প্রিয় মর্ত্যবাসী,
কেমন আছ সকলে? জানি, আমার চেয়ে ভাল আছ। তাই আজ আর চিঠিতে কোন প্রকার শুভেচ্ছা দিতে পারলাম না। কি দেব বলো? এখানে গোলাপ নেই, পায়ড়া নেই, ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক নেই, রাত জাগা তারা নেই, জোনাক জ্বলা রাত্রি নেই, নেই কালো কেশের দিগন্তজোড়া আঁধার। কারণ আমি নিজেই এখন সবুজ পৃথিবীর সমস্ত আলো আঁধারি মায়া ছেড়ে ছিটকে গেছি, রয়েছি কোন সীমাহীন গোলকধাঁধাঁয়, যেখান থেকে মুক্তির আর কোন পথ খোলা নেই।
অভিমানে আর গ্লানিতে আমি নিজেই বেছে নিয়েছিলাম এ গোলকধাঁধাঁর পথ, তখন একবারো ভাবিনি এ সবুজ পৃথিবী, অপূর্ব রূপসী জন্মভূমি, স্নিগ্ধ, শান্ত মাতৃকোল, বাবার প্রশান্ত স্নেহভরা মুখ, কোন কিছুই আর কোনদিন দেখতে পাবনা। কখনো ভাইয়ের সাথে খুনসুঁটি হবে না, বুবুর বিয়েতে আমি থাকব না! অথচ কত রঙিন স্বপ্ন দেখেছি, কত হুল্লোর করব বলে ভেবে রেখেছিলেম! বর আসবে, গেট ধরব, দুষ্টুমি করব অারো কত কি! সেসব আর কিছুই হল না। আমি আংটি আর পায়েল বড্ড ভালবাসতাম। বুবু বলেছিল, চাকরি পেয়ে সুন্দর একটা পায়েল আর এত্তগুলা আংটি কিনে দেবে। এখন আর কিচ্ছু চাই না রে। শুধু তোদের কাছে আবার ফিরতে চাই, তা কি সম্ভব? জানি সম্ভব না।আমার এ চিঠি তোদের কাছে আদৌ পৌঁছবে কিনা, তাও জানি না। যদি পৌঁছে, আমার ডায়েরীগুলো গুছিয়ে রাখিস বুবু, কাওকে পড়তে দিস না। আমি চাই না, এগুলো পড়ে কেউ আমার বেদনায় নীল হোক। ওর কথা জেনে কেউ গালাগাল দেবে ওকে, তাও যে আমার সইবে না। বড্ড ভালবেসেছিলাম রে। তুই তো জানিস বল। তবে এখন বুঝে গেছি, নিজের চাইতে বেশি ভাল আর কাওকে বাসতে নেই। তোরা যত পারিস কেঁদে নে, আমার জন্য অশ্রু বিসর্জন দেবার আর যে কেউ নেই!
ঐতো মা, মা…ও মা, বড্ড গলাটা শুকিয়ে গেছে।প্রচন্ড উত্তাপ এখানে। ঐ তিনতলা বিল্ডিং এর এক কোণে একটা জানালা ছিল, কিন্তু এখানেতো একটাও জানালা নেই। কি করি আমি? হায়রে, মা তুমিতো আমার ডাক শুনতেও পাও না। বাবা, মা, বুবু, ভাই সবাইকে আমি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তারা আমাকে দেখছে না। কী অসহায় বোধ করছি আমি, কিযে দু:সহ যন্ত্রনা, তা বলে বোঝানোর নেই। প্রতিটি মুহূর্তে পিঁপড়ে, জোঁক, সাপ সহ নানা নাম না জানা ভয়ঙ্কর প্রানি আমাকে আক্রমণ করছে, ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে এই দেহটাকে। এখানকার তেলাপোকাগুলো আরো বেশি ভয়ঙ্কর। কি করি এখন? হাত পাও নাড়াতে পারছি না। অথচ কদিন আগেই, তেলাপোকা দেখলে লাফিয়ে উঠতাম! মাকে জড়িয়ে ধরে তাঁর বুকে মুখ গুঁজতাম, আর সেই আমি এখন কী ভয়ানক যন্ত্রণার মাঝে আছি, তা যদি মা দেখতে!
আচ্ছা, মারিয়া, দীনা তোরা কেমন আছিস? এখনো তেঁতুল ভর্তা, বড়ই ভর্তা, ঝালমুড়ি আর ফুচকা কিনে খাস তোরা, ঐ মোড়ের মামাটার দোকান থেকে? মনে পড়ে এই আমিই নাকি অন্ধকারকে খুব ভালবাসতাম!
অথচ, পাতালপুরীর এই অন্ধকার আজ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে! যার কারণে একদিন স্বেচ্ছায় এই নরককে বেছে নিয়েছিলাম, সেও কি আসবে আমার কাছে? নিজের ভুল বুঝতে পেরে সেও কি স্বেচ্ছায় নরককে গ্রহন করবে আমাকে সঙ্গ দেবার জন্য? এখানে যোগাযোগের জন্য কোন নেট নেই, নেই চিঠি পৌঁছানোর পায়ড়া কিংবা ডাকপিয়ন। তবু কী সুন্দরভাবে আমি সকল পাতা কিংবা মুখচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। কী অবাক ব্যপার তাই না? এইতো সে,সবুজ বাতিতে আছে! আমার দেয়া বার্তাগুলি পড়েছে নিশ্চই। হুম, পড়েছে! কিন্তু উত্তর না লিখেই বার্তা কুঠুরী ত্যাগ করছে কেন? আমি দেখতে পাব না বলে? ও এখনো সেই বোকাই রয়ে গেল। একটা উত্তর লিখলেই পারত! আমি দেখি বা না দেখি। কিন্তু না, ওর কক্ষে আরো কত আবেদন জমা পড়েছে, সেগুলোকেই ঘাটছে, নাড়াচাড়া করছে। এত দ্রুত সব সয়ে গেল তার? আর আমি কিনা সইতে না পেরে……
আচ্ছা, আমিই তো একদা নিঃসঙ্গতা সইতে পারতাম না। অথচ আজ এ কি করলাম? সাময়িক নিঃসঙ্গতা থেকে বাঁচতে মহাকালের নিঃসঙ্গতায় ঝাঁপ দিলাম? আরে আমি কত বোকা! মা, আর কেঁদোনা তোমার এ বোকা মেয়েটার জন্য। বাবা, মা পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও। বুবু, তোর বিয়েতে সবই হবে, শুধু আমিই রইব নারে। ভাইটি আমার, বড় হয়ে ভুলে যাস, তোর মেঝদি তোকে ক্লাউড ক্যান্ডি আর পিংপং বল এনে দেয়নি, লাটাইয়ের সূতোটা পরিয়ে দেয় নি, ঘুড়িটা আকাশে উড়িয়ে দেয়নি, তার আগেই তোদেরকে ঠকিয়ে নিজেও হেরে বসে আছে।
আমি যে সবদিক থেকে হেরে গেছি, তা বুঝতে পেরেছিলাম ঠিকই, কিন্তু তখন আমার আর কিছুই করার ছিল না। বড্ড দেরী হয়ে গেছিল। পৃথিবীটা তখন আরো সুন্দর লাগছিল। কী মায়াময় এ পৃথিবীর রঙ, রূপ, আর কী স্নিগ্ধ জীবনের প্রতিটি স্পন্দন! আগেতো বুঝিনি। যখন বুঝেছি তখন বারবার চিৎকার দিয়ে বলতে চেয়েছিলেম, “বাঁচতে চাই”। জীবন তখন ভর্ৎসনা করে একগাল হেসে আমাকে জানাল,
“এ পরিণতি তুমি স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছ।এখন আর কিছুই তোমার হাতে নেই।”
ইতি,
নরকবাসী,
আত্নখুনী।
৩০টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
কত হাহাকার! মহাকালে চলে গিয়ে মহাকালের সময়কার অবস্থা বর্ননা করে কিছু লেখা সত্যি কঠিন। এই সুন্দর জগত, মায়াকে পরিত্যাগ করে চলে যাওয়া এক মেয়ের মর্তের জন্য ক্রন্দন ভালভাবেই ফুটিয়ে তুলেছ চিঠিতে। যার উপর অভিমান করে চলে যাওয়া সেই এখন অন্য কিছু খুঁজছে।
এমন,আত্মহনন কাম্য নয়।
চিঠিটি খুবই ভাল হয়েছে।
শুভ কামনা।
নীরা সাদীয়া
hm অসংখ্য ধন্যবাদ। আমার চিঠির বিষয়বস্তু একটু অন্যরকম। সেটা আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম দাদা।
শুভকামনা।শুভরাত।
নীলাঞ্জনা নীলা
ভাবনা এবং বিষয়বস্তু দারুণ। যারা আত্মহত্যা করে, আমি তাদেরকে ঘৃণা করি। যতো যা কিছুই হোকনা কেন, মুখোমুখি হতে হবে সেই সব সমস্যার। পিছিয়ে যাওয়া মানেই হেরে যাওয়া। আর যে নিজেকে খুণ করে, সে কাউকেই ভালোবাসতে পারেনা। এই চিঠিটা সেই সব মানুষদের জন্য কাজে আসবে, যারা নিজেকে মেরে ফেলতে চাইছে। অনেক সুন্দর একটা পৃথিবী। শুধু একজনের জন্য সকলের ভালোবাসা ভুলে যাওয়াটাকে বলে স্বার্থপরতা।
আপনি দারুণ একটা চিঠি লিখেছেন। ভালো লেগেছে খুব।
নীরা সাদীয়া
ঠিক বলেছেন। এরকম চিন্তাধারী মানুষকে উদ্দেশ্য করেই এ চিঠিটা লিখা। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। খুব ভাল থাকবেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপনিও ভালো থাকবেন নীরা।
তেলাপোকা রোমেন
একান্ত ব্যাক্তিগত মৃত্যুর নাম আত্মহত্যার মতো একটা বাজে শব্দে আটকে যাচ্ছে। যে কেউ চলে যেতে পারে, চাইলেই যখন-তখন। শুধু একটা অনুরোধ চলে যাবার জন্য নিঃশ্বাসের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে নিন। আপনার চলে যাবার ইচ্ছে হতেই পারে। অথচ ফুলের সাথে, ঘাসের সাথে গোপন পরিণয় করে নেওয়া, বাতাসের দোলনায় দোল খাওয়া নিঃশ্বাসকে থামিয়ে দেওয়ার কোনো অধিকার আপনার নেই।
নীরা সাদীয়া
যারা নিজেকে নিজেই খুন করে তাদেরকে সচেতন করার জন্যই এ লিখা। নিজেকে নিজে খুন করার পর তারা কি পেল,কিংবা পাবে সেটা নিয়েই লেখা। যেন তারা সচেতন হতে পারে। আর একটি প্রাণও অভিমানে ঝড়ে না পড়ে।
ধন্যবাদ। শুভ সকাল।
নীরা সাদীয়া
যাই হোক, আমি কি বোঝাতে ব্যার্থ হলাম কিনা জানি না। তবে আপনি পুরোটা পড়েছিলেন কি ভাইয়া?
প্রহেলিকা
শেষ চিঠি শিরোনাম পড়েই অনুমান করেছিলাম ভেতরে কি আছে। যাইহোক এ কেবলি কাল্পনিক ধরে নিচ্ছি। এসব এড়িয়ে যাওয়া দরকার আমাদের। ভাবনাগুলোকে উস্কে দেয়। চিঠি খুব ভালো হয়েছে, আবেগের প্রতিফলন।
প্রতিযোগিতায় সাফল্য কামনা করি।
নীরা সাদীয়া
hh হুম। অবশ্যই কাল্পনিক। কারণ যে মারা গেছে সে মৃত্যুর পর ওখানে কি দেখল, কি পেল তাতো আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব না। জানিনা আপনি পুরোটা পড়েছেন কিনা,কিংবা আমি চিঠিটা বোঝাতে পেরেছি কিনা। কারণ এটা উষ্কানিমূলক তো নয়ই, বরং যারা আত্নহত্যা করে বা করতে চায় তাদেরকে সচেতন করার জন্য লিখা।
নীরা সাদীয়া
হুম। অবশ্যই কাল্পনিক। কারণ যে মারা গেছে সে মৃত্যুর পর ওখানে কি দেখল, কি পেল তাতো আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব না। জানিনা আপনি পুরোটা পড়েছেন কিনা,কিংবা আমি চিঠিটা বোঝাতে পেরেছি কিনা। কারণ এটা উষ্কানিমূলক তো নয়ই, বরং যারা আত্নহত্যা করে বা করতে চায় তাদেরকে সচেতন করার জন্য লিখা।যারা নিজেকে নিজেই খুন করে তাদেরকে সচেতন করার জন্যই এ লিখা। নিজেকে নিজে খুন করার পর তারা কি পেল,কিংবা পাবে সেটা নিয়েই লেখা। যেন তারা সচেতন হতে পারে। আর একটি প্রাণও অভিমানে ঝড়ে না পড়ে।
ধন্যবাদ। শুভ সকাল।
প্রহেলিকা
না পড়ে কখনোই মন্তব্য করি না। যাইহোক আমিও কিন্তু একই কথা বলেছি। যখনই কোনো লেখা কারো ভাবনাকে উস্কে দিতে পারে তখনই সে সচেতন হয়।
ধন্যবাদ আপনাকেও।
নীহারিকা
এ দেখি অন্যরকম চিঠি।
দারুন লাগলো!
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ আপু। শুভকামনা রইল।
আমির ইশতিয়াক
অন্যরকম। ভালো হয়েছে।
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা জানবেন।
ছাইরাছ হেলাল
নরকের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়ে ফেলছেন দেখি!!
আবার নস্টালজিক হচ্ছেন ফেলে যাওয়া পৃথিবীর কথা ভেবে,
চিঠি লেখার হাত তো দেখছি দারুণ,
প্রাকটিস করেন নাকি, এ যুগেও সখের বসে!!
নীরা সাদীয়া
vv না ভাইয়া, এই যুগে কেউ চিঠির প্র্যাকটিস করতে পারে বলুন? তবে প্রেম পত্র না লিখা হলেও প্রবাসী বাবা ও নিজ বান্ধুবীদের অনেক চিঠি লিখেছি ছোটবেলায়। তবে তখন চিঠি লিখতাম মজা করার জন্য,কাওকে ভূতের ভয় দেখানোর জন্য ইত্যাদি। অসংখ্য ধন্যবাদ। শুভকামনা।
মিষ্টি জিন
একেবারেই অন্যরকম চিঠি।
এ চিঠি কল্পনাতেই থাক। কেউ নিজেকে খুন করুক তা একদমই চাই না।
খুব ভাল হয়েছে লেখা।
প্রতিযোগিতা বেশ জমে উঠেছে।
নীরা সাদীয়া
আর কেউ যেন নিজেকে খুন না করে সেই সচেতনতা তৈরির উদ্দশ্য নিয়েই এ চিঠি লিখা। কেউ পুরোটা পড়লে বুঝতে পারবে মৃত্যুর পর তার কি অবস্হা হতে পারে। তাই সে যেন আত্নখুন না করে, তা বোঝানোর জন্যই কাল্পনিক এ চিঠি।
ধন্যবাদ। শুভকামনা।
নীরা সাদীয়া
একদম ঠিক বলেছেন। অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা রইল।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
একজন আ্ত্মহত্যাকারীর পরকালীন জীবন আরো অনেক বেশী ভয়াবহ হবার কথা! আপনি সেভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন নি। শরীরের লোম খাড়া হয়ে যাবে এমনসব বিভৎস বিবরণ যদি সেখানে থাকে তাহলে হয়তো কেউ ভয়ে ঐ মুখো হবে না। তবুও আপনাকে ধন্যবাদ চেষ্টা করার জন্য। -{@
নীরা সাদীয়া
হুম, আপনি ঠিক বলেছেন। আরো বীভৎস হবার কথা। কিন্তু সে সম্পর্কে আমার ধরনা কম বলে সবটা আসেনি। ধন্যবাদ আপনাকে।
গাজী বুরহান
অন্যরকম চিঠি। যতদূর যানি আত্মহত্যা প্রবণতা একটি রোগ। কিন্তু বহু সুস্থ মানুষও আত্মহত্যা করে। কখন যে পৃথিবীটাকে অসহ্য লাগে আর এভাবে না বলে চলে যায়।
নীরা সাদীয়া
সেসব মানুষকে এরকম লেখার মাধ্যমে বেঁচে থাকার কথা ভাবাতে হবে।
নীরা সাদীয়া
bb ধন্যবাদ আপনাকে। শুভকামনা রইল।
ইকরাম মাহমুদ
প্রিয়তে নিচ্ছি।
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা রইল।
ইলিয়াস মাসুদ
দারুণ চিঠি!!! প্রতিনিয়ত যারা মরে,আবার বাঁচে তাদের মনের ভাষায় লিখা। অনেক ভাল লেগেছে 🙂
নীরা সাদীয়া
অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা রইল।