মনে পড়ে সেই শিশুকালের কথা। যখন মাত্র এক -পা, দু-পা করে হাঁটতে শিখেছি তখনই রাজধানীর বুকে পা রেখেছি। বাবার চাকরি সূত্রে রাজধানী ঢাকাতে আগমন- মুখের বুলি ফোঁটার আগেই, কিছু বোঝার আগেই। রাজধানীতে এসে প্রথমেই ঠিকানা হলো ঢাকার বকশীবাজার এলাকাতে। ওখানে কিছু দিন কাটানোর পর চলে এলাম হাতিরপুলের ভূতেরগলিতে। তখন এখানে একটাই স্কুল আর মসজিদ ছিলো। বাবার অফিস ও ছিলো এখানেই। তাই স্কুল আর অফিসের কথা ভেবে এখানেই গেড়ে বসলো আমার পরিবার। স্কুলে ছেলেরা প্রাইমারি পর্যন্ত পড়তে পারতো আর মেয়েরা মেট্রিক পর্যন্ত। এখনকার এস.এস.সি তখন মেট্রিক নামেই পরিচিত ছিলো। মেট্রিকুলেশন থেকেই মেট্রিক নামের উৎপত্তি । তখন এখানে আশেপাশের সবার ভরসা বলতে এই একটি স্কুল -ই ছিলো।
আমাদের পরিবারে বাবা-মা, পিসি,মাসি আর আমি ছিলাম। যথারীতি পাঁচ বছর হবার পর এই স্কুলের শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। প্রথম দিন আমার এক মেসো আমাকে স্কুলে নিয়ে গেল। সেদিনের কিছু ঘটনা আজো মনের গহীনে সযতনে তোলা আছে। ক্লাসের দরজায় দাঁড়াতেই এক মিষ্টি আপা মিষ্টি করে ডেকে ভিতরে বসতে দিলো। মেসো আমাকে ভিতরে দিয়েই চলে আসলো। উনি আমাদের সাবলেট ছিলেন, মায়ের গ্রামতো বোন জামাই । তো প্রথম দিন আরো অনেক নতুন ছাত্রী ভর্তি হয়েছিলো। তারা দেখলাম খুব কান্নাকাটি করছিলো আর তাদের গার্ডিয়ানরা আমাকে দেখিয়ে বললো , ‘ দেখতো ঐ বাবুটা একটুও কাঁদছে না, কি সুন্দর চুপচাপ বসে আছে।’ আমার না কেন জানি কান্না আসেনি বা নতুন পরিবেশ, ম্যাডাম- স্যারদের দেখে ভয় ও লাগেনি! তখন ম্যাডামদের আপা বলে ডাকা হতো আর স্যারদের স্যার। আমাদের স্কুলে একজন প্রধান স্যার ও একজন বড় আপা ছিলেন।
যাইহোক আমি আমার মতো স্কুলে যেতাম আর আসতাম। কারণ স্কুলটা ছিল একদম আমাদের বাসার গেটের বিপরীতে তাই কাউকে নিয়ে যাওয়া আসা করা লাগতো না। আমি এতোটাই ডিসিপ্লিনড ছিলাম যে সবার আগে স্কুলে যেতাম প্রথম বেঞ্চ পাবার জন্য। খুব টানতো স্কুল আমাকে, ফাঁকি দেবার কথা ভাবনাতেই আসতো না যদিও আমি অত ভালো ছাত্রী ছিলাম না তবে নিয়মিত স্কুলে যেতাম। স্কুলে সাতটায় ঢুকতে হতো তারপর এসেম্বলি হতো, ঠিক সাড়ে সাতটায় ক্লাস শুরু হতো। আমি কি করতাম খুব ভোরে উঠতাম, কেন উঠতাম? এটার আরো একটা গোপন রহস্য ছিলো। ঠিক পাঁচটা সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভেঙ্গে যেতো, তখন সবাই কিন্তু ঘুমিয়েই থাকতো । সূর্য ও তখন ঘুম থেকে উঠতো না, আমি তখন আস্তে করে দরজা খুলে বের হয়ে যেতাম, বের হয়েই পাশের গলিতে চলে যেতাম ফুল কুঁড়াতে । ফুল দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকতো না যতক্ষণ না ওগুলো হাতে নিতে পারতাম। ফুলের প্রতি ভালোবাসা আমার আজন্মের। এরজন্য কত যে বকা খেয়েছি ।
তো প্রথম গলির পরেই ছিলো বিশাল বকুল ফুলের গাছ, তার পরের গলিতে ছিলো শিউলি ফুলের গাছ। এদিকে সবাই আমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়ে না পেয়ে বাসার বাইরে এসে দেখতো -আমি গুটিগুটি পায়ে ফ্রকের আঁচলে ফুল নিয়ে আসছি। সবাই ভাবতো আমার কি সাহস এই অন্ধকারে যখন কারো ঘুম ই ভাঙ্গতো না আমি তখন একাই চলে যেতাম ফুলের নেশায় । আর তখন তো এতো লোকসমাগম, জগিং, গাড়ি, রিকসা ছিলো না। খুব শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ ছিলো তবে স্কুল শুরু হলে কোলাহল মুখর হয়ে উঠতো পুরো এলাকাটা। তাই ফুলগুলো নষ্ট হবার আগে , কেউ কুড়িয়ে নেবার আগেই আমি তুলে নিয়ে আসতাম। তারপর মুখে কিছু না দিয়েই স্কুল ড্রেস পরে, বই খাতা গুছিয়ে নিয়ে সবার আগে হাজিরা দেবার চেষ্টা করেছি। আমার স্কুলের নাম ছিল মেহেরুন্নেসা গার্লস হাইস্কুল। কখনো নাস্তা নিয়ে যেতাম , কখনো কেউ দিয়ে আসতো আর স্কুল থেকেও টিফিন দেওয়া হতো। তো শিশু কাল, শৈশব কাল সব আমার এই এলাকাতেই। এই এলাকার আলো বাতাস এ বেড়ে ওঠা এই আমি স্বভাবতই এর মায়াবী জালে আবদ্ধ। মাঝে বছর ছয় অন্য এলাকাতে থাকা হলেও এখন এই প্রায় একুশটা বছর এক বাসাতেই আছি। তো সব মিলিয়ে এই এলাকাতে বসবাস ত্রিশ/একত্রিশ বছর ।
এই এলাকাকে বলা যায় ঢাকার প্রাণভোমরা। কারণ এর কাছাকাছি সাবেক পিজি হাসপাতাল, নিউমার্কেট, শিশু পার্ক, জাতীয় জাদুঘর, পাবলিক লাইব্রেরী, ঢাকা ভার্সিটি, বাংলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, ধানমন্ডি বত্রিশ, ফার্মগেট, ইস্টার্ন প্লাজা, বসুন্ধরা শপিং মল, মোতালিব প্লাজা,ওয়াই ডব্লিউ সি এ স্কুল, বিসিএস আই স্কুল, ল্যাব এইড, সেন্ট্রাল, মডার্ন, স্কয়ার, পপুলার হাসপাতাল, ঢাকা সিটি কলেজ, ঢাকা কলেজ, টিসার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, শুক্রাবাদ স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, বলাকা ও আনন্দ সিনেমা হল ইত্যাদি। তো বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু আশেপাশেই আছে। বরং খুব বেশী ই আছে। তারজন্য ইদানিং প্রচুর যানজট, লোকসমাগম, গাড়ী, রিকসা, বড় বড় এপার্টমেন্টের সংখ্যা বেড়েই চলেছে আর অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। আমার দেখা সেই প্রিয় শহর, প্রিয় এলাকায় আজ আর সেই নিরিবিলি,শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে না। খুব মনে পড়ে সেইসব দিনের কথা, ফেলে আসা সহস্রাধিক স্মৃতির কথা মনে হলে মনটা উচাটন হয়ে যায়। এখনো খুব মিস করি স্কুলের আপা- স্যারদের, বান্ধবীদের। আমাদের ব্যাচটা বের হবার পর কলেজ হয়েছে ,এখন আর স্কুলে সেই আগের মতো প্রাণ নেই, ছাত্র-ছাত্রী ও হাতে গোনা। যখনি দেখি স্কুলের ছাত্রীদের আমার তখন মনে হয় ইস্ আমিও এই স্কুলের একজন ছিলাম। তবে আমাদের সময়ে স্কুলটার স্বর্নালী সময় ছিলো।
সেই বকুল গাছটা এখনো আছে তবে কেটে ছোট করে ফেলেছে আর শিউলি গাছটা নেই। চোখের সামনে এখনো ভাসে ছড়িয়ে থাকা রাশি রাশি বকুল ফুল, সাদা কমলার শিউলি ঢাকা রাজপথ।এখনো সেই প্রথম দিনের মিষ্টি আপার সাথে মাঝে মাঝেই দেখা হয়। কুশলাদি বিনিময় হয়। এই স্কুলে পড়াতেন বিখ্যাত টিভি অভিনেত্রী দিলারা জামান আপা ওনার মেয়েরাও এখানেই পড়তো। এখনকার টিভি অভিনেত্রী মুক্তি ও পড়তো। প্রমা আজিজ, ঈশিকা আজিজ আরেক বিখ্যাত অভিনেতা আব্দুল আজিজের মেয়েরাও এখানেই পড়েছে। আমার এই প্রিয় শহর, প্রিয় এলাকা আজো আছে নেই শুধু আগের প্রাণের স্পন্দন, শুভ্রতায় ঘেরা পরিবেশ।যার রূপ, রস, গন্ধ নিয়ে বেঁচে আছি এখনো -সেতো আমার কাছে প্রিয় হবেই। ভালোবাসি , ভালোবাসি খুব ভালোবাসি আমার প্রিয় এলাকাকে।
২২টি মন্তব্য
সুপায়ন বড়ুয়া
আপনার প্রিয় শহর প্রিয় এলাকা। সর্বোপরি আপনার প্রিয় স্কুল ও ছেলেবেলা সম্বন্ধে জানা হলো আপনার সুনিপুন লেখনিতে।
ভাল লাগলো। শুভ কামনা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা। প্রথম মন্তব্য করেছেন বলে আবারও অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন সবসময় শুভ কামনা রইলো
জিসান শা ইকরাম
স্মৃতি কাতরায় জড়ানো লেখাটি পড়লাম।
ঢাকা আর সেই আগের ঢাকা নেই, শান্ত ঢাকা এখন পাল্টে গিয়েছে।
আমরাও পালটে গিয়েছি।
লেখাটি অনেক ভাল হয়েছে ছোট দি।
শুভ কামনা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ঠিক দাদা ভাই আমরা বদলেছি বলেই চিরচেনা সব বদলে গেছে। ধন্যবাদ দাদা ভাই ভালো লাগার জন্য।
সাদিয়া শারমীন
খুব সুন্দর স্মৃতি কথা।ভালো লাগলো।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন সবসময় শুভ কামনা রইলো
ফয়জুল মহী
অনিন্দ্য সুন্দর , খুবই ভালো লাগলো।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ ভাইয়া। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। শুভ সকাল
জাকিয়া জেসমিন যূথী
প্পুরনো দিনের কথা মনে করিয়ে দিলে।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ তোমাকে। ভালো থাকো সাবধানে থেকো। শুভ সকাল
ছাইরাছ হেলাল
সব চেয়ে অবাক বিষয় এক বাসায় একুশ বছর, নিজের বাড়ী হলেও আজকাল এতদিন কেউ থাকে না।
এত পুরনো ছবি কিভাবে পেলেন, তা অবাক বিষয়। আপনাকে কিন্তু ঠিক চিনতে পারা যায়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
হুম ভাইয়া। একুশটা বছর এক ফ্ল্যাটেই কাটাচ্ছি। সব ছবি আমার কাছে সযতনে তোলা আছে। খুব আগলে রাখি স্মৃতি গুলো আমি। তাই! চেনারই কথা এটা তো আমারই ছবি🙂🙂। ধন্যবাদ ভাইয়া। শুভ সকাল
প্রদীপ চক্রবর্তী
প্রিয় শহর প্রিয় এলাকায় এতো মনোরম সৌন্দর্যে ভরপুর আপনার স্মৃতি।
বেশ লাগলো দিদি।
শুভকামনা অনেক..।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
হুম দাদা আরো অনেক স্মৃতি ছিলো লেখা হয়নি। ৮৮ সালের বন্যায় আমরা ঘরে বসেই মাছ ধরেছি , পাশেই একটা বড় পুকুর ছিলো। সব পানি ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
সুরাইয়া পারভীন
স্মৃতি কখনো হয়না মলিন। স্মৃতি বিজড়িত লেখা মন ছুঁয়ে যায়। এক বাসায় একুশ বছর দারুণ ব্যাপার
আপনার প্রিয় এলাকায় আবার ফিরে আসুক প্রাণের স্পন্দন। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আর ফিরে আসবে না আপু সেইদিন গুলো, সেই প্রাণের স্পন্দন। ধন্যবাদ আপনাকে। শুভ কামনা রইলো
হালিম নজরুল
অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দেবার জন্য ধন্যবাদ।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনাকেও ধন্যবাদ পড়ার জন্য। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
তৌহিদ
আপনার সুনিপুণ লেখনীতে ছোটবেলার কথা, আপনার পরিচিত পরিবেশের কথা জানলাম। ঢাকাতে আমি অনেক বছর ছিলাম ধানমন্ডি ও এর আশেপাশের এলাকায়। যেমন দেখে এসেছিলাম এখন আর তেমন নেই। জনবহুল এলাকা হয়ে গিয়েছে।
স্মৃতিময় লেখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিদিভাই। শুভকামনা জানবেন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
হ্যাঁ ভাইয়া সব বদলে গেছে। ছোটবেলার কথা মনে হলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। সব কেমন যেন হয়ে গেছে। ধন্যবাদ ভাইয়া। ভালো থাকবেন শুভ কামনা রইলো
রেহানা বীথি
নস্টালজিক করে দিলেন! জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বোধকরি স্কুল জীবন। ফেলে আসা সেই স্কুল, স্কুলের রুমগুলো, শিক্ষক থেকে শুরু করে স্কুলের ছোট বড় সব কর্মচারী, যেন হৃদয়ের খুব কাছাকাছি ছিল। বর্তমান সময়ের যান্ত্রিকতার ছোঁয়া লেগেছে স্কুলেও।
বড় ভালো লাগলো আপনার স্মৃতিচারণ।
ভালো থাকুন সবসময়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসংখ্য ধন্যবাদ আপু। আপনি ও ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো