একজন অনন্য মুক্তিযোদ্ধা, মহান মুক্তিযুদ্ধের নেপথ্য নায়ক খালেদ মোশাররফ, পর্ব ০৪

৩১ অক্টোবর, ১৯৭১-
দুপুরে শরীফ বাসায় ফিরল মুখ খারাপ করে। শুনছ খুব খারাপ খবর আছে,”খালেদ মোশাররফ যুদ্ধে নিহত হয়েছে।”
আমার বুক ধড়াস করে উঠল। কি সর্বনাশ! কার কাছে শুনলে?
‘বাঁকার কাছে। বাঁকা খুব ভেঙে পড়েছে।’
আমাদেরও ভেঙে পড়ার অবস্থা হল। একি নিদারুণ দুঃসংবাদ! একি সর্বনাশ হল! খালেদ মোশাররফ নেই? যুদ্ধে মারা গেছে?
রুমীদের গ্রেফতারের ধাক্কা একটু একটু করে সামলিয়ে উঠছিলাম। ঢাকায় গেরিলাদের অপারেশন আবার মনের মধ্যে আশার সঞ্চার করছিল। এর মধ্যে আবার একি বিনা মেঘে বজ্রপাত।

আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। দোতলায় গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভাবতে লাগলাম খালেদেরই কথা।
এই খালেদ- ক্র্যাকডাউনের সময়ই তাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিল তার পাঞ্জাবি বস। কুমিল্লা থেকে সিলেটে পাঠিয়ে দিচ্ছল তাকে পথিমধ্যে খুন করার জন্য। কিন্তু আয়ু ছিল খালদের, দূরদৃষ্টি এবং বুদ্ধি কাটিয়ে সে যাত্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর ছোবল এড়ায় সে। এড়িয়ে সে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যায়, পেছনে ঢাকা পড়ে থাকে তার সুন্দরী স্ত্রী, ফুলের মত ফুটফুটে দুটি মেয়ে। সে জানতও না ২৫ মার্চ পাক বর্বর বাহিনী তার শ্বশুরবাড়ি তছনছ করে দিয়েছিল, ধরে নিয়ে গিয়েছিল তার শ্বশুর, শাশুড়ি, বড় শালী এবং ভায়রাভাইকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। সে জানত না তার স্ত্রী এবং কন্যারা পাক হানাদারপদের এড়াতে এক এক দিন এক একজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল,পালিয়ে বেরিয়েছিল।

কিংবা সত্যি সে কি জানত না? সে নিশ্চয় জানত এমনটায় ঘটবে তার পরিবার-পরিজনদের জীবনে। তা জেনেই সে তাদেরকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল সামনের অনিশ্চয়ের দিকে। সর্বনাশের কিনারায় দাঁড়িয়ে সে পালিয়ে আসা বিদ্রোহী বাঙালি অফিসার,সৈনিক, আর মুক্তিকামী শত শত বাঙালিদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার দূরুহ কাজে মগ্ন হয়েছিল। ঢাকা থেকে সে তার ফ্যামিলির খবর প্রথম পায় তার তার বন্ধুর ছোট ভাই বাদলের মারফত। বাদল,মাসুদ ও বদি ২৭ মার্চ ঢাকা ছাড়ে। তাদের বিশ্বাস ছিল পাকিস্তানিদের এমন বর্বর হামলার পরে কোথাও না কোথাও প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। তারপর তারা ভারতে গিয়ে খালেদের দেখা পেয়ে যায়।

খালেদ বাদলকে বলে একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ হবে। এজন্য রেগুলার আর্মির পাশাপাশি দরকার একটি গেরিলা বাহিনী। তুমি ঢাকায় গিয়ে ছেলেদের সাথে যোগাযোগ কর। যারা আসতে চায়,যুদ্ধ করতে চায় তাদের এখানে পাঠাতে থাক।
খালেদ আরও বলত,”যুদ্ধ হবে তিন ফ্রন্টে। সামরিক, রাজনৈতিক, এবং অর্থনৈতিক। সামরিক ফ্রন্টের জন্য রয়েছে নিয়মিত সেনাবাহিনী। অন্য দুই ফ্রন্টের জন্য সারাদেশের তরুণ সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবি, প্রকৌশলী, ডাক্তার,সাংবাদিক-সকল স্বাধীনতাকামী মানুষ। তাদেরকেও এখানে নিয়ে আসতে হবে।

এপ্রিলের মাঝামাঝি বাদল খালেদ মোশাররফের স্ত্রী রুবি এবং তার মাকে খালেদের কাছে পৌঁছে দেয়। তার ছোট মেয়ে দুটি আটকে পড়ে যায় পাকিস্তানিদের হাতে। যাওয়ার পথে তারা ভৈরববাজারে পাক বিমান বাহিনীর বোম্বিং এবং স্ট্রেফিং এর মাঝে পড়ে। জীবন বাঁচানোর জন্য এই গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে দৌড়ে পালিয়েছিল। কিন্তু তার মেয়ে দুটো ঢাকায় পাক বাহিনীর হাতে আটক হয়।

এতসব সমস্যার মাঝেও খালেদ মাথা ঠান্ডা করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কঠিন কাজ চালিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে ২নাম্বার সেক্টর। মেলাঘর তার হেড-কোয়ার্টার। নিয়মিত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি গড়ে উঠেছে বিশাল গেরিলাবাহিনী। দেশের সব জায়গা থেকে তো বটেই বিশেষ করে ঢাকার যত শিক্ষিত, স্বাস্থ্যবান, টগবগে,বেপরোয়া যুবক এসে জড়ো হয়েছে এই সেক্টর-টুতে। খালেদ মোশাররফ শুধু তাদের সেক্টর কমান্ডার নয় তাদের হিরো। যতগুলো ছেলে সেক্টরে রাখার অনুমতি ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছেলেকে আশ্রয় দিত খালেদ।

খালেদ বলত ঢাকায় গেরিলা তৎপরতা অব্যাহত রাখার জন্য আমার প্রচুর ছেলে দরকার। অথচ আওয়ামিলীগের ক্লিয়ারেন্স, ইউথ ক্যাম্পের সার্টিফিকেট, বা, ভারত সরকারের অনুমোদন পেরিয়ে যে কয়টা ছেলে আমাকে দেওয়া হয় তা যথেষ্ট নয়।
তাই খালেদ বাদলকে বলত যত ছেলে পাও সরাসরি রিক্রুট করে সোজা আমার কাছে নিয়ে আসবে। এই যুদ্ধ আমাদের জাতীয় যুদ্ধ। দল মত নির্বিশেষে যারাই দেশের জন্য যুদ্ধ করতে আসবে আমি তাদের সবাইকে সমানভাবে গ্রহণ করব।
বাদলরা তাই করত। ফলে খাতায় যত ছেলের নাম থাকত খালেদ তার চেয়ে দ্বিগুন ছেলে ক্যাম্পে রেখে ট্রেনিং দিয়ে গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করে ঢাকায় পাঠাতো। ৩০০ ছেলের রেশন ৬০০ ছেলে ভাগ করে খেত। হাত খরচের টাকাও এভাবে ভাগ হয়ে এক একটি ছেলে মাসে পেত ১১ ইন্ডিয়ান রুপি।

বহু ছেলে যুদ্ধ করার উন্মাদনায় আগরতলা এসে ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগ না পেয়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছিল। খালেদ মোশাররফ এভাবে ভারত সরকারের নাকের ডগায় লুকিয়ে বেশি বেশি স্বাধীনতাকামী, যুদ্ধকামী ছেলেদের নিজের কাছে আশ্রয় দিয়ে, ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করার পলিসি না নিলে ঢাকায় গেরিলা তৎপরতায় এত সফলতা আসত কিনা, এমন গতি অব্যাহত থাকত কিনা সন্দেহ। ২৯-৩০ তারিখে এত গেরিলা ধরা পড়ার পরেও অজস্র গেরিলা ঢাকায় ঢুকেছে, অপারেশন চালাচ্ছে, পাক বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করছে, সামরিক সরকারের ভিত্তি নাড়িয়ে দিচ্ছে, দেশেবাসীর মনোবল বাড়িয়ে দিচ্চে। এটাও সম্ভব হয়েছে খালেদের দূরদর্শিতার জন্য।

আসলে খালেদ স্বপ্নদ্রষ্টা, খালেদ শক্তিমান, খালেদ আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। বাংলাদেশের জন্য যা কিছু ভালো মনে করেছে তা কাজে পরিণত করতে দ্বিধাবোধ করেনি সে। এক্ষেত্রে সে আওয়ামিলীগের বা, ভারত সরকারের বিধিনিষেধের ধার ধারেনি।
তার এই দুঃসাহস, আত্মবিশ্বাস, ভবিষ্যতের দিকে নির্ভুল নির্ভীক দৃষ্টিপাত করার ক্ষমতা তাকে সেক্টর-টুর গেরিলা ছেলেদের কাছে করে তুলেছে অসম্ভব জনপ্রিয়। প্রায় দেবতার মত। খালেদের যে কোন হুকুম চোখ বন্ধ করে তামিল করার জন্য প্রতিটি গেরিলা একপায়ে খাড়া। খালেদ মোশাররফ সেক্টর-টুর প্রাণ।

সেই খালেদ মোশাররফ যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হয়েছে। নিঃসন্দেহে তার জন্য গৌরবের মৃত্যু, শহীদের সম্মান পেয়েছে সে। কিন্তু সেক্টর-টুর জন্য? মেলাঘরের উদ্দাম, দুঃসাহসী গেরিলাদের জন্য? ঢাকায় অবরুদ্ধ আমাদের জন্য? আমাদের জন্য এর চেয়ে বড় সর্বনাশ আর কি হতে পারে?

খালেদের মৃত্যু সংবাদে মনের মধ্যে রূমীর শোক দ্বিগুণ উথলে উঠল। মেলাঘর থেকে ফেরার পথে রুমী কতো যে খালেদের গল্প বলত। খালেদ ই তো ছেলেদের বলত,” কোন দেশ জীবিত গেরিলা চাই না। চাই রক্তস্নাত শহীদ।”
তাই কি খালেদ আজ শহীদ?
লক্ষ লক্ষ ছেলদের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়ে খালেদ কোথায় চলে গেল?

দূরে একটা গ্রেনেড ফাটল। কোন এক রুমি,এক বদি,এক জুয়েল এই রৌদ্র উজ্বল অপরাহ্নে মৃত্যু ভয় তুচ্ছ করে গ্রেনেড কোথাও আঘাত হানল। স্বাধীনতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে খালেদ মোশাররফের হাতে গড়া গেরিলারা। এই ছেলেরা কি জানে তাদের নেতা আর নেই?

স্ত্রী এবং কন্যার সাথে খালেদ মোশাররফ।

লেখার উৎস- একাত্তরের দিনগুলি।
লেখিকা- শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
Note- 22 October খালেদ মোশাররফ পাকিস্তানিদের কামানের গোলার স্প্লিন্টারে আঘাতে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। স্প্লিন্টার উনার মাথার মগজ ফুটা করে বের হয়ে যায়। গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল তিনি শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি শহীদ হননি। মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। ডাক্তারেরা প্রথমে বলেছিলেন তিনি বাঁচবেন না। কিন্তু অফুরান প্রাণশক্তির অধিকারী খালেদ বিস্ময়করভাবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাতে কি?
খালেদ অমর।

৬৭৩জন ৬৭৪জন
0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ