যখন স্ব-দলবলে আলোকপতি অধিগ্রহন করে আঁধারের বসতি, ক্লান্ত শেয়ালের গলা ভাঙ্গা চিৎকার স্তিমিত প্রায়, আলোর ক্ষুধায় সবুজের কুসুম ভেঙ্গে উঁকি মারে কোটি কোটি নিষিক্ত কলির ভেতর ঘুমন্ত পাপড়িগুলো, পরগাছার লিকলিকে ডগা সুযোগ বুঝে মেলে দেয় আরও চারটি পাতা, দু’দুটি খুড়ি। দুইপাশে দুটি সুঁড় ফাঁটা বাকলের খাঁজ আঁকড়ে ধরে চার ইঞ্চি মতো বাড়িয়ে নেয় নিজের দৈর্ঘ্য।
ওদের জন্মান্তরের তৃষ্ণায় আর আলো আঁধারের ঢাল তলোয়ারহীন যুদ্ধের মহিমায় চারপাশের বাতাসে ভর করে মিহি কুয়াশার অসচ্ছ আস্তরণ। যেন শেষবারের মতো শৈত্যসূধা পাণ করতে ব্যাস্ত- ধরিত্রীর নিত্য নিশিথ তৃষা।
এখনো নড়ে চড়ে উঠেনি কাক, কোকিল। নড়ে উঠেনি হাজারো / লাখো রং আর আকৃতির স্তন্যপায়ী, তৃণভোজী আর মাংসাসী প্রাণীকূল।
তিন সেকেন্ড হলো ভূমিষ্ট হয়েছে সন্তান, প্রসব যন্ত্রনায় জ্ঞান হারাতে হারাতে সঞ্চিত ফিরে পায় একাকী মা। কিছু একটা নেই, শেষ পেয়ালা পানির জন্য যেমন আটকে থাকে শেষ বেলার শেষ নিঃশ্বাস, তেমনি কিছু একটার অভাব গর্ভদানের কষ্টে- শান্তিতে মুর্ছা যাওয়ার জন্য।
হ্যাঁ- সাড়া শব্দ নেই নবজাতকের দেহে / মুখে। অসহ্য কষ্টে যন্ত্রনায় নেতিয়ে আসা শিরা উপশিরাগুলোতে এক ঝটকায় ইচ্ছের প্রচন্ড বিদ্যুতিক শক্তি ছিটিয়ে দেয়- সতের বছরের পাগলীটার মাতৃত্বের মমতা।
মস্তিষ্কের যে অংশে মাতৃত্ব লুকয়ীত থাকে, তা বিধাতার নিজগুণে তৈরী করা সুরক্ষিত গুপ্ত কুঠুরী। অত্যাচার, অনাচার, অভাব, হীনতা বা কষ্ট যা ই হউক, দুনিয়ার কোনও অনুভুতি সে কুঠুরীর সঞ্চিত অনুভবে স্পর্শ বা বিচরণ করতে পারে না বিধায়, পাগলীরাও মা হয়, ওদের সন্তান ও দুনিয়ার আলো দেখে।
মিলি সেকেন্ডের ক্ষিপ্রতায় রক্তাক্ত তুলতুলে নিথর মাংসপিন্ডটাকে বুকে তুলে নিয়ে আকুতি ভরা চাহনিতে উর্ধ্ব গগণে মুখ তুলে পাগলী মায়ের অষ্পষ্ট উচ্চারণ- বাঁচাও, বাঁ…চা…ও।
কলঙ্কিত গর্ভধারণের সামাজিক তিরষ্কার এতটা তিক্ষ্ন যে পাগলিটাও বুঝতে পেরেছিলো হয়ত। যে সমাজ আর সভ্যতা তাকে মধ্য রাত্রির অসভ্য নগ্ন পাশবিকতা থেকে আড়াল করতে পারেনি, ওরাই করে তিরষ্কার। তাইতো লোকালয় ছেড়ে শহরের অদুরে জঙ্গলের পাশেই কেটেছে গত চারমাস। অন্ধকার পথের শেষ প্রান্তের আলোর খুঁটি আর এই জঙ্গল পাগলীর জীবন বৃত্তের অভ্যন্তরে পরিচিত স্মৃতিমুখর দুঃস্বপ্ন। তাইতো তলপেটের আকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে সামাজিক তিরষ্কার যখন বাড়তে থাকে, তখন জনমানবের চোখের অনেকটা আড়ালে জঙ্গলের এই অংশটাকে নিজের অস্থায়ী আবাসন করে নিয়েছিলো অনাগত সন্তানের পাগলীনী জননী।
আলসে দুনিয়া, নিস্তব্ধতার দেয়াল প্রতিধ্বনি পরে পাগলীর চিৎকার ফিরিয়ে দেয় পাগলীর কানে- বাঁ..চা..ও।
চারপাশে সুনশান নিরবতা। কুয়াসা ভেজা পিচঢালা পথে, দম আটকে থাকা সদ্য প্রসূত সন্তানের জীবন বাঁচানোর তাগিদে এক পাগলী মায়ের অন্তহীন দৌড়।
রাত্রি নামের পর্দার আড়ালে, জীবন নামের ভিবিষীকায়, ক্ষুধা নামের যুদ্ধের বিপরীতে, আধুনিক সভ্যতার দেয়া চুড়ান্ত উপহারের চোখে এক টুকরো আলো দেয়া চাই।
আর মাত্র দশগজ দুরেই আলো। হটাৎ সামনে থেকে রাত্রির নিরবতা খানখান করে ঝলমল করে উঠে হেডলাইটের তিক্ষ্ন আলো, রাবার পাথরে ঘর্ষনের শব্দের সাথে ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে চিৎকার করে উঠে চারচাকা সভ্যতার ব্রেক।দুই পায়ের হাঁটুতে প্রচন্ড ধাক্কা। উত্তপ্ত পিচ আর টায়ার পোড়া গন্ধ নিতে নিতে রাস্তার পাশের ভেজা দুর্বাঘাসে লুটিয়ে পড়ে পাগলীর দেহ।
চিরকালের মতো ঘুমের কোলে লুটিয়ে পড়ার আগে মাথা ঘুড়িয়ে রাস্তায় চোখ মেলে পাগলী। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখতে পায়, হাঁটু গেড়ে বসে কেউ একজন তার প্রসবিত রক্ত ভেজা মাংস পিন্ডটাকে কোলে তুলে নিচ্ছে। মরনকালে শেষবারের মতো একটা নবজাতকের চিৎকারের শব্দ শুনে খুশি হলেও, পাগলিটা প্রচন্ড ইচ্ছায় বুঝতে ব্যার্থ হয়- বাচ্চাটা ছেলে ! না মেয়ে !!
চলবে____
২৪টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
কলংঙ্কিত গর্ভধারণের সামাজিক তিরষ্কার কেবল মাত্র নারীদের জন্যই। তা পাগলী হোক বা না হোক। অথচ এর দায় সম্পুর্নই পুরুষের।
বেঁচে থাকুক পাগলীর সন্তান।
এস.জেড বাবু
এই মন্তব্যের আর একটা জবাব আমি এই গল্পের শেষ পর্বে আপনার মন্তব্য পাওয়ার পর এখানে দিতে চেষ্টা করবো।
ততদিন পর্যন্ত আল্লাহ সকলের মন মানষিকতা আর শরীর স্বাস্থ ভালো রাখুন। আমিন।
ভালো থাকবেন ভাইজান।
জিসান শা ইকরাম
অপেক্ষায় থাকবো বাবু ভাই।
শায়লা খান
খুব ভালো লাগল।
এস.জেড বাবু
ধন্যবাদ আপু। খুশি হলাম অনেক।
আগের দুটি পর্ব পড়ে দেখার আমন্ত্রণ রইলো।
ভালো থাকবেন সবসময়।
ফয়জুল মহী
অসাধারণ উপস্থাপন । চমৎকার ভাবনার প্রকাশ।
এস.জেড বাবু
গনযোগাযোগ প্রিয় ভাইজান।
মিষ্টি মন্তব্য পেয়ে অনেক খুশি।
কৃতজ্ঞতা
এস.জেড বাবু
ধন্যবাদ প্রিয় ভাইজান
(টাইপিং মিসটেক সরি)
তৌহিদ
গর্বধারনের কলঙ্কিত রুপ আমরাই দিয়েছে যারা সমাজের অধিপতি। নারী চিরকালেই অব্যক্ত থেকে গিয়েছে, লাঞ্ছনা সহ্য করতে করতে নিষ্পেষিত হয়ে পাগলি হয়েছে অথচ দায়ী পুরুষ তাকে কলঙ্কিনী আখ্যা দিয়ে নিজেরা হয়েছে মহান!
সেই নিষ্পাপ শিশুটি কি জানে ক্ষুব্ধ মায়ের আস্ফালন!
দারুণ লেখা পড়লাম বাবু ভাই।
এস.জেড বাবু
বাহ্
চমৎকার মতবাদ নিয়ে মন্তব্য।
দারুন
শুভকামনা রইলো ভাইজান
ছাইরাছ হেলাল
আমার স্মৃতি-শক্তি নাই নাই করে
তাই পর্বে ঠাঁই নাই নাই অবস্থা!
এস.জেড বাবু
ইশশ
প্রতিদিন এ্যালোভেরা খাওয়ার পর বাদাম খান
বাদামে স্মৃতিশক্তি বাড়ে কবিরাজ ভাই।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বাবু ভাই আজকের পর্বটার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। এতো সুন্দর করে লিখেছেন কিছু বলার ভাষা নেই। পাগলী হলেও সে মা , একটা মাংসপিণ্ড শরীরে লালন করেছে এটাই ঈশ্বরের লীলা। এই অনুভূতি গুলো কখনো মনে হয় মরে না। পুরুষ সারাজীবন সন্তানের দাবীদার হয় কিন্তু ধর্ষিতা বা পতিতাদের সন্তানের দাবী নিতে চায়না। অদ্ভুত রহস্যময় চিন্তাভাবনা। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন
এস.জেড বাবু
মুগ্ধতা একরাশ আপু
খুশি লাগছে এমন মন্তব্যে।
অনুপ্রাণিত হলাম।
অনেক শুভেচ্ছা রইলো আপনার প্রতি।
ভালো থাকবেন সবসময়।
সঞ্জয় মালাকার
দাদা,কলংঙ্কিত গর্ভধারণের সামাজিক তিরষ্কার কেবল মাত্র নারীদের জন্যই।
।পড়ে বেশ ভালো লাগলো ভাবুভাই, আপনার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা, ভালো থাকবেন সবসময়।
এস.জেড বাবু
গুণী মন্তব্য
ভালো লাগলো আপনাকে পেয়ে
ভালো থাকবেন ভাইজান
বন্যা লিপি
আমিও মহারাজের মতো বলতে চাই, স্মৃতীশক্তি কি বিট্রে করতেছে নাকি? মানে আপনি পার্বিকতায় একেকটা গল্প আনছেন এক এক বারে? অসমাপ্ত আগের গল্পের সমাধান জানার অপেক্ষায় ছিলাম। এইটা কিছু হইলো? নাকি পাগলীর প্রসূত মাংসপিন্ড ঠাঁই নেবে অন্য কোনো মায়ের কোলে? লেখক জানেন লেখকের মনে আছে। আমরা গল্প পড়ি।
শব্দের উপস্থাপনে মুগ্ধ চিত্ত।
এগিয়ে চলুন।
এস.জেড বাবু
খুউব কাছাকাছি ছিলেন আপনি।
অতি তাড়াতাড়ি গল্পের ইতি টানা হবে। পেয়ে যাবেন সব উত্তর।
ভালো লাগলো আপু আপনার মন্তব্যে। তবে পড়ে ভয় পেয়ে যাচ্ছিলাম। আপু ধরে ফেললো প্রায়।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।
বন্যা লিপি
আমিও কিন্তু ভেদ পুরোটা খুলিনি ভাই, আমার ধারনা যা হচ্ছে, আমার মনে হয়, আপনি সেদিকেই এগোবেন। কিছুটা তো অভিজ্ঞতা আছে! ওই যাকে বলে – সিনেমাটিক দৃশ্যায়ন! শেষে গিয়ে টুকরো টুকরো ফিল্মের নেগেটিভ গুলো একতারে জোড়া লাগানো😊
চলুক…..
ফজলে রাব্বী সোয়েব
চমৎকার উপস্থাপন
এস.জেড বাবু
কৃতজ্ঞতা ভাইজান
অশেষ শুভেচ্ছা রইলো সাথে
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
মিলি সেকেন্ডের ক্ষিপ্রতায় রক্তাক্ত তুলতুলে নিথর মাংসপিন্ডটাকে বুকে তুলে নিয়ে আকুতি ভরা চাহনিতে উর্ধ্ব গগণে মুখ তুলে পাগলী মায়ের অষ্পষ্ট উচ্চারণ- বাঁচাও, বাঁ…চা…ও। — মুগদ্ধতায় মনটা ছুঁয়ে গেল। আহা মাতৃত্বের স্বাদ । দারুণ লেখা। শুভ কামনা রইলো ।
এস.জেড বাবু
মা কে খুউব ভালোবাসেন আপনি। মন্তব্য তাই বলে। অনেক ভালোলাগলো ভাইজান। আপনার জন্য অশেষ শুভকামনা।
ভালো থাকবেন সবসময়।
হালিম নজরুল
বিষয় নির্বাচন চমৎকার মনে হল।