এখন রাতের কোন প্রহর? ঠিক ঠাহর করতে না পারলেও বুঝতে পারছি, এখন রাতের দ্বি-প্রহর। কারণ, তিনি এসে বসেছেন তার সে চির আপন ডালে। কয়েকদিন থেকেই বুঝতে পারছি এখানে তিনি বসে থাকেন আমার পাহারায়। আজ আর খুলছি না থাই গ্লাস। বলেছিলাম বাঁশি শিখে আসতে। অন্তত কিছু শব্দ ধরে আনতে। আনে নি জানি। তাই তো চুপ করে বসে আছে। জানি একটু পর পর পাতায় সে খসখস শব্দ তুলবে। ডানা ঝাপটাবে।
সেদিন বললাম, চুপ করে বসে থাকো। উল্টা নাক দেখালো আমাকে!! বলেই দিলো মুখের উপর,’প্রাচীন পদ্ধতিতে গার্হস্থ্য জীবনের সাদাসিধে সুখ আমি কেনো উপভোগ করছি না! শিল্পী সত্তা মনের এক আফসোস আছে নাকি। বিজ্ঞান যতো সহজে স্বীকৃতি পায় শিল্প সাহিত্য চর্চা ততো সহজে স্বীকৃতি পায় না নাকি। আবার বিজ্ঞানমনে আবেগ নেই তাই আবেগের জটিলতা নেই!
কি হবে এমন ছাইপাশ লিখে! বই বন্ধ করো। এসো কান পাতো। পাতার এক বাঁশি বানিয়েছি।’
বুঝেছি, যতোক্ষণ এ গ্লাস টেনে খুলব না ততোক্ষণ সে এমন প্রলাপ বকবে।
খুলে দিলাম। কিন্তু জানি আসবে না ও ডাল ছেড়ে। একচুলও এখন নড়বে না।
গান ছাড়লাম।
‘কেনো যাও জলের কাছে, কেনো জল এ মন টানে।’
জোরে সে এবার ডানা ঝাপটালো। বুঝেছি মেজাজ খারাপ তার।
জিজ্ঞেস করলাম কোন গান?
‘হাম তেরে শহরমে আয়েহে মুসাফির কি তারাহ্?’
মুখ ভাঙ্গালাম। আগের সেই অনুভূতি কি আছে তোমার?
আমাকে পাবার সেই আকুলতা?
দলচ্যুত এক পাখি আমার। আমার রাতের পাখি। আমার নির্জনতার পাখি। এ পাখির কি নাম দিব ভেবে ভেবে সেদিন তার ডানায় লিখে দিলাম তিন অক্ষরের এক শব্দ।
তার জন্য আমার উদ্বেগ। এ উদ্বেগে সে যায় না ছেড়ে এ ডাল। এ সব উদ্বেগের মনস্তত্ব মোটেও সরল নয়। আমার উদ্বেগের কারণ তার জানা আছে। জানে, ভালবাসি। তাই নির্ভয়ে বসে থাকে। তার অপেক্ষায় আমি বসে থাকি জীবন ছন্দের সকল তাল সামলে। কোথায় কোথায় ঘুরে ফিরে উড়ে আসে ক্ষণিক কিছু সময়ের জন্য। এ যেনো ‘শ্যামলিয়ার প্রেমাঙ্গনে জিন্দা পাখির বিলাসী প্রেম।’
নিরব অপেক্ষার প্রহর গুনে আমার অভিমান তখন চরমে। আমি করি রাগ সাথে কিছু অভিমান আর সে মুচকি হাসে, দেখে সে তাতে মিষ্টি ভাব। সে জানে তার এ মুচকি হাসিতে আমার প্রাণ জুড়ানো। অভিমান সব গলে তখন একাকার। দুজনেই দৃষ্টির সোহাগ পেতে ব্যাকুল। মৃদু অভিমান প্রকাশের এক লাভ আছে। মিথ্যে হোক কিংবা সত্যি হোক কিছু আবেগ ঝরে পড়ে তাতে। এতে হাজার তারা সামনে ডোবে। চাঁদ হাসে।
স্নায়ুর স্বাস্থ্যনীতি সম্বন্ধে এখনো বিশেষ গবেষণা আমার হয় নি। হলে অনেক লাভ হতো। আমার জন্য তার সকল ভালবাসার প্রকাশ পেতে শরীর মেরে ফেলে মস্তিষ্ক নামক কারিগরকে জীবিত রেখে চোখ বন্ধ করে তার সকল আকুতি জেনে নিতাম।
জীবন যে তিনটি জিনিসের উপর দাঁড়ানো তার একটি মস্তিষ্ক নামক কারিগর।
শুনেছি হৃদয় মরে যায় হৃদপিন্ডের রক্ত সঞ্চালন কমে গেলে সেই সাথে শরীর। মস্তিষ্ক নামক কারিগর তখনও নাকি কিছু অনুভূতি জাগিয়ে রাখে। অন্তত সে সময়টুকু তার আকুলতা দেখার জন্য এমন একটা সুযোগ চাই। সামনে সে বসে থাকুক সে মুহূর্তটায়। হাতটা জোরে চেপে ধরে চিৎকার করে বলুক আবারো, তোমাকে ছাড়া একমুহূর্ত থাকা যায় না গো!’
তার সে ইচ্ছাশক্তির জোরে হৃদপিন্ডে রক্তের গতির বেগ জেগে উঠবেই জানি।
তার আবেগ ঝরে পড়া মুহূর্তগুলোয় রক্তের প্রতিটা কণা আমার স্থির হয়ে থাকে। চোখের পাতা বুজলেই ঝরঝর করে ঝরে পড়ে অশ্রুধারা। ঝাপসা চোখে অপলোক চেয়ে থাকি তার চোখে।
একটু জোরেই ডানা ঝাপটালো মনে হলো। বুঝলাম লাইট অফ করে বারান্দায় বসতে বলল। আকাশে চাঁদের বুড়ি আলো জ্বেলেছে। সুপারি ফুল তার সুবাস ছেড়েছে। কবে যেনো কাঁচা হাতে কিছু কবিতা জুড়েছিলাম। চাঁদের বুড়ির কাছে তা জমা আছে। কতোবার মিনতি করেছি। ফেরত দেয় না সে আর। সে সব শব্দ শুধু
ডেকে বলে,’রিতু এসো জীবনের স্বাদ নেই প্রাণ ভরে।’
আমরা দুজনেই জানি যে মানুষের স্বাদ গ্রহনের ক্ষমতা আছে। সে শতো বিচলিত মুহূর্তেও শান্ত। আর তাতেই জীবনের প্রকৃত সুখ। যার নেই সে অনেক দুর্ভাগা। আমরা শ্রাবনের আকাশের মতো মুখভারি করে রাখি না, ফাল্গুনের আকাশের মতো হাসি ও হাসাই। উপভোগের বস্তু আমাদের সর্বত্র ছড়ানো। অবশ্য গভীর সংকটের সময় যে বিপদের কথা চিন্তা না করেও থাকা যায় এমন কথা আমি বলছি না। তবে সকল ক্ষেত্রেই মানসিক শৃঙ্খলা থাকা আবশ্যক।
তাই তো ভোরের আলো ফুটলেই, জীবনের প্রয়োজনে জীবন নাটিকার বিচিত্র ভূমিকায় অবতীর্ণ হই।
থাই গ্লাস টেনে দেই একলা পাখি আমার উড়ে যায়,,,,,,,
কোথাও যেনো বেজে ওঠে,’বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে আমি তবু বসে রব মুক্তি সমাধিতে।’
,,,রিতু,,,,
২৬টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
আপনার হাসপাতাল লেখাকে ছিনিয়ে নিতে পারেনি, নিতে পারেনি প্রাণের পাখিটিকেও।
প্রাণের ডাক আমরা শুনতে পাই, শুধু সে ডাকের অনুসরণে ছুটে যেতে পারি না,
হারানো ঠিকানায় হন্যে হয়ে ফিরে আসি নিজের কাছে।
লিখেই বাঁচবেন, লেখা হয়েই বচবেন।
রিতু জাহান
ব্যাঙের আবার সর্দি কাশি বলেন!
আসলে জীবন থেকে যে সকল ধকল যায় তা যে সয় শুধু সে জানে। জীবনের সকল পথ কেনো যে সোজা নয়!!
বাঁচতে চাই বলেই লিখে যাই। লিখতে চাই। যান্ত্রিক জীবনে শব্দ সব সময় ধরা দেয় না। সাজতেও চায় না।
প্রহেলিকা
লেখাটি নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই! শুধু বলব যে আজ অবধি আমার পড়া আপনার সেরা লেখা এটি।
যখন পড়ছিলাম নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম সেখানে! এত সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন যে লেখার ভেতরে অবগাহন করতে পেরেছি এই অধম পাঠক! দারুন, দারুন! প্রিয়তে রেখে দিচ্ছি!
রিতু জাহান
যাক কিছুটা উৎরে উঠতে পারলাম।
অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় কবি লেখক।
এ আমার রাতের বারান্দা। এখানে আমার কতো কতো ভাবনার জাল বোনে! সব যে আর কলমে ওঠে না।
সাহস দিলে ঢেলে দিতে পারি কিন্তু,,,
প্রহেলিকা
“শিল্পী সত্তা মনের এক আফসোস আছে নাকি। বিজ্ঞান যতো সহজে স্বীকৃতি পায় শিল্প সাহিত্য চর্চা ততো সহজে স্বীকৃতি পায় না নাকি। আবার বিজ্ঞানমনে আবেগ নেই তাই আবেগের জটিলতা নেই!”
গভীর দর্শনের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলাম! চমৎকার ফুটিয়ে তুলেছেন লেখাটিকে।
রিতু জাহান
হুম, সেদিন পড়তে গিয়ে এ লাইনটাই আটকে গেছিলাম।
ভাবলাম বিষয়টা নিয়ে। একদম সত্যিই তো কথাটা। এই আমার মতো অধম ছাইপাশ লেখকদের কে-ইই বা আবার মূল্যায়ন করে বলুন,,,
শব্দ আবিষ্কার করা যে কত্তো কঠিন তা তো আমিই জানি। আফসুস কেউ বুঝলো না😥😥
মনির হোসেন মমি
কোথাও যেনো বেজে ওঠে,’বিশ্ব যদি চলে যায় কাঁদিতে কাঁদিতে আমি তবু বসে রব মুক্তি সমাধিতে।’
চমৎকার সব অনুুভুতি আপনার।
রিতু জাহান
ধন্যবাদ প্রিয় ভাই।
আপনাদের এমন উৎসাহে লেখার সাহস পাই।
জিসান শা ইকরাম
এই পাখিটি একটি মাধ্যম মাত্র, আমাদের বিবেক, আত্মোপলব্ধি, চিন্তা ভাবনা, অন্তরের গহীনের কথা মাঝে মাঝে কোন কিছুকে অবলম্বন করে প্রকাশ হয়, এমন গভীর অনুভুতি সব সময় জাগ্রত হয় না, স্বাভাবিক সময়ে এমন ধরনের চিন্তা আমাদের মাথায়ই আসবে না। আসলে পাখিটি একটি প্রতীক, পাখিটি আসলে তুমি নিজেই, নিজেই নিজের সাথে এমন কথা বলো, জীবনকে বিশ্লেষন করো। সোনেলার রিতু জাহানকে আজ নতুন রুপে দেখলাম। এমন লেখা এই প্রথম লিখলে তুমি। প্রহেলিকার মত আমারও ধারনা, এটি তোমার সেরা লেখা। শুভ কামনা।
রিতু জাহান
আসলেই ভাইয়া, এ রুমটায় বসে আমার যে কি উল্টাপাল্টা ভাবনা মাথায় আসে!!
সব আসলে গোছাতে পারি না। তুলে ধরাটা খুব কঠিন।
নিজের সাথে আমার নিজের যে কতো কথা!!
আপনার এমন উৎসাহে প্রতিবারই আমাকে সাহসি করে তোলে ভাইয়া।
জিসান শা ইকরাম
অনেক সুন্দর একটি শিরোনাম আর ছবিতে লেখাটি পুর্নতা পেয়েছে।
রিতু জাহান
ছবি আমাকে শুন্য ধার দিছে। এহ! ননদ বলে কথা। আমাকে এতো অসুকের মধ্যেও ধমক না আদর করেই বলল, একটু ভালো লাগলেই লেখা দাও। দেখো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরুষ ব্লগাররা। তাই তো দিলাম একটা হাবিজাবি। শুন্য বলল, দাঁড়াও ছবি খুঁজি। হারতে চাই না।
থ্যাংকু ভাইয়া।
ইঞ্জা
খুব ভালো মানের লেখা আপু, হৃদয়টা নাড়া খেয়ে গেলো। 😍
রিতু জাহান
ধন্যবাদ ভাইজু। শুভকামনা রইলো।
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা প্রিয় আপু
শুন্য শুন্যালয়
পাখি নিয়ে এমন করে আজ অবধি কেউই লেখেনি।
হাসপাতালে ছিলে বলেই কি স্থির হয়ে লিখেছো?
দাঁড়াও সুন্দর করে মন্তব্য দিব, আজ চা খাইনি, মাথা কাজ করছেনা। চা বানিয়ে আনি আগে।
রিতু জাহান
তুমি লেখো নি!! তোমার পাখি প্রেম দেখেই তো আমিও লেখার সাহস দেখালাম।
মাহমুদ আল মেহেদী
জীবনে যতদিন বাঁচবো আনন্দই হবে জীবনের একমাত্র স্বাদ। বাস্তবতারই রুপক, বাস্তব নিজকে ফুঁটিয়ে তুলেছেন শিল্প মনে। বিজ্ঞান যা প্রমান করে, তা শিল্পীরা অনেক আগেই কল্পনা করে রেখে যায়। এখানে মিল আছে বিজ্ঞানের সাথে শিল্পির।
অনেক ভালো একটা লেখা পড়লাম আপু।
রিতু জাহান
ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকুন সব সময়।
শুন্য শুন্যালয়
একটা কথা মানছি, তুমি অনেক মনোযোগী এবং ডেডিকেটেড পাঠক। কোন লেখা পড়তে পড়তে ভাবি অনেক, কিন্তু সেটা ভুলে যাই পরে। তুমি শুধু পড়োই না, লেখাটা কোট করো, সেটাকে বিশ্লেষণ করো, নিজের মধ্যে এনে তোমার লেখায় জুড়াও। এটা সত্যিই কঠিন ব্যাপার। তাছাড়া তোমার লেখা পড়েই বোঝা যায় তোমার জ্ঞানের পরিধি বিশালতর হচ্ছে। হ্যাঁ মস্তিস্ক জেগে থাকে হৃৎপিন্ড মরে গেলেও। সম্ভবত এটাকেই কেউ কেউ আত্মা বোঝাতে চায়, কী জানি!
পাখির রূপে তুমি, তোমার ভাবনা, আবেগ, দর্শন, বিজ্ঞান, বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার।
এ লেখার জন্যেই তোমার ফ্যান হলাম। (আগে যা বলেছি সব মিথ্যে ;)) আচ্ছা দুস্টুমি করবোনা। তুমি সবসময়ই ভালো লেখো, মাঝে মাঝে মনে হয়েছে একটা কিছু নিয়ে লিখতে গিয়ে তুমি অন্যদিকের কিছু জিনিস মিলিয়ে ফেলো, কখনো বলেছিও বোধহয় তুমি অস্থিরতা নিয়ে লিখেছো। বাট দিস ইজ দ্যা বেস্ট।
মেহেরী তাজ
ভাবীজান এই লেখা কই বসে লিখেছো? হাসপাতাল?
হাসপাতালে গেলে বুঝি এতো সুন্দর লেখা আসে? আমি তো ক্যামিকেল এর গন্ধ ছাড়া অন্য কিছুই পাইনা।
😢
রিতু জাহান
আমি এ হসপিটালের গন্ধ শুঁকে শুঁকে বড় হয়েছি। তাই অভ্যস্তরে।
ভালবাসা নিস। লেখা দে
তৌহিদ
লেখা নিয়ে সবাই যা বলার বলেছে আপু, শুধু বলবো অসাধারণ!!
আচ্ছা হাসপাতালে কে ছিলো? কিছুই জানিনা! কেউ বলেওনি। আপনিও না!
দুঃখ পেলাম।😞😞
রিতু জাহান
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
আনাদের সকলের ভালবাসায় আমি কৃতজ্ঞ।
সাবিনা ইয়াসমিন
তুমিকি কবিতা লেখার জন্যে হাসপাতালে গিয়েছিলে না কবিতা তোমাকে নিয়ে গেছে? কবিতার সাথে এতো প্রেম কেন তোমার? পাখি–পক্ষী সব বাহানা, কবিতার জন্যেই কবিতা লিখেছো এটা ঠিক বুঝতে পেরেছি।
তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠো, দোয়া আর ভালোবাসা ❤❤
রিতু জাহান
কবিতা খুব ভালবাসি। এটা চির সত্য।
ভালো আছি এখন। ভালবাসা নিও।