
সূর্য প্রায় ডুবু ডুবু। সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ। হঠাৎই পাংচার হয়ে গেল সাইকেলটা। অগত্যা কোন উপায় না পেয়ে পায়ে হাঁটা শুরু করল টুম্পা ও তার বাবা। মা মারা যাবার পর এই প্রথম নানাবাড়ি গিয়েছিল তারা। তাই ফিরতে ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল তাদের। মা মরা মেয়ে। তার উপর নানাবাড়ি বলে কথা। সবাই তাকে পেয়ে আদর আহ্লাদে মেতে উঠেছিল। এমন লক্ষ্মী মেয়েকে কে না ভালবাসতে চায় ! তাছাড়া টুম্পারও আজ খুব ভাল লাগছিল নানাবাড়ির সবাইকে একসাথে পেয়ে। আম – কাঁঠালের বাগানে ঘোরাঘুরি, বিলের জলে গোসল করা, মাছধরা, বউচি -কানামাছি খেলা সে কি কম আনন্দের কথা ! এতসব আনন্দের মাঝে সে একবারও ভাবেনি পথে এমন বিপদে পড়তে পারে তারা।
ধু ধু মাঠের মাঝ দিয়ে হেঁটে চলেছে টুম্পা ও তার বাবা। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। পথে আর কোন মানুষের দেখা মিলছে না। যে যার গন্তব্যে চলে গিয়েছে সন্ধ্যার আগেই। ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে অন্ধকার। সামনে বিশাল বিল। বিলের পাশে ঘন কাশবন। কয়েকটা বিশাল বটগাছে। তারপর বড় কবরস্থান। আরেকটু সামনেই পথের দু’পাশে ঘন জঙ্গল। মামাদের কাছে টুম্পা গল্প শুনেছে এইখানে নাকি ভূত -পেত্নীও বাস করে।
ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার। কাছাকাছি শেঁয়ালের হাঁক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে হুতুমপেচা – ডাহুকের ডাক। ভূতুড়ে আওয়াজে গা ছমছম করে উঠছে টুম্পার। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে চলেছে তারা। হঠাৎ জোরালো আলো এসে পড়ল টুম্পাদের চোখের উপর। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। আলোয় চোখ মেলতে পারছে না তারা। মুহূর্তে কারা যেন ঘিরে ধরল তাদের। চোখ বেঁধে ফেলল তাদের। তারপর জঙ্গলের ভিতরে নিয়ে গেল তাদের।
অনেকক্ষণ পর টুম্পা বুঝতে পারল আশেপাশে কেউ নেই তখন। হয়তো কোন ডাকাতদল তাদের সবকিছু নিয়ে পালিয়েছে। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলল সে। কিন্তু চারদিকে গভীর অন্ধকার। কোনকিছুই দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে শুধু বিদঘুটে আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
হঠাৎ আবার একটা উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখা গেল। টুম্পা চমকে উঠল। ভয়ে কাঁপছে সে। এমন সময় অপূর্ব সুন্দরী এক পরি সামনে এল টুম্পার। টুম্পা ভয়ে কাঁদতে লাগল। কিন্তু পরি তাকে আদর করে কাছে ডেকে নিল। তার চোখ মুছে দিয়ে বলল কেঁদোনা টুম্পা। আমি তোমার পরিবন্ধু রিমি। আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি। চল তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। আমার অন্য বন্ধুরা তোমার বাবাকেও খুঁজে নিয়ে আসবে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবন্ধু রিমির সাথে বাড়ি পৌঁছে গেল। গিয়ে দেখল বাবাও পৌঁছে গেছে। তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরল। পরিবন্ধু রিমি তাদের কাছে আবার আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিল।
কয়েকদিনের মধ্যেই রিমির সাথে টুম্পার ভাল বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। একদিন রিমি টুম্পাকে পরির দেশে নিয়ে গেল। সেখানে সে সুন্দর সুন্দর নানান জায়গা ঘুরে দেখল। অনেক ভাল ভাল শিক্ষা অর্জন করল। টুম্পা পরিবন্ধুর কাছে তাদের স্কুলে যাবার আব্দার করল। রিমি তাকে পরিদের স্কুলে নিয়ে গেল। অপরূপ সুন্দর সে স্কুল। সামনে চমৎকার খেলার মাঠ। পাশেই শিশুদের পার্ক, চিড়িয়াখানা, ফুল ফলের নয়নাভিরাম বাগান, চোখধাঁধানো ঝর্ণাধারা, কি নেই এখানে !
টুম্পার সাথে অন্যান্য বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে রিমি। এমন সময় প্রধান শিক্ষক সবাইকে একসাথে ডাকলেন। তিনি ঘোষণা দিলেন আর কয়েকদিনের মধ্যেই তারা স্বর্গ ভ্রমণে যাবেন। আজ বিকালের মধ্যে যারা সবচেয়ে সেরা ফুল খুঁজে নিয়ে আসতে পারবে, তারাই হবে এই যাত্রার সফরসঙ্গী। প্রধান শিক্ষকের ঘোষণা শুনে সবাই সেরা ফুলটি খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল।
দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল, একে একে সবাই ফুল নিয়ে হাজির। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুলে ফুলে ভরে গেল স্কুলপ্রাঙ্গণ। কিন্তু একেকজনের হাতে একেক রকমের ফুল। শিক্ষকেরা বিব্রত, কোন কোন ফুলকে সেরা ঘোষণা করবেন ! এমন সময় প্রধানশিক্ষক ঘোষণা দিলেন সেরা ফুল বাছাইয়ের এই কঠিন কাজটি করবে টুম্পা। টুম্পাই ঘোষণা করবে এবার স্বর্গভ্রমণের সহযাত্রী কারা হবে।
শত রূপের – শত গন্ধের অজস্র ফুলের মধ্যে টুম্পাকেও ফুলের মতোই সুন্দর দেখাছে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে টুম্পা কোন কোন ফুলকে সেরা ঘোষণা করে। টুম্পা প্রথমে একটা গোলাপ হাতে নিল। তারপর শিক্ষকদলকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কে কে এই ফুলটি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন? তিনজন শিক্ষক জানালেন তারা এই ফুলটি বেশি পছন্দ করেন। কেন পছন্দ করেন প্রশ্ন করলে তারা কেউ বলল এটা সবচেয়ে সুগন্ধি ফুল, কেউ বলল এটা দেখতে সুন্দর। এরপর টুম্পা শিউলী ফুল হাতে নিল এবং আবারও শিক্ষকদলকে জিজ্ঞেস করল কারা এই ফুলটি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। এবারও কেন পছন্দ করেন জানতে চাইলে বলল এটার গন্ধই সর্বসেরা। এভাবে টুম্পা আরও কয়েকটি ফুল নিয়ে একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করল।
কিছুক্ষণ পর টুম্পা সবাইকে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কি কেউ বুঝতে পেরেছেন জগতের সেরা ফুল কোনটি? কিন্তু কেউ কোন উত্তর দিতে পারল না। টুম্পা বলল পৃথিবীতে যত ফুল আছে তার হয়তো কোনটি গন্ধে, কোনটি রূপে সেরা, কোনটি সেরা ফলের জন্ম দেয়, কোনটি সর্বোত্তম ঔষধ তৈরি করে, কোনটি ঘর সাজানোয় সেরা, কোনটি। তার মানে এক একটি ফুল একেক ক্ষেত্রে সেরা। তেমনি মানুষের মনেরও ভীন্নতা রয়েছে। একেক মানুষ একেক কারণে একেকটি ফুলকে সেরা মনে করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট সব ফুলই উত্তম। সব ফুলকেই বিধাতা কোন না কোন উত্তম কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন। তেমনি মানুষ ও সব সৃস্টিকুলকে তিনি এভাবেই সৃষ্টি করেছেন। তাই পৃথিবীর সকল মানুষ ও সৃষ্টিকুলকে আমাদের ভালোবাসা উচিৎ। সেরা ফুল বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যেহেতু সব ফুলকেই আমার সেরা মনে হচ্ছে, সেহেতু এবারের স্বর্গযাত্রায় সবাইকেই সহযাত্রী হিসাবে নিয়ে যাওয়া উচিৎ। প্রধান শিক্ষক বললেন ঠিক আছে তাই হবে। এবার সবাই আমাদের সাথে স্বর্গে যাবে। সে যাত্রায় টুম্পাও আমদের সঙ্গী হবে। এই কথা শুনে সবাই আনন্দে তুমুল করতালিতে মেতে উঠল।
২২টি মন্তব্য
আলমগীর সরকার লিটন
খুব সুন্দর এক অন্যরকম গল্প পড়লাম কবি দা
হালিম নজরুল
অন্তহীন ভালোবাসা ও শুভকামনা ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
বাহ সুন্দর ছোটগল্প, কবি যা লেখে তাই পড়তে ভাল লাগে, লাগতে থাকুক।
ভাগ্যিস পরীমনির সাথে দেখা হয়ে যায়নি! তাই রক্ষা।
মনির হোসেন মমি
ভাইয়ের আবৃর্তিও কিন্তু চমৎকার।
হালিম নজরুল
আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ। আপনাদের ভীষণ ভাললাগে, তাই সাথে পথ হাঁটি। লজ্জা দেবেন না প্লিজ।
ছাইরাছ হেলাল
আহা আহা , বিনয় চুইয়ে পড়ছে!!
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সুন্দর ছোটগল্প। ফুল ভিন্ন ভিন্ন কারনে সবার কাছে প্রিয়। কোনোটা গন্ধে, কোনোটা বর্ণে ইত্যাদি । তাই আমার কাছে সব ফুল ই প্রিয়। আলাদা করতে পারিনা ।
হালিম নজরুল
আমার কাছে ফুলের চেয়ে আপনারা প্রিয়। মূলতঃ আমি মানুষ ভালোবাসি।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ ভাইয়া
বোরহানুল ইসলাম লিটন
অত্যন্ত সুন্দর লেখা!
কোন এক মহাজ্ঞানী বলেছিলেন
প্রত্যেক মানুষই মহামানব কিন্তু সে জানে না বলে
সাধারণ মানুষের মতো আচরণ করে।
মুগ্ধতায় শুভ কামনা রেখে গেলাম নিরন্তর।
হালিম নজরুল
চমৎকার মন্তব্য। ধন্যবাদ ভাই।
মোঃ মজিবর রহমান
মন ভরে যায় এমন গল্প পড়ে ধন্যবাদ নজরুল ভাই।
হালিম নজরুল
প্রেরণা বেড়ে গেল ভাই। ধন্যবাদ।
মোঃ মজিবর রহমান
ভালো থাকবেন ভাই।
নার্গিস রশিদ
ফুলগুলো খুব সুন্দর। ভালো লাগলো ।
হালিম নজরুল
ফুলগুলো ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম। লেখায় ভুলভ্রান্তি থাকলেও জানাবেন প্লিজ। খুব খুশি হব।
মনির হোসেন মমি
স্রস্টার সব কিছু সৃস্টির মাঝে কোন না কোন গুণ দিয়েছেন তাই সব ফুলই সেরা।
মানুষের মনের ভিন্নতা ও ভিন্ন ভিন্ন।
চমৎকার গল্প।
হালিম নজরুল
অন্তহীন ভালোবাসা ও শুভকামনা ভাই।
খাদিজাতুল কুবরা
সৃষ্টিকর্তা আঠারো হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন প্রয়োজন ছিল বলে। সুন্দর ছোট গল্প। গল্পে গল্পে বিষয়বস্তুও চমৎকার ছিল
হালিম নজরুল
প্রেরণা দেবার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইল আপু।
হালিমা আক্তার
ভিন্ন মাত্রার গল্প পড়লাম। চমৎকার বিষয়বস্তু। খুব ভালো লাগলো।
হালিম নজরুল
অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভকামনা