একজন মাত্র ব্যক্তি দেশের তথাকথিত কাণ্ডারি হয়ে ঘুর্ণিপাক খাচ্ছে এইপ্রান্ত থেকে ওইপ্রান্তে- নাম তার সফদার। যে এখনো বাপ দাদার আমলের কুইনাইকে টিকিয়ে রেখেছে নিজের ক্যারিশম্যাটিক হাতের ছোঁয়াতে। বিশেষ কিছু গোপন রোগের চিকিৎসায় “সফদার” আবার সিদ্ধহস্ত।
রোগী যায় রোগী আসে, খুঁজলি রোগ আর সারেনা এলোপ্যাথিতে। কোয়াক থেকে শুরু করে এফ আর সি পি এস সবাই হচ্ছে নাজেহাল। নাকানিচুবানি খেয়ে ডাক্তাররা রোগীদের রেফার্ড করছে সফদারের কাছে। তার সিরিয়াল পাওয়ার চেয়ে মঙ্গল গ্রহে যাত্রা এখন অনেক সহজ।
ষোলো কোটি মানুষের চারভাগের একভাগও যদি এখন খুঁজলি রোগে আক্রান্ত হয় আর সফদার প্রতিটি রোগী দেখতে যদি পাঁচ মিনিটও সময় নেয় তাহলেও শেষ রোগীর সিরিয়াল আসতে আসতে আজকে জন্মনেয়া শিশুটির বয়স প্রায় আট বছর ছাড়িয়ে যাবে।
এসব ভাবতে ভাবতে সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে গোঁধুলী লগ্ন হয়ে আসে সফদারের। ঢাল নেই তলোয়ার নেই সেজেছে নিধিরাম সর্দার! উপায় ভাবতে হবে অন্যকিছু। এত মানুষ খুঁজলি রোগে আক্রান্ত হলে সে কুইনাইন পাবে কোথায়? শেষতক কপালে না জোটে গণপিটুনি।
নাহ্! এভাবে হবেনা, সম্ভব নয়। উপায় একটা বের করতেই হবে। কিন্তু কি সেই উপায় সেটাই মাথায় আসছেনা। দরজার পর্দা সামান্য ফাঁক করে একবার টুক করে দেখে নেয় বাইরের ক্যাম্পের জনস্রোত। এই দেশে এত এত খুঁজলি রোগী? অবিশ্বাস্য!
রোগীদের সেবা নির্বিঘ্ন করতে বিদেশী কিছু সংস্থা ক্যাম্প খুলেছে। এদেশ থেকে কিছু না হোক বাইরের দেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থে পকেট ভরছে মিস্টার টিংটিং আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা। এদেশের মানুষ বেগুনভর্তা, আলুভাজির সাথে পাতলা ডাল খেতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের মগজে এখন শুঁয়োপোকা কিলবিল করে। মাথায় কান আছে কিন্তু দৌঁড়ায় চিলের পিছে। খুঁজলি বগলে হলে তাদের চুলকায় পিঠে। আর এই চুলকানিকেই কাজে লাগিয়েছে টিংটিং।
হঠাৎ ঐ দূরে কিছু মানুষের জটলা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে কেন? কিছু কি হয়েছে নাকি? মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছে আগুন! আগুন! অথচ সেটি নাকি ছিলো অসুস্থ রোগীকে স্যুপ খাওয়ানোর জন্য ধরানো উনুনের ধোঁয়া! তাই দেখেই হাইব্রিড মসুরের ডাল খাওয়া মাথামোটাগুলির এই শোরগোল।
চট করে মাথায় বুদ্ধি খেলে যায় সফদারের। উপায় পাওয়া গেছে এইবার। পরিকল্পনা মাফিক সফদার নিজের সহকারী সিমলা বিবিকে পাঠিয়ে দিলো টিংটিং সাহেবের কাছে। সিমলা যা বললো দেশের জনগনের মাথায় বাজ পড়েছে তাতে। দেশের কে একজন নাকি হারবাল টনিক যেটা আবার সর্বরোগের বিশেষ করে খুঁজলি রোগে বিশেষ কার্যকর- নতুন বড়ি আবিষ্কার হয়েছে। কে করেছে? অবশ্যই সফদার, এছাড়া আবার কে!
এই কান কথা মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ে গোটা ক্যাম্পে। জনতার ঢল এখন মহাসমুদ্রে রুপ নিয়েছে। কে কার আগে পাবে সেই মহৌষধ। সবারই পুরো শরীরে তিরতির করে চুলকানো শুরু হয়েছে নতুন করে সেই মহা টনিকের কথা শুনে। খুঁজলি নাকি এবার সারবেই।
ক্যাম্পে মাঝেমধ্যে শোনা যাচ্ছে ছেলেধরা! ছেলেধরা! – ধর ধর, মার মার শব্দগুলি। শেষতক জানা গেলো ভুল লোককে মারা হয়েছে। আগে সিরিয়াল পাবার জন্য অসহায় এক মানুষকে পিটিয়েছে জুম্মন কসাই নামের এক পিশাচ। জুম্মুনের খুঁজলি যে একেবারে গোপনাঙ্গে! সবার সামনে চুলকাতেও লজ্জার মাথা কেটে ফেলেছে নিজেই।
এদিকে সফদারের পরিকল্পনা সফল হয়েছে। কুইনাইন আর পানিতে গুল মিশিয়ে বানানো গোপন ফর্মূলা। ছোট্ট শিশিতে ভরে সাপ্লাই দেয়া শুরু করলো সে টনিক। খুঁজলির উপরে কয়েকফোঁটা দিলেই রোগীর কেল্লাফতে। তিড়িংবিড়িং নাচ শুরু হচ্ছে জনতার।
বাহ্ বাহ্! বেশ বেশ, ধন্য সফদার তুমি ধন্য। এসব মেডেলিক তকমা গায়ে লাগিয়ে সফদার একটু আয়েশি ঢেঁকুর তুলে চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিতেই তার পিঠে কূট কূট করে কি যেন নাড়া দিয়ে গেলো। দিনশেষে অর্ধেকের বেশি রোগী সেই ফ্রীতে পাওয়া মহামুল্যবান টনিক নিয়ে বাসায় ফেরার পথে টিংটিং এর সাজানো ডাকাতির শিকার হলো কিছু খুঁজলি রোগী।
অগত্যা আবার ফিরে আসা সফদারের কাছে। কিন্তু আর যে টনিক নেই। এবার কি হবে? নিজের সাগরেদ টিংটিং এর বিদেশী কোম্পানি থেকে সেই টনিক নতুন করে বানিয়ে আমদানি করার বিকল্প ছাড়া সফদারের আর গতি নেই। সে যে নিরুপায়! আর আমদানিকৃত টনিক ফ্রীতে দেয়া অসম্ভব। টু পাইস ইনকামের রাস্তা সফদার তার সিমলা বিবিকে দিয়ে আগেই টিংটিং এর কাছে করে রেখেছে।
যেই ভাবা সেই কাজ। উচ্চমূল্যে টনিক কিনে দিশেহারা হচ্ছে মানুষ। টাকার ভাগের আশায় টিংটিং সাহেব যখন সফদারের কাছে এলো, সফদার দিলো পল্টি। টিংটিং তুমি যেন কে? তোমাকেতো ঠিক চিনলামনা! তবে কোথায় যেন দেখেছি বাবু তোমাকে?
এমন কথা শুনে টিংটিং মাথা গরম করে নালিশ করলো তার হাট্টিমাটিম গুরুর কাছে, যে নিজেও মাথামোটা এক ভাঁড়। আর যায় কোথায়! তারা সিমলাকে বগলদাবা করে নিয়ে বানালো দাবার ছকের মন্ত্রী। সফদারের গায়ে লাগলো ফিটিংবাজীর স্টীকার।
সফদারও কম নয়, সেও ভর্তা ভাজি খায়, মসুরের ডালভাতে পুষ্ট হয়েছ তার মগজ। পাল্টা চালে টিংটিংকে বললো- খুঁজলি আমাদের জাতিগত সমস্যা। তোমার লোকজন তাহলে আগুন আগুন বলে চিৎকার দিলো কেন? ছেলেধরা গুজবে আমার রোগীদের যে প্রাণ গেলো তার কি হবে? ক্ষতিপূরণ চাই তাও নগদে।
বিপদ বুঝে টিংটিং দিয়েছে চম্পট। এক মুহুর্তেই নাই হয়ে সে উঠে বসেছে মহাকাশচারী হয়ে। পৃথিবী ছেড়ে তার যাত্রা নতুন গ্রহ এক্সিমো- ৯ গ্রহের দিকে। সেখানে আর যাই হোক খুঁজলি রোগী নাকি নেই। সে গ্রহের মানুষের মগজ মাথায় নয় থাকে তাদের হাতে। নিজের ইচ্ছেমত অপব্যবহার করেনা।
টিংটিং নেই, সে পলাতক; সিমলাও নিখোঁজ। সফদারের এবার পোয়াবারো। লাভের ভাগ নেবার আর কেউ রইলোনা। নিজের ব্যবসা জাঁকিয়ে বসেছে সে। দেশে আর খুঁজলিও নেই। তবে পুরোনো সেই রোগ “গুজব” নামে নতুন আরেকটি এক রোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সফদারের মগজে গিজগিজ করছে এই রোগের নামকরণ করার। আপাতত সে রোগের নাম সফদার ভেবে রেখেছে “গজব” হিসেবে। খুঁজলি টনিকের মত এটাও পাবলিক খাবে সে নিশ্চিত।
এই “গজব” রোগের আদি ইতিহাস জানতে যেতে হবে সেই এক্সিমো- ৯ গ্রহে। মানুষ খুঁজলির মতন মহামারী আর চায়না। সে কারনেই সফল টনিক আবিষ্কারের কাণ্ডারি সফদারকেই মনোনীত করা হয়েছে সেই গ্রহে যাবার জন্য। এটা অনেকটা মহাকাশীয় নোবেল পুরস্কার পাবার মত বটে। এ সুযোগ হাতেগোনা তিন চারজনই পেয়েছে এর আগে। তবে সেই নতুন গ্রহে সেই যে তারা গিয়েছে আর ফিরে আসেনি।
শেষতক –
সেইদিন আর বেশী দূরে নয়, যেইদিন চোখ খুলে সফদার নিজেকে আবিষ্কার করবে মহাকাশের নতুন গ্রহ এক্সিমো- ৯ এর বলয়ে। সে দেখবে পৃথিবী থেকে যারা সেখানে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছে তারাই সেখানে একজন রাজা যিনি হয়েছেন ভোজনরসিক, মন্ত্রী ঘুমকাতুরে, সেনাপতি আঁতেল আর সভাসদরা সবাই তেলবাজ নামধারী। তবে এদেরও অনেকেই যে সেই খুঁজলি রোগাক্রান্ত হয়েছে পৃথিবী থেকে বয়ে নিয়ে যাওয়া টিংটিং এর সেই খুঁজলির জীবাণু থেকে। এ তথ্য যখন সফদার জানবে তখন আর কিছু করার থাকবেনা তার। নিজেও যে খুঁজলি রোগাক্রান্ত হয়েছে ততোদিনে।
সে যেটা জানেনা তা হলো, নিজের মাথার চুল সে একসময় নিজেই ছিঁড়বে আর চিৎকার করে বলতে থাকবে – আমি আর লাভের মুখ দেখতে চাইনা। কে কোথায় আছো ? আমাকে একটিবার পৃথিবীতে যাবার সুযোগ দাও। আমি খুঁজলির সেই মহৌষধের ছোট্ট শিশিটা ভুল করে সেখানেই ফেলে রেখে এসেছি!
ধন্যবাদ সেইসব রথী মহারথীদের, যাদের বদৌলতে আমাদের আর বিনোদন খুঁজতে পেপার পত্রিকা কিনতে হচ্ছেনা। সার্কাসে যেতে হচ্ছেনা। কমিকস পড়তে হচ্ছেনা। এসব গোপালভাঁড়দের নিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে রকেট গতিতে।
পৃথিবীর মানুষ সফদারের ফিরে আসার পথ চেয়ে আকাশের দিকে পালা করে তাকিয়ে থাকে প্রতিদিন। আর সফদারের নামকৃত “গজব” রোগটি মহামারীর আকারে দেয়াশলাইয়ের জ্বলন্ত বারুদের মত দিনে দিনে “গুজবে” রুপান্তরিত হয়ে দাবানলের মত পুড়ে ছারখার করে দিচ্ছে এই সুন্দর পৃথিবীর মানচিত্রের ছোট্ট একটি ব-দ্বীপকে।
২২টি মন্তব্য
রেহানা বীথি
পাগলখানায় পরিণত হচ্ছে যেন দেশটা। একেবারে আজগুবি।
দারুণ লিখলেন
তৌহিদ
লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপু।
প্রদীপ চক্রবর্তী
গুজব দিনদিন ভয়ানক ব্যাধি আকারে রূপ ধারণ করছে।
এর পরিত্রাণ কবে?
গুজবে দেশটা অন্ধত্বার পরিচয় বহন করছে।
.
সময়োপযোগী লেখনী দাদা।
তৌহিদ
গুজব থেকে আমাদের নিজেদেরই সাবধান থাকতে হবে দাদা। শুভকামনা রইলো।
জিসান শা ইকরাম
হাজিরা দিয়ে গেলাম।
তৌহিদ
ধন্যবাদ জানবেন।
শিরিন হক
কিছু বলবার নেই, মুখে কুলুপ এটে বসে থাকি। সার্কাস চলবে চলছে দর্শক হয়ে দেখতে থাকি। গোপাল ভাঁড়ের রসের হাড়ি কুলুর বলদের মতো মাথায় রাখি।
বেশ লিখছেন।
তৌহিদ
চলিতেছে সার্কাস!! আরও যে কত দেখবো!!
ছাইরাছ হেলাল
চিলের পেছনে ছোটাই যেন নিয়ম, এমনই মনে হচ্ছে।
হ্যা, গুজব এখন গজবে পরিণত হয়েছে।
তৌহিদ
হুজুগে জাতি আমরা ভাই। গত ক’দিন থেকে যা ঘটছে!!
মনির হোসেন মমি
কেউ কম যায় না।তবুও কিছুই বলার নেই বলা যায়না।সুবোদের মত কেবল ঘুরে বেড়ানো আর এখানে সেখানে উকি মেরে জানান দেয়া।
তৌহিদ
এটাই এখন ট্রেন্ড হয়েছে যেন। ভালো থাকবেন ভাই।
জিসান শা ইকরাম
রম্যের মাধ্যমে দেশের বাস্তব অবস্থাটা দারুন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
গোপালভাড় এখন আমাদের দেশে অনেক।
এনারা আছেন বলেই আমরা লাইভ কৌতুক দেখতে পারি।
এমন লেখা আরো চাই,
শুভ কামনা।
তৌহিদ
আর গ্রহের নামটা বাংলায় করলেও চুলকানি হয়। হা হ হা। লেখা নিয়ে সন্দিহান হয়ে আছি ভাই। আবার আসবো হয়তো একদিন। ভালো থাকবেন।
রাফি আরাফাত
বলতে লজ্জা লাগলেও বলতে হচ্ছে ভাই, এসব দেখি কানার হাট বাজার,হাহা চোখ থাকিতে অন্ধ।
ধন্যবাদ ভাই
তৌহিদ
আমরা চোখ থাকতেও অন্ধ, ভালো বলেছেন।
আরজু মুক্তা
দারুণ উপস্থাপন।
কৌতুকের মাধ্যমে সত্য কথা বলা
তৌহিদ
ধন্যবাদ আপু।
ইঞ্জা
আসলেই আমরা সবাই খুঁজলি রোগে আক্রান্ত, শুধু কি নিজেরটা খোঁজাই, অনেরটাও যে খুঁজাতে ভাই, সফদার ডাকতার তার কাজ করিয়াছে, এখন আমাদের গুজবের গজব সারবে কবে?
তৌহিদ
আর গ্রহের নামটা বাংলায় করলেও চুলকানি হয়। হা হ হা।
এক্সিমা, এক্সিমো ☺☺
ভালো থাকবেন দাদা। আবার দেখা হবে হয়তো কোন একদিন।
শামীম চৌধুরী
জাতি হিসেবে আমরা কত নোংরা। স্বার্থের জন্য নিজেকে বিক্রি করতেও কোন লজ্জা নেই এই জাতির। আর কত?
তৌহিদ
আমি নিজেও লজ্জিত ভাইয়া। ভালো থাকবেন।