পরওয়ানা
************
প্রথম পর্ব
জন স্যাডিন।
দীর্ঘদেহী মানুষ সে। লালচে হ্যাটের ব্রিমের নিচে রোদে পোড়া মুখ কেমন শান্ত নির্লিপ্ত। চোখ জোড়া কালো কুচকুচে , আর সবসময় কেমন একটা হাসি হাসি ভাব খেলা করে।প্রশস্ত কাঁধ, সুঠাম দেহের সঙ্গে মানানসই লম্বা হাত। ভেষ্টের নিচে হালকা আকাশী সার্ট পরনে, গলায় কাল ব্যান্ডনা পেঁচানো। পায়ে রং জ্বলা বুট। কোমরে দুই পাশে হোলস্টারে বাঁধা নেভি কোল্ট। আর পিছনে বেডরোলের সঙ্গে বিশেষ ভঙ্গিতে বাঁধা স্ক্যাবার্ডে স্পেন্সর পয়েন্ট ফাইভ-সিক্স রাইফেল।
সান্তাফে পার হয়েছে ও চার দিন হল। শুনেছে সামনেই ছোট একটা শহর আছে। ওর গন্তব্য সেখানেই। অনুমান মতে শহরটার খুব কাছে পৌঁছানোর কথা ওর আজ। আর তখনিই দুই তিন মাইল দূরে শহরের ঝাপসা বাড়ি ঘরের আভাস ।
ওহ আর একটি নতুন শহর, নতুন মানুষ, নতুন কিছু দেখা। মনে মনে কেমন এক ধরনের থ্রিল অনুভব করল জন স্যাডিন। সঙ্গে মনের অতি পরিচিত ভাবনা —
ওর ভবঘুরে দীর্ঘ পথ চলা শেষ হবে কি এই কাঙ্ক্ষিত শহরে?
না আবার ছুটে চলা।
ক্যানসাস সিটি ,এবিলিন, ডজ সিটি মাঝে আরও বেশ কয়েকটা ছোট বড় শহরে ওর পায়ের ধুলো পড়েছে প্রায় এই এক বছর হতে চলা সময়ে।
চারদিন আগে সান্তাফেতে কিছু খোঁজ খবর নিয়ে দেখেছে জন । ওর টার্গেট নেই এখানে। তবে এমন কিছু প্রমাণ পেয়েছে যা প্রমাণ করে মাস তিনেক আগেও সান্তাফেতে দেখা গেছে টার্গেট কে। তার পর স্রেফ উধাও হয়ে গেছে। কারও কাছে আর কিছু জানতে পারে নি । তাই আবার বের হয়ে পড়েছিল।
আর সামনেই ওর কাঙ্খিত রিক সিটি। জনশূন্য শহরটার একমাত্র ধূলি-ধূসর রাস্তা। দূর হতে কেমন মরা মরা খাঁ খাঁ নির্জন লাগছে শহরটাকে। ভর দুপুর বলেই কি?
বাতাসে সূর্য তাপের দাহ। মাথার উপর সূর্যও যেন আগুনের গোলা নিক্ষেপ করে চলেছে।
শহরের মাঝ বরাবর এসে জন তার সোরেল ঘোড়া সহ থেমে দাঁড়াল।পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে চারপাশ দেখছে জন ।
এই সময় শহরের নিরবতা ভেঙ্গে খান খান করে রাস্তার অদূরে একটি নেড়ে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ওর উপস্থিতি জানিয়ে দিল শহরময়।
আসলে শহরটা দেখার ফাঁকে ফাঁকে খাবার পাওয়া যায় এমন কুকশ্যাক আর আস্তাবলটা খুঁজছে।
কারণ পেটে আগুন জ্বলছে ক্ষুধায়।সেই সূর্য উঠার আগে শুকনো জার্কি আর কড়া এক কাপ কফি খেয়েছে।
সোরেলটাও কাহিল। নিজের আর ঘোড়ার জন্য পানি আর খাদ্য ছাড়া ওর মাথায় এখন আর অন্য কিছু কাজ করছে না। একপলকে দেখা শহরটাকে তেমন সমৃদ্ধ মনে না হলেও খারাপও না। পশ্চিমের গড়পড়তা শহরগুলির মতই।
ঘোড়াটাকে হাঁটিয়ে আস্তাবল লিখা সাইনবোর্ডের দিকে এগিয়ে চলল জন। চলার ফাঁকে পকেট হতে দোমড়ান একটা সিগেরেট ধরিয়ে গল-গল করে নাকমুখ দিয়ে ধোয়া ছেড়ে দিল। আর কেমন এক প্রস্থ স্বস্থির ভাব ফুটে উঠল চোখে মুখে। আস্তাবলে বৃদ্ধের কাছে ঘোড়াটা গছিয়ে সামনের স্টার স্যালুনে গিয়ে ঢুকে পড়ল জন।
নতুন শব্দঃ
হ্যাট-—টুপি
ব্যান্ডনা— রুমাল বিশেষ
ভেষ্ট—পাতলা সাটের উপর পরার এক ধরনের জামা। মুজিব কোটের মত।
সোরেল—এক জাতের ঘোড়া।
আস্তাবল—ঘোড়া রাখার স্থান ।সঙ্গে ঘোড়ার যত্ন ও খাবার সার্ভিস দেয়।
স্যালুন—মদ, খাবার আর আড্ডা দেবার স্থান। আমাদের বর্তমান খাবার হোটেল গুলির মত।
জার্কি—- প্রক্রিয়া জাত গরু/মহিশ এর শুকনা মাংশ।
কুকশ্যাক—শুধু খাবার পাওয়া যায় এমন হোটেল।
বেডরোলের—রাত কাটাবার বিছান, কাপড়, বর্ষতি ইত্যাদি নিয়ে বাঁধা পোটলা/ব্যাগ।
************
পর্ব—২
———
অত্যুজ্জল আলো হতে স্যালুনে ঢুকে স্যালুনের আধো অন্ধোকার পরিবেশ ওকে অন্ধ করে দিয়েছে।তাড়াহুড়া করে বড় একটা বোকামি করে ফেলেছে ও। আলো সয়ে এলে ভিতরটা দৃষ্টিগোচর হলো।
ব্যাট-উইংডোর এর বিরক্তকর কচকচানি শব্দে ভিতরে বসা সবার দৃষ্টি যে ভাল করে আকর্ষিত হয়েছে তা সকলের ঘুরে তাকানো দেখেই ঠিক বুজল জন।
উচু টেবিলের পেছেন হতে হোঁৎকা শরীরের বারটেণ্ডার পিট পিট করে তাকিয়ে ওর দিকে। তার চোখে মুখে স্পষ্ট জিজ্ঞাসা খেলা করছে। চোখে চোখ পড়তেই ঘুরে বারে সাজানো বোতল ঠিক করার ভান করল অখন্ড মনোযোগ নিয়ে।
স্যালুনের কর্নারে পিছনের একটা টেবিল ঘিরে বসা চার জন।একপলকেই জন বুজল এক একটা কঠিন চিজ এরা। তা ছাড়া ফাঁক গোটা স্যালুন। চারজনের দল্টার সঙ্গে চোখা চোখি হলো। সবার দৃষ্টিতে অনুসন্ধানের একটা ভাব খেলা করছে। তবে খুব বেশিক্ষণ কেও তাকালনা ওর দিকে। নিলিপ্ত একটা ভাব নিয়ে আবার খাওয়ার কাজে মন দিল।
হেটে বারটেণ্ডারের টেবিলের নিকট পৌঁছে বারটেণ্ডার এর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে টেবিলে মৃদু টোকা দিল জন। মুখে মধুর হাসি নিয়ে ঘুরে তাকাল হোঁৎকা।
জনও ভদ্রতার হাসি হেসে প্রশ্ন করল—- সিনর, হাত মুখ ধোবার ব্যবস্থা আছে?
নিঃশব্দে হাতের ইশারায় পেছেনের দিক দেখিয়ে দিল বারটেণ্ডার। সে দিকে যাবার আগে একগাদা খাবারের অর্ডার দিল জন।
পরিষ্কার হয়ে এসে ঢুকতেই ওয়েটার নিগ্রো একটা মেয়ে খাবার দেবার টেবিলটা দেখিয়ে দিয়ে নীরবে প্রস্থান করল।
মেয়েটাকে উদ্ভিন্ন যৌবন যে কোন পুরুষের মতিভ্রম ঘটাতে সক্ষম। হঠাত কোন মাতালের পাল্লায় পড়ে দুর্ঘটনাও বিচিত্র নয়। তবে এই সুদূর পশ্চিমেও মেয়েদের সম্মানের চোখে দেখা হয়। যদিও কথাটা শুধুমাত্র শেতাঙ্গ মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মেয়েটির নিতম্বের দুলুনি দেখতে দেখতে টেবিলে বসতেই খাবারের ঘ্রান পেটে কেমন মোচাড় দিয়ে উঠল জনের। প্লেটটা টেনে নিয়ে গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করল ও।
প্রথমে গম আর জবের রুটি দিয়ে গরম গরুর মাংসের সঙ্গে টমেটুর সালাড।
আহ ! যে রেঁধেছে তার রান্নার হাতের প্রশংসা করতেই হয়। নিঃশব্দে খেয়ে চলেছে জন। বারটেণ্ডারের সংগে বার কয়েক চোখাচোখি হয়েগেল ওর। লোকটা কেমন স্থির, নিষ্কম্প দৃষ্টিতে ওকে জরিপ করে চলেছে ।
সবশেষে আপেল পাই দিয়ে খাওয়া শেষ করল জন। পানি খেয়ে আপনা আপনিই বড্ড বেমানান একটা স্বস্থির ও তৃপ্তির ডেকুর উঠে আসল।
কফির অর্ডার করতেই কিছুক্ষণ পরে আবার নিগ্রো সুন্দরী হাজির পট নিয়ে। সাদা দাতের ঝলক হাসি আর চোখের মদির কটাক্ষ হেনে নিতম্বের ঢেউ তুলে হারিয়ে গেল অন্দরে।
নতুন শব্দঃ
ব্যাট-উইংডোর— এক প্রকার দরজা। যা ঠেলে ঢুকলে আবার আপনা আপনি লেগে যায়।
বারটেণ্ডার—বারে মদ সারভ করে /হোটেল ম্যানেজার।
সিনর—নতুন কাওকে সম্বোধন করার মেক্সিকান রীতি।
ওয়েটার—হোটেল কর্মী।
নিগ্রো—-কালো চামড়ার (আফ্রিকান বংশভুত )মানুষ।
শেতাঙ্গ—শাদা চামড়ার মানুষ।
আপেল পাই—আপেল ও দুধের সংমিশ্রণে রাধা কেক।
************
পর্ব—তিন
আয়েস করে কফির পটে চুমুক দিতে দিতে খোলা জানালা পথে বাইরে তাকাল জন। জনশূন্য শহরটার শেষ প্রান্ত পর্যন্ত চোখে পড়ছে। শহরে ঢোকার সময় যেমন দেখেছিল ঠিক তেমনি জনশূন্য ধূলি-ধূসর রাস্তা।
টেবিলে বসেই একটু চড়া স্বরে বারটেণ্ডার কে উদ্দেশ্য করে বলল—
সিনর, বোর্ডিং হাউসটা কোন দিকে?
হোঁৎকা উপরের দিকে হাতের ইশারা করে বলে উঠল—দোতালায় আমাদের নিজস্ব বোর্ডিং, ইচ্ছে হলে থাকত পার সিনর। অবশ্য পছন্দ না হলে আরও আছে।
এই শরীর নিয়ে বাইরে আর খোঁজার প্রবৃত্তি নেই জনের। ভাল আর মন্দ যাই হোক এখানেই উঠবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো ও। কফি পটে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়াল জন। বার টেবিলের সামনে গিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বলল–
আমার একটা রুম লাগবে সিনর। বাট আমার একটা কৌতূহল মিটাবে সিনর?
তোমাদের,মানে এই রিক সিটিকে মনে হচ্ছে অতি বেশি শান্ত আর ঝামেলা মুক্ত। অবশ্য শান্ত আর ঝামেলা মুক্ত শহর আমার খুব পছন্দ।
তুমি বলছ, তুমি কিছুই জান না?
কি বিষয়ে বলছ, আমি ঠিক বুজতে পারছি না। আর আমি এই শহরে একজন আনকোরা আগন্তুক। সান্তাফে হতে আসছি।
বুঝেছি ম্যান।কি বলব কি দিয়ে শুরু করব ঠিক বুঝছি না। ইতি মধ্যে আমরা বেশ কয়েকজন ভাল এবং সাহসী মানুষ হারিয়েছি।এ সব বলতে আমার বেশ কষ্ট হবে।কোনায় বসা টেবিল লক্ষ করে হোঁৎকা বলে উঠল– মি জোন্স প্লীজ হেল্প মি। ভিতরে হারিয়ে যাওয়ার আগে হোঁৎকার চোখে মুখে ঠিক কষ্ট দেখতে না পেলেও কেমন একধরণের অস্বস্থি লক্ষ করল জন।
কর্নারে বসা চারজনের মধ্যে একজন উঠে দাঁড়াল। ওর সামনে এসে হাত বাড়িয়ে দিল।
আমি জোন্স রোনাল্ড ।
আমি জন স্যাডিন। হাত ঝাঁকিয়ে ছেড়ে দিল জন।
পাশের একটা টেবিল দেখিয়ে ওকে বসতে অনুরোধ করল মি জোন্স।
মুখ মুখি বসে নীরবে এক ঝলক লোকটাকে পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে দেখে নিলো জন।
জোন্স রোনাল্ড নাতিদীর্ঘ বিশাল কাঠামর মানুষ। মাথার সামনে চুল কমে এসেছে, বয়স অনুমানিক ফরটি ফাইভ হতে ফিপটির মাঝা মাঝি। সেকহ্যান্ড করার সময় বুঝেছে লোকটা অসম্ভব শক্তিশালী। তার হাতের বাইসেপ আর বুকের পেশি হতে যেন শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। খৌরি না করা থুতনিতে দুই তিন দিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি। নিষ্প্রভ চোখে হতাশার চিহ্ন।
নিগ্রো মেয়েটা নিঃশব্দে টেবিলে হুইস্কির গ্লাস রাখতেই দুজনে নিঃশব্দে দুজনের উদ্দেশ্যে উইশ করে গ্লাসে চুমুক দিল ওরা।
অবশেষে জনই মৌনতা ভেঙ্গে বলে উঠল— নাম তো জেনেছ, আর বিশেষ কিছু বলা মনে হয় অপ্রয়োজনীয়। এবার সিসেম ফাঁক কর ম্যান। আমি ভীষণ টায়ার্ড।
ইয়েস সিনর। আমরা মানে এই চারজন আজ আট দিন ধরে এই হতভাগ্য শহরে আটকে আছি। পাশের একটু দূরের টেবিলের বাকি তিনজনের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করল জোন্স।
যেদিন এই শহরে পৌঁছলাম সেই রাতে কে বা কারা অতর্কিত হামলা করে মার্শাল আর তার দুই ডেপুটি কে গুলিতে ঝাঁজরা করে ফেলে যায়। তিনজনকে চেনার কোন উপায় ছিলনা।
পরের দিন এই বারটেণ্ডার এর ছেলেকে মার্শাল নিযুক্ত করে পসি বাহিনী করে ওদের ব্যাক ট্রাক অনুসরণ করে। কিন্তু সবাই ফিরে আসে লাশ হয়ে। সে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য সিনর। গোটা শহর কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল সেদিন।
পর পর দুইজন সেরা লোককে মার্শাল নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু দুইজনের কেওই এক রাতের বেশি বাঁচেনি। শহরের মানুষ ভিত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। সবার আশংকা, এবার বড় আক্রমণ আসছে এবং ধ্বংস হবে শহরটা।
( চলমান———-)