ঋতু বৈচিত্রের কথা যদি বলি তবে সেই ষড় ঋতুর দেশ এখন আর বাংলাদেশকে অনেকটাই বলা যায় না।বছরে ছয়টি ঋতুর কেবল আসা যাওয়ার মাস গণনা করি কিন্তু ষড় ঋতুর যে বৈশিষ্টগুলো প্রকৃতির মাঝে বিরাজমান ছিলো তা আজ কেবলি ইতিহাস।প্রকৃতির উপর আমরা যে অত্যাচার করেছি তার প্রতিশোধ সে নিবে, এটাই সত্য।সেই প্রতিশোধের থাবায় আজ বিপর্যস্ত আমাদের চিরচেনা ষড় ঋতুর রূপের বৈচিত্রতা।আমাদের ছেলে মেয়েরা ষড় ঋতু কি হয়তো অনেকে জানবেই না,অনেকের কাছে তা আজ কেবলি ইতিহাস মাত্র।
“আমাদের ছোট নদী”কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি যতই নতুন করে পড়ি ততই মুগ্ধ হই।
আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।
আর-পারে আমবন তালবন চলে,
গাঁয়ের বামুন পাড়া তারি ছায়াতলে।
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাইবার কালে
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।
সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচল ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।
বালি দিয়ে মাজে থালা, ঘটিগুলি মাজে,
বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে।
আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।
মহাবেগে কলকল কোলাহল ওঠে,
ঘোলা জলে পাকগুলি ঘুরে ঘুরে ছোটে।
দুই কূলে বনে বনে পড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।।
কবিতায় কবি আমাদের প্রিয় জন্মভুমি বাংলাদেশের পুরো প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং তার সাথে খাপ খায়িয়ে জীবন বৈচিত্রের চিত্রটি সার্থক ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন।এ কবিতাটি পড়লে রূপসী বাংলার প্রকৃত বাংলাদেশকে জানা হয়ে যায়।বড় আফসোস লাগে আধুনিক সভ্যতার নগরায়ণে নির্বিচারে বৃক্ষ কর্তন এবং আধুনিক কলকব্জার বসত ভিটা তৈরীর দখলে আজ রূপসী বাংলার ঐতিহ্যবাহী রূপসী রূপে যেন অসনি সংকেত।
তবুও ষড়ঋতু আসে কখনো জানিয়ে কখনো বা অজানতেই নীরবে অভিমানে চলে যায়।প্রকৃতির প্রতিশোধে শহরের মানুষতো দূরে থাক অনেক গ্রামের মানুষও আজ ষড় ঋতুর সেই প্রকৃত ইমেজ তেমনটি খুজেঁ পান না।
নবান্ন উৎসবের আনন্দে কৃষক-কৃষাণীরা মুখিয়ে থাকত হেমন্তের আগমনে।শরতের কাশফুল মাটির আলিঙ্গণে নত হলে, ভোঁর কিংবা গোধূলীর লগ্নে কুয়াশাঁ শিশির বিন্দু যখন ঘাসের ডগায় নাক ফুলের শোঁভা পায়-রৌদ্রের ঝলকানিতে পড়ে না যখন চোখের পলক,বৃক্ষ রাজির নরম-কচি পাতার ফাঁকে ফাঁকে মিষ্টি রোদের উকিঁ,নীলাকাশে যেন হাত ছানি দিয়ে ডাকে। হেমন্তের রাতে মেঘ মুক্ত আকাশে জোৎস্নার আলো যেন অন্য সময়ের চেয়ে একটু বেশি ঠিকরে পড়ে।
স্মৃতির পটে ভেসে উঠে সেই স্মৃতি হালকা শীত শীত ভাব।ভোঁরের শিশির বিন্দুতে উদোম পায়ে ক্ষেতের আইল পেরিয়ে দিগন্তের মাঠ পেরিয়ে দূরে কোথাও শালিক ফড়িং এর শিকারে।
ভোঁরে হালকা শীতের প্রহরে গ্রাম গঞ্জে ফসল তুলার আয়োজনে কাস্তে হাতে ফলসের মাঠে মাঠে কৃষাণ কৃষাণীদের গমন দৃশ্য মনকে ভরে দেয় অভাবনীও সূখে।নবান্নকে বাদ দিয়ে হেমন্তের অধ্যায়ের রচনা শেষ হয় না।হেমন্তে ফলস কাটাকে কেন্দ্র করে উৎসবে মুখরিত হয় গ্রামাঞ্চল।এই নবান্নেই মেয়ের জামাইকে দাওয়াত করে আনা হয় মেয়ের বাড়ীতে।একটা সময় গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট যখন শুধু মেঠো পথ ছিলো সেই মেঠোপথ ধরে এ সময়টায় দেখা যেন বর কনের যাতায়াতের পালকির ব্যাবহার আর বহন কারীদের মুখে লোকজ গীত উৎসবের গান।হেমন্তে নবান্নে উৎসবে নতুন ধানের চাল দিয়ে মা চাচীরা রাতভর রকমারী নাঁরকেল পিঠা তৈরী করে সকালে জামাই সহ আত্মীয় স্বজনদের মাঝে আদান প্রদানের রীতিমত উৎসব চলত।যা এখন অনেকটাই কল্পনাতীত।
হেমন্ত অন্যান্য সব ঋতু হতেই একটু আলাদা।আলাদা তার আগমন ও বিদায়ের পরিবেশ।গ্রীষ্ম,বর্ষার মত সে নয় কোন ভয়ংকর বায়ুবীয় পরিবেশে,নেই সূর্য তাপের তীব্রতা,নেই বসন্তের মত অহংকার ভাব- হেমন্ত কেবলি মৌনতা শীতল অন্তমুখী।
“হিমের রাতে” কবিতয় কবি গুরুর ভাষায় হেমন্তকে দেখেছেন সংমিশ্রনে।
হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে,
হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে।
ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো
‘দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো,
আপন আলো,
সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।
ষড়ঋতুর এই একটি ঋতু হেমন্তকে নিয়ে কবি সূফিয়া কামালও আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখেছিলেন তার “হেমন্ত” কবিতায়।
“সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে।
এপার ওপার দুই বাংলার প্রায় সকল কবি সাহিত্যিক প্রকৃতি প্রেমিক প্রত্যেকের লেখনীতে উঠে এসেছে এই হেমন্ত ঋতুর রূপ যৌবনের উম্মাদনার ইতিহাস।সেই ক্ষেত্রে সোনেলাও বাদ যায়নি।সোনেলার সোনালীও উঠোনও ব্লগার লেখকদের লেখনীতে এখন ভরে উঠেছে হেমন্তের বন্দনায়।
“সবাইকে হেমন্তের শুভেচ্ছা”।
১২৫২জন
১০৭৭জন
৩২টি মন্তব্য
কামাল উদ্দিন
প্রকৃতির প্রতি আমাদের নির্মমতায় ওরা আজ পথ হারিয়েছে বলেই হৈমন্তি সৌন্দর্য্য আজ পুরোপুরি দেখা থেকে আমরা বঞ্চিত। রবি ঠাকুরের ছোট নদীটা অনেক দিন পর পড়ে খুবই ভালো লাগলো।
মনির হোসেন মমি
হুম ঠিক বলেছেন।অসংখ ধন্যবাদ।
কামাল উদ্দিন
[ছবি মুছে ফেলা হয়েছে]
ভালোলাগা জানিয়ে গেলাম ভাই
মনির হোসেন মমি
অসংখ্য ধন্যবাদ। এমন একটি ফুল দিয়ে লেখাটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিলেন।
ছাইরাছ হেলাল
আমাদের সোনেলা হৃদয় জুড়ে এখন হেমন্ত-সুর বাজছে,
লেখাটি দিয়ে আপনি-ও আপনার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলেন।
মনির হোসেন মমি
হুম ধন্যবাদ চেষ্টা মাত্র।
সুরাইয়া পারভিন
ঋতু বৈচিত্রের কথা যদি বলি তবে সেই ষড় ঋতুর দেশ এখন আর বাংলাদেশকে অনেকটাই বলা যায় না।বছরে ছয়টি ঋতুর কেবল আসা যাওয়ার মাস গণনা করি কিন্তু ষড় ঋতুর যে বৈশিষ্টগুলো প্রকৃতির মাঝে বিরাজমান ছিলো তা আজ কেবলি ইতিহাস।প্রকৃতির উপর আমরা যে অত্যাচার করেছি তার প্রতিশোধ সে নিবে, এটাই সত্য।সেই প্রতিশোধের থাবায় আজ বিপর্যস্ত আমাদের চিরচেনা ষড় ঋতুর রূপের বৈচিত্রতা।আমাদের ছেলে মেয়েরা ষড় ঋতু কি হয়তো অনেকে জানবেই না,অনেকের কাছে তা আজ কেবলি ইতিহাস মাত্র।
কথা গুলো একদম সত্য এবং বাস্তব।
চমৎকার লিখেছেন ভাইয়া
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ আপু।
আকবর হোসেন রবিন
সুন্দর লেখা। আমার ঈর্ষা হচ্ছে। হেমন্ত নিয়ে সবাই এতোকিছু লিখে ফেললো যে, আমি লেখার মতো নতুন কিছু খুঁজে পাচ্ছিনা।
শুভকামনা ভাই।
মনির হোসেন মমি
লিখে ফেলুন এখনো একদিন আছে। ধন্যবাদ।
নিতাই বাবু
সোনেলা উঠোনে আপনার হেমন্তের বন্দনায় আমি মুগ্ধ হলাম মনির দাদা।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ দাদা ভাই।
রাফি আরাফাত
মুগ্ধ হলাম লেখা পরে।
অনুভূতিরা আজকে নতুন স্বাদ পেলো।
ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকবেন
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ ভাইয়া।
শামীম চৌধুরী
ভাইজান, অতীতকে খোঁজা যায় না। অনুভব করা যায়।
মনির হোসেন মমি
আপনার কথাও ঠিক আবার আমার কথাও ঠিক।এক শব্দের বহু অর্থ বহু ব্যাবহার । যা গত হয় বর্তমানে নেই এ ক্ষেত্রে পেতে হলে খোঁজ শব্দ টাকে আমি ভাল মনে করি।সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
এস.জেড বাবু
প্রকৃতির উপর আমরা যে অত্যাচার করেছি তার প্রতিশোধ সে নিবে, এটাই সত্য।
প্রসিদ্ধ সব কবি সাহিত্যিকের হেমন্ত বন্দনার সাথে আপনার উদ্ধৃতির কি চমৎকার সামঞ্জস্য ।
গুণী প্রকাশনা
অভিনন্দন ভাই।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ ভাইয়া।
তৌহিদ
বাব্বাহ! হেমন্তকে নতুন রুপে চিনলাম আপনার লেখায় ভাই। লেখাটি পড়ছি আর আমি নিজেই যেনো হেমন্তে বাতাসে শীতল হচ্ছি। আপনি এমন লেখাও লেখেন আজ তা জানলাম। সত্যিই মুগ্ধ হলাম ভাই।
হেমন্ত বন্দনার উপযুক্ত লেখা এটি। ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য।
মনির হোসেন মমি
না ভাইটি আপনার লেখার ধারে কাছেও এ যায়নি। সরল মনে সহজ সরল ভাষায় কেবল স্মৃতিচারণ করছি। তবুও অসংখ্য ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
অসাধারণ লিখা।
হৈমন্তী শুভেচ্ছা।
মনির হোসেন মমি
অসংখ্য ধন্যবাদ আপু।
মাহবুবুল আলম
অনেক ভাল লাগা। “আমাদের ছোট নদী”কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটি যতই নতুন করে পড়ি ততই মুগ্ধ হই ” কবিতাটি শৈশবের পাঠশালায় নিয়ে গেল আবার!
মনির হোসেন মমি
কবিতাটি পুরোটা দিয়েছি কারন আমরা সেই কবে পুরোটা পড়েছি এখন কিছু মনে আছে কিছু নেই তাই পুরো কবিতাটা দিয়ে অতীত গ্রাম বাংলার চিরচেনা রূপকে নতুন করে চিনলাম। ধন্যবাদ।
রেহানা বীথি
হেমন্ত বন্দনা বেশ জমে উঠেছে। মমি ভাই, দারুণ লাগলো আপনার লেখা।
মনির হোসেন মমি
হুম সময় বাড়িয়ে নভেম্বর হাফ করা হয়েছে । ধন্যবাদ আপু।
বন্যা লিপি
আমরাই করেছি প্রকৃতিকে নিঃস্ব।প্রতিশোধ তো প্রকৃতি নেবেই।এত এত চমৎকার সব হেমন্তবন্দনা পড়ে পড়ে ভাবনায় পড়ে যাচ্ছি।
লিখবো টা কি?
হেমন্তের শুভেচ্ছা ভাইটি।
মনির হোসেন মমি
আবার শুরু করে তবে আশপাশের বন্ধুদের কিছু খাওয়াইয়া দোয়া লইয়েন যাতে এবার আর ডিলেট না হয়ে যায়। লিখে ফেলুন।
সঞ্জয় মালাকার
আমরাই করেছি প্রকৃতিকে নিঃস্ব।প্রতিশোধ তো প্রকৃতি নিবেই। কবিতা পড়ে আনন্দ পেলাম দাদা,আপনার জন্য শুভ কামনা।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ ভাইয়া।
জিসান শা ইকরাম
সোনেলা ব্লগের বুকে এখন হেমন্তের আমেজ,
আপনার লেখা পড়ে কিছুটা অতীত স্মৃতিতে আক্রান্ত হলাম ভাই।
পোষ্ট ভালো হয়েছে।
শুভ কামনা।
মনির হোসেন মমি
ধন্যবাদ ভাইজান। হেমন্তের শুভেচ্ছা।