আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে নারী এবং কিশোরদের অবদান তেমনভাবে আলোচিত হয় নি । তাঁদের বীরত্ব গাঁথাগুলো নিয়ে যেসব কাজ হয়েছে তার সংখ্যাও অল্প।সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান ‘ থেকে নির্মিত ‘গেরিলা’ একজন সাহসী নারী বিলকিসকে তুলে এনেছে। তেমনি মুহম্মদ
জাফর ইকবালের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ যারা পড়েছেন , যারা দেখেছেন প্রত্যেকেই কিশোর রাশেদ আর তাঁর বন্ধুদের সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের কথা জানেন।কিশোর উপন্যাসের এই চরিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধে বাস্তবেও ছিলো। Y Platoon বা Young Platoon এর সদস্য ছিলো ওরা। ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয় নি বলে আমরা জানিনা সেই নামগুলো। এমন একজন নাম না জানা কিশোরের কথা বলি। কি গভীর ছিলো তাঁর স্বাধীনতার প্রতি প্রেম! যুদ্ধ করে জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছে! পাকিস্তানিদের প্রতি ক্ষোভে কিশোর বয়সেই দেশকে হানাদার মুক্ত করতে হয়েছে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ !
রমজান আলী , বয়স ১৩ বছর। বাড়ি দিনাজপুর। ২৫ মার্চের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর পাকিস্তানিরা আক্রমণ শুরু করে শহর-মফস্বলে। শান্তাহার রেল ষ্টেশনে ছিলো রমজারের বাবার চায়ের দোকান। পাকিস্তানিরা যখন শান্তাহারে আক্রমণ চালায় তখন রমজানের বাবাকে চায়ের দোকানেই গুলি করে মেরে ফেলে। কাছেই ছিলো রমজানদের ছোট একটা থাকার ঘর। সেই ঘর জ্বালিয়ে দিলে রমজানের মা জীবন নিয়ে অনেকের সাথে পালিয়ে যায়। রমজান চোখের সামনে এইসব ধ্বংসলীলা দেখেছে। সেদিনের পর সে হারায় বাবা-মাকে। পাকিদের ভয়ে সেদিনই অনেকের সাথে পালিয়ে যায় রমজান। দৌঁড়ে ক্লান্ত রমজান পালিয়ে আসা অনেক লোকের সাথে রাতেরবেলা অচেনা একজায়গাতে ঘুমিয়ে যায়। সকালে যখন ঘুম ভাঙে, আবিস্কার করে সবাই চলে গেছে , সে একা। সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলো আশরাফ মণ্ডল নামে এক ব্যবসায়ী। রমজানের দুঃখ বৃত্তান্ত শুনে নিজের চালের আড়তে কাজ দেয় সে। এখান থেকে এক রাজাকার কমাণ্ডার রমজানকে ভয় দেখিয়ে পাকিস্তানিদের ফরমায়েশ খাটার জন্য নিয়ে যায়।রমজান সেখানে থিতু হয়।
ভোর রাত। মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমান লুকিয়ে জলপাইতলির পাকিস্তানি ক্যাম্পের তথ্য আনতে গিয়েছেন। হঠাৎ উনার দৃষ্টিতে আসে রমজানকে। নাগালের কাছে আসতেই রমজানের হাত-পা বেঁধে নিয়ে আসা হয় মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে। ভয়ার্ত রমজান সমস্ত ঘটনা খুলে বলে । তাঁকেও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়ার আকুতি জানায়। রমজানের আকুতি কাজে লাগে।
১৭ ই নভেম্বর পরিকল্পনা করা হয় পাকিস্তানিদের ক্যাম্প রেকি করার। শত্রুর অবস্থান, গতি-বিধি যথাযথভাবে জানা থাকলে আক্রমণে সফলতা আসে। কিন্তু সেই ক্যাম্পে যাওয়াটাও রিস্কি ছিলো। হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধা তারেকের মনে আসে রমজানের কথা। রমজান সেই ক্যাম্পেই কাজ করেছে। সবকিছু রমজানকে বুঝিয়ে বলতেই সে রাজি। রমজান পথ চিনিয়ে নিয়ে যায় দলকে।সেদিন রেকি করতে যাওয়া পুরো দলটি রমজানের জন্যই বিপদে পড়েনি।রেকি সম্পন্ন করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ২০ নভেম্বর আক্রমণ করা হবে।
আক্রমণের প্রস্তুতি চলছে ক্যাম্পে। রমজানের সেকি চঞ্চলতা ! সরাসরি সেও
থাকছে যুদ্ধ ময়দানে।
দিনাজপুর এবং হিলির দিকে ব্লকিং পজিশন তৈরি করে আক্রমণ চালানো হলো। যাতে এই দুই দিক থেকে শত্রুপক্ষ পাল্টা আক্রমণ করতে না পারে। আক্রমণের প্রথম ধাপেই পাকবাহিনী হতবিহ্বল হয়ে উঠলো। কিছু সৈনিক পালিয়ে গেলো ফুলবাড়ির দিকে । কিন্তু এক দিক থেকে তখনও মেশিনগানের গুলি এবং কামানের গোলা ছোঁড়তেই থাকলো পাকবাহিনী।তাই মুক্তিবাহিনীর দলটি কিছুটা কোনঠাসা হয়ে গেলো। পাল্টা আক্রমণ থামিয়ে পেছন দিক থেকে বাঙ্কারে যাওয়ার পথ খুঁজতে লাগলেন কমাণ্ডার। আবার দায়িত্ব পড়লো রমজানের উপর। বাঁশঝাড় , ডোবা পাড় হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলকে সে বাঙ্কারের এতো কাছে নিয়ে আসলো যে , কর্নেল দত্ত হতভম্ব হয়ে গেলেন। আগে থেকে জানলে কেউই শত্রুর এতো নাগালে আসতো না। শত্রুদের একটি কামানের গোলাই যথেষ্ট সবার জীবন নিতে। তবুও মাথা ঠাণ্ডা রেখে রকেট লঞ্চার ফায়ার করতে বলা হলো। লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলে রমজানরা ধরা পড়বে ।আর লক্ষ্যে আঘাত করলে মারা পড়বে পাকিরা। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিলো। প্রথম আঘাতেই ওড়ে গেলো বাঙ্কার। আহত পাকিস্তানিদের আর্তনাদের সাথে সাথে থেমে গেলো প্রতিরোধ। আক্রমণ সফল। আনন্দ ,উত্তেজনায় ‘জয় বাংলা’ বলে চিৎকার দিয়ে বাঙ্কারের দিকে দৌঁড়ে যাচ্ছে রমজান। পেছন থেকে সবাই ডাকছে। রমজান তাকাচ্ছে না। তাঁর মা-বাবার হত্যাকারী , দেশের শত্রুদের মৃত্যু সে স্বচক্ষে দেখছে। আজ সে উল্লাস করবে।
কিন্তু , সেই উল্লাস মুহুর্তেই ম্লান হয়ে গেলো। শত্রুদের পুঁতে রাখা একটি মাইনে পা দিতেই গোটা এলাকা কাঁপিয়ে বিস্ফোরিত হলো সেটি। ছিন্নভিন্ন হয়ে ওড়ে গেলো রমজানের ছোট শরীর। জয়ের আনন্দের বদলে সবার চোখে পানি। সকলের আদরের রমজান চলে গেলো না ফেরার দেশে ।
রমজানের বিচ্ছিন্ন শরীর স্ট্রেচারে তুলে সবাই সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বিদায়ী স্যালুট জানালো।
দেশের মাটি রঞ্জিত হয়েছে এমন অনেক রমজানের রক্তে ।যাদের আমরা চিনি না , নামও জানিনা।
নাম না জানা এমন কিশোরদের প্রতি রইলো বিমুগ্ধ ভালোবাসা….
৬টি মন্তব্য
ফারহানা নুসরাত
রমজানরা এভাবেই যুদ্ধের ময়দানে নিজের জীবন দিয়ে দেশকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছে। কিন্তু সেই খবর আমরা রাখিনি। তাঁরা হারিয়ে গিয়েও অমর হয়ে রয় সকলের অজান্তে। আজ আপনি একজন রমজানকে তুলে ধরলেন। ভাল লাগল। ধন্যবাদ আপনাকে।
রুম্পা রুমানা
আপনাকেও ধন্যবাদ সময় করে পড়বার জন্য।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিটা বিবরণ পড়লেই চোখ পানিতে ভিজে আসে। কতো নাম না জানা মানুষ এভাবে হারিয়ে গেছে। বিমুগ্ধ ভালোবাসা রইলো দেশের প্রয়োজনে নিজেকে বিসর্জন দেয়া ক্ষুদে মুক্তিযোদ্ধা রমজানের প্রতি।
নীলাঞ্জনা নীলা
কিশোর একটা ছেলে দেশকে ভালোবেসে দামী জীবনকে কিভাবে দান করে দিলো।
এসব দেশপ্রেমিক বাংলার মাটিতে এসেছিলো বলেই আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হতে পেরেছি।
ধন্যবাদ আপনাকে মুক্তিযোদ্ধা রমজানের সম্পর্কে জানানোর জন্য।
মৌনতা রিতু
আমার শশুরবাড়ি নীলফামারী তাই এই মহান চির শিশুর গল্প শুনেছিলাম। এখন পড়ে আরো জানতে পারলাম। অনেক ধন্যবাদ। মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে এবার গিয়ে দেখে এসেছি খুব সুন্দরভাবে।
এসব পোষ্ট পড়লে গা শিউরে ওঠে।
ইঞ্জা
কতো অজানা মুক্তিযোদ্ধা রমজান যে এখনো বেঁচে আছে তা প্রায় অজানায় রয়ে গেল আর যেইসব রণযুদ্ধে শহীদ হয়েছে তাদেরকে তো চিনিই না আমরা, সরকারের কাছে আমার আবেদন রইল যেন সকল খুদে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা তালিকা প্রণয়ন করে তাদের যথাযথ স্বীকৃতি দান করা হোক।
ধন্যবাদ আপু দারুণ এই পোষ্টের জন্য।