একের ভেতর তিন

আকবর হোসেন রবিন ২৬ অক্টোবর ২০১৯, শনিবার, ০২:২১:০৩পূর্বাহ্ন বুক রিভিউ ৩১ মন্তব্য

রীটা আপু মেসেঞ্জারে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র ইউটিউব লিংক দিয়ে বললেন, ‘এটা দেখো। সংলাপগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবে’। আমিও বাধ্য ছেলের মতো এক বসায় দেখে ফেললাম ২ ঘণ্টা ৫০ মিনিট দৈর্ঘ্যের ‘রক্তকরবী’ । দেখে আপুকে নক করলাম। উনি আমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন হলো, নন্দিনী রাজাকে তার হাত ধরতে দিয়েছিল। চুলে আঙ্গুল বুলাতে দিয়েছিল। কেন? আমি তাৎক্ষনিকভাবে প্রশ্ন গুলোর সঠিক উত্তর দিতে পারিনি। তখন আপু বললেন, ‘বিষু ও নন্দিনীর সংলাপের অংশটুকু একবার মন দিয়ে দেখো। উত্তর পেয়ে যাবে।’ এইভাবে আপু আমাকে বারবার বিভিন্ন সংলাপ ধরিয়ে দিয়ে ‘রক্তকরবী’ বুঝতে সহযোগিতা করলেন। কিন্তু, আরও পরিষ্কার ভাবে জানার একটা ক্ষুধা মনের ভেতর রয়ে গেছে। তাই আগামী মাসের বাজেটে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ কেনার বিষয়টা টুকে রাখলাম।

 

ভেবে দেখলাম, ‘রক্তকরবী’ কেনার আগে একটু পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনা দরকার। অনেকদিন ধরে বই পড়া হচ্ছেনা। বুক শেলফের দিকে তাকিয়ে দেখি আনিসুল হকের ‘নন্দিনী’ আমাকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে। এর আগে আনিসুল হকের অনেক প্রবন্ধ পড়া হলেও গল্প, উপন্যাস পড়া হয়নি। তাই ধ্রুব এষের প্রচ্ছদ খুব আগ্রহ নিয়ে উল্টাই। দেখি, বইটি ২০০৬ সালে কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। উৎসর্গ করেছে আরেক কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনকে।

 

২৬ পরিচ্ছেদে রচিত ১১২ পৃষ্ঠার বইটি শুরু হয়েছে স্বরবর্ণ থিয়েটারে মুক্তার যোগ দেওয়ার কথা দিয়ে। মুক্তা গল্পের নায়কা। স্বরবর্ণ থিয়েটারে নাটকে অভিনয় করছে সে। রংপুর শহরে মাইকিং হচ্ছে। স্বরবর্ণ থিয়েটারের পঞ্চম প্রযোজনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ও বিকাশ চক্রবর্তী মানু পরিচালিত ‘রক্তকরবী’ ঐতিহাসিক টাউন হলে অনুষ্ঠিত হবে। তাই স্বরবর্ণ থিয়েটারের দপ্তরে চলছে জোর প্রস্তুতি। নাটকের পরিচালক বিকাশ চক্রবর্তী মানু অভিনয় করবেন রাজা চরিত্রে। বায়েজিদকে দেওয়া হয়েছে বিষুর চরিত্র।আর নন্দিনীর চরিত্রটি দেওয়া হয়েছে মুক্তাকে। ধবধবে সাদা, গোলাপি ঠোঁট, বড় কালো চুল, ভাসাভাসা চোখের অধিকারী মুক্তাকে নিয়েই সবার যত মুগ্ধতা।

 

শহরের প্রধান রবীন্দ্র-সমালোচক রংপুর কলেজের বাংলার অধ্যাপক রেজা স্যারকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে রিহার্সাল দেখানোর জন্য। তিনি এসে রিহার্সাল দেখার পাশাপাশি ‘রক্তকরবী’ নাটকের বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এই কাজ করতে গিয়ে রেজা স্যার মুগ্ধ হয়ে পড়েন মুক্তার রুপে-গুণে। তিনি মুক্তাকে ডেকে নিয়ে পড়তে দিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রাণু ও ভানু’। তার ধারনা নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করার আগে মুক্তাকে জানতে হবে, রবীন্দ্রনাথ কেন রক্তকরবী লিখেছিলেন।

 

রক্তকরবী মঞ্চস্থ হওয়ার দিন ঘনিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে রংপুর শিল্পকলা একাডেমীর একটা নাট্য কর্মশালায় যোগ দিতে হাজির হন দেশের প্রখ্যাত অভিনেতা তৌফিক আহমেদ। তিনি কর্মশালায় মুক্তাকে দেখেন। প্রথম দেখাতে মুগ্ধ হয়ে উঠেন।

 

গল্পের এক পর্যায়ে দেখা যায়, বায়েজিদ, মানু, রেজা স্যার, তৌফিক আহমেদ সহ আরও কয়েকটি চরিত্র মুক্তাকে পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে ওঠে। কেউ এই আকুলতা মুক্তার কাছে সরাসরি প্রকাশ করে। কেউ আবার নানা ভাব-ভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশ করে। এভাবে এগুতে থাকা গল্পটির শেষ কীভাবে হয়েছিল? স্বরবর্ণ কি নাটকটি মঞ্চায়ন করতে পেরেছিলো? শেষ পর্যন্ত মুক্তার সাথে কী ঘটেছে? মুক্তার সাথে কার মিলন হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আপনাকে অবশ্যই বইটি পড়তে হবে।

 

এই গল্পে, লেখক মুক্তার বাস্তব জগতের কিছু অংশ রক্তকরবীর নন্দিনীর সাথে সাদৃশ্য রেখেছেন। আবার স্বরবর্ণের রিহার্সালে রক্তকরবীর বিক্ষিপ্ত কিছু সংলাপ ব্যবহার করেছেন। এসব করে লেখক রেজা স্যারের মুখ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ বর্ণনা করেছেন। এই কাজটি করে তিনি ক্লান্ত হননি। বরং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রাণু ও ভানু’ নিয়ে এসে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন, ‘রক্তকরবী’ লেখার চিত্রপটে থাকা রবীন্দ্রনাথ ও তরুণী রাণুর গল্প।

 

একটা গল্পের ভেতর আরও দুটো গল্প নিয়ে সমান-আলোচনা করা চারটেখানি ব্যাপার না। কিন্তু, আনিসুল হক এই একের ভেতর তিন খুব সহজ সরল ভাষায় সুনিপুন ভাবে করতে পেরেছেন। এছাড়া, প্রথম পরিচ্ছেদ থেকে শেষ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত এই উপন্যাসটির যে গুণটি খুব তীব্র তা হচ্ছে উপন্যাসটির অন্তনির্হিত ভাবটির অসামান্য মৌলিকতা।

 

সবশেষে বলা যায়, ‘নন্দিনী’ পড়ে পাঠক আনিসুল হকের একটা মৌলিক গল্পের স্বাদ তো পাবেই, সাথে বুঝতে পারবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রক্তকরবী’ ও সুনীলের ‘রাণু ও ভানু’। আর বোনাস হিসেবে থাকছে গল্পের প্রয়োজনে লেখা লেখকের কবিতা।

 

‘এত ঝড় তুমি দিও না ঈশ্বর সে সইতে পারবে না’

 

আমি কবিতার এক লাইন রীটা আপুকে পাঠ করে শুনালাম। আপু জানতে চাইলেন, ‘ঈশ্বরের কাছে এতো আকুতি কার জন্য?’ আমি বললাম, মুক্তার জন্য। এবার আপু ঠোঁটের কোণায় হাসি রেখে জিঙ্গেস করল, ‘বানরের গলায় মুক্তার মালা পড়ালো কে?’ আপুর ঠোঁটের উপরে এক কোণে খুব ছোট, কিন্তু উজ্জ্বল একটা তিল আছে। সে যখন হাসে তিলটাও হাসে। মুক্তার সাথে আপুর এই একটা পার্থক্য ছাড়া আরও একটা পার্থক্য আছে। আমি সেটা আপুকে জানালাম। বললাম, ‘মুক্তা রংপুরের নাট্য শিল্পী। আর আপনি নাটোরের বনলতা সেন।’ মুহূর্তেই অপর পাশ থেকে ভেসে এলো, ‘নাটোরের লতাপাতা সেন।’

১৫৫৩জন ১৩৬১জন
0 Shares

৩১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ