০১লা আষাঢ়, ১৪২৬
——————————————————————
আজ আষাঢ়স্য প্রথম দিবস। বৃষ্টি পিয়ে মাতাল হবো হিক!
বাদল-ও দিনের-ও প্রথম-ও কদম ফুল…কে দেবে আমাকে? কেউ কি দেবে? আচ্ছা, কদম কি ফুটেছে? শালার শহরে কদম গাছ-ও কি আর আছে? আমার ছোটবেলায় মোহাম্মদপুরে চুনকাম করা তবে সবুজ শ্যাওলা ধরা দূর্গের দেয়ালের মতো উঁচু এক দেয়ালের পাশে এক বিশাল কদম গাছ ছিল। প্রতি বর্ষায় ছেয়ে যেত নরম হলদে-সাদা, নাহ, এটা হলুদ-সাদা হবে, লেখাটার কিছু কিছু জায়গা আনুষ্ঠানিক, তাই হলদে-সাদার বদলে হলুদ-সাদা লেখা সঠিক হবে, কদম ফুলে। আমি বড় হতে হতেই কোন শুয়োরের বাচ্চা জানি গাছটা কেটে ফেলেছিল। আচ্ছা, আমি কিন্তু খুব অবাক হতাম। কদম ফুল হাতে নিয়ে…আমার মনে হত ফুল মানেই গন্ধ। কদম ফুল নাকের সাথে চেপে ধরে শুঁকেও কোন গন্ধ পেতাম না…তবে এর নরম রোঁয়াগুলো নাকে-মুখে আদরের পরশ বুলাতো। আসলে কদম ফুলের প্রেমাতাল গন্ধ পাবার বয়স তখনো হয়নি, তাই বুঝতে পারতাম না। আরেকটা ব্যাপার ছিল। মাঝে মাঝে জানোয়ারের মতো এর সব রোঁয়া টেনে তুলে ফেলতাম। দেখতাম ভেতরে কেমন করুণ সবুজ একটা বলের মতো আছে…কষ্ট পেতাম, হতাশ হতাম নাকি বিহবল হতাম মনে নেই। তবে মাঝে মাঝে নেড়ীকুত্তার মতো খেউ খেউ করে ওটা দিয়েই ফুটবল খেলতাম। আর রোঁয়া তুলে ফেলার পর ওটাকে ঠিক আম্মুদের কামিয়ে দেয়া মাথা আমার, ভাইয়ার বা অন্যান্য খেলার সাথীদের ন্যাড়া মাথার মতোই লাগতো। হা ঈশ্বর!
এভাবে বড় হতে হতে একদিন এক শ্রাবণ সন্ধ্যায় দুষ্টু বাও বাতাস এসে কানে কানে বলে গেল, জোড়া কদম হলো নারীর জোড়া স্তন। তখন থেকে কদম ফুলের মানেটাই বদলে গেল। কিভাবে যেন দেখতাম, ছুঁতাম ওদেরকে। শিহরিত হতাম কি? পরে শুনলাম সেইগান, “এসো নীপবনে…”, এটাও বুঝলাম নীপা এক অসম্ভব সুন্দরী আপুর নাম…আপুর নীপবনে খুব গোপনে আমি কি যেতে চাইতাম না? আচ্ছা এটা কোন প্রশ্ন হলো? ওইসব ক্ষুদে ক্ষুদে কোন ইঁদুরের বাচ্চা শালার ব্যাটারা ওখানে যেতে চাইতো না? আপুকে দেখলে বুকের রক্ত ছলাত ছলাত করতো। আমি চোখে হলুদ সর্ষে মানে কদম ফুল ছাড়া আর কিছু দেখতে পেতাম না। খুব চেষ্টা করতাম আপুর কদম ফুলজোড়ার দিকে না তাকাতে। চেষ্টা করতাম পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে। কিন্তু পারতাম না। আপু যেইদিন হলুদ জামা পড়ত, আর হাতায় সাদা কাজ করা থাকত, অথবা হলুদ কামিজের ওপর বুকে পরা থাকত সাদা ওড়না, সেইদিন আমার ভরা বর্ষা, মানে আমি আষাঢ় মাসের পুলকিত কোলা ব্যাং। নীপা’পু টের পেতেন? মনে হয়। কেমন করে যে হাসতেন! ঐ হাসি দেখে আমার নদীতে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করতো।
তারপর একদিন আষাঢ়ের এক বিকেলে সারা শহরে বৃষ্টির আয়োজন চলছে। চোখে গাঢ় করে সুরমা পরে ফেলেছে দিগন্ত। সরসর করে হাওয়া বইছে কদমের ডালে, পাতায়, ফুলে। মাঠের কোণায় দাঁড়িয়ে নীপা’পু ডাকলেন। সাদা সেলোয়ার, হলুদ কামিজ, দুধের মতো সাদা ওড়না- বুকে নেই। প্রবল হাওয়া তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে গলায়। তখন মেয়েরা গলায় ওড়না পরতো না। বুকেই পরতো। কিন্তু নীপা’পু ওড়না নামালেন না। নামিয়েও হয়ত লাভ হতো না। উনার উর্বশী মুখে তখন উড়ে আসা জলের কণারা সঞ্চিত হচ্ছে। তবে আমি জানি সবটাই উড়ে আসেনি। উনি কিছু বলছেন হাত নেড়ে। আমার কানে পৌঁছানোর আগেই সর্বনাশা বাতাস তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তবে, উনি হয়ত ভেজা গলায় বলছিলেন, “চলে যাচ্ছি রে। এই দেখে নে। আর কোনদিন হয়তো দেখা হবে না।” যে সৌন্দর্য সেদিন সেই অলোকসামান্য বিকেলে দেখেছিলাম, না অনুভব করেছিলাম, তার কোন বর্ণনা নেই। কোন বঙ্গভাষীর পক্ষে হয়ত লেখা সম্ভব না।
এর কয়েকদিন পর কোন এক শুওরের বাচ্চা এসে নীপা’পুকে বিয়ে কর নিয়ে চলে গেল অনেক দূরে। যেখানে বৃষ্টি হয়না, কাদার মত বরফ পড়ে। আমি জ্বরে পড়ে ছিলাম। জানতেও পারিনি। লোকটাকে সেই সময় দেখতে পেলে নির্ঘাত দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতাম। সেই সময় “দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া” শব্দবন্ধের খুব প্রচলন ছিল। কেউ কাউকে হুমকি দেবার সময় হত্যা, খুন, খতম এইসব না বলে এইটা বলতো। যাকে বলা হতো তার গায়ের রক্ত সাথে সাথে হিম হয়ে যেতো।
এরপর আমিও আরেকটু বড় হলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তরঙ্গ বাসে যাতায়াত করি। একদিন শ্রাবণ মাস। দুপুর বেলা আকাশ মেঘে ঢাকা, ঘন কালো সুরমা পরে অভিমানী চোখে চেয়ে আছে সারা দিগন্ত। চারিদিকে বৃষ্টির তুমুল জল-নূপুর। বাস গিয়ে থামল, আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটের ফটকে। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল বৃষ্টি ভেজা নীপা’পু- না, না কদম গাছ। হলুদ-সাদা ফুলে ছেয়ে আছে। বাসের জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে ধরা যায়। আমি সাবিনার দিকে তাকালাম। সাবিনা আমার দিকে। আমি ছিলাম জানালার পাশে, ও ছিল আমার পাশে। ওর অনিন্দ্যসুন্দর-ফর্সা মুখখানা জ্বলজ্বল করছে। যেন বৃষ্টি ধোয়া কদম ফুল। হাত বাড়ালাম। আমার হাতে চলে এলো একজোড়া জলসিক্ত কদম। একুশ বছরের সাবিনা হেসেছিল। খুশীতে। অসভ্য বাতাসে ওর ওড়না সরে গিয়েছিলো। মরালী গ্রীবায় গিয়ে লটকে ছিল। সাবিনাও গলায় নয়, বুকেই ওড়না পরতো। ও সেদিন পরেছিলো সাদা সেলোয়ার। কদম ফুলের মতো হলুদ জামার ওপরে দুধের মত সাদা ওড়না। কিছুটা লাজুক, এবং ভীষণ লক্ষী মেয়ে সাবিনা ঐদিন কেন যেন আর সাথে সাথেই ওড়না টেনে নেয়নি। অমন ঝড়ো বাতাস, হয়তো টেনে নিয়েও লাভ হতো না! আর আমি তো জানি সময় থেমে গিয়েছিলো।
এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে, এসো করো স্নান নবধারাজলে॥ দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ, পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ- এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে-
২১টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ভালো লিখেছেন।
আসিফ ইকবাল
ধন্যবাদ সুপর্ণা 🙂
সাবিনা ইয়াসমিন
গল্পটা পড়লাম। খুব মনোযোগ দিয়েই পড়েছি।
একটি ছেলের শৈশব থেকে কৈশোরে পৌঁছে যাওয়া, ফুলের প্রতি তার তখনকার ভাবনা/ আগ্রহের ধরন। আবার, কৈশোর থেকে যৌবনে চলমান সময়কালে নারী/ প্রেম, নিষিদ্ধতার দিকে নিজস্ব ভাবনার প্রতিফলন। এবং সব শেষে নিজেকে প্রকৃতির মাঝে প্রকৃত পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিটি ধাপ অত্যন্ত সুনিপুণ কৌশলে ব্যাক্ত করেছেন। আর সবটাই একটি ফুলের উদাহরণ দিয়ে।
আপনার লেখাগুলোর সব সময়েই দুটো রুপ দেখতে পাই। এক সাইড পাঠক যেভাবে পড়তে চায়, সেভাবেই রাখেন। অন্য সাইডে নিজে যা ভেবে লেখেন তারও ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন। প্রকৃত লেখকরা কি এভাবেই ধাঁধা দিয়ে লেখে? কবে যে এভাবে লিখতে পারবো!!
নিয়মিত লিখুন, আর হ্যা অন্যদের লেখাও সময় করে পড়ুন।
শুভ কামনা 🌹🌹
আসিফ ইকবাল
অসাধারণ মন্তব্য এবং অসামান্য বিশ্লেষণ! তোমার মন্তব্য পড়ে নিজের লেখাটাই আরেকবার পড়লাম। ঠিক-ই বলেছ, ফুলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে যেন পরবর্তী বিকাশের ধাপগুলো। তুমি অত্যন্ত মনোযোগী পাঠিকাও বটে। না হলে লেখার নির্যাসটুকু এইভাবে ধরে ফেলা সম্ভব হতো না। আর হ্যাঁ, পাঠক/পাঠিকাকে যেমন নিজের মতো করে ভাবতে দেই, তেমনি নিজের ভাবনাটাও বহমান রাখি, রাখতে হয়, কারণ সেটাই অন্তরের তাড়না।
তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এই মূল্যবান মন্তব্যটীর জন্যে।
তুমিও অনেক অনেক ভালো থেকো।
মোঃ মজিবর রহমান
শিশু মনএর ভাবনা এলোমেলো ভেবেই হয়না। শিশু পেরিয়ে কিশর বয়স সে ভাবনায় দারুন ফুটিয়ে তুল্লেন লেখায়। তা বর্ষায় ফুটা কদম ফুলের কদম নির্যাসে। যখন যা মনে হউ। তবে নিপা আপুর যাওয়াতে জ্বরে হয়াতে বুঝা যায় আত্বিক সং্যোগ ভালই ছিল মনের মাঝে।
সুন্দর একটি লেখা আসিফ ভাই। ছেলে বেলার ভাবনার কথা মনে পড়ে। যা আপনি সুন্দর গল্পে রুপদান করেছেন তা আমি পারিনা।
আসিফ ইকবাল
সুন্দর মন্তব্যটির জন্যে ধন্যবাদ ভাই।
মোঃ মজিবর রহমান
শিশু মনএর ভাবনা এলোমেলো ভেবেই হয়. হবে। দুঃখিত আসিফ ভাই।
ইসিয়াক
লেখায় মুগ্ধতা রেখে গেলাম।
আসিফ ইকবাল
ধন্যবাদ ভাই। শুভ কামনা রইল।
সুপায়ন বড়ুয়া
গল্প হল নীপবনে
পড়েছি ভাই আপন মনে
ভাল লাগে হৃদয়কোণে
শুভ কামনা
আসিফ ইকবাল
বাহ সুন্দর ছড়া। ধন্যবাদ 🙂
জিসান শা ইকরাম
আপনার লেখা পড়ার সাথে সাথে নিজেকে আবিষ্কার করলাম ঐ কিশোর বয়সে,
ঐ বয়সে প্রায় সব কিশোরই বড় কোনো আপুর প্রেমে পরে যায়, তা অনেকটা নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষনের মত।
মেয়েরাও পরে প্রেমে সুন্দর স্মার্ট কোনো বড় ভাই বা টিচারের।
কদম ফুলকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তা নতুন করে ভাবনার বিষয় হয়ে থাকলো।
গল্প ভালো লেগেছে।
শুভ কামনা।
আসিফ ইকবাল
বাহ জিসান ভাই, খুব সুন্দর করে বললেন তো! হুম, সত্য কথা। ভালো লেগেছে জেনে সুখী হলাম।
সুরাইয়া পারভিন
আহা! কদম ফুলের প্রেমে মাতোয়ারা এক শিশু,
শিশু থেকে কৈশোর, কৈশোর থেকে যুবক
স্তরে স্তরে পরিবর্তন হলেও কদম ফুল প্রীতি পরিবর্তন হলো না।
চমৎকার লিখেছেন
আসিফ ইকবাল
সুন্দর মন্তব্যটির জন্যে অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
সাদিয়া শারমীন
ভালো লাগলো আপনার লেখা।কোনো কিছু দেখা ও বোঝার প্রকাশ জীবনের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন হয়।সুন্দরভাবে তা প্রকাশ করলেন।
আসিফ ইকবাল
বাহ চমৎকার বলেছেন। সত্যিই বয়সের সাথে সাথে দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টাতে থাকে। পাল্টাতে থাকে দেখার চোখ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
রেহানা বীথি
গল্পটির তিনটি বিষয়ে আকৃষ্ট হলাম —
কদম ফুল
প্রেম এবং
ভাষার প্রয়োগ।
গল্পের ধাঁধায় বাঁধা পড়ে পাঠক তার মনের ভেতর হাতড়ে বেড়াবে হয়তো।
দুর্দান্ত লিখেছেন।
আসিফ ইকবাল
রেহানা বীথি, অনেক ধন্যবাদ। বোঝা যাচ্ছে আপনি মনোযোগী পাঠিকা 🙂
বন্যা লিপি
দুর্দান্ত এক সিঁড়িভাঙা কিশোর থেকে যুবা পর্যন্ত বিশ্লেষন! আপন দৃষ্টিতে রাখা মাননিক ভাবনার সোপান! অক্ষর-শাব্দিক নিপুণায় এক চমৎকার কদম কাব্য।
আসিফ ইকবাল
বাহ খুব সুন্দর করে বললেন তো! কিশোর থেকে যুবা, আহা এই সিঁড়ি যে যাদুর সিঁড়ি! ভালো থাকবেন 🙂