জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক...
জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক…

আমাদের সপ্তম শ্রেণীর শ্রেণী-শিক্ষক ছিলো আমার মামনি মীরা দাস। মামনি ইংরেজী আর অঙ্ক করাতো। প্রথম দিন ক্লাশ ওয়ার্কের খাতা টেবিলে রাখার পর ব্রেঞ্চে এসে বসেছি। মামনি ডাকলো, গিয়ে বললাম কি মামনি? মামনি সোজা আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কে তোমার মামনি?” আমি বললাম ভুল হয়ে গেছে ম্যাডাম। যাক মামনির ক্লাশ এলেই আমার অবস্থা একেবারে গুরুচরণ। ছোট্ট একটা কথা বলে রাখি আমার শিক্ষকতার কিছু স্টাইল মামনি আর রায়হান স্যারের থেকে নেয়া। তবে এটা ঠিক মামনির খুবই জনপ্রিয় একজন শিক্ষক। এতো ভালোবাসা পেয়েছে এবং এখনও মামনির অনেক অনেক ছাত্রী আমার ফেসবুকে আছে, যারা মামনির কথা জানতে চায়। মামনিকে নিয়ে গল্পও বলে। কতোটা গর্ব হয় যখন শুনি “বড়ো দিদিমনির ফোন নাম্বারটা দেবেন দিদিভাই?” এসব ছাত্রীরা আজ মা হয়ে গেছে। কি স্বার্থ আছে আর মামনির কাছে? স্কুলে প্রথম যেদিন ক্লাশ নিতে যাই, মামনি আমায় বলেছিলো, “শিক্ষকতার প্রথম শিক্ষা কি জানিস? নিজেকে শেখানো। তুই কাউকে শেখাতে যাচ্ছিস এটা কখনো ভাবিস না। আর চোখের শাসনে স্নেহ রাখিস। একজন প্রকৃত শিক্ষক তাকেই বলে।” আমার মামনি ওই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন আপু। কিন্তু কখনো শিক্ষকের মেয়ে হিসেবে কোনো সুবিধা পাইনি।

ক্লাশ এইটে একজন নতূন শিক্ষক এলেন অঙ্কের। ওই স্যারের নাম মুকুল। মুকুল স্যার খুবই শান্ত-শিষ্ট ছিলেন এবং অসম্ভব সুন্দর একটা ব্যক্তিত্ত্ব ছিলো। স্যার নিজে থেকেই আমায় পড়াতে চাইলেন। মামনি তাই না করতে পারেনি। যাক আমায় অঙ্ক করাতেন বাসায় এসে। একটা টাকাও নিতে চাইতেন না। মামনি তারপর মানা করে দিতে চাইলো। স্যার শেষে নিতে বাধ্য হলেন। মুকুল স্যার বেশীদিন স্কুলে ছিলেন না, ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গিয়ে চাকরী ছেড়ে দিলেন। সামনে আমাদের অষ্টম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা। আর মাত্র দু’ মাস বাকী। সবাই বেশ চিন্তায়। আমার চিন্তা ছিলো না (ভেবে বসবেন না সব পারি)। অঙ্ক ক্লাশ নেই, একটা ক্লাশ কমে গেছে। কত্তো মজা! কিন্তু আমাদের আনন্দকে মাটি করে দিতে নতূন শিক্ষক এলেন উনার নাম আত্তর আলী স্যার। এই স্যারের নাম নিয়ে যথেষ্ট মজা করেছে সকলে। সত্যি বলতে কি আমার জীবনে এতো সহজ-সরল শিক্ষক আর একজনও দেখিনি। প্রচন্ড ভালো মনের অধিকারী একজন। আর খুবই মেধাবী। স্যার এতো সহজভাবে অঙ্ক বোঝাতেন, চোখে অন্ধকার দেখিনি কখনো। ক্লাশে প্রথম যেদিন এলেন স্যার, চেয়ারে বসলেন রোলকল করার জন্য। অমন সময় আমাদের সহপাঠী মনোয়ারা বেগম মনি(দুষ্টুর শিরোমণিদের একজন) বললো “স্যার আপনার মাথায় তেলাপোকা।” স্যার তো লাফিয়ে উঠলেন “কই, কই, কই?” তারপর সবাই হাসি, স্যার বললেন “এমন মজা করতে নাই। তোমরা বড়ো হয়েছো।” যাক স্যারকে আমার অনেক ভালো লাগতো। মামনির স্যারকে ছোট ভাইয়ের মতোই দেখতেন উনার এই সহজ-সারল্যের জন্য। একদিন মামনি বাসায় নিয়ে এলেন স্যারকে। স্যার নাকি সেভাবে খেতে পারছেন না। তাই মামনি স্যারের জন্য প্রায়ই খাবার নিয়ে যেতেন আর স্যারও এসে খেতেন। একদিন স্যার আমায় বললেন, “তুমি আমার কাছে পড়বায়নি?” আমি কি বলবো বুঝতে পারছিনা। ক্লাশে সবাই যদি শোনে আমায় ক্ষ্যাপাবে। চুপ করে রইলাম। অমন সময় মামনি খাবার নিয়ে এলো, স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, “বৌদি আপনার কাছে অনুরোধ, নীলারে পড়াইতে চাই। এই মেয়ে আমার স্বপ্ন-পূরণ করবো।” অবশেষে রোজ স্যার আসতেন। ওহ ছোট্ট একটা কথা বলে নেই। হাইস্কুলের মাওলানা স্যারের সেই অপমান মাথা থেকে তখনও যায়নি। শুধু মনে হতো আমায় দিয়ে কিছুই হবেনা। প্রথম বা দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় অঙ্কে কোনোমতে তেত্রিশ পেয়ে পাশ করলাম। ঘটনা কি? বশির স্যার তখনই জানলেন মাওলানা স্যারের কথা। মামনিকে ডাকলেন স্যার, আত্তর স্যারকেও। শিক্ষকতা মানে কি সেটা আবারও সুন্দরভাবে অনুভব করালেন আত্তর স্যার। এবং মামনিও।

স্যারের একটা গুণ ছিলো, কারো নামে সমালোচনা করতেন না। যা বলার সামনা-সামনিই বলে দিতেন। মামনির সাথে তাই এতো মিল ছিলো স্যারের। একদিন ক্লাশে স্যার খুব রাগ করে বেত নিয়ে গিয়েছিলেন, কাউকে মারতে পারেননি। খুব সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করতেন। স্যারের নিঃশ্বাসের সাথে মিশেছিলো অঙ্ক। এতোটাই ভালোবাসতেন তিনি। স্যারের একটা কথা আজোও মনে পড়লে হো হো করে হাসি। এস.এস.সি পরীক্ষার আগেরদিন রাতে স্যার দেখি বাড়ী থেকে চলে এসেছেন। আমাদের বাসায় থাকবেন সারারাত অঙ্ক করাবেন। মামনি বললো, “আত্তর কাল সকালে পরীক্ষা এখন রাত প্রায় একটা বাজে, নীলার কি ঘুমানো দরকার না?” স্যার বললেন, “বৌদি পরীক্ষার পর অনেক ঘুমাইতে পারবো। এক রাইত না ঘুমাইলে কিছু হইতো না।” মামনি আস্তে করে সরে গেলো। আমি বললাম সব পারবো স্যার। আমার আর ভালো লাগছে না। স্যার অমনি বললেন, “তুমি এস.এস.সি পরীক্ষায় ফেইল করলে করো, আমার কুনু আপত্তি নাই। কিন্তু অঙ্কে লেটার আনতে হইবোই।” আমি শুনে বললাম এটা কি বললেন স্যার? অঙ্কে লেটার পেয়ে পরীক্ষায় ফেল করবো? সেদিন রাত দুটায় শুতে গেছি। আমার জীবনে পরীক্ষার আগের রাতে পড়ে পাশের রেকর্ড আছে, কিন্তু তা বলে এতো রাত অব্দি অঙ্ক? ছোট্ট করে বলে রাখি অঙ্কে লেটার পেয়েছিলাম। মারাত্মক জটিল প্রশ্ন এসেছিলো, ৮৪ নাম্বারের পরীক্ষা দিয়ে ৮২ পাওয়া সে স্যারের জন্যই সম্ভব হয়েছে। এখনও মনে আছে একটা সম্পাদ্য এসেছিলো ঘুরিয়ে-প্যাঁচিয়ে, অবাক করে দিয়েছিলো আমাকে। কারণ আগের রাতে স্যার বলেছিলেন কেন জানি মনে হচ্ছে এটা আসবে, তবে অন্যভাবে। উনি আমায় দু’ ভাবেই শিখিয়েছিলেন। আমার এস.এস.সি পরীক্ষার পর স্যার স্কুল ছেড়ে দিয়ে চা’ বাগানের চাকরীতে জয়েন করলেন। স্কুলে নাকি বেশ রাজনীতি ঢুকে গেছে। এদিকে বেতনও তেমন না। স্যারের ব্যবসার প্রতি টান নেই। তাই বাপিকে বলে চা’ বাগানে জয়েন করলেন। স্যারের সাথে অনেক মজার গল্প হতো আমি-মামনি-বাপি-সিকদার আঙ্কেল। স্যার যেদিন বিয়ে করলেন আমরা ছিলাম ভি.আই.পি। মামনি কখনো কোনো বিয়েতে বরযাত্রী যায়না, স্যারের বিয়েতে যেতে বাধ্য হয়েছিলো। স্যারের স্ত্রী বীণা ম্যাডাম অন্তর্মুখী হলেও মামনির সাথে বেশ সৌহার্দ্য ছিলো। গেলো বছর দেশে গিয়ে জানলাম আত্তর স্যার বাগান থেকে চলে গেছেন। কোথায় আছেন, সে জানিনা। শুধু জানি স্যার আমার মনের আসনে চিরকাল থাকবেন। স্যার শুধু একজন শিক্ষকই ছিলেন না, বন্ধুর মতো পাশে ছিলেন আমাদের পরিবারের। স্যারের খবর পেয়ে যাবো এটুকু জানি। খোঁজ লাগিয়েছি, দেখি কবে পাই!

**পুনশ্চ, একটা কথা মামনি বললো আমায় আজ। গেলোবার যে দেশে গিয়েছিলাম, ব্যাঙ্কে আমার একজন শিক্ষিকাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে দিয়ে উনাকে বসতে বললাম। উনি আমায় কখনো পড়াননি। আমরা যখন ক্লাশ ফাইভ শেষ করে ফেলার পথে, তখন উনি জয়েন করেছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আমি উনাকে দেখেই চিনেছিলাম। গতকাল নাকি ওই ম্যাডামের সাথে মামনির দেখা, বললেন, “দিদি একদিনও তো পড়াই নাই নীলারে। তাও আমারে দেখিয়াই পায়ে ধরি প্রণাম করলো। তারপরে চেয়ারও ছাড়ি দিলো। আইজকাল হাত তুলিয়া নমষ্কার/আদাবই কেউ দেয়না।” মামনি আমায় বললো, “তুই এমনই থাকিস, বদলে যাসনা। তীর্থ ভাইয়াকেও শেখাস, ও যেনো সম্মানীয়কে সম্মান দেয়।” সত্যি বলছি এসব প্রশংসা আমার প্রাপ্য না, আমার বাপি-মামনির শিক্ষা। আর শিক্ষকদের ভালোবাসা। আজকাল যদি এমন শিক্ষক থাকতো আমাদের দেশে, তাহলে সভ্য ও জ্ঞানী মানুষের অভাব হতো না। এখন শিক্ষকতার নামে রাজনীতির খেলা চলে। হায়, সুবর্ণকাল আবার কবে আসবে?

ক্রমশ

হ্যামিল্টন, কানাডা
১৩ জুলাই, ২০১৬ ইং।

যাঁদের কাছে ঋণী এ জীবন (তৃতীয় ভাগ)

৭৬৮জন ৭৬৮জন

৩৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ