নবনীর নীল আকাশ!

রোকসানা খন্দকার রুকু ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার, ০৮:৪৩:২৭অপরাহ্ন গল্প ২৬ মন্তব্য

আমার ডিভোর্স হয়ে গেল। লোকে রাস্তায় আমাকে দেখিয়ে ফিসফাস করে। আমি হেসে দেই। অতঃপর বলে, হাসেও বেহায়া কোথাকার! আমি নির্দিধায় চলে যাই। কারণ স্বাধীনতার গন্ধের কাছে কারও ভৎর্সনা বড়ই তুচ্ছ। সেটা পেতে কিছু বিষয় তো এড়িয়ে চলতে হবেই। আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে বেঁচে থাকাটা ঠিক বেঁচে থাকা নয়!

নবনী, বয়স বত্রিশ। শ্যামলা গড়নের মেয়েটির পাঁচবছর পর সংসার কেন ভাঙলো। অতিরিক্ত স্বাধীনতাই কি তার কাল হলো? বিয়ের পর এসব কি? স্বামী যা চাইবে তাই! দেখা যাক সে কি কি করেছিল—

ফাষ্টফুড ভীষন পছন্দ তার, তাই ওজন একটু বেশি। বিয়ের আগে ভারী নবনীই সবার পছন্দের ছিল, তাকেই বিয়ে করবে এমনটাই ছেলে ও তার বাবা গো ধরে বসেছিল। দেখাদেখির পরই বিয়ে হতে হবে। ছোট্ট আরও একটা উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল। মেয়ের ব্যাংক ব্যালেন্স। সে সময় তাদের ভীষন জরুরী ছিল সেটা। বিয়ের পর ছ‘মাস না যেতেই তার ভারীটুকু শাশুড়ী অপছন্দ করতে শুরু করলেন। তাছাড়া এত বড় অফিসার এর বউ স্লিম না হলে হয়। বিভিন্ন সময় ‘মোমসুন্দরী‘ সেজে এনুয়াল প্রোগ্রামগুলোতে এটেন্ড করতে হয়। নবনীকে স্লিম তো হতেই হবে, তাই হয়ে গেল তার ফাষ্টফুড বন্ধ।

ছোটবেলায় শখ করে নাচ শিখেছিল। বাবার পছন্দ ছিল। বিয়ের পর বর কদিন আহ্লাদী করে নাচল, নাচও দেখল। একদিন কি হলো, কড়া নির্দেশ নাচানাচি বন্ধ। সবাই ভালো চোখে দেখছে না। আচ্ছা সেতো আর স্টেজ ডান্সার নয় নিজের আনন্দেই নাচে। হয়ে গেল বহু বছরের নাচের বিসর্জন। একসময় ভুলে যেতে থাকলো নাচের  সব তাল , লয়, মুদ্রা।

বিয়ের দেখাদেখিতে শশুর মশায় জানতে চেয়েছিলেন নবনীর চাকুরী ও বেতন। বেসরকারি চাকুরীতে বেতন ভালো। বেশ খুশিই ছিলেন তিনি। নবনীর জমানো বেতনের টাকায় বরের চাকরি হল। তিনি এখন গভর্মেন্ট জব করেন এখন পজিশন অনেক ভালো। নবনী ভেবেই রেখেছিল চাকরি বেশিদিন করবে না। কিন্তু বরের হঠাৎ চাপ বেসরকারি চাকুরী লোকে ভালো বলে না। চাকুরী করতে হলে অন্যকিছুতে ট্রাই কর। এখনও বয়স আছে নবনী দিনরাত একাকার করে পড়াশোনা শুরু করে দিল।তার ড্রিমজব ছেড়ে দিতে হল। ভাগ্য ভালো বলে কলেজের জবটা হয়ে গেল। মেয়েদের জন্য শিক্ষকতাই অনেক বেটার। সবার কাছ থেকে এমন বাহবা পেল।

নবনীর পছন্দ একটু ছোট শহর কিংবা মফস্বলের দিকে স্যাটেল হবার। বরের পছন্দ নয়, তাই সব টাকা একখানে করে তার পছন্দের জায়গায় ফ্ল্যাট নেয়া হল। নবনীর নিঃশ্বাস বন্ধ হলেও ছুটির সময়গুলো সেখানেই কাটাতে হয়। কারন স্বামীর কর্মস্থলে বউ থাকবে, বউ এর পছন্দে কি যায় আসে।

লিখতে- পড়তে ভালোবাসে তাই নবনী কিছুটা ভাবুক টাইপের, আত্মভোলা; উদাসিন। কদিন রাঁধতে তরকারি পুড়ে ফেলেছিল। শাশুড়ী মা ভীষন ক্ষ্যাপা কি এত ভাবে। আর কি সব নোংরা প্রেমের কবিতা দিয়ে ফেসবুক ভরিয়ে ফেলছে। লোকে কানাকানি করে। কারণ একটা নাম বারবার আছে সেখানে‘ জানপাখি‘। এই ‘জানপাখিটা‘ আবার কে? চলল বেশ খোঁজাখুঁজি। নবনী হাসে কারণ জানপাখি তার কল্পনার মানুষ। প্রতিটি মেয়ের কল্পনায় একজন স্বপ্নপুরুষ থাকে যাকে সে কৈশর থেকে সারাজীবন লালন করে মনে- প্রাণে। বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই।

বিকেলের বারান্দায় বসে আকাশ দেখতে ভালো লাগে। কি করে একেক সময় একেক রং ধারণ করে। রাস্তা দিয়ে ছেলেরা যায়; তাকিয়ে থাকে দোতলার বারান্দায়। শ্যামলা মেয়েটির পাগলামী দ্যাখে। বাপের বাড়ি থেকে ফিরে নবনী দেখে বারান্দায় মোটা পর্দা ঝুলছে। কারন জানতে চাইলে বলা হল, ধুলা-বালি আসে। বন্ধ হল তার আকাশ দেখা। আকাশ- বাতাস যা দেখার সব স্বামীর সাথে দেখ, সে যখন যেভাবে চায়।

ফেসবুক-ইন্সটাগ্রামে বেশ জমজমাট আসর নবনীর। ভার্সিটি ফ্রেন্ড, সহকর্মী, অনেক দিনের পরিচিত, ভালো বন্ধুত্ব অনেকের সাথেই। হাসিখুশি বলে তাকে সবাই পছন্দ করে। ছবিটবির চেয়ে ফেসবুকে কবিতাই বেশি লেখে সে। হঠাৎই কিছু ছবি পোস্ট করল। এটা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড।এ বয়সে বিয়ের পর কিসের এত বন্ধুদের সাথে আড্ডা। তারপর ছবিটবি কত লোক দেখছে। খন্দকার পরিবারের বউ, মেয়েরা ছবি দেয় না তাছাড়া ছবি দেয়া হারাম। এটা নিয়ে বরের মন্তব্য আমি ছবি দিলে শ‘খানেক লাইক- কমেন্ট পরে না। আর তুমি কি যাদু কর যে শত শত লাইক-কমেন্ট। এসব বন্ধ করে নামাজ কালাম মনোযোগ দিয়ে কর! ব্যস তারপর থেকে ছবি, লেখালেখি, ফেসবুক টোটালি বন্ধ।

শুধু ডায়েরীর পাতা ভরে কবিতায়। কিন্তু এভাবে কতদিন। একফাঁকে কবিতার বই বেরিয়েছে নবনীর। একটু গোপনেই সে সেরে ফেলেছে। বর জানতে পারার পর অসাধারণ মন্তব্যে সমৃদ্ধ করল,

“কি যে সব কর। কাজ নাই দুপয়সার মাষ্টারমশাই। সংসার কর সংসার। আর প্রতিবছর যত কবিতার বই বের হয়। তোমাদের সস্তা আবেগের কবিতা কে পড়বে।” যেটি নিয়ে  উঠেপড়ে লাগলেন সেটি অবাক করার মত।

সবার কাছেই জটিল ও কৌতূহলের বিষয় তার প্রেম প্রেম লেখা। জীবনের কোন কোন ঘটনা তুলে ধরেছে কিংবা বিয়ের আগের কেউ ছিল কিনা। কিংবা এখনো চলছে কিনা এসব নিয়ে নানা কল্পনা জল্পনা।

এবার নবনীর বয়স হয়েছে বাচ্চা নিতে হবে। কিন্তু জামাই বেচারা তো মহা ব্যস্ত। ডাঃ দেখানো হল কোন সমস্যা নেই শুধু একসাথে থাকতে হবে। অবশেষে নবনীর উপর কঠিন চাপ হয় স্বামী কিংবা চাকুরী। একটা বেছে নিতে হবে। প্রথম কদিন নবনীর ভীষন খারাপ লাগলো। কলিগ, বন্ধু, স্টুডেন্ট ছাড়া কেমন করে থাকবে। অবশ্যই তার বাচ্চা নেয়ার দরকার। কিন্তু তার জন্য জব ছাড়তে হবে কেন? আল্লাহ চাইলে এমনিই হবে! তার জামাই তো কিছুই ছাড়েনি, বাবা-মা, পছন্দ, বন্ধু বান্ধব। সব নবনীকেই ছাড়তে হচ্ছে। সংসার মানে কি একতরফা ত্যাগ? মেয়েদের অস্তিত্বের অস্বীকার করা? অস্তিত্ব ছাড়া কি মানুষ বাঁচে? সে কি চলতে পারবে ? একেএকে শখের সবকিছু ছেড়ে?

সম্পর্ক টিকে থাকে শ্রদ্ধাবোধ, সম্মান,ভালোবাসা,বিশ্বাস ও একে-অপরের ত্যাগে। তা যখন নেই তখন এর নাম কি? নবনী সিদ্ধান্ত নিল সে চাকরী ছাড়বে না, যা হয় হোক!

অবশেষে পাঁচবছরের ভালোবাসা জানিয়ে দিল তার বউ দরকার, বাচ্চা দরকার। ওভারঅল বাইরে থেকে ফিরে সেবাটুকু খুবই দরকার যেটা নবনী খুব বেশী দিতে পারে না। নবনীর বাবা বেঁচে নেই। মা বললো, ছেড়ে দে মা, সব ছেড়ে দে, তবু সংসার হোক। নবনী সিদ্ধান্ত নিল বাকি জীবন সে একাই কাটাবে সম্মানের সাথে, আত্মমর্যাদার সাথে। ডিভোর্স হলে হোক, আর লোকে যা বলে বলুক।

আজ বাইরের আকাশ বেশ ঝকঝকে নীল, মেঘমুক্ত। একটা লম্বা নিঃশ্বাসে বুক ভরে নিয়ে নবনী বেড়িয়ে পড়ল বাসা খুঁজতে। যেটা হবে তার একান্ত নিজের, নিজের সংসার। যেখানে সে স্ব- সম্মানে বেঁচে থাকবে।

আমরাও চাই নবনীরা বেঁচে থাকুক নিজের মেঘমুক্ত, নীল ঝকঝকে আকাশে। শুভ কামনা ও প্রাণঢালা অভিনন্দন সকল নবনীদের জন্য🌹🌹🌹🌹🌹🌹

ছবি- নেট থেকে।

৮৬১জন ৬৫৮জন
0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ