প্রায় ৯/১০ বছর আগে আমার বোনের বাসায় একজন রান্নার বুয়া রাখা হয়েছিল, বয়স আনুমানিক ৫৫ বছর হবে, তবে বেশ কর্মঠ। সবাই বুয়া বললেও আমি তাকে নানী বলে ডাকতাম। আমার সাথে বেশ একটু খাতিরও জমেছিল। একদিন তাকে বললাম, নানী তুমি অন্য কাজ করো, আজকে আমি রান্না করি। এক চুলায় গরুর মাংশ, আরেক চুলায় সবজী চড়িয়ে অপেক্ষা করছি। নানী দেখি আমার পাশ থেকে নড়েই না। আমার রান্না দেখছে। বললাম, কই নানী যাও অন্য কাজ করো, কি দেখো? হঠাৎ সে আমার হাত থেকে খুন্তীটা নিয়েই ধুতে শুরু করলো। কিছুই বুঝলাম না, কি হইছে নানী জিজ্ঞাসা করলাম। সে বললো, আমি গরুর মাংশ খাইনা। এতক্ষনে তার চিন্তা আর ঠায় দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণের কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট হলো। যেহেতু সে গরুর মাংশ খায়না, আমি যদি আবার একই খুন্তী সবজি তে ব্যবহার করি সে সবজীও খেতে পারবেনা। এই হচ্ছে তার চিন্তার কারন। পরে তার সাথে গল্পের এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম, গরুর মাংশ খাওনা কেনো? এলার্জি? যেটা বললো, সেটা শুনে মনটা খুবই খারাপ হলো।
নানী একজন হিন্দু পরিবারের মেয়ে ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স যখন ১৬/১৭ বছর তখন তাকে বিয়ে দেয় তার পরিবার। ছোটবেলায় মুক্তিযুদ্ধের কোন এক সিনেমাতে দেখেছিলাম অনেক নৌকায় করে বিয়ের বর-বউ যাচ্ছে। মাথায় প্রশ্ন এসেছিল, যুদ্ধের এতো আতংকের মধ্যেও এতো বিয়েসাদি হতো!! উত্তর টা নিজেই বুঝতে পেরেছিলাম এক সময়। অই সময় অনেক পরিবারই অবিবাহিত মেয়েদের সম্ভ্রমের চিন্তায় তড়িঘড়ি করে বিয়ে দিয়ে দিতেন। যা হবার বিয়ের পরে হোক, অন্তত কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা-মাতা তো আর হতে হবেনা।
অবিবাহিত মেয়ের বোঝা সরে গেলো এক পরিবার থেকে, আর বিয়ের পর তার শ্বশুরবাড়ির পুরো পরিবার জীবনের ভয়ে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে মুসলমান ধর্ম গ্রহন করলেন। ১৬/১৭ টা বছর একটা রীতিনীতির মধ্যে বড় হওয়া মানুষকে আচমকা বলা হলো, এতোদিন যা জেনেছ সব ভুল ছিল, ধুপ ধুনো, ঢোলের মাতন সব আজ থেকে তোমার জন্য হারাম। চার কালিমা আধ ভেঙ্গে হলেও পারো তো!! মানে নাই বা জানলে!! মূর্তির সামনে পাঠা বলি নয়, এখন থেকে গরু, যাকে “মা” বলে পূজো করে এসেছ এতদিন তাকেই বধ করে খুশি করতে হবে তোমার বিধাতা কে।
কতো শত এমনি নানীদের বছরের পর বছরের মানসিক চাপের ভারে নুহ্য এদেশের মাটি, অভিশাপও কি নেই?? পূজোর দিনগুলো এলে আমার মনটাই কেমন আনন্দে ভরে যায়, কত স্মৃতি আছে পূজো ঘিরে, তাহলে নানীর মনটা কেমন করে ওঠেনা??
৩৮টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
তাহলে নানীর মনটা কেমন করে ওঠেনা?? কথাগুলো একেবারে অন্তরে অন্তস্থলে আঘাত পেলো।সমাজ এমনিই মানুষের মন বুঝতে চায় না তার নিষ্ঠুরতার কাছে।সকাল সকাল সুন্দর একটি লেখা পড়লাম শুণ্য আপুর এবং মনও চাঙ্গা হলো দেখি বাকী সময়টা কেমন যায়।
শুন্য শুন্যালয়
ধন্যবাদ মনির ভাই। বাকি দিনটা কেমন গেলো জানিয়েন।
আশা জাগানিয়া
বেঁচে থাকার জন্য আমরা কত কিছু করি।এ শুধু শরীরের বেঁচে থাকা।আত্মা তো মরে যায় জোর করে বা জীবন বাঁচানোর জন্য ভয়ে ধর্মান্তরের দিন থেকে।
পরিবর্তনটা আসলে বাইরের,ভিতরে ঠিকই থেকে যায় আসল আমি।
শুন্য শুন্যালয়
খুব সুন্দর বলেছেন আপু, ভিতরে ঠিকই থেকে যায় আসল আমি। জোর করে এ পরিবর্তনের অভিশাপ ঠিকই লেগে থাকে।
অরণ্য
আমার এক ডাক্তার বন্ধু আমাকে ইদানিং একটা ছবক দিচ্ছে – “Peaceful Coexistence”। আপনার নানীটার কথা জেনে নিজেকে অনেকটা ঐ নানীর মতো মনে হচ্ছে। তবে আমার চেয়ে উনি অনেক উন্নত। উনার তরিকা উনি ঠিক পালন করেন, আমরা অনেকে গুলিয়ে গালিয়ে ধরে নেই তরিকা আমার ঠিকই আছে। আসলে তা নেই মোটেই। অভিনয় করে যাচ্ছি কিন্তু মানতে রাজি নই আমরা।
শুন্য শুন্যালয়
“peaceful coexistance” existance এর মধ্যে contradiction আসতে বাধ্য. ভালো বলেছেন, অভিনয় করে গেলেও মানতে রাজি নই আমরা। জোর করে কি আর তরিকা বদলানো যায়?
স্বপ্ন নীলা
পড়ে নানীর জন্য মনটাই খারাপ হয়ে গেল – আমরা নিজেদেরকে বাঁচানোর জন্য কত কিছুই না করি –কিন্তু মন হতে মানতে পারি কি !!
যখন পড়ছিলাম শেষে এসে মনে হচ্ছিল লেখাটা আরো একটু বড় হলে আরো ভাল হতো, কারণ মন চলে গিয়েছিল আপনি আর নানীর মাঝে —– অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখাটা —
শুন্য শুন্যালয়
ঠিকই বলেছেন আপু, আরেকটু বড় করলে হয়তো ভালো হতো। তবু তো বেঁচে ছিলেন তারা, অনেকে ধর্মান্তরিত হয়েও শেষ রক্ষা পাননি। পাকিস্তানের এক সৈন্য একটা জায়গায় লিখেছিলেন, তাদেরকে অর্ডার দেয়া হয়েছিল একটা গ্রামের নাম মেনশন করে, এ গ্রামের সবাই হিন্দু, একটাকেও যেন প্রানে বাঁচানো না হয়। তারা যখন সে গ্রামে পৌঁছালেন, অই গ্রামের সবাই মুসলমান হয়ে গেছে অলরেডি, কেউ কেউ কোরআন পড়ছিলেন। তবুও অর্ডার ছিল, তাই প্রত্যেককে তারা হত্যা করে।
ব্লগার সজীব
অভিশাপ অবশ্যই আছে আপু।একারনেই দেশে যে শান্তি নেই।ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষুদ্র এক ঘটনা থেকে সৃষ্টি হলো এক জীবন দর্শন।
শুন্য শুন্যালয়
ঠিকই বলেছেন, হয়তো একারনেই শান্তি নেই 🙁 কতোটা মানসিক প্রেশার তাদের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, যাচ্ছে ভাবুন।
আপনাকে তো দেখিই না আজকাল।
কৃন্তনিকা
মন খারাপ হয়ে গেল… বাস্তবতা অনেক ক্রুড়…
শুন্য শুন্যালয়
এই ক্রুড বাস্তবতাকেই মেনে নিতে হয়েছে, হচ্ছে। ঘটনাটা আমাদের জন্য ছোটই, কিন্তু তাদের কাছে?
আমি মাঝে মাঝে ভাবি, যদি আজ আমাকে কেউ এমনি জোর করে ধর্মান্তরিত করে?
ইমন
অভিশাপও কি নেই??
লাইনটা বারবার কানে বাজতেছে ……
শুন্য শুন্যালয়
হ্যাঁ ইমন ভাই, আমার মনের মধ্যেও এটা সারাক্ষনই খোঁচায়।
ইমন
……..~
শুন্য শুন্যালয়
এইটা কি সিম্বল? 🙂
আশা জাগানিয়া
যতই আমরা গোপন রাখি,মনের গহীনে থেকে যায় আসল সুর।যা পাল্টাবে না কোনদিন।আমরা অভিশপ্ত,এটা প্রায়ই মনে হয়।
শুন্য শুন্যালয়
আমার কাছেও এটা মনে হয় প্রায়। জোর করে কিছু পাল্টানো যায়না, যারা তা করতে চায় তারাই ভুল করে, পাপ করে।
নীলাঞ্জনা নীলা
শুন্য শুন্যালয়,আপনার অন্তর্দৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হলাম।আমাদের প্রায় সবার না বলা কথা বলে দিলেন খুব সহজে।কিছু কান্নায় ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়।
শুন্য শুন্যালয়
হ্যাঁ আপু, এতো শুধু একটি লেখা, একটু বোঝার চেস্টা। যারা দিনের পর দিন এই মানসিক চাপের মধ্যে গিয়েছে তারাই শুধু জানে কতটা রক্তক্ষরণ হয়েছে।
জিসান শা ইকরাম
১৯৭১ এ যদিও বেশ ছোট ছিলাম তারপরেও দেখেছি অনেক হিন্দু পরিবার কেবলমাত্র বেঁচে থাকার জন্য ধর্মান্তরিত হয়েছেন।স্বাধীনতার পরে আবার পূর্বের ধর্মে ফিরে গিয়েছেন।
জোর করে কোনকিছুই ১০০ ভাগ পরিবর্তিত হয়না।
অভিশাপ তো আছেই,না হলে দেশের এই অবস্থা কেন হবে?
ভালো লিখেছেন।
শুন্য শুন্যালয়
হ্যাঁ এমন অনেক পরিবার আছে। জানিনা আজকের এই দেশ দেখে তাদের আক্ষেপ আবার ফিরে আসে কিনা। ১৯৭১ এর সেই পাপীদের বীজ এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অই সময়ে কতো হিন্দু পরিবারকে যে অসহায়ের মতো ধর্মান্তরিত হতে হয়েছে! অনিচ্ছাকৃত ধর্মান্তরিত হওয়ার এই খেদ তাঁরা সারাজীবনই বয়ে বেড়ায়।
শুন্য শুন্যালয়
হ্যাঁ আপু। তাদের অসহায়ত্বের অভিশাপ আছেই এদেশে।
খেয়ালী মেয়ে
এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিষ্ঠুরতার ছাপ–যত জানছি ততই ঘৃনা বাড়ছে…
আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাও হিন্দু ধর্মের–তাদের পুজোকে ঘিরে আমাদেরও কতোই না আয়োজন থাকে..অথচো___________…তোমার মতো আমারও খুব জানতে ইচ্ছে করছে আপু, পুজোর সময় নানীর মনটা সত্যি কেমন করতো?….
শুন্য শুন্যালয়
কতোটা যন্ত্রণা তারা বয়ে বেড়ায় ভাবো একবার। আল্লাহ্র কোন বিচারে এই পাপিষ্ঠ মুসলমানরা বেহেশতে যাবে জানিনা।
এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিষ্ঠুরতার ছাপ ঠিক বলেছ। ঘৃণা যত বাড়বে এ দেশের জন্য টান ততই বাড়বে। বহু আত্মত্যাগের ফসল এই দেশ। তার হেফাজত আমরা করতে পারছিনা, এটাই আফসোস।
খেয়ালী মেয়ে
মুসলমান হলেই যে বেহেশতে যাবে এমন কোন কথা নেই আপু…
আফসোস লাগে ভালো মানুষগুলোকে যন্ত্রনায় ছটপট করতে দেখলে,
আর পাপিষ্ঠগুলোকে ভালো থাকতে দেখলে মনের মাঝে পাহাড় সমান ঘৃনা জন্ম নেয়…
শুন্য শুন্যালয়
পাপিষ্ঠগুলোই এই সংসারে ভালো থাকে বেশি রে…
লীলাবতী
ছোট একটি লেখায় কত বিশাল একটি বক্তব্য দিলেন আপু।জোর করে কোন কিছুকেই পাল্টানো যায়না।আমরা বাহির থেকে কতটুকুই বা জানি একজন মানুষ সম্পর্কে?অনিচ্ছায় আমরা অনেক কিছু কেবল মেনে যাই,ভিতরে দহন ঠিকই থাকে।
শুন্য শুন্যালয়
হুম সুন্দর বলেছেন ভত্তাবতী। ভিতরে দহন ঠিকই থেকে যায়। এলোমেলো চিন্তাভাবনা এসে যায় কখনো কখনো।
স্বদেশী যোদ্ধা
নানী হয়তো ভেবেছিলেন ধর্মটা গেলেও নিজে অন্তত আপন প্রাণ এবং সম্ভ্রম নিয়ে বাঁচতে পারবেন । তাই হয়তো ঊনার ধর্মান্তরিত হওয়া ।
শুন্য শুন্যালয়
হ্যাঁ প্রাণ বাঁচানোর জন্য ইচ্ছের বিরুদ্ধে কতকিছু করতে হয় মানুষকে।
স্বপ্ন
অন্তর যায় না পাল্টানো আপু।
শুন্য শুন্যালয়
হ্যাঁ স্বপ্ন, অন্তর কখনো পাল্টানো যায়না।
অলিভার
সময়ের স্রোতে জীবন এগিয়ে যায়, থেকে যায় আক্ষেপ। নানীর মনেও সেই আক্ষেপ জমা রয়েছে।
শুন্য শুন্যালয়
মানসিক চাপও এটা।এখন হয়তো মানিয়ে নিয়েছেন, কিংবা মানিয়ে নেয়ার অভিনয় করছেন।
মেহেরী তাজ
ছবির বাহিরে এই প্রথম শুনছি আপু এরকম কিছু।
এমন টা যদি আমাদের সাথে হতো আমরা কি করতাম??? ভাবতেই তো কষ্ট হচ্ছে। উনি সহ্য করছেন কি ভাবে???
শুন্য শুন্যালয়
এরকম হাজার হাজার পরিবার আছে তাজ, ভেবে দেখো তারা কি সময়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে কিংবা যাচ্ছে। সেটাই, আমাদের সাথে হলে কি করতাম আমরা?