
বিকেলের দিকে ফিরছিলাম বাজার হয়ে। ছোট মুদি দোকানে চলছে তখন জমজমাট করোনা গবেষনা। সম্ভবত একজন সেদিনই টিকা নিয়েছেন। তাকে ঘিরেই গোল হয়ে চলছে আলোচনা- ভাই সুই কতো বড় , ব্যাথা কেমন লাগে, রক্ত বের হয় কিনা? এসব।
করোনা মানেই আতঙ্ক আর কৌতুহল। আমিও কৌতুহলী হয়ে শুনবার আশায় কান পাতলাম। টিকা দেওয়া ভাইটিকে অন্যজন বলছে, “ ইশ্রে! কি আগুনটা লাগাইলেন ভাই। এই কাজ করার আগে একবার এই অধম ভাইটারে জিজ্ঞাসা করবেন না? বাড়িতে আপনার এত সুন্দর একটা বউ। এখনও বাচ্চা হয় নাই। ভাবি কি আর সংসারে থাকবে? সরকারের বুদ্ধি বোঝেন, দেশে লোক বেশি হয়ে গেছে। সরকার কিছুতেই চালাবার না পারিয়া এই ফাঁকে কাজ সেরে ফেললো।
এরপর কানে-মুখে ফিসফিস। আমি কানের ফিসফিস আন্দাজ করতে পারলাম না। তবে বোঝা গেল, মারাত্বক কিছু। কারণ বেচারার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
আবার জোরে জোরে “ পুরুষ লোকেরা আর যাতে বাচ্চা জন্ম দিতে না পারে এজন্যেই এ ব্যবস্থা। তোমরা ভাই বড়লোক দেও করোনা টিকা। আমরা গরীব, আমাদের বছর বছর বাচ্চা- কাচ্চা হবে এটাই আনন্দ।
টিকা নেওয়া লোকটি একটু আতংকিত হয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন।
“এই যে পাশের দেশ ভারতে প্রতি মিনিটে কয়টা কর মানুষ মরছে সেগুলো কি এমনি। ওরা যে সারাদিন ঢকঢক করে মুত খায়। এই জন্যে ওদের সব নষ্ট। ভাই আমরা একটু হসেও খাঁটি মুসলমান। আমরা মুত টুত খাই না এজন্য আমাদের শরীরও খাঁটি, করোনাও নাই।”
প্রচন্ড রোদ আর গরমেও মামাদের ধান কাটা কাজের মাঝেই চলছে সমসাময়িক, রাজনীতি, অর্থনীতির আলোচনা। শুনে মনে হলো, বেশ ভালোই বোঝে তারা। এরা জ্ঞানী ও পরিশ্রমী হচ্ছে বলেই হয়ত দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
তারা করোনার অন্য নামও বের করে ফেলেছে যেমন- কলোনা, কোরোনা, কোলোনা, করুনা। আর ’মাস্ক’কে বলে মাস, মাচ, মুক ঢাকা ইত্যাদি।
এরপর, “করোনা আসলে কোন রোগ নয়। এটা বড়লোক, ঘুষখোরদের শাস্তির জন্যে আল্লা পাঠাইছে। এই জন্যে খালি তাঁদেরই হয় এবং তাঁরাই মরে যাচ্ছে। আজ পর্যন্ত একটা গরীব লোকেরও করোনা হয় নাই এবং মরেও নাই।”
এই করোনা টিকা কি জিনিস বা কেন দেয়া হচ্ছে? “সরকার কতদিন আর মাষ্টারদের বসায় বসায় পয়সা দিয়ে পালবে তাই বুদ্ধি করে টিকা দিল। যাতে শরীরে শক্তি না পায়, জ্বর হয়, পঙ্গু হয়ে কিছু অন্তত মরে। তখন “সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙ্গলো না।”
আমি দাড়িয়ে শুনছিলাম। এক মামা আমাকে ডেকে বললেন, মা আপনিও টিকা নিছেন। আমি হ্যাঁ সূচক মাথা দোলাতেই তিনি শিউরে উঠে বললেন, আহারে! তার বলার ভঙ্গিতে মনে হলো আমি আর কদিন মাত্র। এটা ভাবতেই আমার হেচকি উঠে, মাথা ঘোরা শুরু হয়ে গেলো।
দ্বিতীয় গবেষক দল:
আমাদের একটা আড্ডাবাজ গ্রুপ আছে, সবাই একসাথেই টিকা নিয়েছি। একসাথে দ্বিতীয় ডোজও সবাই গেলাম নিতে। অনেকদিন পর আমরা যেহেতু একসাথে হলাম তাই, জমজমাট খাওয়া দাওয়ার পর কফি হাতে সব গ্যাজাচ্ছি যার যার বিভিন্ন মতামতের সাথে। অন্যান্য গল্প শেষ এবার গল্প হচ্ছিল, এই করোনা টিকাটা আসলে কি? কি কাজে দেবে বা কি উপাদানে তৈরি এসব।
কেউ বললো, তেমন কিছু না শুধু এন্টিবডি তৈরি করবে হয়ত। কেউ বললো, রোগ- প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে। ঘুরে ফিরে একই কথা।
আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে খচ্চর হালিমা। সবার মতামত শুনেটুনে সে বলে উঠলো, না ভাই লোকে যাই বলুক এটা হাই ডোজেজ সেক্স হরমোন ইনজেকশান। কারণ জানতে চাইলে বলল, আর বলো না ইনজেকশান নেবার পর থেকেই ঐশ্বর্যের বাবা সন্ধ্যা হলেই খেতে পারে না। শুধু আমার দিকে ঢুলুঢুলু চোখে তাকায়। আমি ভালোই বুঝি এ তাকানোর মানে। ভাবছি কদিন বাপের বাড়ি গিয়ে থেকে আসবো।
তার কথায় আমরা সবাই স্বশব্দে হেসে উঠলাম। যদিও আসল ঘটনা অন্য। সন্ব্যার পর বেচারার হয়ত জ্বর আসে তাই অসহায় হয়ে বউয়ের দিকে তাকায়। আমারও ইনজেকশান দেবার পর গায়ে হাল্কা জ্বর জ্বর হয়। এটা অনেকেরই হয়। আমাকে নিয়েও গবেষণা হলো, আমি কেঁচোর শরীর নিয়ে জন্মেছি, রক্ত নেই তাই জ্বর হয়।
সবচেয়ে ড্যাসিং ইনোসেন্ট হাবীব সাহেব সেদিন আসেননি। কদিন আগেই বিয়ের কাজ সেরেছেন। সে এক ইতিহাস। আমাদের বিয়ের দাওয়াত দিলেন নয় তারিখ। আমরা শাড়ি- কাপড় কিনলাম। হঠাৎ তিনি আমাদের কোনকিছু না জানিয়েই লকডাউনের আগে বিয়ে সেরে ফেললেন। এ নিয়ে আমরা চরম হতাশ হয়ে তাকে দলচ্যুৎ করলাম।
হালিমা আবার শুরু করলো, হাবীবের আর দোষ কি?বলেছিলাম এই টিকা নিলে বিয়ে আবশ্যক। বেচারার আর সইলো না। করোনার টিকার অত্যাচারে নয় তারিখের কাজ আগেই সারতে হলো। আবার সবাই হৈ হৈ করে উঠল।
দলের একমাত্র ব্যাচেলরের এমন হাসি- ঠাট্টায় পরিমরি করে পালাবার উপক্রম। এবার তাকে নিয়েও হলো-শোনো হাবিবের মতো করো না, আমাদের তো দায়িত্ব আছে নাকি? দাওয়াত না খাওয়াও, অন্তত জানিও যে তোমারও দাওয়াত দেবার সময় নেই। অবশেষে বেচারা উঠে পালিয়েই গেলো।
অনেক হাসিঠাট্টার পর যে যার যার মত বিদায় নিলাম। মুহূর্তেই সবার মুখে গভীর বিষাদের ছায়া। পৃথিবী ভালো নেই, সাথে আমরাও। কার কতটা বিষাদ বোঝা গেলোনা কারন কষ্ট ঢাকতে সবাই মাস্কে মুখ ঢেকে বিদায় নিলো। যেখানে কোন জডিয়ে ধরা বা কোলাকুলি নেই! এরপরের আড্ডাও অনিশ্চিত। কিংবা আমি বা সে যে কেউ নাও থাকতে পারি!!!!
ছবি নেটের
২৩টি মন্তব্য
পপি তালুকদার
দারুণ মজা পেলাম দ্বিতীয় প্যারাতে😆😆।কিন্তু শেষ এসে সেই অজানা অনিশ্চয়তা ভর করলো! দিনকাল উৎকন্ঠার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে কি হয় কি হয়!😟😟😟
রোকসানা খন্দকার রুকু
জানিনা কবে শেষ হবে? ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইলো আপু। ভালো থাকবেন।
হালিমা আক্তার
রম্য রচনা হলেও পুরোটাই বাস্তবতার চিত্র। খুব ভালো লাগলো। করোনা উৎকণ্ঠা শেষ হোক। শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনার জন্যও শুভকামনা ও অশেষ কৃতজ্ঞতা।ভালো থাকবেন।
আরজু মুক্তা
আপনার লেখার স্টাইল চেন্জ করতে হবে। রম্য হলে আপনার হেডিং একটু মজাদার হওয়া দরকার। যেমন তৃতীয় প্যারা দিয়ে যদি শুরু করতেন। যেমন কি এক করোনা আসলো। নাম ও চমৎকার ভম্গিতে মানুষ বলে। তারপর উদাহরণ দিয়ে। বাজারের আড্ডা, বা আপনার আড্ডা এরপর দিতেন। তখন রম্যে প্রাণ আসতো। আর রম্য এতো ডিটেইলসে লিখবেন না। একটু ডিপলি ভাবেন। পারবেন।
শুভ কামনা
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা অশেষ। চেষ্টা করলাম সম্পাদনের। এবার কি চলবে?
মোঃ মজিবর রহমান
মুই ও দুই ডোজ লইলাম কি যে হই ডরে আছি।
কত জন কত কথায় কই, মোর কিন্তু কোন কথায় মন বসেনা। ২ মে ২য় ডোজ নিবনা ভাবলাম আবার নিলাম তয় ব্যথা পাইছি এবার।
যাদের কাজ না্ তারা সমালোচন-আলোচনা করেই যাবে, তাঁদের মোক্ষম কাজই এটা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আহারে ব্যাথা পেয়েছেন । আমাদের জনগন বোঝে বেশি। টিকা নিতে হবে কারন একসময় দুরের জার্নিতে হয়তো টিকা কার্ড ছাড়া যাওয়াই যাবে না। ভালো থাকুন ভাইয়া।
জাহাঙ্গীর আলম অপূর্ব
ভালো লাগল
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাই।
তৌহিদুল ইসলাম
আমরা এখনো করোনা নিয়ে অনেক ভুল তথ্যের মাঝে বসবাস করছি। এটা সাধারণ জনগনের দোষ বা ভুল নয়, টিকা নিয়ে আমাদের সচেতনতামুলক তেমন কোন কাজ আমরা করিনি শুধুমাত্র মিডিয়াতে কিছু প্রচার ছাড়া।
যে দেশে ইউটিউব, ফেসবুক ওপেন করলেই শোনা যায় ওয়াজে বক্তারা বলছেন- এই টিকা ইহুদীর টিকা। এই টিকা সরকার ইমান নষ্ট করতে দিচ্ছে, এই টিকা দিয়ে সব গোপন তথ্য বের করবে।☺☺
আড্ডাবাজি ভালোই হয়েছে। শুভকামনা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনার কাছেও একটা নতুন তথ্য পাওয়া গেলো। তথ্য দাতারা মহাজ্ঞানী। একসময় যখন টিকা না নিয়ে আটকে যাবে বিভিন্ন জায়গায় তখন বুঝবে মজা। আমি ওটা লিখতে গিয়েই রম্য লিখে ফেললাম।
ধন্যবাদ ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
আপনাকে তো এখন বিজ্ঞানী বলতেই হচ্ছে, কেঁচোর শ্রীর নিয়ে কত কথা বলেরে।
তা বাপের বাড়ী গেলে আমাদের জানিয়ে যাবেন। সবার ই মানবিক বিষয় থাকে, এই করোনা কালে।
রোকসানা খন্দকার রুকু
হা হা হা আচ্ছা অবশ্যই জানিয়ে যাবে। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইলো।
রেজওয়ানা কবির
করোনাকালে করোনার ভয়াবহ ছোবল নিয়ে এভাবে সবার ভাবনা আমরা রাস্তাঘাটে অহরহ দেখি কিন্তু রম্যের ছলে এভাবে আমি লিখতে আমি পারতাম না!এটা তোমার দ্বারাই সম্ভব। খুব মজা পেলাম। হায়রে! করোনার টিকা আর সবার আড্ডা জেনে দারুণ হাসি পেল তবে রম্য পড়ার সময় সবাইকেই দেখতে পেলাম এটাই কম কিসে?করোনায় সবাই যার যার মত সাবধানে থাকি,ভালো থাকি এই কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইলো।
সৌবর্ণ বাঁধন
মজার ছলে বাস্তবতাকে তুলে এনেছেন। সুন্দর লিখেছেন।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া। ভালো থাকবেন।
জিসান শা ইকরাম
রম্যের মাধ্যমে সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা খুবই কঠিন। আপনি সেই কঠিন কাজটি অবলিলায় করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আপনি অনন্যা। এমন পোস্টের জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আপনার লেখা পড়ে শিখছি আমি।
শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনাদের মন্তব্যই অনুপ্রেরণা।
সাবিনা ইয়াসমিন
লেখাটি পড়েছিলাম গতরাতে, প্রায় মাঝরাত পাড় হওয়ার পর, যেই না এই লাইনে এলাম ❝ পুরুষ লোকেরা আর যাতে বাচ্চা জন্ম দিতে না পারে এজন্যেই এ ব্যবস্থা❞
টের পেলাম হাসির ঠেলায় খাঁট কাপছে, কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বের করিনি। পড়া জারি রেখেছি। কিন্তু আপনার রম্য বলে কথা, শান্ত শিষ্ট হাসি বজায় থাকলো না পরের প্যারায় 😀
❝সরকার কতদিন আর মাষ্টারদের বসায় বসায় পয়সা দিয়ে পালবে তাই বুদ্ধি করে টিকা দিল। যাতে শরীরে শক্তি না পায়, জ্বর হয়, পঙ্গু হয়ে কিছু অন্তত মরে। তখন “সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙ্গলো না❞
হাহাহাহাহা, ভুলেই গেছিলাম আশেপাশে লোকজন ঘুমাচ্ছে। ফলাফল, ধমক খেয়ে ঘুমিয়ে গেছি আর জেগেছি সেহেরি খাওয়ার ছয় মিনিট আগে।
করোনা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অজ্ঞতা আর গা ছাড়া ভাব ক্রমেই বাড়ছে। কোন ভীতি-ই তাদেরকে সতর্ক/ সচেতন করতে পারছে না। এটা আতংকের ব্যাপার। আল্লাহই জানেন এর পরিনতি আগামীতে কি হতে যাচ্ছে।
আপনি নিরাপদে থাকুন, শুভ কামনা 🌹🌹
রোকসানা খন্দকার রুকু
হা হা হা আপনার মন্তব্যও মজাদার। না জানি কতো বকা খেয়েছেন আমার জন্য।
বকার জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা রইলো
নবকুমার দাস
বেশ মজা লাগলো দিদিভাই। তবে দুশ্চিন্তা যাচ্ছে না। ভাইরাসটি দ্রুত তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট বদলাচ্ছে। মানুষের কষ্ট বাড়ছে।