়াশা! জাবের ভাই আমার হাত ধরে হেঁটে চলেছে আজ এক দুর্দান্ত মিশনে। ফিঙ্গে পাখি দেখানোর মিশন। আমাদের এলাকা রেখে অন্য কোথাও চলে গেলো হাঁটতে হাঁটতে। বাড়ির সাম্নের আশ পাশ ছাড়া আমি অন্য কোথাও চিনিনা। এ যেনো আমার নতুন কোন মিশন! নতুন দেখা কোন শহর। চারিদিকে আনন্দের আমেজ লেগে আছে। চোখের ঘুম একটু আগেই হারিয়ে গেছে।
আকাশের পানে তাকিয়ে পথ চলছি। ফিঙ্গে পাখিদের সন্ধান পাওয়ার চেষ্টা করছি। দু’ চোখে শুধু পাখিদের খোঁজ। কিছু উড়ে যেতে দেখলেই বলে উঠছি “ঐ যে ফিঙ্গে পাখি!
সাথে সাথে জাবের ভাই বলে উঠছে ওটা ফিঙ্গে না, ওটা কাক! আবার কিছুক্ষন পর নতুন পাখি দেখে বলে উঠছি, ঐ যে ফিঙ্গে পাখি! পরক্ষনেই জাবের ভাই বলে উঠছে ওটা ফিঙ্গে নয় ওটা শালিক পাখি! উদ্বিগ্ন মন, চিন্তার আসর দু চোখের পাতায় উৎকণ্ঠা ভর করে আছে। কিছুদুর গিয়ে একটা খালি পার্কের মত জায়গাতে ফাকা একটা বেঞ্চে গিয়ে আমায় নিয়ে বসে পড়লো জাবের ভাই।
হাত উঁচু করে দেখালো, ওই দেখো ঐ যে কারেন্টের তারের উপর সারি বদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে ফিঙ্গে পাখি! ফিঙ্গে পাখি দেখার পর আমার মনটা আনন্দে, উতফুল্লে ভোরে উঠলো। কি যে খুশি লাগছিলো আমি সেই খুশি অনুমান করে বোঝাতে পারবোনা। খুশি মাপার মত কোন যন্ত্র যদি বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করতো, তাহলে দেখা যেতো আমার খুশির রেখা ১১০ ছাড়িয়ে গেছে! জাবের ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ফিঙ্গে পাখিদের লেজ মাছের লেজের মত কেন? এমন প্রশ্নে জাবের ভাই কি উত্তর দেবে তাই হইতো বলেছিলো, “ওরা পাখিদের রাজা না? এজন্য ওদের লেজ সব থেকে আলাদা! আমার প্রশ্ন আবার ছিলো, আচ্ছা তাহলে ওদের শরীর কাকের মত কালো কেন? ওদের অন্য কোন রঙ হলো না কেন? জাবের ভাই আমাকে নিয়ে উঠতে উঠতে জবাব দিলো, ওরা রাজা পাখি না, তাই কালো রঙের হয়! আমিও আপন মনে সেটাই বুঝে নিলাম। আর মনে মনে ভাবতে লাগ্লাম ফিঙ্গে পাখি পাখিদের রাজা! আর তারপরের রাজা হলো কাক! কারন কাকের শরীর ওতো কালো হয়।
(ঘটনা ১৯৯৭ কি ৯৬ সালের, আমার চাচাতো ভাই তখন আমাদের বাসায় থাকতো। আমাকে খুব ভালোবাসতো সে! তাঁর আদরে অনেক দূর পর্যন্ত এসেছি। হঠাৎ কোন একদিন সে বাসা ছেড়ে চলে গেলো। আর আমি হারালাম মাথার উপর থেকে এক বড় ভাইয়ের ভালোবাসার হাত! আপন কোন ভাই না থাকায় তাকেই বড় ভাই হিসেবে মানতাম। এখনো অন্তর থেকে তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা এবং অঢেল ভালোবাসা রয়ে গেছে। এখনো অনেক ভালোবাসা আছে তাঁর প্রতি। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে আজ সে বেশ সুখেই আছে। “আল্লাহ” তাঁর জীবনে আরো সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করে দিক এই কামনায় করি।)
শৈশবের দিন গুলির কথা মাঝে মাঝে বেশ গভীর করে তোলে। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিলো কৈশোরের সময় গুলি!
আজ অনেকদিন পর ফজরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে হঠাৎ কি মনে করে আকাশের দিকে তাকালাম। কিছুই লক্ষ্য করলাম না! সব শুন্য। কারেন্টের তাঁর গুলিতে ফিঙ্গেদের অবস্থান টের পেলাম না। একেবারেই খালি! এখন কি ফিঙ্গেরা সকাল বেলা বের হয়? কি জানি বাপু” আমিই তো কত কাল পরপর একদিন ভোরের আলোর মুখ দেখি! জীবনটা আগের মত সাজানো গোছানো নেই। চলছে খাপছাড়া খাপছাড়া ভাবে।
১০টি মন্তব্য
প্রহেলিকা
ei khapchara khapchara jibon niyei je amader samne srmitibijorito ei onuvuti tole dhorlen setar jonno shuveccha roilo. Onek dhonnobad mone hocchilo amio amar koishor jibone fire giyechilam khaniker jonno. Golpo seshe takiye dekhi na fire jaoa ar holo na,finge pakhio ar bujhi dekha paoa jabe na konodin.tobe etokichur majheo je namaz porechen setar jonno dhonnobad khushi holam shune. Namaz dhore rakhar ceshta korben jodio ami nijei pori na tobe ceshta korbo porar jonno. Dhonnobar apnake shoishober srmiti share korar jonno. Shuvkamona.dinti shuvo hok.
Banglate type korte parlam na bole dukkhito.
রাসেল হাসান
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপ্নাকে “আমিন” ভাই। হঠাৎ ছোটবেলার স্মৃতিটা চোখের সামনে জেগে উঠলো তাই তুলে ধরলাম। সাজানো গোছানো জীবন যেভাবে হারিয়ে গেছে সেভাবে ফিঙ্গে পাখিরাও হারিয়ে গেছে। নামাজ নিয়মিত পড়া হচ্ছেনা তবে নিয়মিত করার চেষ্টায় আছি। দোয়া করবেন। বাংলাতে লেখা আর ইংরেজিতে লেখা এটা কোন ফ্যাক্ট না! আপনি যে মন্তব্য করেছেন, আপনার মনের ভাষাটা জানিয়েছেন এটাই সব থেকে বড় ব্যাপার! অনেক ভালো লাগছে আপনার মন্তব্য পড়ে। ভালো থাকবেন। শুভ কামনা রইলো।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার সাথে আমরাও বলি আল্লাহ্ যেন আপনার বড় ভাইকে আর সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যান ।
রাসেল হাসান
আমিন…”আল্লাহ” যেনো তাই করেন। ভালো থাকবেন “প্রিয় হেলাল” ভাই।
লীলাবতী
ছোট বেলার ঘটনা গুলো কত মজার হয়। ভালো লেগেছে ভাইয়া -{@
রাসেল হাসান
ভালো লাগাতে খুশি হলাম। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ “প্রিয় লীলাবতী” আপু।
হতভাগ্য কবি
ভালো থাকুক আপনার স্মৃতি ভালো থাকুক আপনার প্রিয়জনরা, আপনার এমন আরো স্মৃতি জানাবেন। শুভকামনা
রাসেল হাসান
ধন্যবাদ দোয়া করবেন, পাশে থাকবেন তাহলেই লিখে যাওয়ার সাহস পাবো।
নীহারিকা
খুব ভাল লেগেছে ভাই। জীবন এভাবেই বদলায়।
রাসেল হাসান
আসলেই “আপু” জীবনটা এভাবেই বদলাই!
শুভেচ্ছা জানবেন। ভালো থাকুন নিরন্তর।