হ্যাকার (২য় ও শেষ পর্ব)

নীরা সাদীয়া ৬ অক্টোবর ২০১৯, রবিবার, ০১:০৭:০৯অপরাহ্ন গল্প ২৮ মন্তব্য

আইডি হ্যাক করা এখন আমার নেশা থেকে চরম নেশায় পরিনত হয়েছে। গতরাতে ঘুমোতে পারিনি, তাই আজ ১০টা অব্দি ঘুমালাম। অবশেষে পাশের বাসার পেরেক ঠোকার শব্দে ঘুম ভাঙলো। জেগে দেখি ৫৭ টা মিসড কল। এত ফোন কে দিলো তাই ভেবে ভেবে ফোন লক খুলে দেখি মিতু সাহা। দ্রুত ম্যাসেঞ্জারে ঢুকলাম। সে লিখেছে, “দোস্ত, মানুষকে কিভাবে পিকচার ট্যাগ দিতে হয়, তাতো শেখাস নি।” আমি এতে অবাক হইনি, তবে পাঠকরা হয়ত একটু অবাক হলেও হতে পারেন। যাই হোক, অনলাইনে যেহেতু এলামই, এখনতো আর বসে থাকতে পারি না। শুরু করলাম কাজ।

রিতু মাধবী
পিয়াস বৈরাগী
রিতু মাধবী নামে একটি মেয়ের আইডি পেলাম, সেটাই হ্যাক করলাম। মেয়েটা প্রোফাইলে কখনো ছবি দেয় না। কিন্তু ইনবক্সে তো কাহিনী উল্টো। রনি, জিকরুল, পিয়াস, রাসেল সবাইকে নানা ঢঙে ছবি তুলে তুলে পাঠিয়েছে। এর মাঝে পিয়াসের সাথে পাঠানো ছবিগুলো ছিলো সবচেয়ে অশ্লীল। আবার পিয়াসের আইডিতে গিয়ে দেখি, ধর্মীয় যত স্ট্যাটাসের ছড়াছড়ি! আরো যেসব স্ট্যাটাস চোখে পরলো, তার মাঝে রয়েছে, “কোন ধরনের নারীকে বিবাহ করবেন নাঃ…”
“কোন ধরনের নারীকে বিবাহ করলে সুখী হবেন”

ইলোরা রালোই
এরকম নাম দেখেই মনে হলো, একটু পাগলাটে টাইপের হবে মেয়েটা। দুপুরে খেয়ে দেয়ে তার আইডিতে ঢুকলাম। মেয়েটা হয়ত তখন ভাত ঘুম দিচ্ছিলো। চ্যাটে ঢুকে দেখি ১৫ মিনিট আগেও ম্যাসেজ পাঠিয়েছে তার বন্ধু সুবর্ণাকে। লিখেছেঃ

ইলোরা: দোস্ত আমি কেক বানাচ্ছি আর ভাবছি, আমার বাবা সরকারি চাকরি করতেন। খুব সৎ ছিলেন। তিনি কখনো এত দামী দামী জিনিস খেতেই পারেন নি। আর এখন তাঁর মেয়ে ইলোরা কেক বানায়, পিজ্জা বানায়, কখনো তৈরি করে চাওমিন। বাবা এসব দেখে যেতে পারলেন না। ভালো মন্দ খাবারের প্রতি বাবার সবসময়ই একটা আকর্ষণ ছিলো।

সুবর্ণা : আমরা এখন যা আয় করি বা খরচ করি, তা দিয়ে যদি নিজের আপনজনদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে না পারি, তাহলে আমাদের এ উপার্জনের মূল্য কোথায়? কি করব এত টাকা দিয়ে?

সাব্বির আল আমিন
এই ছেলেটার আইডিতে শুধু শেয়ার আর শেয়ার। নিজের কোন লেখা নেই। তো এটাতে ঢুকেছিলাম এক বন্ধুর অনুরোধে। সে এই ছেলেটার ভেতরের খবর জানতে চায়। হয়ত সে ছেলেটার প্রতি দূর্বল। মেয়েটার নামটা আর প্রকাশ না করি। তার আইডির চ্যাটে নুরুল হুদার সাথে কথপোকথন :

সাব্বির : বন্ধু খুব বিপদে আছি।
নুরুল : টাকা ঠিকমত তুলেছিস?
: টাকা তুলে হাসপাতালে যাবো, এমন সময় ব্যাংকের সামনে থেকে ছিনতাইকারী সব টাকা নিয়ে চলে গেছে! এখন আমার মায়ের অপারেশন কি করে হবে???

আদ্যোপান্ত পরে যা বুঝলাম, ছেলেটার মায়ের কিডনী অপারেশন হবে। সেজন্য অনেক টাকা দরকার। টাকাটা ব্যবস্থা করে দিয়েছে ফেসবুকের একটা গ্রুপ। এতগুলো টাকা তুলে ব্যাংক থেকে হাসপাতালে যাচ্ছিলো ছেলেটা, মায়ের অপারেশনের টাকা জমা দিতে। এমন সময় সব টাকা ছিনতাই হয়ে গেলো। কে বলতে পারে, ছেলেটার মা আবারো অপারেশন টেবিল থেকে হাসিমুখে নিজ বাড়িতে ফিরবে কিনা?

সাব্বিরের ঘটনাটা পড়ে এতটাই দুঃখ পেলাম যে, আমি আইডি হ্যাক করা বন্ধ করে দিলাম। প্রায় দেড় মাস এসব থেকে দূরে ছিলাম। একদিন হঠাৎ সুবর্ণা আমাকে বন্ধু তালিকায় যোগ করলো। মনে পরে গেলো তার সাথে ইলোরার কথপোকথন। তার সাথে টুকটাক কথা বলে জানলাম সে তিনটে ছাত্রী পড়ায় আর প্রাইভেট ভার্সিটির লেকচারার। সামান্য যা আয় করে, তা দিয়ে বাবা মায়ের শখ পূরণ করে। একদিন গভীর রাতে মনে হলো, দেখি ইলোরাকে সে কি কি লিখেছে:

: জানিস, এবার ঈদে বাবা কাওকে কিছু কিনে দিতে পারছে না বলে মন খারাপ তাঁর। এদিকে আমি যে চাকরিটা করি সেখানে আড়াই মাস হলো, তবু কোন বেতন নেই! আগের কিছু জমানো টাকা ছিলো।তাই দিয়ে বাসার সবার জন্য সামান্য কিছু কিনে আনলাম। তাতে যদি সবার মন ভালো হয়।

:ভালো করেছিস।

কিছুদিন পর…
: শোন, আজ বেতন পেলাম। সব টাকা একত্র করে দেখলাম বিশ হাজারের মত হয়। বাজার থেকে কিছু কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরলাম।

: তারপর?

:আমার মায়ের খুব আক্ষেপ তিনি কোন চাকরি করেন না। তাঁর হাতে কোন টাকা থাকে না।তিনি ইচ্ছেমত খরচ করতে পারেন না। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, বেতন পেলে মার হাতে কিছু টাকা দিব, যেন ইচ্ছে মত খরচ করতে পারেন।

:দিয়েছিস?

: হ্যাঁ। প্রথমে মা বিশ্বাসই করেন না। ভেবেছেন আমি মজা করছি। পরে যখন দেখলেন সত্যি সত্যিই আমি টাকাটা দিচ্ছি, তখন টাকাটা হাতে নিয়ে কেঁদে ফেললেন।

:ইশ আমার বাবা যদি আজ থাকতেন! তিনি নানারকম নতুন নতুন খাবারের স্বাদ নিতে খুব ভালোবাসতেন। ভোজন রসিক ছিলেন খুব। আজ তাঁর মেয়ে কত কি খাবার রাঁধে, কত বন্ধু বান্ধবকে খাওয়ায়। অথচ তিনি খেতে পারেন নি কোনদিন।

:আমরা বন্ধু, বস, কলিগ আরো কত মানুষের জন্মদিন পালন করি, কত কি উপহার দেই, আজ একে কাল ওকে রেস্টুরেন্টে খাওয়াই। অথচ নিজেদের ঘরের মানুষগুলো, সবচেয়ে কাছের মানুষগুলো পরে থাকে অনাদর, অবহেলায়।

:ঠিক বলেছিস
একটা সময় আমাদের শখগুলো কিনতে গিয়ে ওনারা নিজেদের শখগুলোকে ছাইচাপা দিয়েছেন। বাবা মা বেঁচে থাকতে যদি আমরা তাঁদের এই ছোট ছোট চাওয়াগুলো পূরণ করতে না পারি, তাহলে কিসের এত উপার্জন, কিসের এত আয়োজন!

——————

এরপর আমি আর কোনদিন কারো আইডি হ্যাক করিনি এই ভয়ে যে নতুন কোন আইডির ভেতর ঢুকলে যদি ইলোরা আর সুবর্ণার কথপোকথন আমার মনের উঠোন থেকে দূরে সরে যায়! কিছু স্মৃতি হারাতে দেয়া ঠিক না। কিছু স্মৃতি গেঁথে রাখতে হয় মনের গহীনে, জ্বলতে দিতে হয় সুখ তারার মত।

৮৬১জন ৬৯৩জন

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ