আমরা বাঙালি! কিন্তু সত্যি কি আমরা বাঙালি? এই প্রশ্ন আজ ভাবিয়ে তুলছে আমাকে। আমাদের মানবিকতা নেই, দেশপ্রেম মুখে মুখে! অপর বাঙালিদের প্রতি আমরা উদাসীন এবং স্বার্থলোভী। আমরা কেমন বাঙালি? একজন বাঙালি হিসেবে পদে পদে অবজ্ঞা আর অন্ধ দেশপ্রেমের বুলি আওড়ানো একজন বাঙালি আমি/ আমরা একথা ভাবতে এইমূহুর্তে লজ্জিতবোধ করছি নিজে নিজেই।

করোনাভাইরাস নিয়ে এখন আতঙ্কিত সবাই। এটাই হয়তো স্বাভাবিক। তবে এই আতঙ্ক কিন্তু একশ্রেণীর গুজব রটনাকারীর জন্য অন্যেরা ভয়ভীত হয়েই হচ্ছে। আর সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি প্রকট হচ্ছে সেটি হলো, করোনাভাইরাস নিয়ে আমাদের অজ্ঞতা।

আমরা দূর্যোগ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় কাজগুলি সম্পন্ন করতে পারিনা। আগে থেকেই গা ছাড়া মনোভাব নিয়ে বসে থাকি আর বিপদ এলে হা হুতাস করি। অথচ পূর্ব সতর্কতাই কিন্তু অনেক বিপদাপদ থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারে।

আমরা বাঙালি হয়েও সুযোগসন্ধানী। অর্থলোভী কিছু মানুষের জন্য আমাদের সামাজিক অবক্ষয় কমছেনা। এই যে করোনা নিয়ে জনমনে আতংক এর পিছনেও এই শ্রেণীর মানুষরাও একপ্রকার দায়ী। কেন ও কিভাবে? বলছি শুনুন।

রংপুরে প্রচুর ধুলোবালি। শহরের সব রাস্তার উন্নয়নকাজ হচ্ছে একসাথে। বাতাসে ধুলিকণার পরিমান বেশি, রুক্ষ শুষ্ক পরিবেশ চারপাশে। মাস্ক ব্যবহার করা প্রয়োজন এখানে। অন্যদিকে দেশে করোনাভাইরাস আক্রান্তের খবর নিয়েও গতকাল থেকে অহেতুক কিছু সন্দেহ বাঁসা বেধেছে মনে। আমি করোনাভাইরাস বিশেষজ্ঞ নই, তবে স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করার ফলে এটুকু অন্তত জানি এত প্যানিক হবার মত এখনো কিছুই হয়নি। করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে সাধারণ স্বাস্থ্য সুরক্ষানীতি মেনে চলাই এখন জরুরি।

মাস্ক কিনতে গিয়েছি পরিবারের সদস্যদের জন্য। কোন দোকানেই মাস্ক নেই! কেন? বলছে মার্কেট আউট। অথচ যে দোকানে, ফার্মেসীতে গত দু’দিন আগেও মাস্ক ছিলো আজ তারা বলছে নেই। যারা আবার বিক্রি করছে তারা ১৫ টাকার মাস্ক বিক্রি করছে ৫০ টাকায়! শুনছি পুরো দেশেই একই অবস্থা। এ কেমন অসভ্যতা!

এর ফলে যেটি হচ্ছে জনমনে এটি দৃঢ় হচ্ছে মাস্ক ব্যবহার করতেই হবে। কারন সবাই কিনছে দেখেই মাস্ক পাওয়া যাচ্ছেনা, তারমানে মাস্ক ব্যবহার করতেই হবে। এটি বদ্ধমূল ধারনা হয়ে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে যা মোটেই সঠিক নয়।

মহামান্য হাইকোর্ট আদেশ দিয়েছেন মাস্ক নিয়ে যাতে কেউ ব্যবসা না করে। অর্থাৎ জীবন রক্ষাকারী মাস্ক উচ্চমুল্যে বিক্রয় করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গ্রহনযোগ্য। একটি মাস্ক এর মূল্য বৃদ্ধি নিয়েও এদেশের সর্বোচ্চ আদালতে সাধারণ মানুষকে দাঁড়াতে হচ্ছে! যা লজ্জাজনক।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না হলে মাস্ক ব্যবহার জরুরি নয় এটি আমরা বুঝতে চাইছিনা। এর কারনটাও কিন্তু অজ্ঞতা এবং করোনাভাইরাস নিয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষার অভাব। যার কারনেই এইসব অসভ্য অসাধু ব্যাক্তিরা ফায়দা লুটছে।

সুযোগসন্ধানী সেই বাঙালিদের বলতে চাই- ওহে বাঙালি, তোমার জন্ম কি এইদেশে? ন্যূনতম মানবিকতাও কি এদেশ তোমাদের শেখায়নি? যে দেশের বাতাসে শ্বাস নিয়ে বেঁচে আছ, সেই দেশেরই আকাশের তলে বসবাসকারী তোমার অন্য বাঙালি ভাইদের সাথে এই আচরণ করছ কেন? তাঁদেরকে কেন তুমি নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছ? কেমন বাঙালি তুমি? উত্তর আছে তোমার কাছে?

অথচ হওয়া উচিত ছিলো উল্টোটা। পৃথিবীর যেসব দেশে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে সেখানকার অনেক দেশে বসবাসকারী আমার পরিবারের সদস্য, বন্ধু এবং ভার্চুয়ালি পরিচিতদের কাছ থেকে জানলাম অন্যকথা। সেখানে মাস্ক এবং সেনিটাইজারের কোন অপ্রতুলতা নেই। বরং যারা এসবের ব্যবসা করে এই দূর্যোগের সময় তারা দাম কমিয়ে দিয়েছে, সহজলভ্য করেছে এসব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। লাভ কমিয়ে ফার্মেসীগুলোতে বিক্রি হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী অনেক ওষুধ।

এর কারন হচ্ছে নিজেদের শিক্ষা, মানবিকতা ও তাদের দেশপ্রেম। আমার পরিচিত বাঙালি যিনি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী একজন ফার্মাসিস্ট। তিনি আজ সকালেই বলছেন ভাই, আমার ফার্মেসি থেকে যারাই ব্রংকাইটিস, এ্যাজমা এবং ফুসফুস প্রদাহের ওষুধ কিনছেন তাদের আমি একটি করে মাস্ক ফ্রী দিচ্ছি! যতবার ওষুধ নিচ্ছেন, একই ব্যক্তি হলেও তাকে আবার একটি মাস্ক দিচ্ছি।

বললাম, কেন ফ্রীতেই কেন? তিনি এর কারন হিসেবে মানবিকতা এবং সহমর্মিতাকেই ব্যাখ্যা করলেন। অথচ তিনিও বাঙালি!

তিনি বলছেন, এতে আমার দু’টো লাভ হচ্ছে। যারা ওষুধ নিতে আসছেন তারা আমাদের বাঙালিদের সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করছেন এবং মাস্ক ফ্রী পেয়ে আবারও আমার ফার্মেসীতেই আসছেন ওষুধ নেয়ার জন্য। ফলে বিক্রি হচ্ছে ভালো। কারন এসব ওষুধেও আমি দাম কম রাখছি।

কথাগুলো মনে বিধলো আমার। ভাবছি সেও বাঙালি, আমরাও বাঙালি। যদিও সেসব দেশের সরকারের নজরদারি এবং দূর্যোগ মোকাবেলায় আপামর জনগনকে প্রয়োজনীয় দীক্ষায় দীক্ষিত করা এবং স্বপ্রণোদিতকরণ উদ্যোগ গ্রহণ করা তাঁদের নৈমিত্তিক সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমের অংশ। আর এসব যথাযোগ্য তদারকি করা হয় বলেই সেখানে সুযোগসন্ধানী ও অর্থলিপ্সু মানুষ প্রায় নেই বললেই চলে। যা আমাদের দেশে চিন্তাও করা যায়না।

অফিসে চলে এসেছি। নিত্যদিনের অফিস ব্যস্ততা শুরু হবে এখন। মনে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে- আমরা বাঙালি কেন গুরুচণ্ডালী?

হে বিধাতা! তুমি মোরে বাঙালি করেছ, মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন দেশপ্রেমিক কেন করোনি?

৯০৪জন ৬৪৪জন
0 Shares

৩৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ