রীটা আপু মেসেঞ্জারে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র ইউটিউব লিংক দিয়ে বললেন, ‘এটা দেখো। সংলাপগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবে’। আমিও বাধ্য ছেলের মতো এক বসায় দেখে ফেললাম ২ ঘণ্টা ৫০ মিনিট দৈর্ঘ্যের ‘রক্তকরবী’ । দেখে আপুকে নক করলাম। উনি আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন হলো, নন্দিনী রাজাকে তার হাত ধরতে দিয়েছিল। চুলে আঙ্গুল বুলাতে দিয়েছিল। কেন? আমি তাৎক্ষনিকভাবে প্রশ্ন গুলোর সঠিক উত্তর দিতে পারিনি। তখন আপু বললেন, ‘বিষু ও নন্দিনীর সংলাপের অংশটুকু একবার মন দিয়ে দেখো। উত্তর পেয়ে যাবে।’ এইভাবে আপু আমাকে বারবার বিভিন্ন সংলাপ ধরিয়ে দিয়ে ‘রক্তকরবী’ বুঝতে সহযোগিতা করলেন। কিন্তু, আরও পরিষ্কার ভাবে জানার একটা ক্ষুধা মনের ভেতর রয়ে গেছে। তাই আগামী মাসের বাজেটে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ কেনার বিষয়টা টুকে রাখলাম।
ভেবে দেখলাম, ‘রক্তকরবী’ কেনার আগে একটু পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনা দরকার। অনেকদিন ধরে বই পড়া হচ্ছেনা। বুক শেলফের দিকে তাকিয়ে দেখি আনিসুল হকের ‘নন্দিনী’ আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। এর আগে আনিসুল হকের অনেক প্রবন্ধ পড়া হলেও গল্প, উপন্যাস পড়া হয়নি। তাই ধ্রুব এষের প্রচ্ছদ খুব আগ্রহ নিয়ে উল্টাই। দেখি, বইটি ২০০৬ সালে কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। উৎসর্গ করেছে আরেক কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনকে।
২৬ পরিচ্ছেদে রচিত ১১২ পৃষ্ঠার বইটি শুরু হয়েছে স্বরবর্ণ থিয়েটারে মুক্তার যোগ দেওয়ার কথা দিয়ে। মুক্তা গল্পের নায়কা। স্বরবর্ণ থিয়েটারে নাটকে অভিনয় করছে সে। রংপুর শহরে মাইকিং হচ্ছে। স্বরবর্ণ থিয়েটারের পঞ্চম প্রযোজনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ও বিকাশ চক্রবর্তী মানু পরিচালিত ‘রক্তকরবী’ ঐতিহাসিক টাউন হলে অনুষ্ঠিত হবে। তাই স্বরবর্ণ থিয়েটারের দপ্তরে চলছে জোর প্রস্তুতি। নাটকের পরিচালক বিকাশ চক্রবর্তী মানু অভিনয় করবেন রাজা চরিত্রে। বায়েজিদকে দেওয়া হয়েছে বিষুর চরিত্র।আর নন্দিনীর চরিত্রটি দেওয়া হয়েছে মুক্তাকে। ধবধবে সাদা, গোলাপি ঠোঁট, বড় কালো চুল, ভাসাভাসা চোখের অধিকারী মুক্তাকে নিয়েই সবার যত মুগ্ধতা।
শহরের প্রধান রবীন্দ্র-সমালোচক রংপুর কলেজের বাংলার অধ্যাপক রেজা স্যারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে রিহার্সাল দেখানোর জন্য। তিনি এসে রিহার্সাল দেখার পাশাপাশি ‘রক্তকরবী’ নাটকের বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এই কাজ করতে গিয়ে রেজা স্যার মুগ্ধ হয়ে পড়েন মুক্তার রুপে-গুণে। তিনি মুক্তাকে ডেকে নিয়ে পড়তে দিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রাণু ও ভানু’। তার ধারনা নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করার আগে মুক্তাকে জানতে হবে, রবীন্দ্রনাথ কেন রক্তকরবী লিখেছিলেন।
রক্তকরবী মঞ্চস্থ হওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে রংপুর শিল্পকলা একাডেমীর একটা নাট্য কর্মশালায় যোগ দিতে হাজির হন দেশের প্রখ্যাত অভিনেতা তৌফিক আহমেদ। তিনি কর্মশালায় মুক্তাকে দেখেন। প্রথম দেখাতে মুগ্ধ হয়ে উঠেন।
গল্পের এক পর্যায়ে দেখা যায়, বায়েজিদ, মানু, রেজা স্যার, তৌফিক আহমেদ সহ আরও কয়েকটি চরিত্র মুক্তাকে পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ওঠে। কেউ এই আকুলতা মুক্তার কাছে সরাসরি প্রকাশ করে। কেউ আবার নানা ভাব-ভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশ করে। এভাবে এগুতে থাকা গল্পটির শেষ কীভাবে হয়েছিল? স্বরবর্ণ কি নাটকটি মঞ্চায়ন করতে পেরেছিলো? শেষ পর্যন্ত মুক্তার সাথে কী ঘটেছে? মুক্তার সাথে কার মিলন হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আপনাকে অবশ্যই বইটি পড়তে হবে।
এই গল্পে, লেখক মুক্তার বাস্তব জগতের কিছু অংশ রক্তকরবীর নন্দিনীর সাথে সাদৃশ্য রেখেছেন। আবার স্বরবর্ণের রিহার্সালে রক্তকরবীর বিক্ষিপ্ত কিছু সংলাপ ব্যবহার করেছেন। এসব করে লেখক রেজা স্যারের মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ বর্ণনা করেছেন। এই কাজটি করে তিনি ক্লান্ত হননি। বরং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রাণু ও ভানু’ নিয়ে এসে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন, ‘রক্তকরবী’ লেখার চিত্রপটে থাকা রবীন্দ্রনাথ ও তরুণী রাণুর গল্প।
একটা গল্পের ভেতর আরও দুটো গল্প নিয়ে সমান-আলোচনা করা চারটেখানি ব্যাপার না। কিন্তু, আনিসুল হক এই একের ভেতর তিন খুব সহজ সরল ভাষায় সুনিপুন ভাবে করতে পেরেছেন। এছাড়া, প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে শেষ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত এই উপন্যাসটির যে গুণটি খুব তীব্র তা হচ্ছে উপন্যাসটির অন্তনির্হিত ভাবটির অসামান্য মৌলিকতা।
সবশেষে বলা যায়, ‘নন্দিনী’ পড়ে পাঠক আনিসুল হকের একটা মৌলিক গল্পের স্বাদ তো পাবেই, সাথে বুঝতে পারবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ ও সুনীলের ‘রাণু ও ভানু’। আর বোনাস হিসেবে থাকছে গল্পের প্রয়োজনে লেখা লেখকের কবিতা।
‘এত ঝড় তুমি দিও না ঈশ্বর সে সইতে পারবে না’
আমি কবিতার এক লাইন রীটা আপুকে পাঠ করে শুনালাম। আপু জানতে চাইলেন, ‘ঈশ্বরের কাছে এতো আকুতি কার জন্য?’ আমি বললাম, মুক্তার জন্য। এবার আপু ঠোঁটের কোণায় হাসি রেখে জিঙ্গেস করল, ‘বানরের গলায় মুক্তার মালা পড়ালো কে?’ আপুর ঠোঁটের উপরে এক কোণে খুব ছোট, কিন্তু উজ্জ্বল একটা তিল আছে। সে যখন হাসে তিলটাও হাসে। মুক্তার সাথে আপুর এই একটা পার্থক্য ছাড়া আরও একটা পার্থক্য আছে। আমি সেটা আপুকে জানালাম। বললাম, ‘মুক্তা রংপুরের নাট্য শিল্পী। আর আপনি নাটোরের বনলতা সেন।’ মুহূর্তেই অপর পাশ থেকে ভেসে এলো, ‘নাটোরের লতাপাতা সেন।’
এটা আমার লেখা প্রথম বুক রিভিউ। লেখার পিছনেও কারণ আছে। গত কয়দিন ধরে ব্লগে অনেকে বুক রিভিউ দিচ্ছে, কিন্তু তার মধ্যে কয়েকটা পড়ে আমার মনে হচ্ছিলো এইগুলা একেকটা বইয়ের বিজ্ঞাপন। তাই নিজে একটা লিখতে বসলাম। জানিনা কেমন লিখতে পেরেছি। তবে এখন আপনার মন্তব্য দেখে একটু হালকা অনুভব করছি।
আপনি তো দারুন রিভিউ করেন,
আমার তো এখন রানু ভানু পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।
খুব একটা আনিসুল হক পড়া হয়নি,
তবে রক্ত করবী! সে তো অনেক পড়েছি, আপনার মত দেখেছি ও।
আপনার তো দেখছি অনেক গুণ, রিভিউ চালু রাখুন আমাদের জন্য হলেও।
৩১টি মন্তব্য
সঞ্জয় মালাকার
দাদা পড়ে খুব ভালো লাগলো, রিভিউ লেখাটি
এত ঝড় তুমি দিও না ঈশ্বর সে সইতে পারবে না।
আকবর হোসেন রবিন
আপনার মন্তব্য দেখে আমারও খুব ভালো লাগলো। ভালোবাসা নিবেন।
সঞ্জয় মালাকার
ধন্যবাদ দাদা শুভেচ্ছা রইল।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনিও খুব সুন্দপর গোছালো ভাবে বইটির রিভিউ দিয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নাই রবিন ভাই। আমি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু লিখতে পারিনা। আপনার রিভিউ দারুন উপস্থাপনা। আল্লাহ আপনাকে আরও লেখার তৌফিক দিন।
আকবর হোসেন রবিন
এটা আমার লেখা প্রথম বুক রিভিউ। কতোটা গুছিয়ে লিখতে পেরেছি তা জানিনা। আপনার মন্তব্য আমাকে উৎসাহ দিবে। ধন্যবাদ ভাই। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক।
মোঃ মজিবর রহমান
আল্লাহ সহায় হবে। বই পড়া হইনা। চাকরি ও সাংসারিক ঝামেলায়। আপনার লেখায় অনেক জানলাম রবিন ভাই।
জিসান শা ইকরাম
নন্দিনী পড়া হয়নি এখনো,
আপনার রিভিউ পড়ে বইটি পঠনের ইচ্ছে হচ্ছে।
টুকে রাখলাম নামটি।
রিভিউ ভাল লেগেছে,
রিভিউ লেখার ব্লগার সোনেলায় খুব কম,
আপনি এগিয়ে এলেন দেখে ভাল লাগলো।
আরো বই রিভিউ চাই। এতে পাঠকের পাঠ্যাভ্যাস আসে।
শুভ কামনা।
আকবর হোসেন রবিন
এটা আমার লেখা প্রথম বুক রিভিউ। লেখার পিছনেও কারণ আছে। গত কয়দিন ধরে ব্লগে অনেকে বুক রিভিউ দিচ্ছে, কিন্তু তার মধ্যে কয়েকটা পড়ে আমার মনে হচ্ছিলো এইগুলা একেকটা বইয়ের বিজ্ঞাপন। তাই নিজে একটা লিখতে বসলাম। জানিনা কেমন লিখতে পেরেছি। তবে এখন আপনার মন্তব্য দেখে একটু হালকা অনুভব করছি।
ধন্যবাদ ভাই।
জিসান শা ইকরাম
লেখুন বুক রিভিউ আপনার মনের মত করে,
প্রথম দিকে কেবল মাত্র গালিবা ইয়াসমিন বুক রিভিউ দিতো,
এরপর আরো দু একজনে দেয়া আরম্ভ করলেন।
এখন যুক্ত হলেন আপনিও,
ভালো থাকবেন।
নীরা সাদীয়া
আপনি বাংলা সাহিত্যে পড়েছেন কিনা তা জানি না। তবে আপনার বিশ্লেষণ ক্ষমতা প্রচুর। খুব সুন্দর করে রিভিউ দিয়েছেন আপনি।
আকবর হোসেন রবিন
আমি সাংবাদিকতায় অনার্স শেষ করলাম মাত্র।
আপনার মন্তব্য পেয়ে উৎসাহ পাচ্ছি, বুক রিভিউ লেখার।
ধন্যবাদ।
হালিম নজরুল
চমৎকার বিশ্লেষণ
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ ভাই।
সুরাইয়া পারভিন
বাহ্ !
কি দুর্দান্ত বিশ্লেষণ ক্ষমতা আপনার!
এতো চমৎকার বুক রিভিউ! তুখর মনোযোগী পাঠক
ছাড়া সম্ভব নয়
আকবর হোসেন রবিন
এটা আমার লেখা প্রথম বুক রিভিউ। খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। কেমন না কেমন হলো!
কিন্তু, এখন আপনাদের মন্তব্য পেয়ে একটু হালকা অনুভব হচ্ছে। উৎসাহ পাচ্ছি।
ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
বইটি পড়া হয়নি। এতোগুলো উপাদান একসাথে পাবো। অবশ্যই পড়বো।
আকবর হোসেন রবিন
অনলাইনে পিডিএফ পাবেন। তবে এটা পড়ার আগে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ পড়া থাকলে ভালো হয়, বুঝতে সুবিধা হবে।
শামীম চৌধুরী
তার ডানা দুটো ছোট তৈরি জোছনা দিয়ে
এত ঝড় তুমি দিও না ঈশ্বর সে সইতে পারবে না
ঈশ্বর মগডালে আমি এক বৃদ্ধ শকুন আছি বসে
তুমি আঘাত করতে চাইলে আমাকে করো……
ইশ্বরের কাছে খুব সুন্দর করে উপস্থাপনা। ভালো লেগেছে ভাই। আরো লেখা পড়তে চাই।
আকবর হোসেন রবিন
চেষ্টা করবো বেশি বেশি লেখার জন্য।
ধন্যবাদ।
শিরিন হক
চমৎকার বিশ্লেষণ। ইশ্বর কাউকে নিরাশ করেন না
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ।
তৌহিদ
নন্দিনী পড়েছি আগেই তবে আপনার মত ভালো পাঠক বোধহয় আমি নই। বইটির রিভিউ লিখে তার প্রমাণ আপনি দিলেন। যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন পাঠক হিসেবে মুগ্ধ হলাম ভাই।
শুভকামনা রইলো।
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
আপনি তো দারুন রিভিউ করেন,
আমার তো এখন রানু ভানু পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।
খুব একটা আনিসুল হক পড়া হয়নি,
তবে রক্ত করবী! সে তো অনেক পড়েছি, আপনার মত দেখেছি ও।
আপনার তো দেখছি অনেক গুণ, রিভিউ চালু রাখুন আমাদের জন্য হলেও।
আকবর হোসেন রবিন
এটা আমার লেখা প্রথম বুক রিভিউ। চেষ্টা করবো আরও লেখার।
ধন্যবাদ ভাই।
এস.জেড বাবু
অল্পস্বল্প বুক রিভিউ পড়েছি,
মনেই হয়না যে আপনার প্রথম রিভিউ
বরং মনে হয় আপনি রিভিউয়ের সিদ্ধহস্ত।
বইটি আপাতত অনলাইনে খোঁজ করবো।
অভিনন্দন আপনাকে
আকবর হোসেন রবিন
অনলাইনে পেতে পারেন। তবে ভালো হয় নন্দিনী পড়ার আগে রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী পড়া কিংবা ইউটিউবে রক্তকরবী দেখা। তাহলে নন্দিনী পড়ে বুঝতে পারবেন। পড়ে আরাম পাবেন।
ধন্যবাদ ভাই।
সাখিয়ারা আক্তার তন্নী
ভাইয়া,বুক রিভিউ লিখা কিন্তু অনেক কষ্ট
আমার দ্বারা কখনোই হয় না।
শুভ কামনা আপনার জন্য
আকবর হোসেন রবিন
আমি আগে কখনও চেষ্টা করিনি। এটাই আমার লেখা প্রথম বুক রিভিউ।
ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
২৬ অক্টোবর এর পোস্ট আজ আবার পোস্ট করার কারন কি ভাই ?
আকবর হোসেন রবিন
আমি আসলে লেখাটা এডিট করতে চেয়েছিলাম। পরে দেখি এটা নতুন করে পোস্ট হয়ে গেছে।