গল্পটি শোনা।আমি নিজেও ধর্মভীরু মানুষ।নামাজ কালামসহ সব ধর্মীয় অনুশাসন মেনেই চলি।তারপরও সাম্প্রতিক সময়ের আমাদের চলাফেরা থেকেই বলতে হচ্ছে।
“তিনি একজন জবরদস্ত আলেম।মধু খেতে তাঁর মন চেয়েছে।মধু খাওয়া সুন্নাত।আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) মধু বেশ পছন্দ করতেন।আলেম হুজুর জীবনে অনেক মধু খেয়েছেন কিন্তু কোথায় যেন খুঁতখুঁত করছে।ঠিক মন ভরছে না। সাথীদের তিনি এ খায়েশের কথা জানালেন।
তাঁরা বলল, হুজুর আপনার জন্য পুরো মধুর চাক পেরে এনে দেই।সেখান থেকে মুখ লাগিয়ে খান।
মন ভরল না। হুজুর বললেন,আমি সরাসরি গাছে উঠে চাক থেকে মধু খেতে চাই।
-এটা তো রিস্কি। আপনাকে যদি মাছি কামড়ে দেয়।
হুজুর গোঁ ধরে বসল।কি আর করা।সবাই চাক থেকে ধোয়া,ধুপ দিয়ে মাছি তাড়িয়ে দিল।মাছিরা কিন্ত যায়না।আসেপাশেই ঘোরে।এখন যারা মধু সংগ্রহ করে তাঁরা একটা মোটা পোশাক পড়ে আর ধোয়া নেয় তারপর চাক থেকে মধু সংগ্রহ করে।হুজুরকে ধোয়া আর মোটা পোশাক দেওয়া হল।তিনি তো মহা গরম।
“এই পোশাকে গাছে উঠে মধু খেলে মজা হয়? সব কাজেরই একটা আরামবোধ থাকা দরকার।তাই তিনি পাতলা গেঞ্জি পড়ে গাছে উঠতে লাগলেন।সাথীরা অনেক জেদ করল, অনুরোধ করল।তিনি কিছুতেই শুনলেন না। সাথে সাথে একজন ধোয়া নিয়ে উঠতে লাগলেন। হুজুর ধমক দিয়ে নামিয়ে দিলেন।
তাঁর কথায় যুক্তি আছে”আমি আল্লাহর ধ্যানে-জ্ঞানে জীবন পার করছি। তাঁকে এত ভালোবাসি।তিনিও আমাকে পছন্দ করেন।আমার জন্য এত মানুষ ইসলামের আলো পাচ্ছে। আমার আল্লাহর উপর অগাদ বিশ্বাস আছে।আমাকে তিনিই রক্ষা করবেন”।
কোন প্রোটেকশান ছাড়াই তিনি গাছে উঠে যেই মধু খাওয়া শুরু করেছেন।অমনি হাজার হাজার মাছি এসে তাঁকে কামড়ে দিল।তিনি মারা গেলেন।
যথারীতি আল্লাহর সাথে তাঁর দিদার হল।হুজুর মুখ ভেংচি কেটে অভিমানে ফিরিয়ে নিলেন। আল্লাহ বললেন,”কেন কথা বলছ না?
-“কেন বলব। সারাজীবন আপনার সেবা করেছি,ভালোবেসেছি।আর আপনি আমার একটা আশা পূরন করলেন না। মারলেন আমায়”।
আল্লাহ তাঁকে বললেন, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ।আমিই তোমার সাথীদের বারবার তোমাকে সাবধান করতে বলেছিলাম।গাছের অর্ধেক পর্যন্ত আগুন নিয়ে পাঠিয়েছিলাম।তুমি অহমিকায় আর নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসে ফেরত পাঠিয়েছ।দুনিয়াতে বেঁচে থাকতে হলে নিয়মমাফিকই চলতে হয়। ব্যতিক্রম বলে কিছু নেই।অনিয়ম করলে তার সাজা হয়।হুজুর নিজের ভুল বুঝতে পারলেন।
আমি কদিন ধরে হাসপাতালে যাওয়া আসা করলাম।ভাইয়া অসুস্থ। হঠাৎ কিডনির সমস্যায় ডাক্তার কদিন হাসপাতালে থাকতে বলেছেন।বাড়ির সদস্যদের মধ্যে আমি আর ছোট ভাইয়াই ওর কাছে যাওয়া আসা করছি কারন হল করোনা ভাইরাস। প্রথম দিন তো জানে পানি ছিলনা।ভয়ে ভয়ে প্রোটেকশন নিয়ে গেলাম। হাসপাতালে ঢোকার পর লোকজন আমাদের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছে।কেউ ফিক করে হেসেও দিচ্ছে।এমন একটা অবস্থা আমরা মঙ্গল গ্রহের এলিয়েন এই মাত্র ল্যান্ড করলাম।
নিজেরও অস্বস্তি হতে লাগলো। প্রোটেকশান হল মাস্ক পড়েছি ডাবল,হাতে গ্লাভস আর স্যান্ডেলের উপর পলিরাপ,যেটা ডাক্তাররাও পড়ে।এটাতে কেন এলিয়েন ভাবছে বুঝলাম না।ছোট ভাইয়া বোধহয় কিছুটা লজ্জা পেল।সে বেডে যাওয়ার পর পায়েরটা খুলে ফেলে দিল। আমার ভীষন রাগ হচ্ছিল।
যা হোক ডাঃ ও নার্স এলেন।আমাদের প্রোটেকশন দেখে তাঁরা বোধহয় খুশি। ভালো ব্যবহার করলেন।একটা ভালো খবর হল মোটামুটি সব ওষুধই হাসপাতাল থেকে দিল।অন্য সময় হলে থাকত না বা দিতনা।
সন্ধ্যা হয়েছে তাই খাবার দেবে। বারান্দায় খাবার নিতে লোকজন আসছে।বেশ হাসিখুশি মুখে মাস্ক নেই।কারও কানে ঝুলছে কারও থুতনীতে কারও শুধু নাক ঢাকা।বাবুর্চি কতজনকে যে ধমক দিল তার শেষ নেই।আমরা ভুলোমনা বাঙালি। তাদের নাকি মনে থাকে না।অথচ হাসপাতালে চব্বিশ ঘণ্টাই মাস্ক পড়ার কথা।
ছোট ভাইয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।আমি বুঝলাম কারনটা।আমরা তিনজনই কলেজে পড়াই।কতমাস হল স্কুল,কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়,পড়াশুনা,পরীক্ষা সব বন্ধ।সরকার হয়ত কিছুটা ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করছে কিন্ত সামাল তো দিতে পারছেনা। তাঁরা ভালো করেই করোনার ভয়াবহতা জানে। তাই বারবার বলছে কিন্তু খুলছে না।
শিক্ষক হল হ্যামিলিনের বাঁশিঅলা।শিক্ষক বের হলে শিক্ষার্থীরা বের হবে।বাবা মা বের হবে।বাদাম,ফুসকা,চকলেট,চানাচুর,রিক্সার ঢল সব বের হবে। জানিনা এ অবস্থায় কচদিন চলতে হবে বা চলবে।দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে যাচ্ছে।অর্থনীতির বেহাল দশা আর কিছু মানুষ বুঝতেই পারছে না আসলে হচ্ছে কি?
হাসপাতালে একটা রোগীর পেছনে পাঁচ ছয় জন এসেছে। দিব্যি ভাত খাচ্ছে, পান চিবোচ্ছে,সবার সাথে গল্প করছে।ভাইয়াকে কৌতুহলী একজন জিজ্ঞেস করল, কি হইছে?
ও চোখ বন্ধ করে ফেললো কারন লোকটা মাস্ক পড়েনি।
আমি বললাম,-চাচামিয়া মাস্ক পড়েননি কেন?
সাবলীল উত্তর-দুরো বাহে!কই করোনা।আল্লাহর উপর ভরসা রাখলে কিছু হয়না।
-চাচামিয়া নামাজ পড়ছেন?
লাল দাঁত বের করে হেসে,-পড়ি নাই মা। আমি বুঝলাম না আল্লাহর হুকুম না মেনে তার উপর ভরসা ক্যামনে হয়।
বড় বড় দেশগুলোতে যখন করোনা শুরু হল।আমরা বললাম,”শালা খ্রিস্টানদের এইবার শ্যাশ।করোনা খাইছে ওদের।মুসলিমদের কাছে আসবেনা।এল।ভাই টেনশান নাই আবহাওয়া! আল্লাহ ইমানী পরীক্ষা নিচ্ছে।এই বিশ রমজানেই যাবে।
রমজান,শাওয়াল,জিলক্বদ, জিলহজ্জ সব গেছে।করোনা যায় নাই। বোকা(অতি চালাক), ছ্যাচড়া, গন্ডারের চামড়া বাঙালি আজও সেই বিশ্বাসে আছে। তাই মাস্ক পড়ে না। স্যানিটাইজার নেই। আর আমরা কেউ কেউ ডাবল মাস্ক পড়ে কুল কুল করে ঘামছি।স্যানিটাইজার লাগিয়ে হাত পুরে ফেলছি।ডাক্তার,নার্সরা পি পি পড়েছে। ভাদ্র মাসের তালপাকা অসহনীয় গরমে জীবন পানি হয়ে যাচ্ছে। শরীরে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে।তাতে কার কি?দিব্যি দোকানে দোকানে পান,বিড়ি,সিগারেট,রাজনীতি,ধর্মনীতি সব চলছে।যেন পৃথিবীর তাবত জ্ঞানের ভাণ্ডার এরাই।এই ভয়ানক শ্রেণীরে রাস্তায় তাড়া করলে বড় রাস্তায় যায়। বড় রাস্তায় তাড়া করলে ছোট রাস্তায় যায় সেখানে তাড়া দিলে আইলে যায়।পুলিশ কি আর আইলে নামতে পারে? পুলিশ চলে গেলে আবার আগের জায়গায়।
এই শ্রেণী অতি ভয়ানক কারন তারা ভাইরাস বহন করে এবং ছড়ায় কিন্তু তাঁদের কিছুই হয়না। ভবিষ্যতে ও এরা তাই করবে।এদের কঠোর আইনের আওতায় এনে নিয়ন্ত্রন করা দরকার।
২২টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি
ধর্মীও গোড়ামী বা ধর্মান্ধতা কোন ধর্মেই পারমিসন নেই।আমাদের দেশে অধিকাংশই ধর্মভিরু ধর্মান্ধ তারা ধর্মকে নিয়ে ব্যাবসা করে তাদের মুখ হতে এমন সব উদ্ভট কথা আসবেই।চমৎকার বিশ্লেষণধর্মী লেখা।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
কে বলেছে মমি ভাই লেট।ধন্যবাদ ভাইয়া। শুভ কামনা।
মনির হোসেন মমি
হা হা হা …ধন্যবাদ।
শামীম চৌধুরী
দারুন উপলব্ধি। শুভ কামনা রইলো্
রোকসানা খন্দকার রুকু।
ধন্যবাদ ভাইয়া।
শুভ কামনা।
ফয়জুল মহী
কমনীয় । সৃষ্টিশীল লেখনী ।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
ধন্যবাদ মহী ভাই। ভালো থাকবেন।
শুভ কামনা।
সৌবর্ণ বাঁধন
খুব বাস্তব কথা। সুন্দর করে লিখেছেন।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
ধন্যবাদ ভাইয়া। ভালো থাকবেন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনার লেখনীতে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এতো সুন্দর করে প্রথম উদাহরণ দিলেন যে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখলেই হবে না সেই ভাবে নিয়মনীতি ও পালন করার আদেশ দিয়েছেন , নিজেকে ভালো রাখতে, অন্যকে ভালো রাখতে যা করা দরকার তা করা উচিত। এখন অনেকেই মাক্স পড়ছে না , রাস্তা ঘাটে দেদারছে ঘুরে বেড়াচ্ছে, শপিং মলে ও একি অবস্থা। চেহারা দেখাতে না পারলে এদের আসলে পোষাচ্ছে না বলে মনে হয়। অদ্ভুত জাতি, অদ্ভুত মানসিকতা নিয়ে এরা বেঁচে থাকে। কারো কোনকিছুতে তোয়াক্কা না করাটাই এদের ধর্ম। গায়ে গায়ে ধাক্কা খাওয়াও বেড়ে গেছে। এদের এই অসভ্যতা ই সামনে আরো ভোগাবে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
রোকসানা খন্দকার রুকু।
অসাধারণ মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম।কি যে হবে এটা ভাবলে ঘুমাতে পারিনা আর এরা কি করছে তাই বোঝেনা।
ধন্যবাদ ও শুভকামনা।
তৌহিদ
অতি চমৎকারভাবে সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় করোনায় মাস্ক পরিধান এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অবশ্য কর্তব্য যা আমরা অনেকেই মানছিনা সেটিকে লেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি করার প্রবনতা এদেশের বেশিরভাগ মানুষের। আল্লাহ রহমত করবেন কিন্তু তিনি কি বলেছেন তোমরা অসাবধান হতে চলাফেরা করো?
আসলে আমরা জ্ঞানপাপী। সবকিছুই জানি কিন্তু মানিনা। চমৎকার এই লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ আপু।
ভাইয়ের সুস্থতার প্রার্থনা করছি।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
একদম তাই ভাইয়া।আমরা কবে যে নিজের ভালো বুঝব।
শুভ কামনা।
ছাইরাছ হেলাল
আপনার সময়ানুগ সচেতনতার প্রশংসা করছি।
ধর্মান্ধতা অতিক্রম করা খুব কঠিন। যেখানে আমাদের ক্রমাগত ভুল শেখানো হচ্ছে।
আশু রোগ মুক্তি অবশ্যই কামনায় রাখছি।
আপনি ভাল লেখেন, তা জানতে/দেখতে পেরেছি/পাচ্ছি।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
প্রশংসায় আপ্লুত হলাম।পাশে থাকবেন। আপনিও ভালো থাকবেন। শুভ কামনা।
আলমগীর সরকার লিটন
চমৎকার লেখেছেন অনেককিছুর বুঝার আছে
রোকসানা খন্দকার রুকু।
ধন্যবাদ ভাইয়া । শুভ কামনা।
আলমগীর সরকার লিটন
জ্বি আপনাকেউ
শিরিন হক
চমৎকার ভাবে লিখেছন।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
এই প্রথম আপনাকে পেলাম।আর একটু যোগ করলে বেশি ভালো লাগতো। অসংখ্য ধন্যবাদ ও ভালোবাসা।
শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
হযরত মোহাম্মদ ( সাঃ) এর একটা হাদীস আছে “আগে গরু খুঁটিতে বাধো তারপর ওযুতে যাও!”
আগে সাবধনতা।
রোকসানা খন্দকার রুকু।
আমাদের সমস্যাই হল যেটা করা উচিত সেটা করিনা আর যেটা করা উচিত নয় সেটাই করতে পছন্দ করি।
শুভ কামনা আপু। ভালো থাকবেন।