আমাদের বাড়ির দক্ষিণে বড় পুকুর। পুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকটায় গভীর জঙ্গল। আকাশে মেঘ জমলে, জঙ্গলে দিন-দুপুরে যেতেও গা ছম ছম করে। তবুও অনেকে পাতা কুঁড়াতে, ঢেঁকি শাক খোঁজতে যেত। ওখানে কিছু গাব গাছ আছে, বর্ষাকালে গাব পাড়ার জন্যও কিছু মানুষের যাওয়া হতো। এছাড়া আরও একদল লোক দূর-দূরান্ত থেকে দিনে-রাতে এই গভীর জঙ্গলে আসত, জুয়া খেলতে। ওরা খেলার পর তাসের প্যাকেটগুলো কাগজে মুড়িয়ে বাঁশঝাড়ের ভেতরে ছোট ছোট গর্তে রেখে যেত। এই গোপন আস্তানা সম্পর্কে বাড়ির ছেলেরা ধীরে ধীরে জানতে পারে, তাই জঙ্গলে গেলে সবাই প্রথমে ওই বাঁশঝাড়ের দিকে উুঁকি মারতো। অনেক সময় প্যাকেট ভর্তি তাসের পাশাপাশি সিগারেট, লাইটার, চিপস, চানাচুরও পাওয়া যেত। আর ভাগ্য খুব ভালো হলে কিছু টাকা-পয়সাও কুড়িয়ে পেতাম।
এক গ্রীষ্মের দুপুরে আম্মা আমাকে সাথে নিয়ে পাতা কুঁড়াতে গেল। আম্মা পাতা কুঁড়াচ্ছে আর আমি ওই বাঁশঝাড়ের আশাপাশে উুঁকিঝুঁকি দিচ্ছি, যদি কিছু পাওয়া যায়! সেদিন আমার ভাগ্য ভালো ছিল, দুই প্যাকেট ঝকঝকে নতুন তাসের পাশাপাশি একটা দশ টাকার ও একটা দুই টাকার নোট আর একটা পাঁচ টাকার কয়েন অর্থাৎ মোট সতের টাকা পেয়েছি। এই যে আমি টাকা পেয়েছি এটা আম্মারে বলি নাই। আম্মা জানলে বলতো কুড়িয়ে পাওয়া টাকা খাওয়া ভালো না, ভিক্ষুকরে কিংবা মসজিদে দিয়ে দিতে হবে। ক্লাস সিক্সে পড়া একটা ছেলের কাছে সতের টাকা তখন অনেক কিছু। সে কখনো টাকাগুলো হাত ছাড়া করতে চাইবে না, আমিও করলাম না। সেই সময় দেশে সাড়ে ছয়’শ টাকায় চালের বস্তা পাওয়া যেত। দোকানে সিংগারা-সমুচার সাইজ ছিলো যথেষ্ট পরিমাণ বড়। টিফিনে দুই টাকার একটা সিংগারা আর এক গ্লাস পানি পান করলে বিকেল চারটা পর্যন্ত আরামসে ক্লাস করা যেত। তখন আমি চাইলে এই সতের টাকা দিয়ে অনেক কিছু কিনতে পারতাম। কিন্তু আমি কিছুই কিনি নাই। টাকাগুলো ঘরের এক কোণায় লুকিয়ে রাখলাম।
আমার ছোট চাচা খুবই সাহসী মানুষ। যে জঙ্গলে দিনের বেলায় একা একা যেতে সবার মনে একটু হলেও ভয় কাজ করত, সে জঙ্গলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলো থেকে মাছ ধরতে চাচা গভীর রাতে টোটা নিয়ে বের হতেন। উনি দিনের বেলায়ও প্রায় জঙ্গলে আসতেন। যাওয়া-আসা করতে করতে জুয়ারীদের সাথে উনার একটু সখ্যতা গড়ে উঠে। প্রথম দিকে জুয়ারীরা উনাকে দেখলে ভয় পেত। পরে ধীরে ধীরে এটা কমতে থাকে। আমার ধারণা জুয়ারীরা চাচাকে ফ্রিতে চা-সিগারেট খাইয়ে বশ করেছে।
সে যাই হোক, চাচা দেখলেন বাড়ির ছেলেদের মধ্যে মোটামুটি সবার হাতে তাস। তাই উনি একদিন আমাদের মধ্যে বড়দের ডেকে দুই-তিন রকমের তাস খেলা শিখিয়ে দিলেন। বললেন বর্ষার দিনগুলোতে ঘরে বসে তাস খেলে অবসর কাটাতে পারবে। এই কাজটা উনি খুব সরলভাবে ভেবে করেছেন। বাড়ির ছেলেরা তো তখন মহা খুশী। যে মানুষ সবসময় রাগী রাগী ভাব নিয়ে থাকে, যাকে দেখলে ছেলেদের মধ্যে কম-বেশি সবাই ভয় করে, আজ উনিই কিনা আমাদের তাস খেলা শিখালেন!
এরপর শুরু হলো বাড়ির ছেলেদের তাস খেলার পর্ব। ধীরে ধীরে বাড়ির ছোট-বড় সব ছেলেই ‘কল ব্রিজ’ খেলা শিখে ফেলে। এই খেলা পরে মহামারীর মতোই আমাদের বাড়ি থেকে পাশের বাড়িগুলোর ছেলেদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিকে আমরা অবসরে খেললেও এক পর্যায়ে সবার ভীষণ নেশা হয়ে যায়। স্কুল, প্রাইভেট ফাঁকি দিতে শুরু করলো সবাই। অন্যসব খেলা রেখে সারাদিন শুধু তাস খেলা হত। পরে বাড়ি ছেড়ে তাস খেলার আসর বসত ক্রিকেট মাঠে, অনাবাদি জমিতে। অনেক সময় তো আমরা শুকনো খালের ভেতর বসে বসেও খেলতাম যাতে কেউ না দেখে। শুরুর দিকে এমনি এমনি খেললেও এক পর্যায়ে সবাই টাকা বাজি রেখে খেলতে শুরু করলাম। চারজন প্রত্যেকে দুই টাকা করে জমা রাখত। যে প্রথম হবে সে পেত ছয় টাকা। যে দ্বিতীয় হবে সে নিজের টাকা গুলো ফেরত পেত। এভাবে দুই টাকা থেকে পাঁচ টাকা, দশ টাকা করে টাকার পরিমাণ বাড়তে থাকল।
আমি একদিন দুই টাকা নিয়ে খেলতে বসলাম। ভাগ্য আমার বড় আজব যাদুকর, তাস খেলার প্রথম জুয়াতে আমি জিতে গেলাম। এতে আমার লোভ বেড়ে গেল। আমি আরও খেলতে লাগলাম। দিনশেষে দেখা গেল হারতে হারতে আমার সব টাকা শেষ। ঘরের কোণায় লুকিয়ে রাখা সেই সতের টাকা শেষ করেও আমার জমিয়ে রাখা সব টাকাও শেষ হয়ে গেছে। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। কোন উপায় না দেখে আমি ঘরের অকেজো লোহা লঙ্কর সব বিক্রি করতে শুরু করলাম। পুরাতন বই-খাতা সব বিক্রি করে দিলাম। এসব বিক্রি করে যা টাকা আসছে সেই টাকাও তাস খেলায় হারালাম। এরপর বাজারের টাকা থেকে চুরি করা শুরু করলাম। বাজার করে এসে আম্মারে মাছ, তরি-তরকারির দাম দুই-চার টাকা বাড়িয়ে বলতাম। এভাবে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল।
এই যে সবাই টাকা বাজি রেখে তাস খেলে, পড়ালেখায় দিনের পর দিন ফাঁকি দেয় এসব হুট করে একদিন চাচা জানতে পারলেন। বাড়ির কয়েকজন ময়মুরুব্বি চাচারে বিচার দিয়েছে। চাচা গেল খুব ক্ষেপে। এবার শুরু হলো নতুন খেলা। চোর-পুলিশ খেলা। আমরা সবাই চোর, চাচা হচ্ছেন পুলিশ।যখনই আমাদের তাস খেলতে দেখত সাথে সাথে মাইর দেওয়া শুরু করত। আমরা সবাই চাচা থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম। কিন্তু উনি আরও বেশি চালাক, চুপিচুপি আমাদের গোপন আস্তানাগুলোতে এসে হামলা লাগাত। হাতে ইয়া বড় গাছের চিকন ডাল। যেখানেই দেখতে পেত সেখানেই মাইর। এভাবে মাইর খেতে খেতে আমাদের নেশাও কমতে শুরু করলো। আমরা সবাই ধীরে ধীরে জুয়ার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করলাম। সবাই আগের মতো হৈ-হুল্লোড় করে ক্রিকেট, ফুটবল খেলায় ফিরে আসল। মনোযোগী হয়ে চোখ পড়ল বইয়ের পাতায়।
যে শাসন করে সোহাগ ও সে করে । অবসর কাটানোর জন্য আর বাইরে না যাবার জন্য তিনি ভালো করতে চাইলেন আর আপনারা সবাই হাঁটলেন উল্টা দিকে নেশার কারনে। শেষপর্যন্ত এমন শাসন ই দরকার ছিলো। যাক আপনারা নেশা কাটাতে পেরেছেন এজন্য ধন্যবাদ। যেকোন নেশাই খারাপ যদি সেটা খারাপ পর্যায়ে আর সহ্যের বাইরে চলে যায়। ভালো থাকবেন
আমার জীবনে শুধু একদিন তাস খেলায় ছিলাম। সেদিন সেই খেলায় অন্যদের সাথে লাজ্ঞা যেতে যেতে আর হারতে হারতে নগদ ৩০/=টাকা হেরে কেঁদেছিলাম। আজ আপনার পোস্ট পড়ে সেই দিনের কথা মনে পড়ে গেলো।
শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয়।
সরল স্বীকারোক্তির পোস্টে লেখকের মানসিক সারল্য মিশে আছে। উঠতি বয়সী ছেলেদের মাঝে নানারকম ফ্যান্টাসি কাজ করে।এর সাথে যোগ হয় পারিপার্শ্বিক অবস্থা। তখন হাতের কাছে তাস ছিলো যার কারণে তাস খেলা, পরে জুয়ায় আসক্তি এসেছিলো। এখন যেমন বাচ্চারা ভিডিও গেমস, স্মার্ট ফোনে আসক্ত হচ্ছে। সময় কালে একসময় এগুলো ঠিক হয়ে যায়। যেমন আপনার বেলাতেও হয়েছে।
খুব সুন্দর লিখেছেন রবিন। এমন করে আরও লিখুন, নিয়মিত হোন।
শুভ কামনা অবিরত 🌹🌹
১২টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
অসাধারণ ভাবনাময় লিখনশৈলি
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ ভাই।
আলমগীর সরকার লিটন
বেশ স্মৃতিবহর লেখা অনেক ভাল লাগল সেই সাথে শুভেচ্ছা রইল ——
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ। আপনার জন্যও শুভেচ্ছা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
যে শাসন করে সোহাগ ও সে করে । অবসর কাটানোর জন্য আর বাইরে না যাবার জন্য তিনি ভালো করতে চাইলেন আর আপনারা সবাই হাঁটলেন উল্টা দিকে নেশার কারনে। শেষপর্যন্ত এমন শাসন ই দরকার ছিলো। যাক আপনারা নেশা কাটাতে পেরেছেন এজন্য ধন্যবাদ। যেকোন নেশাই খারাপ যদি সেটা খারাপ পর্যায়ে আর সহ্যের বাইরে চলে যায়। ভালো থাকবেন
আকবর হোসেন রবিন
আমি তিন রকমের জুয়া খেলেছি। সবগুলোই ছোটবেলায়, না বুঝে বা মজার ছলে।
ধন্যবাদ আপু।
আরজু মুক্তা
এই চাচাগুলো ই ভালো। যখন তখন কাজে লাগে
আকবর হোসেন রবিন
হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।
নিতাই বাবু
আমার জীবনে শুধু একদিন তাস খেলায় ছিলাম। সেদিন সেই খেলায় অন্যদের সাথে লাজ্ঞা যেতে যেতে আর হারতে হারতে নগদ ৩০/=টাকা হেরে কেঁদেছিলাম। আজ আপনার পোস্ট পড়ে সেই দিনের কথা মনে পড়ে গেলো।
শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয়।
আকবর হোসেন রবিন
হা হা …. । আমি কখনও কাঁদি নাই। যাই হোক, দাদা ভালোবাসা নিবেন।
সাবিনা ইয়াসমিন
সরল স্বীকারোক্তির পোস্টে লেখকের মানসিক সারল্য মিশে আছে। উঠতি বয়সী ছেলেদের মাঝে নানারকম ফ্যান্টাসি কাজ করে।এর সাথে যোগ হয় পারিপার্শ্বিক অবস্থা। তখন হাতের কাছে তাস ছিলো যার কারণে তাস খেলা, পরে জুয়ায় আসক্তি এসেছিলো। এখন যেমন বাচ্চারা ভিডিও গেমস, স্মার্ট ফোনে আসক্ত হচ্ছে। সময় কালে একসময় এগুলো ঠিক হয়ে যায়। যেমন আপনার বেলাতেও হয়েছে।
খুব সুন্দর লিখেছেন রবিন। এমন করে আরও লিখুন, নিয়মিত হোন।
শুভ কামনা অবিরত 🌹🌹
আকবর হোসেন রবিন
ধন্যবাদ আপু।