মিলাদ ও শিরনি
ছোটতে গ্রামের পরিবেশে আমার বেড়ে উঠা। আমার শৈশব কৈশোরের সময় গুলি কেটেছে গ্রামীণ মুক্ত আলো বাতাস আর সবুজের সংস্পর্শে।কত মজা কত হাসি আনন্দ আর স্মৃতি মিশে আছে গ্রামীণ পথে ঘাটে। গ্রামের সমবয়সী বন্ধু বা একটু বড় বন্ধুদের নিয়ে ফুটবল, ডাংগুলি, মার্বেল, সাতার সহ কত খেলা খেলেছি। একসাথে আবার হেঁটেছি স্কুলের পথে। সেই আনন্দময় জীবনের একটি ঘটনা বা এখনো ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে আজ আমার স্মৃতিচারণ বা জাবর কাটাও বলতে পারেন।
গ্রামের সহজ সরল মানুষের কাছে ধর্ম বলতে গ্রামের মাওলানারা(মলবি, মৌলভি,হুজুর) যা বলত তাই। তাদের জীবনের ও আখিরাতের জীবনের জন্য শুধু শুক্রবারের নামাজটাই কাফি( যদিও এখন আমাদের গ্রামের মসজিদে বেশ মানুষ হয়)। আর শুক্র বারে তাদের জীবনের নিয়ামক আর একটি ধর্মীয় অনুষঙ্গ হল মিলাদ পরানো। তাই শুক্রবারে মসজিদে ছোট পোলাপানের আমদানিও হত বেশ। তাদের উৎসাহ নামাজের চেয়ে লোভ থাকত নামাজ শেষে মিলাদের শিরনী/ সির্নি/ শিরনি( অনেকের হয়তো তা থাকত না)।
শুক্র বারে নামাজের পরে মৃত বাবা-মা, দাদা-দাদি,ভাই-বোন বা অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের জন্য দোয়া করার বা চাওয়ার একটি বিশেষ পদ্ধতি হল এই মিলাদ। যা এখনো বেশ প্রচলিত আমাদের গ্রামে।
শুরু: নামাজের আগেই শিরনির গামলা আর কলা পাতার আমদানি হত মসজিদে। সামনের কাতারের আগে ফাকা জায়গায় গামলা ও কলাপাতা সহ বেশ পরিচ্ছন্ন কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকত শিরনি। তবে সব সময় কলা পাতা থাকত তা কিন্তু নয়। কলাপাতা নেই মানে শুকনা শিরনি। একেক দিন দেখা গেল ২-৩ জন এক সাথে মিলাদ আর শিরনি দিয়েছে। তখন বাচ্চাদের তো ঈদ। হা খাবার ঈদ
প্রকার: শিরনির প্রকার গ্রামে ২ ধরনের।
১। শুকনা
২। ভেজা
@ গামলায় কলাপাতা নেই মানেই শুকনা শিরনি। তবে গ্রামে বহুল প্রচলিত শুকনা শিরনির মধ্যে উল্লেখ যোগ্য—জিলাপি, খুরমা, সৌদি খেজুর, শুকনা মিষ্টি।
@ আর গামলায় কলা পাতা মানেই ভেজা শিরনি। অর্থাৎ হয় মোরগ পোলাও না হলে খির।
@@ গল্প:
গ্রামের স্বল্প আয়ের মানুষ তার প্রিয় বাবা-মা——– বা অন্য আত্মীয়-স্বজনদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় খুব সহজ সরল বিশ্বাসের সাথে মিলাদ ও শিরনির ব্যবস্থা করে থাকে।
আগের রাতে কর্তা ও কর্তি মিলে পরামর্শ করে কাল শুক্রবার বাবা-মার জন্য একটু দোয়া মাহফিল করা যায় কি না। দুজনে ফিরে দেখে তাদের আর্থিক অবস্থা। কি করলে ভাল হয়। হয়তো বধূটি বলে বড় মোরগটা জবাই করি আর মলের( গেরস্থ/ ধনি/ গ্রামের মোড়ল) বাড়ি হতে কটা চিকন চাল চেয়ে এনে পোলাও রান্না করি। তা মন পুত না হলে মোটা ভাতের চাল দিয়েয় হয় পোলাও। বা তা না হলে বধূটি বলে সকাল সকাল হাটে গিয়ে কেজি খানেক গুঁড় কিনে আন। চাল আছে খির বানিয়ে দিব। বা কেও টাকা দিয়ে বাজার হতে কিনে আনে জিলাপি/খুরমা———-।
সকালে স্বামী বেচারা বাজারে যাচ্ছে, বধূ তার আচল খুলে খুব কষ্টে ডিম বেঁচে জমানো টাকা তুলে দেয় স্বামীর হাতে। এ যেন গ্রামীণ মুসলিম সমাজে চলে আসা এক ভালবাসার নিদর্শন এবং মৃতের আত্মার মাগফেরাত কামনার সহজ উধাহরন।
সকালে বাড়ির বধূটি তার পালিত সবচেয়ে বড় মোরগ টি ধরে (শুক্রবার সকালে) নিজের ভাত খাবার চালের সঙ্গে খুব যত্নের সঙ্গে রেধে দেয় পোলাও। কেও কেও বা পোলার চাল কিনে বা পাশের বাড়ি হতে ধার করে রেঁধে দেয় পোলাও। কেও বা গুঁড় দিয়ে বানিয়ে দেন খির।
@@ মসজিদের অবস্থা:
যে যার মত সুন্নত নামাজ পড়ে খুব মনোযোগ দিয়ে খুতবা শোনা, তা বুজুক আর না বুজুক, এক হরফে ১০ নেকি। তবে এখন অনেক গ্রামে মুল আরবি খুদবা দেবার আগে ঐ বিষয়ে বাংলায় বক্তব্য দেওয়া হয়।পরে দুই রাকাত জুম্মার নামাজ আদায় করে। এর পর আসে চিরায়ত মুনাজাত।মুনাজাত শেষ হলে ঠিক এখনকার তাবলীগ জামাতের মত কেও দাড়িয়ে বলে উঠে —- নামাজের পর ঈমান আমল নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে, ইনশাল্লাহ সব্বাই বসবেন। বহুত ফায়দা হবে।
তেমনি করে মিলাদ ও শিরনির ব্যবস্থা করা লোকটি দাড়িয়ে বলে—– মোর বাপের/মায়ের জন্য মিলাদের ব্যবস্থা করছু, নামাজ শ্যাশ করে কেও যাইও না।
ছোটদের তো যাবার কথায় নাই। শিন্নি কি মিস করা যায়।
@@ মিলাদ: নামাজ শেষে মৌলভি সাহেব তার কিন্নর কণ্ঠে শুরু করেন—-আল্লাহ হুম্মা ছাল্লি আলা—–
মাঝে মঝে হাম নাথ। আর দাড়িয়ে নবী (সঃ) কে সম্মান জানানো। এখন অবশ্য এটি দেখা যায় না।
শেষে লম্বা মুনাজাত—মৃত ব্যক্তির মাগফেরাত ও গুনা মাফ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা মার্জনা । সঙ্গে সঙ্গে নিজের এবং অন্যান্য মৃত ব্যক্তির ক্ষমা প্রার্থনা। এ এক ব্যথা ভরা বান্দাদের মনের আকুল আবেদন নিবেদন মহা পরাক্রম-শিল খোদার নিকট ক্ষুদ্র বান্দার আকুল আবেদন নিবেদন। আল্লাহ কি ক্ষমা না করে পারেন।
@@ কলাপাতা: কলাপাতা গ্রামীণ সমাজে প্লেটের পরিবর্তে ব্যবহৃত জনপ্রিয় তৈজসপত্র/প্লেট।
@@ শিন্নি বণ্টন/বাটা: হাতে হাতে কলাপাতা দিয়ে তাতে শিরনি দিয়ে একে একে বিদায় নেয় মুসল্লিরা। আর শুকনা হলে হাতে হাতে ২-৪টি জিলাপি/ খুরমা দিয়ে বিদায় করা হয়।
সবশেষে মৌলভি কে বিশেষ প্যাকেটে করে শিরনি বেঁধে দেওয়া এবং মিলাদ পড়ানোর জন্য হাদিয়া স্বরূপ ১০-১০০ টাকা পকেটে ঢুকিয়ে দেন( যার যা সামর্থ সে অনুজায়ি। (আমার গ্রামের কিয়াওমিদ্দিন মৌলভি/আমরা বলতাম ফেকা মলবি মিলাদ প্রতি ২০ টাকা নিতেন— ২০ বছর আগের কথা। তিনি অনেক আগেই ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুক)
বিঃ দ্রঃ এই মিলাদ এর চল গ্রাম গুলিতে ভাবা হয় মৃতদের আত্মার মাগফেরাত ও নিজেদের গুনা মাফের একটি পথ। আর রোজার সময় ঠিক ১৫ রোজার পর মৌলভি দের খুব ব্যস্ত সময় কাটে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিলাদ পড়ানোর জন্য। এই জন্য অবশ্য কোন শিরনি দেওয়া হয় না। তা দেওয়া হয় ইফতারের সময় মসজিদে। আর বাড়ি বাড়ি আগেই দাওয়াত দেওয়া হয় আজ বিকেলে মিলাদ।
৫টি মন্তব্য
স্বপ্ন নীলা
দিলেন তো মনে করিয়ে কলা পাতায় শিরনী খাওয়ার কথা !! কোথায় পাই বলুন তো সেই দুর্লভ মজাদার খাওয়া — ইস কত দিন খাইনা — মাঝে মাঝে হারিয়ে যাই সেই সব দিনগুলোতে —
আন্তরিক ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য ——
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
হূম পুরানো স্মৃতি জেগে উঠল -{@ ।
খসড়া
ওহ সেই স্মিতি আমরা এখনও করি কেউ মানুক আর না মানুক, তবে মানতে বাধ্য ও করি হাসি আনন্দ তথ্য ও ভালবাসাদিয়ে।
পুষ্পবতী
মসজিদের শিরনি মানে অনেক কিছু। আমরা ওইটাকে তবারুক বলি। খুব আগ্রহ করে খাওয়া হতো। কিন্ত শেষ কবে খেয়েছিলাম মনে নাই।
ভালো লাগলো ভাইয়া। ধন্যবাদ। -{@
জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
অনেক ভাল লাগল লেখাটি —- আবার পড়ব ভাইয়া —।।