
অবস্থা আজকাল এমন দাঁড়িয়েছে আমি পৃথিবীতে বাস করি না ফেসবুকে বাস করি বুঝতে পারি না। দেখা যায় আমি পৃথিবীতে থাকতে চাইলেও পৃথিবীবাসী আমাকে অথবা আমাদেরকে ফেসবুকবাসী বানিয়েই ছাড়বে। এমনিতে আমি ফেসবুক নামক খোলা বইটিতে খুব বেশি নিয়মিত নই; সংসার, কর্মক্ষেত্রের ব্যস্ততা, সর্বোপরি সদিচ্ছার(!?) অভাবেই আমার ফেসবুকে খুব বেশি যাওয়া হয় না। মাঝে মাঝে ছবি আপলোড দেই, ছবিগুলো যাতে একেবারে হারিয়ে না যায় সে উদ্দেশ্যে। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি ফেসবুকে মানুষের যে চেহারাটা দেখা যায়, বেশিরভাগটাই মেকি। অন্তত আমার নিজের বেলায় এটা শতভাগ সত্যি। তাতে আসলে কোন সমস্যা নেই, সমস্যা তখনি হয় যখন অনেকেই আমার ফেসবুক সত্তার সাথে বাস্তব সত্তাকে গুলিয়ে ফেলেন। এক গুরুজন, যিনি আমাকে সামনাসামনি প্রথমবার দেখেছেন, তিনি হঠাৎ বলে বসলেন, এই তুমি তো অনেক শুকনা, ছবিতে কিন্ত মোটা দেখায়। চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তাকাতেই তিনি বললেন তিনি আমার অমুক বন্ধুর তমুক মিউচুয়াল ফ্রেন্ড।
একবার এক জুনিয়র ছোটবোন বলল, আপু, ভাইয়ার সাথে ঝগড়া হইছে নাকি? আমি তো অবাক! ঝগড়া যদি হয়েও থাকে এর তো জানার কথা নয়! বললাম নাতো, কেন? সে বলে, না, তোমার প্রোফাইল পিক এ তো সবসময় ভাইয়া থাকে এই প্রথম দেখলাম ভাইয়া নাই, শুধু তোমার মেয়ে। আমি প্রোফাইল পিকচারের সাথে ঝগড়ার সমীকরণ সমাধানে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে বেচারির প্রশ্নের উত্তর আর দেওয়া হলো না।
বাচ্চার জ্বর, কাশি। এক আত্মীয় অভিযোগ করলেন, ফেসবুকে তো দেও নাই, জানি ও না। তাইলে একটু খোঁজখবর নিতাম।
এসব ঘটনা দেখে ও শুনে মনে হতেই পারে ফেসবুক হচ্ছে আমাদের জগতের পাশাপাশি একটা প্যারালাল ইউনিভার্স।
কয়েকদিন আগে সিলেট ঘুরতে গিয়েছিলাম। দর্শনীয় সব জায়গায়ই ঘুরেছি, প্রচুর ছবিও তুলেছি, কিন্ত অভ্যাসগত আলসেমির কারণে একটাও পোস্ট করা হয়নি। আমার কলিগ ছবি দেখতে চাইলেন, দেখাতে পারলাম না, ছবিগুলো সব বরের মোবাইলে তোলা হয়েছে। জিজ্ঞেস করলেন, আপলোড দিবা কবে? বললাম, দিব, দিব। কয়েকদিন পরে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এই সত্যি তোমরা গেছিলা, নাকি চাপা মারতেছ? আমি তো হাঁ। বললাম, চাপা কেন মারব? উনি বললেন, ফেসবুকে তো একটাও দেও নাই, বুঝব কেমনে আসলেই গেসিলা!!
আমরা এতটাই ভার্চুয়াল হয়ে গেছি, আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়, রিয়েলিটি থেকে না হারিয়ে যাই!!
গল্প শেষ করছি আমার প্রিন্সিপাল স্যারের বক্তব্য দিয়ে। প্রেক্ষাপট একটু বলে নেই, ছুটি নিয়ে দার্জিলিং ঘুরতে গিয়েছিলাম পরিবার সমেত। ৮ দিনের ছুটির প্রথম কয়েকদিন মহা উৎসাহে দিনের ছবি দিনে পোস্ট করলেও পরে ক্লান্তি, আলসেমি আর ঘোরাঘুরির আধিক্যের কারণে পরবর্তী ছবিগুলো পোস্ট করতে দেরি হয়ে যায়। ছুটি শেষে যেদিন কলেজে গেলাম, সেদিনই মিরিক ভ্রমণের ছবি দিয়েছি। তো প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে যোগদানপত্র আর দার্জিলিং এর চা নিয়ে হাজির হতেই স্যার বললেন, একি, তুমি না ইন্ডিয়া? স্যার,ছিলাম, আজ জয়েন করতে এসেছি। আমার উত্তর। স্যার বললেন, ফ্লাইট থেকে নেমেই কলেজে আসছ? স্যারের কথা ঠিক ধরতে পারছিলাম না, বললাম না স্যার, গতকাল এসেছি। স্যার বললেন, অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে, আমি তো একটু আগেই তোমার পাহাড়ের মধ্যে ছবি দেখলাম। এতক্ষণে ঘটনা বুঝতে পেরে আমিও দাঁত কেলিয়ে বললাম, স্যার ক্যাপশন দেখেন নাই, ওটা লেট পোস্ট ছিল।
৩২টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
অনেক মজাদার করেই উপস্থাপন করেছ পোস্ট।
আমি মাঝে মাঝে বিদেশে থাকাকালীন ছবির পোস্ট দেই, লিখেও দেই মধ্যে যে আগে গেছিলাম। অনেকেই জিজ্ঞেস করে কবে গেলেন ভাই? এরা লেখা পড়েই না।
ফেইসবুক আলাদা জগতই হয়ে গিয়েছে, জন্মদিনের শুভেচ্ছা দিতে হবে ফেইসবুকে, মোবাইলের ম্যাসেজ কেউ পড়েনা আজকাল।
বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় যাবা? কেউ নিজেদের মধ্যে আড্ডা দেবেনা, সবাই ফেইসবুকে ছবি আপলোড দিতে ব্যাস্ত। পাশের বাসায় আগুন লেগেছে? কেউ ফায়ার সার্ভিসে কল দিবে না, ছবি ভিডিও করে আপলোড দেবে।
একজনের বাবা মারা গিয়েছে, সে কিছু লিখে মৃত্যু সংবাদ পোস্ট দিল। কিছু মানুষ লিখবে – দারুন লিখেছেন ভাই, আনন্দ পেলাম,।
ফেইসবুক আমরা একদিন নিজেরাই বন্ধ করে দেব, সেদিন আসতেছে।
আগের পোস্টের সবার মন্তব্যের জবাব দাও আম্মু। জবাব দেবে জবাব শব্দে ক্লিক করে।
নিয়মিত লেখো,
শুভ কামনা।
শায়লা শারমিন
ধন্যবাদ কাকা। আমারো মনে হয় এটা আমরা নিজেরাই বন্ধ করে দেব। আমি দেখি, দিন দিন জটিলতা বাড়ছে এর জন্য। আমি প্রায়ই আমার একাউন্ট ডিএক্টিভেট করে রাখি।
হালিম নজরুল
দারুন সব অভিজ্ঞতা সম্বলিত লেখাটিতে মুগ্ধ হলাম।
শায়লা শারমিন
ধন্যবাদ জানবেন।
শবনম মোস্তারী
অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে লিখেছেন আপু। আজকাল এই ভার্চুয়াল জগত টা আসলেই ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। সবাই ভার্চুয়াল জগতকেই রিয়েল মনে করছে । ফেসবুক টাকে মানুষ এখন দিনলিপি মনে করে। তারা ভাবে আমরা সারাদিন যা করবো
তার সবই ফেসবুকে দেবো। সেটার নিরিখেই তারা বিচার করবে ভালো আছি না মন্দ আছি।
আমিও ফেবুতে কম আসি।
পার্সোনাল বিষয় গুলি ফেবুতে খুব কম শেয়ার করি।
কিছুদিন আগের একটা ঘটনা বলি,
আমি প্রায় ছয়-সাত যাবত আমার আর বরের কোনো যুগল ছবি আপলোড করিনি, তো আমাদের এক আত্মীয় এবার আমায় জিজ্ঞেস করেই ফেললো বরের সঙ্গে কি আর ঘুরা ঘুরি করোনা, আমি বললাম করি তো। উনি বললেন কই ফেসবুক এ একসঙ্গে কোনো ছবি দাওনা…
আমি পুরাই আকাশ থেকে পড়লাম।
এই হলো আমাদের বর্তমান অবস্থা।
শায়লা শারমিন
হা হা হা… এভাবেই চলছে।
শবনম মোস্তারী
দুঃখীত। ছয়-সাত মাস যাবত হবে..
আকবর হোসেন রবিন
হা হা হা…..লেখাটা খুব মজার ছিলো।
আমি একবার রাঙ্গামাটি গিয়ে দারুণ কিছু ছবি তুলেছিলাম। তো, সেগুলো থেকে দুটো ফেসবুকে আপলোড দিতেই অনেকে জিঙ্গেস করে বসলো, জায়গাটি কোথায়। জবাবে মজার ছলে বললাম ইন্দোনেশিয়ায়। আর এই কমেন্ট দেখেই আমার আত্মীয় স্বজন চৌদ্দ গুষ্ঠির কেউই মনেহয় বাকি ছিলোনা, সবাই আব্বা-আম্মারে কল দিয়ে জিঙ্গেস করতে লাগলো। ছেলে দেশের বাহিরে কখন গেলো। আমাদের বলে গেলো না কেন। হ্যানত্যান। কি একটা অবস্থা!!
শায়লা শারমিন
মানুষের জীবনযাপনের মধ্যে খুব সহজে ঢুকে যাওয়ার সুযোগ ফেসবুক আসার আগে ছিলনা। ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
ফেসবুক কি ঝলক দেখাইছে
আমাদের মাতয়োরা বানাইছে
শায়লা শারমিন
বোকাও বানাচ্ছে বটে!
শামীম চৌধুরী
ভার্চুয়াল তখনই আনন্দ দেয় যখন রিয়েলিটি হয়ে দাঁড়ায়। যেমন আপনি এখনও আমার কাছে ভার্চুয়াল। আনন্দটা তখনই বাড়বে যখন আপনি সত্যিকারে আমার সামনে উপস্থিত হবেন। ভালো বর্ননা হয়েছে।
শায়লা শারমিন
ধন্যবাদ, মন্তব্যের জন্য।
সাখিয়ারা আক্তার তন্নী
আহারে জীবন,
শায়লা শারমিন
এইতো জীবন।
রাফি আরাফাত
মজার ছিলো। আমাদের ভবিষ্যত হয়তো আ্যবনরমাল একটা ভবিষ্যতে পরিনত হবে।
লেখা ভালো লাগছে। ধন্যবাদ
শায়লা শারমিন
ধন্যবাদ, অলরেডি আমরা এবনরমাল হয়ে গেছি। আমার কর্মস্থলের শহীদ মিনারে একদিন দেখি ৭-৮ জন বসে আছে, কেউ কারো সাথে কথা বলছে না, সবার হাতে মোবাইল, তাতেই সবাই মগ্ন। এর থেকে অস্বাভাবিক আর কী হতে পারে।
ছাইরাছ হেলাল
আমার প্রথম কথা হলো এমন সত্যাসত্য কী করে রম্য হয়ে গেল।
খুব গোছানো লেখা, আসলে ফেসবুক থেকে বাইরে থাকা অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে/অসম্ভব করা হচ্ছে।
দেখুন স্রোতের বিপরীতে কীভাবে কতটুকু দাঁড়াতে পারেন।
শায়লা শারমিন
ধন্যবাদ, দেখি, কতটুকু পারি।
এস.জেড বাবু
ফেসবুকে মানুষের যে চেহারাটা দেখা যায়, বেশিরভাগটাই মেকি
–
আমিতো একটু আগেই তোমার পাহাড়ের মধ্যে ছবি দেখলাম
কি সুন্দর সহজ করে, বাস্তবতা লিখে ফেললেন। মুগ্ধ।
শায়লা শারমিন
অনুপ্রাণিত হলাম, ধন্যবাদ।
শাহরিন
একেবারেই বর্তমানে আমাদের অবস্থা তুলে ধরেছেন আপু। কেউ তো পারলে খাবার আগে ও খাবার পরের ছবি তুলেও আপলোড করে। কোথাও গেলে বা নতুন কিছু রান্না হলে খাওয়ার আগে ছবি তুলতে ব্যাস্ত সবাই। সমসাময়িক সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন এটি। খুবই ভালো লেখা। শেয়ার করলাম। ধন্যবাদ।
শায়লা শারমিন
শেয়ার করেন, আপু, বাট আমার নাম দিয়েন না প্লিজ। প্রফেশনাল কিছু কারণে নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাচ্ছি না।
শাহরিন
জ্বি অবশ্যই মনে থাকবে ব্যপারটি।
সাবিনা ইয়াসমিন
সোনেলা উঠোনে আপনাকে স্বাগতম।
বর্তমান জীবনে ভার্চুয়াল জগত কতখানি প্রভাব বিস্তৃত করেছে, তারই নমুনা দেখালেন। ভালো লাগলো পড়ে।
নিয়মিত থাকুন আমাদের পাশে।
শুভ কামনা 🌹🌹
শায়লা শারমিন
অনেক ধন্যবাদ আপু।
ইঞ্জা
ফেইসবুক যেন আমাদের গিলে খেয়েছে, আগে ফেইসবুকে প্রচুর সময় দিতাম, এর জন্মদিন, ওর মায়ের ইন্তেকাল, ওর বিবাহবার্ষিকী কিছুই মিস যেতোনা, এখন এমন অবস্থা যে ফেইসবুককেই বিরক্ত লাগে, এরচেয়ে লেখালেখি করি, ব্লগে দিই৷ এই এখন আনন্দ।
চমৎকার পোস্ট দিলেন।
শায়লা শারমিন
ঠিকই বলেছেন। ধন্যবাদ।
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা আপু
শিরিন হক
এর চেয়ে বড় নেশা কেউ আবিষ্কার করতে পারবে কিনা জানিনা।
বাথরুমে পর্যন্ত এ নেশা প্রভাব ফেলছে অন্যকিছু বাদ দিলাম।
চমৎকার লিখেছেন
শায়লা শারমিন
অনেক ধন্যবাদ।
রেহানা বীথি
কম বেশি ফেসবুক নিয়ে সবার অভিজ্ঞতা প্রায় একই।
ভালো লাগলো আপনার লেখা।