
শেষ পর্ব
মানুষের ভেতরে যে হুঁশ থাকে সম্ভবত সে হুঁশটা মানুষের পাপ ও পূণ্য নিয়ে নড়াচড়া করে। বাহিরে যতোই প্রলেপ দেওয়া হোক লাল কে নীল হলুদকে সবুজ করা হোক। ভেতরের সে মানুষটা এক ইঞ্চিও ছাড় দিতে জানে না, জানে না কোনক্রমেই আপোষ করতে। তাই সে সত্য কে সে সত্য হিসেবেই চিনে মিথ্যেকে চিনি মিথ্যে হিসেবেই।
মায়ের মৃত্যুর পর মিথুন নিঃশব্দ প্রতিবাদে করে যাচ্ছে। তার সেই দম শক্তি কথার জৌলুস কোনকিছুই যেন নেই। নিছক একটা রোবটের মতো হয়ে গেছে তার জীবনচিত্র। ডক্সিও বিষয়টা টের পেয়েছে কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলে না সে। মিথুন লক্ষ্য করেছে এইযে ডক্সির অবহেলার কারণে তার মা চলে গেলো এতে তার কোন অপরাধ বোধ নেই। বরং একটা মুক্তির নিঃশ্বাস ঢেউ তুলেছে তার চিবুক বরাবর। যেখানে তাকালেই একটা ভূকম্পন পৃথিবীকে আলাদা করতে চায় নিজের পরিমণ্ডল থেকে।
একমাসের বেশি হলো ডক্সির মা এসেছে। ডক্সি কতো উৎফুল্ল কতো কিছু গল্প করছে মায়ের সাথে। মাঝে মাঝে তার মা বারান্দায় বসে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। একটা নিবিড় বিচরন একটা শান্ত নীড়। যা কিছুদিন আগেও কালো মেঘে ঢেকে ছিলো। কিন্তু সুখ সবসময় সহ্য হয় না কখনও সুখ ও সুখের শত্রু হয়ে উঠে। কিন্তু মিথুনের এসব দেখে কেবলই বাড়ছে শূন্যতা চোখের সামনে ভেসে উঠছে মায়ের অনাদ্রিত মুখখানা। আর আস্তে আস্তে জেগে উঠছে ভেতরের হিংস্রতা।
তখন রাত দশটা বাজে টেবিলে বসে চা মুখে দিলো মিথুন। এমন সময় ডক্সির মা এসে সাদিনের গ্লাসটায় পানি ঢেলে পান করলো। মিথুন কেন যেন জ্বলে উঠলো ভেতর থেকে। নিজেকে আর সংবরণ করতে পারলো না। সাথে সাথে গ্লাসটা জানালা দিয়ে বাহিরে ছুঁড়ে মারলো। বেচারি শাশুড়ী লজ্জায় লাল হয়ে মেয়েকে গিয়ে বললো। ক্ষিপ্র হরিণীর মতো ছুটে এলো ডক্সি। শান্ত সমুদ্রে বেজে উঠলো যু্দ্ধের দামামা। কিন্তু মিথুন শক্ত হয়ে গেল তার গলার স্বর পাল্টে গেছে আজ।
চূড়ান্ত সহ্যর সীমা ভেঙে গেলে মানুষের আর হুঁশ কাজ করে না। তখন নিজের অবচেতনে একটা খেয়ালই কাজ করে যা সে নিজেই জানে না। ডক্সি শুরু করলো অকথ্য ভাষার বমি সংলাপ “আমার মা’কি তোর মায়ের মতো নোংরা, আমার মাকে অপমান করিস তুই, তোকে আমি জুতা দিয়ে পেটাব”। এই বলে মিথুনের গালে জুতা দিয়ে আঘাত করলো ডক্সি। মিথুনও ধরে ফেললো শক্ত করে গলায় ডক্সির মা অনুরোধ করছে মিনতি করছে ছেড়ে দাও মিথুন মেয়েটা আমার মরে যাবে। কিন্তু মিথুন কিছুতেই ছাড়তে পারছে না।
এক পর্যায়ে মিথুনের শাশুড়ী দা নিয়ে এসে মিথুনের হাতে স্টেপ করলো। রক্ত বেরিয়ে গেলো লাল। আহা জীবন তো এভাবেই লাল হয়ে উঠে। মিথুন এখন সিংহের মতো গর্জন করছে। আদিম পশুত্ব জেগে উঠছে মিথুনের ভেতরে তার দিকে কেউ তাকাতে পারছে না। ভয়ে মেয়ে ও মা রুমের দরজা আটকিয়ে দিয়েছে।
এদিকে মিথুন বাসা থেকে বেড়িয়ে প্রতিবেশীদের কয়েকজনকে ডেকে আনলো এবং সবাইকে সব খুলে বললো। যদিও প্রতিবেশীরা আগে থেকেও সব জানতো। তার মায়ের মৃত্যুর জন্য যে দায়ী ডক্সি এ বিষয়টাও তারা বুঝিয়েছে কথায় ইশারা ইঙ্গিতে। আজ প্রতিবেশীরা সবাই সবাই ডক্সিকে ধিক্কার জানিয়ে নানান কথা বলছে । প্রতিবেশীদের শব্দ পেয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো মা ও মেয়ে। এবার শুরু হলো নতুন সংলাপ কিন্তু মিথুন কোন কথা শুনতে রাজি নয়। সে বুক ফুলিয়ে বড়ো একটা দম নিলো এবং এরপর যা বললো তাহলো “আপনারা সবাই স্বাক্ষী, আমি আমার স্ত্রী,কে তালাক দিচ্ছি! তালাক! তালাক! তালাক!
মিথুনের এরুপ আকস্মিক আচরণে
সবাই হতভম্ব হলো। একটা অচেনা জানোয়ার হয়ে উঠলো মিথুন। তারা ভয়ে এতোটা শঙ্কিত হলো যে মা ও মেয়ে একেবারে ছোট হয়ে গেল। যতোটা ছোট হলে মানুষের দিকে আর তাকানো যায় না লজ্জা অথবা কান্না দুটোকে আলাদা করা যায় না। পিঁপড়ে যতটুকু ছোট হয় তারচেয়ে বেশি ছোট লাগছিলো তাদের। রক্ত ঝরা চিত্ত নিয়ে একটা হিংস্র বাঘের পদতলে যেভাবে নিজেকে সমর্পণ করে পৃথিবীকে শেষবার দেখে নেয় অসহায় হরিণের অশ্রুসিক্ত দুটো চোখ । ডক্সি ও সেদিন নিজের রূপ ও যৌবনের অহঙ্কার ভুলে সামান্য অনুুকম্পা পেতে মিথুনের দিকে তাকানোর সেইটুকু সাহসও হারিয়েছিলো ভয় ও লজ্জায়।
তাদের চোখে মুখে যে প্রশ্নটা সেদিন ছাপাখানার যন্ত্রের মতো মুদ্রণ করে যাচ্ছিলো, তাহলো একটা আশ্রয় আজকের রাতটা আমরা কোথায় যাবো কার কাছে যাবো। হুহু করে যেন কান্না করছে বিছানার লাল চাদরটা গতকালও যেটাকে হুইল পাউডার দিয়ে ওয়াশ করেছেন ডক্সি যত্ন করে। তাকিয়ে আছে সখের ড্রেসিং টেবিল ও আলমারি যেটাতে সে শতবার নিজের মুখ দেখেছেন । অথচ সে আয়নায় আজ আর তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। সেখানে দেখা যাচ্ছে বেদনাদীর্ণ এক খোলা প্রান্তর।
সবকিছু নিয়তি মুছে দেয় । সব মায়া ছিন্ন করে একদিন আলাদা হয় দেহ থেকে আত্মা । কিন্তু বেঁচে থেকেও মানুষ যে কতো ভবে আলাদা হয় মানুষ থেকে তাও দেখা যায় । মায়ার সুতো কেটে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে দুটো নদী। নদীরা তো বয়েই যায় হয়তো দ্রোহে হয়তো বিরহে ।
তেমনি এক পৃথিবীর সব দুঃখের ওজন পায়ে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক দুঃখিনী মা ও মেয়ে। রাস্তায় একটা কনকনে ঠান্ডা বাতাস অতিক্রম করে যাচ্ছে তাদের। পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ বৃক্ষেরা একান্তে জানিয়ে যাচ্ছে নিজেদের আশ্রয়হীনতার ইতিহাস।
অদূরে একটি কবরস্থান দেখা যাচ্ছে সেখানে বসে গান গাচ্ছে একদল গায়ক পাখি। ডক্সির কাছে আজ মনে হচ্ছে এটাই বোধহয় মানুষের শ্রেষ্ঠ আশ্রয়স্থল।
১৮টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
শেষপর্যন্ত তালাক হয়ে গেল। কবর ই শেষ ঠিকানা। তবুও কেন যে মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে। ধন্যবাদ ভাইয়া
দালান জাহান
ধন্যবাদ কবি শুভেচ্ছা ও শুভসন্ধ্যা
ছাইরাছ হেলাল
আগের গুলো পড়া হয়নি, তারপর ও এই পর্বটি পড়লাম।
পরের লেখা পড়ব অবশ্যই।
দালান জাহান
ধন্যবাদ ভাই শুভেচ্ছা
সুরাইয়া পারভীন
আগের পর্ব গুলো পড়া হয়নি। শেষ র্পব পড়ে ভালো লাগলো। বাকী গুলো পড়ে নেবো
দালান জাহান
ধন্যবাদ কবি শুভেচ্ছা
হালিম নজরুল
“মানুষের ভেতরে যে হুঁশ থাকে সম্ভবত সে হুঁশটা মানুষের পাপ ও পূণ্য নিয়ে নড়াচড়া করে। বাহিরে যতোই প্রলেপ দেওয়া হোক লাল কে নীল হলুদকে সবুজ করা হোক। ভেতরের সে মানুষটা এক ইঞ্চিও ছাড় দিতে জানে না, জানে না কোনক্রমেই আপোষ করতে। তাই সে সত্য কে সে সত্য হিসেবেই চিনে মিথ্যেকে চিনি মিথ্যে হিসেবেই”
—————-চমৎকার কথা।
দালান জাহান
কৃতজ্ঞতা ভাই। ভালো থাকুন সবসময়
ফয়জুল মহী
অপরূপ ভাবনা। বস্তুনিষ্ঠ লেখা।
দালান জাহান
ধন্যবাদ ভাই ভালো থাকবেন সবসময়
মনির হোসেন মমি
গল্পের শেষটা শেষের মত করেই শেষ করলেন। খুব ভাল লাগল। এ সমাজ পুরুষশাষিত সমাজ তা আপনার লেখনীতে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
দালান জাহান
সুন্দর মন্তব্য করেছেন দাদা। অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা।
আরজু মুক্তা
কবরই শেষ ঠিকানা।
দালান জাহান
ধন্যবাদ কবি শুভেচ্ছা ও শুভসন্ধ্যা
জিসান শা ইকরাম
তালাক তালাক তালাক, তিনটি শব্দ উচ্চারিত হবার সাথে সাথে একটি সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। এটি মেনে নেয়া অত্যন্ত কস্টের। মানাই যায় না আসলে।
তিন পর্বে খুব ভাল একটি গল্প শেষ করলেন। এমন শক্তিশালী গল্প খুব শিঘ্র পড়িনি আমি।
ভাই, প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বের শিরোনামে তালাক এর পর প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব দিয়ে দিন ব্রাকেটের মধ্যে। এতে পাঠকদের সুবিধা হবে।
শুভ কামনা।
দালান জাহান
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা দাদা। ভালো থাকবেন সবসময়।
সঞ্জয় মালাকার
অসাধারণ লেখা,
কাজের ফাঁকে পর্ব পড়েছি, তবে সময় করে আগের পর্ব পড়বো।
মানুষের ভেতরে যে হুঁশ থাকে সম্ভবত সে হুঁশটা মানুষের পাপ ও পূণ্য নিয়ে নড়াচড়া করে।
দালান জাহান
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা দাদা