“শেকড়ের সন্ধানে…” আমার নিজের তৈরি একটি ক্ষুদ্র ডকুমেন্ট। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন বই, পত্রিকা, একাত্তরের ভিকটিমদের নিজ মুখের ভাষ্য, সহব্লগারদের দেয়া অনেক অজানা তথ্য একত্র করে একটা ডকুমেন্ট বানাতে চেষ্টা করছি নিজের জন্য, আমার ছোট দুইটা ভাই আছে- যারা এখনো এসব কিছুই বুঝে না ওদের জন্য; যাতে ওরা কখনই নিজেদের শেকড়ের সন্ধান পেতে ভুল না করে সেই জন্য, ওদের মতো আরও অনেক অনেক ছোট ছোট ভাই-বোন আছে আমাদের ওদের জন্য সর্বোপরি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আমি জানি, এটা খুব সহজ কাজ হবে না আমার পক্ষে। আমি হয়তো এটা ঠিকভাবে করতেও পারবো না। হয়তো আমার অনেক ভুল থাকবে, যেটা শুধরে দেবার দায়িত্ব আপনাদের 🙂
এই ডকুমেন্টের শুরুটা ছিল –
“জন্মকথা ‘ ১৯৭১: শেকড়ের সন্ধানে, হ্যাঁ আমাদের নিজেদের শেকড়ের সন্ধান বের করাই আমাদের উদ্দেশ্য। আর এর জন্য জানতে হবে ৪৪ বছরের পুরনো এক ইতিহাসকে, যে ইতিহাস আমাদের মানচিত্রের, আমাদের লাল সবুজ পতাকার, আমাদের ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের। আর সেই ইতিহাসের মাঝেই লুকিয়ে আছে আমাদের শেকড়……..“
এই কথাগুলোর মাধ্যমে।
কাজটা আমি শুরু করেছিলাম এ বছরেরই ২৫ শে জানুয়ারীতে। মূলত, এই লেখাগুলো সংক্ষেপে আমার ফেসবুকে দিতাম আমি। কিন্তু আমি মনে করছি ঘটনাগুলো শুধু ফেসবুকে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্লগেও দেয়া উচিৎ। আমার প্রতিদিনের সকল কাজের পাশে একটি করে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা জানাটাও প্রায় রুটিনের মতোই করে নিয়েছি। আর সেসব ঘটনা থেকেই ২ টি করে ঘটনা থাকবে এই ধারাবাহিক পোস্টের প্রতিটি পর্বে।
(শুরু করছি, ঘটনা-০১ দিয়ে)
“বেশ বড় একটা আগাছার বন,তারই মধ্যে লেপ,কাঁথা,বালিশ তোষক পাটে পাটে সাজানো;এগুলো ধর্ষণ বা নারী সঙ্গমের শয্যা।পাশেই বিশাল একটা গর্ত। যেসব মেয়েরা একটা পর্যায়ে নির্যাতিত হতে হতে একেবারে মৃত্যুর দোরগোড়ায় চলে যেতো এবং যারা অপারগতা প্রকাশ করতো তাঁদের বেয়ানট দিয়ে খুঁচিয়ে,জবাই করে কিংবা টুকরো করে কেটে ফেলে দেয়া হতো সেই গর্তে।কখনো কুকুর, কখনো শিয়াল কিংবা পোকামাকড়ের খাদ্য হতে হতো তাঁদের।দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরা মেপেঝুপে হিসেব করে বলেছিল সেই গর্তে প্রায় সাড়ে চারশো থেকে- পাঁচশো মেয়েকে ফেলা হয়েছে।উক্ত গর্তের মধ্যে তাঁদের এলোমেলো চুল,লম্বা বেণী গাঁথা চুল,সায়া,শাড়ি,সালোয়ার,কামিজ,মাথা,হাড়,খুলি আধপচা মাংসসহ পোকা ঘিন ঘিন করা মাথা পাওয়া গিয়েছিলো।সেখানে আরও পাওয়া গিয়েছিলো কয়েক ঝুড়ি ভাঙা চুড়ি”
—— বাংলাদেশের গনহত্যা ১৯৭১, খালেক বিন জয়েনউদ্দীন সম্পাদিত।
সেদিন এক জায়গায় কথায় কথায় একজনকে বলেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে বীরঙ্গনা মায়ের সংখ্যা অবশ্যই ছয় লাখ।সংখ্যাটি এর চাইতে বেশি হলেও কিছুতেই কম নয়।তাতে তাঁর কাছে আমার কথাকে “আবেগের অতিশয্য” মনে হয়েছে। হতেই পারে এবং আমি হলফ করে বলতে পারি এরকম অনেকের কাছেই মনে হয় সেই সাথে অনেকসময় তাঁরা সেই দুই লাখ হিসেবের সংখ্যা মেলাতে ক্যালকুলেটর নিয়েও বসে পরে।তাঁদের সাথে আমি তর্ক করার মতো কোন ইচ্ছেই প্রকাশ করি নাহ্। শুধু একটা প্রশ্নই তাঁদের করতে চাই যে, একটা ছোট্ট ঝোপের গর্ত থেকে যদি সাড়ে চারশো থেকে- পাঁচশো নারীর গলিত লাশ পাওয়া যায়, তবে এই ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশটাতে তৈরি অসংখ্য গর্তে কতো নারীর লাশ পাওয়া যেতে পারে ?
সূচনা পর্বটি একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করলাম। পরবর্তী পর্বগুলোতে আশাকরি দুইটি করে ঘটনা তুলে ধরবো।
[চলবে…]
৩৬টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
আপনার এই প্রচেষ্টা প্রসংসার দাবীদার।বিশাল একটি কাজে হাত দিয়েছেন।আপনাকে দেখে মনে হয়,আমরা যা পারিনি,আপনি তা পারবেন।
অবশ্যই ব্লগে শেয়ার করবেন। ফেইসবুকের লেখা আর ব্লগে লেখা আলাদা বিষয়। ব্লগে পড়েন অধিক পাঠক।
সংখ্যা নিয়ে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন পাকি আদর্শের লোকেরা করে।
ফাতেমা জোহরা
বেশ বড় কাজে হাত দিয়েছি, সেটা কাজটা হাতে নেবার পরে বুঝতে পারছি। আমি জানি কাজটা আমি শেষ করতে পারবো না। এরপরেও আমি করে যাবো 🙂
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য -{@
জিসান শা ইকরাম
আপনি শুরু করুন,শেষ করবে আপনার সন্তান।
নিরন্তর শুভ কামনা।
ফাতেমা জোহরা
হ্যাঁ, আমিও চাই, আমার অসমাপ্ত সকল কাজ আমার পরবর্তী প্রজন্ম শেষ করুক এবং সেটা আমার চেয়েও সুনিপুণতার সাথে 🙂
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ঠিক আপনি শুরু করুন,শেষ করবে আপনার সন্তান।
অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
লিখে যান এমন সাহসী বাস্তবতা যা নতুনদের কাজে লাগবে -{@
ফাতেমা জোহরা
কাজে লাগলেই আমি কৃতজ্ঞ থাকবো এবং আমার পরিশ্রম সার্থক বলে মনে করবো 🙂
খেয়ালী মেয়ে
আপনার এই ডকুমেন্ট থেকে আমরাও অনেক কিছু জানতে পারবো, চালিয়ে যান আপনার এই কাজ, শুভকামনা রইলো আপনার জন্য -{@
ফাতেমা জোহরা
ধন্যবাদ আপু 🙂
নুসরাত মৌরিন
আপু আপনাকে স্যালুট।
এমন করে শেকড়ের সন্ধান করাটা অনেক বড় কাজ।
এভাবে তো ভাবিনি,নতুন করে ভাবাচ্ছে আপনার লেখাগুলো।
আমিও প্রতিদিন আমার শেকড়ের দুটি গল্পের জন্য অপেক্ষা করে থাকবো।
ফুলটুকু অভিনন্দন এমন বিশাল একটা কাজের সূচনা করার জন্য…-{@
নুসরাত মৌরিন
-{@
ফাতেমা জোহরা
আবেগাপ্লুত হয়ে পরলাম আপু। আপনাদের এই অনুপ্রেরণা আমার কাজের গতিকে অনেকগুণে বাড়িয়ে দেবে। নিরন্তন সাথে থাকুন, ভালো থাকুন (3
লীলাবতী
শুরু করাটাই অনেক সাহসের কাজ আপু।আপনি পারবেন -{@
ফাতেমা জোহরা
তা-ই যেন হয় ! আমি যেন কাজটা করার মতো সময় পাই, আমি যেন আপনাদের এই অনুপ্রেরণা পাবার জন্য আরো অনেক দিন এই ধরায় বেঁচে থাকি, আমার এছাড়া জীবনে আর তেমন কোন চাওয়া নেই আপু। ভালো থাকুন -{@
কৃন্তনিকা
আমি অনেকদিন ধরেই বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম। খুঁজে পাচ্ছিলাম না। রুবা আপু ও সঞ্জয় ভাইয়ার লেখায় কিছুটা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার আরো অনেক কিছু জানা দরকার। আপনার লেখার অপেক্ষায় রইব।
আপনার এই উদ্যোগের জন্য আপনাকে কি বলা উচিৎ হবে- আমি জানি না। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে…
ফাতেমা জোহরা
বীরাঙ্গনা মায়েদের নিয়ে কিছুদিন আগে সামান্য কিছু লেখালেখি করেছিলাম। আশাকরি পর্যায়ক্রমে আমি লেখাটি এখানে প্রকাশ করবো 🙂
আর আমরা কেউই বৃহৎ নই। ক্ষুদ্র থেকেই অনেক বৃহৎ কিছুর সৃষ্টি। ক্ষুদ্রকে পেছনে রেখে কখনই বৃহৎ কিছু করা যায় নাহ্। আমি যা করছি তা মূলতঃ একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাই বটে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এতোই বিস্তর যে আমার একজীবনে এই ইতিহাসের গভীরে যাওয়া অসম্ভব। শুধু আমি কেন, চাইলে আপনারাও এরকম উদ্যোগ নিতে পারেন। তাতে আমাদেরই বরং ভালো।
ধন্যবাদ রইলো।
ব্লগার সজীব
আপনার এই উদ্যোগের জন্য হৃদয়ের অন্তস্থল হতে আপনার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।আমরা অপেক্ষায় থাকবো। -{@
ফাতেমা জোহরা
ধন্যবাদ আপনার অনুপ্রেরণার জন্য 🙂
শুন্য শুন্যালয়
মনে মনে অনেক কিছু করবার ইচ্ছে থাকলেও সবাই সেটা বাস্তবায়ন করতে পারেনা। আপনাকে স্যালুট জানাচ্ছি উদ্যোগটির জন্য। আপনার সব লেখাই পড়েছি, তাই বুঝতে পারছি অসাধারন একটি ডকুমেন্টারি হতে যাচ্ছে। শেষ আপনি করতে পারবেন, আগাম শুভকামনা জানাচ্ছি।
ফাতেমা জোহরা
আপনার মন্তব্য সবসময়ই আমাকে অফুরন্ত অনুপ্রেরণার যোগান দেয় আপু ! আমি চেষ্টা করবো আপনাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে। ধন্যবাদ -{@
সঞ্জয় কুমার
সঠিক ইতিহাস জানতে হবে জানাতে হবে ।
সাহসী উদ্যোগের জন্য অভিনন্দন ।
ফাতেমা জোহরা
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা 🙂
শিশির কনা
আপনাকে স্যাল্যুট আপু।আমাদের এসব জানতেই হবে। সোনেলার প্রতি অনুরোধ,এই পর্বগুলো যেন ষ্টিকি করে রাখা হয়।
ফাতেমা জোহরা
ধন্যবাদ এবং সোনেলার প্রতি কৃতজ্ঞতা রইলো 🙂
রিমি রুম্মান
একটু একটু করে জানছি । গা শিউরে উঠা ইতিহাস। অনেকটা দলিল বলা চলে। ধন্যবাদ
ফাতেমা জোহরা
তা তো উঠবেই !! এমন নৃশংসতার ইতিহাস গোটা পৃথিবীর সকল নৃশংসতাকে হার মানায়।
নিঝুম
বীরাঙ্গনাদের সম্পর্কে জানার জন্য অনেক আগ্রহ ছিলো। আমার সেই আগ্রহ পূরন হচ্ছে। ধন্যবাদ আপু এরকম ভালো একটা কাজ শুরু করার জন্য। 🙂
ফাতেমা জোহরা
এই সিরিজের বাকি পর্বে কিছু কিছু ঘটনা থাকবে মায়েদের নিয়ে কিন্তু তাঁদের নিয়ে বিস্তারিত আরেকটি সিরিজ আশাকরি শীঘ্রই সোনেলায় দিতে পারবো 🙂
ছাইরাছ হেলাল
এ উদ্যোগ এগিয়ে যাবে ,আমরা সাথেই থাকব।
অনেক জানব।
ফাতেমা জোহরা
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া 🙂
স্বপ্ন
এমন সাহসী উদ্যোগ নেয়ায় অভিনন্দন আপনাকে -{@
ফাতেমা জোহরা
লেখাটি পড়ার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
আমি আবারও বলছি, এ প্রজন্মের কোন মেয়ে দেশকে নিয়ে এতো গভীরভাবে ভাবে, আপনাকে না জানলে জানতেই পারতাম না।
শেকড়ের সন্ধানে যে পদযাত্রা শুরু করেছেন, সফলতা কামনা করি।
আমাদের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা অনেক আছে কিন্তু বীরাঙ্গনাদের নির্যাতনের ইতিহাস, গণহত্যার ইতিহাস খুব কমই আছে।
বংশ পরম্পরায় নির্যাতন, অপমানের বিষয় যতোটা দাগ কাটে, বিজয়ের আনন্দ ততোটা দাগ কেটে আঘাত করে না। আমি মনে করি নির্যাতনের ইতিহাস চাপা পড়ায় মুক্তিযুদ্ধে হারানোর বেদনা, অপমানের জ্বালা মানুষের মনকে তাড়িয়ে বেড়ায় না। ফলে মুক্তিযুদ্ধের তাৎপরয অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বব্যাপী সাধারন মানুষের মাঝে দ্রুত সমর্থন পেয়েছিলো, শরণার্থী, ধর্ষণ, আর নির্যাতনের কারনেই।
আর সুচনা বলছে আপনার পদযাত্রা সেদিকেই। শুভকামনা রইলো অন্তর থেকে।
ফাতেমা জোহরা
পুরোপুরি একমত আপু আপনার সাথে।
//আমাদের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা অনেক আছে কিন্তু বীরাঙ্গনাদের নির্যাতনের ইতিহাস, গণহত্যার ইতিহাস খুব কমই আছে//
ইতিহাস অনেক আছে আপু, কিন্তু যেটা কম আছে সেটা হল “সংরক্ষিত ইতিহাস”… আমাদের দেশের জন্ম ইতিহাসের ৫০ ভাগই হারিয়ে যেতে বসেছে সঠিক সংরক্ষণের অভাবে। আর ইতিহাসের বিকৃতিটাও মূলত সেকারণেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা যদি একবারে পিউর ইতিহাসটা এখন জানতে চাই, তাহলে যে কি পরিমাণ ঝামেলা পোহাতে হয়, সেটা মাঠে গিয়ে কাজ না করলে অনুধাবন করা যায় না। এমনকি এখনো অনেকে সঠিক তথ্য দিতে কুণ্ঠাবোধ করে।
তবে আমরা তো হেরে যেতে শিখিনি আপু। আমরা পারবো, আমরা যতোটা পারি চেষ্টা করবো। আপনার এতো সুন্দর মন্তব্যটি অনেক উৎসাহ যোগালো মনে। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করার মতো দুঃসাধ্য দেখবো না আপু। ভালো থাকুন 🙂
মারজানা ফেরদৌস রুবা
পারবেন, অবশ্যই পারবেন।
যে তারুণ্যকে পূর্বসূরিদের অপমানের জ্বালা তাড়িয়ে বেড়ায়, রক্তের ঋন শোধের নেশা তাঁদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়, তাঁরা আবার না পারে?
তারুণ্য কখনোই হারে না।
জয় হোক তারুন্যের, জয় হোক মানবতার।
ফাতেমা জোহরা
//যে তারুণ্যকে পূর্বসূরিদের অপমানের জ্বালা তাড়িয়ে বেড়ায়, রক্তের ঋন শোধের নেশা তাঁদের রাতের ঘুম কেড়ে নেয়, তাঁরা আবার না পারে?
তারুণ্য কখনোই হারে না।//
…… খুব সাহস পেলাম আপু। এরকম সাহসের যোগান আর অনুপ্রেরণা দেবার জন্য কৃতজ্ঞতা রইলো 🙂