তিনি যখন বললেন-আগামী সপ্তাহেতো আমি থাকছি না। এক সপ্তাহের ছুটি নিচ্ছি। আমি রীতিমত হতভম্ভ হয়ে যাই। আগামী মাসে আমাদের প্রজেক্টের রিলিজ ডেট। প্রজেক্টের রিলিজ নিয়ে গোটা টিমের সবাই এই মুহূর্তে প্রচন্ড ওয়ার্ক লোডে আছি। এমুহূর্তে তার না থাকা মানে আমার উপর আরও খানিকটা বাড়তি প্রেশার। আর যে মানুষটি কিনা গত এক বছরে একটাও ক্যাজুয়াল লিভ নেয় নি, রোদ ঝড় বৃষ্টি এমনকি হরতাল অবরোধেও ঠিক টাইমে অফিসে হাজির হয়েছে সেই লোকের এবার একেবারে এক সপ্তাহের ছুটি। ব্যাপারটা কি ?
-কি ব্যাপার হুজুর? একবারে এত দিনের ছুটি নিচ্ছেন যে …
আমার কথা শুনে হুজুর খানিকটা লজ্জা পায়। লজ্জা ঢাকার খানিকটা চেষ্টা করতে করতে বলেন -আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছ।
-তাই নাকি ? আগে বলবেন না। কংগ্রাচুলেশনস।
-থ্যাংস।
-তলে তলে এত কিছু সেরে ফেললেন। একবার জানাইলেনও না। এইটা কোন কথা হল ?
-জ্বি মানে হঠাত করে ঠিক হয়ে গেছে। কাউরেই কিছু বলা হয় নাই।
– ভাল। তবে সামনে তো প্রজেক্টের রিলিজ ডেট আছে জানেনই তো, বিয়েটা কয়েক দিন পিছিয়ে দিলেও পারতেন।
– আমিও তাই চাইছিলাম। কিন্ত মেয়ে পক্ষ তাড়াতাড়িই অনুষ্ঠান সেরে ফেলতে চায়। আসলে হয়েছে কি ভাই জানেন মেয়ের মামার ব্লাড ক্যান্সার। একেবারে যায় যায় অবস্থা। তিনি মৃত্যুর আগে ভাগ্নীর বিয়ে দেখে যেতে চান।
– ও আচ্ছা। অফিসের কাউকে কি জানিয়েছেন?
– না ভাই, আপনারেই আগে জানাইলাম।
-তাহলে অফিসের সবাইরে জানিয়ে আসি, কি বলেন ।
আমি হুজুরের ডেস্ক থেকে বের হয়ে সবাইকে খবরটা জানাই। কিছুক্ষণের মধ্যে অফিসের সবাই এসে একেএকে হুজুরকে শুভেচ্ছা জানাতে থাকে। একটা ফুলের তোড়াও এনে আমরা হুজুরে ডেস্কে রেখে আসি । আমাদের এই সব তৎপরতা দেখে হুজুরের লজ্জাবোধ যেন আরও খানিকটা বাড়ে। মিষ্টি করে হেসে তিনি বলেন -এই সবের কি দরকার ছিল।
হুজুরের পুরো নাম শাহিনুর রহমান। বয়স আনুমানিক সাতাশ। চোখ মুখ থেকে এখনো বাল্যকালের আভা যায়নি। দু গাল বেয়ে নেমে আসা লম্বা শুশ্র ই যা একটু ভারত্ব এনেছে তার চেহারায়। বেশ ভদ্র আচার ব্যাবহার। কথাবার্তায় অমায়িক।বছর দেড়েক হল আমাদের টিমে জয়েন করেছেন। সকাল সাড়ে সাতটায় ফার্মগেট থেকে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। অধিকাংশ সময় সকাল ৯টার আগেই অফিসে প্রবেশ করেন। অফিস থেকে বের হতে হতে তার প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে সাতটা বেজে যায়। বাসা-অফিস-বাসা এর বাইরে তার আর কোন জীবন আছে বলে মনে হয় না । অবসর সময়গুলো কাটান কোরআন-হাদিসের বই পড়ে। তার সঙ্গে থাকা ব্যাগটিতে সবসময় কোরআন হাদিসের বই দেখি। ছুটির দিন গুলো কাটান তাবলীগ জামায়াতের হয়ে দাওয়াতের কাজে। জীবনের প্রতি তার আর কোন বাড়তি চাওয়া আছে বলে মনে হয় না বরং যা পেয়েছেন এতেই যেন আল্লাহর প্রতি তার শোকরের শেষ নেই। যেহেতু একই টিমে কাজ করি এবং বয়সেও প্রায় কাছাকাছি সেই সুবাদে আমার সঙ্গে তার বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। যদিও আর কোন দিক দিয়েই তার সঙ্গে আমার কোন মিল আছে বলে মনে হয় না।যেদিন তাকে প্রথম বলি যে আমি একজন স্কেপ্টিক, ধর্ম ও ঈশ্বরে আমার খুব একটা বিশ্বাস নেই। তিনি রীতিমত হতভম্ভ হয়ে যান। এক দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বিড় বিড় করে বলেন-আল্লাহ আপনাকে হেদায়েত দান করুক। ঐদিন ওনার অভিব্যক্তি দেখে খুব মজা পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আর কখনো তিনি হয়তো আমাকে আর নামাযের দাওয়াত দিবেন না। হয়তো এড়িয়েও চলতে পারেন। কিন্ত হয়েছে ঠিক তার উল্টো। তিনি আমার সঙ্গে বেশ আগ্রহ নিয়েই মেশেন এবং আমার ধারণা কাজটি তিনি বেশ সচেতন ভাবেই করেন।
লাঞ্চ ব্রেকে আমরা হুজুরকে কেন্দ্র করে আড্ডা দেই। কিউএ টিমের শাহাদত ভাই বলে ওঠেন -তো হুজুর শেষ পর্যন্ত তাহলে বিয়েটা সেরেই ফেলছেন।
উল্লেখ্য শাহাদত ভাইয়ের সঙ্গেও হুজুরের বেশ ভাল সম্পর্ক। উনারা এক সঙ্গে লাঞ্চ করেন । একসঙ্গে নামাজও পড়তে যান।
– জ্বি। আজ হোক কাল হোক বিয়ে-শাদী তো করতেই হবেই। নবীর সুন্নত বলে কথা।
-ভাল। তো হুজুরের মেয়ে পছন্দ হইছে তো নাকি ?
-জ্বি হ্যা। মাশাল্লাহ।
– হুজুর কিন্ত পছন্দের ব্যাপারে খুবই খুত খুতে। এই তো গত মাসে হুজুররে আমার এক বন্ধূর শালীর ছবি দেখাইলাম। মেয়ে রাজশাহী ভার্সিটিতে পড়ে। অনার্স থার্ড ইয়ার, বোটানি। দেখতে শুনতেও খুব ভাল। মেয়ের ফেসবুক প্রোফাইলের লিংক দিলাম কিন্ত হুজুর তো একেবারে প্রথম দেখাতেই রিজেক্ট কইরা দিছে।
কিউএ টিমেরই আরেকজন প্লেবয় খ্যাত তৌকীর ভাই বলে ওঠেন – এইটা কোন কাজ করছেন শাহাদত ভাই । আপনি আমারে না দেখাইয়া আগে হুজুররে দেখাইছেন। আরে ভাই আমিও তো বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতাছি। আমাদের দিকটাও তো একটু দেখবেন নাকি ।
-তোমার চরিত্রের যা অবস্থা তৌকীর। তোমার আর বিয়ে করে কাজ নেই।হা হা হা।
-ছি ভাই । এই কথা আপনি আমারে কইতে পারলেন।
-ছি বইলা কোন লাভ আছে? ভুল কিছু কি বললাম নাকি ?
আমরা সবাই একসঙ্গে বলে ওঠি – না না মোটেও ভুল বলেন নাই।
শাহাদত ভাই বলতেই থাকেন- আর ভাল কথা তৌকীর, মিয়ানমারের ঐ মেয়েটার কি খবর?
-জিয়ান পেনের কথা কইতাছেন?
-হ্যা, জিয়ান পেন।
-আর কইয়েন না, একেবারে লস প্রজেক্ট । বাংলাদেশে যখন আইছিল কত কষ্ট করে ওরে টেষ্টিং ফ্রেম ওয়ার্ক শিখাইলাম। কয়েক বার কেএফ সি তে নিয়া খাওয়াইলাম। অথচ এখন ফেসবুকে নক করলে একটা ঠিক মত রিপ্লাইও দেয় না । আফসোস।
তৌকীর ভাইয়ের বলার ভঙ্গি শুনে আমরা হেসে ফেলি। শাহাদাত ভাই বলেন -শোন তৌকীর, ঐ সব বিদেশী মেয়েদের পিছনে ঘুইরা কোন লাভ নেই বুঝলা। তার চেয়ে দেশী মেয়ের পিছনে ঘুর কামে দিব। কবি বলেছেন “স্বদেশী পণ্য কিনে হও ধন্য”।
আমরা সবাই আর এক প্রস্থ হেসে ওঠি। আমি হুজুরকে জিজ্ঞেস করি -তা হুজুর ,শাহাদত ভাইয়ের বন্ধুর শালীরে রিজেক্ট করলেন কেন ?
-আর কইয়েন না। ঐ মেয়ের ফেসবুক প্রোফাইলে ঢুকে দেখি ঠোট মুখ ভেংচা কইরা একটা ছবি। এই মেয়েরে কি আর বিয়া করা যায় বলেন ? এরে বিয়ে কইরা না জানি আমার জীবনটাই না ভেংচা হয়ে যায়।
তৌকীর ভাই হাসতে হাসতে বলেন -আরে হুজুর এইটাই হল এখন কার ক্রেজ। এখনকার মেয়েরা ঠোট মুখ ভেংচেই সেলফি তোলে। এই জেনারেশন হইতাছে গিয়া সেলফি জেনারেশন। বুঝলেন কিছু ?
-আমার অত কিছু বুঝে কাজ নেই। আপনিই বুঝেন।
-আচ্ছা। তো ভাবীর সম্পর্কে কিছু বলেন ?
-কি বলব?
আমিও তৌকীর ভাইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলি – ভাবী কি করে ? পড়াশোনা না চাকরী-বাকরী ?
এতক্ষণ আমাদের ইয়ার্কি ফাজলামোর মাঝে পড়ে হুজুর অনেকটাই বিব্রত বোধ করছিলেন। আমার এই প্রশ্ন শুনে তার বিব্রতবোধ যেন আরো খানিকটা বাড়ে। মিন মিন করে বলে ওঠেন – ক্লাস টেনে পড়ে। আগামী বার এস এস সি দিবে।
-কন কি ? এত কম বয়সী মেয়েরে বিয়ে করতাছেন।
আমার প্রশ্নের কোন জবাব হুজুর দেন না । এক দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকেন।তার অস্বস্তিভাব সুস্পষ্ট।
শাহাদত ভাই বলেন – দেইখেন সাবধান, জে এস সি পাশ মেয়েরে বিয়ে কইরা আবার বাল্য বিবাহের দায়ে ফাইসা যাইয়েন না।
তৌকীর ভাই বলেন -তবে আপনারা যাই বলেন না কেন আমি কিন্ত হুজুরের ডিসিশনের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।
আমি বলি-কেন?
-আজকালকার যুগে ভার্জিন মাইয়া পাওয়া খুবই টাফ। স্কুলের মেয়েই যা একটু ভরসা।
শাহাদত ভাই বলেন- তৌকীর তো এই লাইনে বিশেষজ্ঞ। ওর এই ব্যাপারে ভাল ধারনা থাকাই স্বাভাবিক।
-শোনেন শাহাদত ভাই। আপনিতো বিবাহিত মানুষ । আপনিতো আমার থেকে আরো বেশি অভিজ্ঞ। তাছাড়া খনার বচনে আছে -কচি ডাব করিও ভক্ষণ ,কচি নারীর মন করিও গ্রহন তারপর আর কি যেন মনে নেই।
আমি বলি -তৌকীর ভাই, খণার বচনটা কি এইমাত্রই বানাইলেন?
আমার কথা শুনে সবাই আবারো হেসে ওঠে।
শাহাদত ভাই বলেন – তৌকীর দেখি জিয়ান পেনের কাছ থেকে ছেকা খাইয়া কবি হওয়ার পথে অগ্রসর হইতাছে । হা হা হা।
লাঞ্চের পর হুজুর লিভ এপ্লিকেশন নিয়ে প্রজেক্ট ম্যানেজার শাখাওয়াত ভাইয়ের কাছে যায় । লিভ এপ্লিকেশনের রিজন ফিল্ডে “লিভ ফর ম্যারেজ” লেখা দেখে সাখাওয়াত ভাইয়ের গম্ভীর মুখও হাসি হাসি হয়ে যায় ।
-বিয়ে করছ তাহলে ?
-জ্বি ভাইয়া।
-ভাল কিন্ত এক সপ্তাহের ছুটি কি খুব বেশি হয়ে যায় না ? তুমি তো জানই আমাদের প্রজেক্টের রিলিজ আছে সামনে।
-জ্বি ভাইয়া , জানি । কিন্ত বিয়ে বৌভাত সব মিলিয়ে এক সপ্তাহের ছুটি না নিলে তো আর হয় না ।
-আমার বিয়েতে আমি মাত্র ৩ দিন ছুটি পেয়েছিলাম, জানো । এর মধ্যেই সব আয়োজন শেষ করতে হয়েছিল। প্রফেশনাল লাইফ বড়ই কঠিন জিনিস বুঝলা।
-জ্বি ভাইয়া।
-ঠিক আছে যাও ৫ দিন ছুটি এপ্রূভ করে দিলাম। ৫ দিন পর অফিসে জয়েন করবা কেমন।
-ঠিক আছে ভাইয়া।
হুজুর বিমর্ষ মনে চোখ মুখ কাল করে ডেস্কে ফিরে। ছুটির এপ্লিকেশন করতে গিয়ে তার বিয়ের আনন্দ যেন অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে।
আমি বলি-কি ব্যাপার হুজুর কোন সমস্যা?
-আর কইয়েন না । চাইলাম ৭ দিনের ছুটি আর দিল ৫ দিনের।
-বিয়ের কথা বলেন নাই ?
-বললাম তো। কইতাছে উনার বিয়েতে মাত্র ৩ দিন ছুটি পাইছিল, প্রজেক্টের চাপ ইত্যাদী ইত্যাদী।
-বাদ দেন তো ,অত টেনশন নিয়েন না। বাড়তি দুই দিন থাইকা আইসেন । বলবেন যে মেয়ের বিয়ে দিয়ে আমার শ্বশুর অসুস্থ হয়ে গেছিল তাই তাকে দেখতে গেছিলাম।
-মিথ্যা কথা বলব?
-একটু একটু মিথ্যা বলাতে দোষের কিছু নেই তাছাড়া বিয়ে হইল নবীর সুন্নত, নবীর সুন্নত পালন বলে কথা।
-হুম।
-তবে সাবধান ভুলেও আবার নিজের অসুস্থতার কথা বইলেন না।
-কেন?
-লোকে আবার অন্য মিনিং করতে পারে। হা হা হা
হুজুর আমার ইঙ্গিতপূর্ণ রসিকতাটি ধরতে পারেন না। গম্ভীর হয়ে যান । সম্ভবত ৫ দিনের ছুটিতে সব অনুষ্ঠান কি করে সারবেন তা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ভোগেন। বেশ বিমর্ষ মনেই ঐ দিন হুজুর অফিস থেকে বিদায় নেন।
এর ঠিক এক সপ্তাহ পর আমরা আবার হুজুরকে অফিসে দেখি । মুখে চিরচেনা সেই লাজুক হাসি। আমরা সবাই একে একে ডেস্কে গিয়ে হুজুরকে অভিনন্দন জানাতে থাকি।
তৌকীর ভাই বলেন – কি ব্যাপার হুজুর, এই কয়দিনেই যে এত শুকিয়ে গেলেন ঘটনা কি ?
-না না কোন ঘটনাই নাই, এমনি ।
-না না বললেই কি আর হল। হুজুরের উপর দিয়ে মনে হয় খুব ধকল যাইতাছে…
হুজুর কিছু বলেন না, মুচকি মুচকি হাসেন ।
শাহাদত ভাই হাসতে হাসতে বলেন- হুজুর ঠিকমত খাওয়া দাওয়া কইরেন। বেশি বেশি কইরা পুষ্টিকর খাবার …
আমি বলি- হুজুর আপনার না বিয়ে উপলক্ষ্যে ট্রিট দেওয়ার কথা। কবে দিবেন?
তৌকীর ভাইও আমার সাথে তাল মিলিয়ে বলেন – হুজুর ট্রিটটা আজকেই দিয়ে দেন । আমরা সব মিলিয়ে ১৫ জন আছি । ১৫টা কাচ্চির অর্ডার দিয়ে দেই কেমন ।
-ঠিক আছে দেন ।
দুপুরের লাঞ্চ ব্রেকে আমরা এক সঙ্গে কাচ্চি বিরিয়ানী খেতে বসি । প্রজেক্ট ম্যানেজার শাখাওয়াত ভাই হুজুরকে উদ্দেশ্য করে বলেন- শাহীন তোমার বিয়ের অনুষ্ঠান কেমন হল?
-জ্বি ভাইয়া, মাশাল্লাহ ভাল।
-বিয়ের অনুষ্ঠান করলে কোথায় ?
-জ্বি ভাইয়া, শ্বশুর বাড়ি সিরাজগঞ্জে।
আমি বলি -ভাই, ভাবীরে কি ঢাকায় নিয়ে আসছেন?
-না না। বাসা খুঁজতাছি। বাসা ঠিক হয়ে গেলে তারপর নিয়ে আসব। তাছাড়া ওর সামনে পরীক্ষা।
– ও আচ্ছা । একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি কিছু মনে করবেন না তো ?
-করুন।
-বিয়ের পর ভাবীরে কি লেখাপড়া করাইবেন ?
হুজুর আমতা আমতা করে বলেন – না ।
আমি হুজুরের কথা শুনে রীতিমত হতভম্ভ হয়ে যাই । আমি জানি এই মেয়েটিকে হয়তো নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বিয়ে দেওয়া হয়েছে। হয়তো স্বামীর আদেশে তার পড়াশোনাই বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে। বিয়ে নামক নির্মম শৃঙ্খলের মাধ্যমে সে তার আজন্ম স্বাধীনতাটুকুকে হারিয়ে ফেলছে চিরতরে। এখন থেকে প্রতি রাতে হয়তো নিজেকে সপে দিতে হবে স্বামী নামক এই শক্তিমান পুরুষটির হাতে। স্বামীর চোখ দিয়ে দেখতে হবে পৃথিবীর সমস্ত রুপ। হয়তো বোরখা নামক অন্ধকার গুহায় তাকে আবদ্ধ হতে হবে সারাটি জীবনের জন্য। আমাদের এই পৃথিবীটাই কি তার জন্য একমুখী হয়ে যাবে না? লক্ষ্য করি যে এই সব ভাবতে গিয়ে আমার মোটেও ভাল লাগছে না। অনেক চেষ্টা করেও আর বিরিয়ানী গলা দিয়ে ঢোকাতে পারিনা। নিষ্ঠুর এই পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার অংশ হওয়ায় নিজের কাছেই নিজেকে অপরাধী বলে মনে হতে থাকে আমার। এই অপরাধ বোধ থেকে আমি মুক্ত হতে পারি না। কখনোই না দেখা সেই অপরিচিত মেয়েটির প্রতি প্রবল মায়া অনুভব করি আমি। ঐ দিন সারাটি দিন আমি আর পারতপক্ষে হুজুরের সঙ্গে কথাই বলি না, তার দিকে তাকাতেও আমার ইচ্ছা হয় না। সন্ধ্যার দিকে প্রজেক্টের একটা কাজ বুঝে নিতে হুজুর আমার ডেস্কে আসে। আলোচনার এক পর্যায়ে হুজুরের ফোন বেজে ওঠে।হুজুর খানিকটা ইতস্তত বোধ করতে থাকেন । আমি বলি – কি ব্যাপার ফোন ধরছেন না যে?
-আপনার ভাবী ফোন করেছে।
-ঠিক আছে। ফোন নিয়ে কনফারেন্স রুমে চলে যান । কথা শেষ করে তারপর আসুন ।
মিনিট পাঁচেক পরে হুজুর আবার আমার ডেস্কে ফিরে আসে। চোখে মুখে আনন্দের রেশ।
আমি বলি – কি ব্যাপার হুজুর এত খুশি যে, ভাবী কি বলল ?
-আর বইলেন না । দুপুরে খেয়েছি কি না, বাসায় ফিরব কখন এই জাতীয় নানান প্রশ্ন আর কি ? বুঝলেন ভাই, এই মেয়ের হল অতিরিক্ত টেনশন।
-দেশের পরিস্থিতি তো ভাল নয় । স্বামীদের বাসায় ফেরা নিয়ে স্ত্রীদের দুশ্চিন্তায় থাকাটাই স্বাভাবিক ।
-তা ঠিক। কিন্ত আপনার ভাবী অল্প বয়সী মেয়ে তো। এর ছটফটানি একটু বেশিই। এর সঙ্গে বসবাস করা মনে হয় কঠিনই হবে। খুবই টেনশনে আছি ,ভাই ।
বলছেন বটে কিন্ত তাকে দেখে মনে হচ্ছে না তিনি টেনশনে আছেন বরং তিনি যে বেশ আনন্দিত তা বেশ সুস্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় হল তিনি এই আনন্দ গোপন করার কোন চেষ্টাই করছেন না। কে জানে আর কেউ হয়তো এত প্রবল আবেগে তার বাড়ী ফেরা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগেছে কি না। এত তীব্র ভালবাসাও হয়তো কেউ কখনো তার জন্য অনুভব করেনি। সব মেয়েই শক্তিশালী অভিযোজন ক্ষমতাকে সঙ্গী করে জন্মায়। হয়তো এই মেয়েটিও তার ব্যতিক্রম নয়। হয়তো এই মেয়েটিও তার সকল স্বপ্নকে জলাঞ্জলী দিয়ে এই প্রতিকুল পরিবেশেই নুতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে। স্বামীর চোখ দিয়েই দেখতে চাইছে গোটা পৃথিবী। অন্ধকার কোন গুহার মাঝেও বাস করে খোঁজার চেষ্টা করছে তীব্র জ্যোর্তিময় কোন আলোর শিখা। মেয়েরা আশ্চর্য রকমের মায়াবতী হয়। হয়তো এই মেয়েটিও তার অফুরন্ত মায়ার শাখা প্রশাখাগুলোকে বিস্তার করা শুরু করেছে। খুব অল্প দিনেই সেই মায়ার শিকড়গুলো ছড়িয়ে পড়েছে জীবন সঙ্গীটির মনের অনেক গভীরে। পরম মায়ার এই তীব্র বন্ধন ছিন্ন করা কি কারো পক্ষেই সম্ভব ? মনে হয় না। এই মেয়েটি কি সুখী হবে ? আমি জানি না । কেউ যদি অন্ধকারকে চিরসঙ্গী করে তার মাঝেই সুখের আলো খোঁজে তাহলে আমিই বা আর কি করতে পারি? নিঃসঙ্গ, প্রেমহীন কোন ইট কাঠের খাচার চেয়ে ভালবাসার পরিপূর্ণ সেই অন্ধকার কুঁড়েঘরটি কি অধিক সুখকর নয়? নয় কি অধিক জ্যোর্তিময়? আমি আমার কল্পনায় এদের একটি সুখী জীবন দেখতে পাই। অনেক সীমাবদ্ধতার সেই জীবনে শুধু একটি জিনিসের যেন কোন কমতি নেই। ভালবাসা ,অনেক তীব্র একটা ভালবাসা। তাদের ঘিরে এই সুখ কল্পনাটুকু করতে আমার ভাল লাগে , বড়ই ভাল লাগে।
১৪টি মন্তব্য
অরুনি মায়া
পৃথিবীতে মায়া বলে কিছু নেই | নইলে অনেক মায়াময়ী স্ত্রী শুধুই ঘরের শো পিস হিসেবে বেঁচে রয়,,,
অপার্থিব
পৃথিবীতে মায়া বলে কিছুই নেই এই কথাটি বোধ হয় ঠিক নয়। মায়া নারী পুরুষ উভয়শ্রেনীর মধ্যেই আছে । মায়া মমতা,ভালবাসা এগুলো মানুষের মানবীক গুণ, এসব না থাকাই বরং অস্বাভাবিক। তবে আমাদের সমাজ কাঠামোটা এমনভাবে দাঁড় করানো হয়েছে যেন মায়া -মমতা , ভালবাসা শুধু নারীদের সম্পত্তি। নারীদের নম্র হতে হবে, ভদ্র হতে হবে, লাজুক হতে হবে, মায়াবতী হতে হবে এই ধারনাগুলোকে খুব শক্ত ভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কারন সে যেন তার এই গুণ গুলোকে ব্যবহার করে পুরুষতন্ত্রের সাথে সমঝোতা করতে পারে । এই ষ্টেরিওটাইপ গুলো ভাঙ্গাই নারী মুক্তির অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
ছাইরাছ হেলাল
আমাদের সামাজিক বাস্তবতার কঠিন দিক তুলে ধরেছে।
আপনি তো বেশ পুরনো লেখক।
অপার্থিব
বাস্তবতা অনেক নির্মম রে ভাই। এই নির্মম কঠিন বাস্তবতার কারনেই প্রতিটা মানুষকে জীবনেকে চলার পথে নানা ধরনের কম্প্রমাইজ করে চলতে হয়। আমাদের সমাজটা এমনভাবে গঠিত হয়েছে যেন সবক্ষেত্রে শুধু নারীদেরকেই সবচেয়ে বেশি কম্প্রমাইজ করতে হয়। এটিই সবচাইতে দুর্ভাগ্যজনক।
লীলাবতী
যাক অপেক্ষার সময়কে প্রলম্বিত করতে দেননি।ধন্যবাদ ভাইয়া -{@ এখন লেখা পড়ি 🙂
অপার্থিব
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
আবু খায়ের আনিছ
ভাইয়া গতকাল লীলা আপু বলে দিয়েছিল, দৃশ্যমান করার আগে টেক্স করতে। যাতে লেখার মাঝে স্পেশগুলো না থাকে।
বিষয়টা একটু দেখবে।
লেখায় যে দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা দেখিয়েছেন তাতে যে কেউ বুঝতে পারবে আপনি কতটা অভিজ্ঞ এই বিষয়ে। শুভেচ্ছা নিবেন। 🙂 -{@
অপার্থিব
আপনাদের দুজনকেই ধন্যবাদ বিষয়টি মনে করিয়ে দেয়ার জন্য। পরবর্তীতে বিষয়টি মাথায় রাখবো। ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্যও।
আবু খায়ের আনিছ
স্বাগতম। 🙂 🙂
জিসান শা ইকরাম
মায়াই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে
প্রেরণা যোগায়।
ভালো লিখেছেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
মায়া আর এই-ই বোধ হয় আমাদের মনুষ্যত্ত্বকে হারাতে দেয়না।
ভালো লেগেছে গল্পটি। (y)
অপার্থিব
আমার কাছে প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার যে অভিযোজন ক্ষমতা সেটাকেও এক ধরনের মায়া বলে মনে হয়। এই ক্ষমতাটাও অনেক শক্তিশালী। মনুষ্যত্ত্ব টিকিয়ে রাখতে বা জাগ্রত করতেও এটি অনেক বড় ভুমিকা রাখে। ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
ড্রথি চৌধুরী
বাহ! খুবই সুন্দর লিখেছেন! এক দিকে যেমন কঠিন বাস্তবতা অন্য দিনে ভালবাসার শুরু!
অপার্থিব
আমার কাছে এটা ভালবাসা বলে মনে হয় না । এটাকে বলা যায় বাস্তবতার সাথে সমঝোতা করার প্রথম ধাপ। তবে এই সমঝোতা থেকে ভালবাসার জন্ম হতে পারে । ব্যাপারটা ভবিষ্যৎ উপর তোলা থাক। ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। -{@