আমার একটি বৃষ্টি বারান্দা ছিল। বারান্দাই বলবো কারন এর দুই দিক জুড়ে ছিল অর্ধ দেয়াল। অর্ধ ঠিক নয় তার চেয়ে নিচু । আর এর অর্ধেকটায় ছিল ছাদ। সবুজ টিনের ছাদ। একে আমি জোৎস্না বারান্দাও বলতাম। কারন এখানেই আমি জোৎস্নার জলে গা ভেজাতাম। পাশে নিম গাছের ঝিরঝিরে পাতাগুলি অপূর্ব ছন্দ তুলে গুনগুনাতো যখন বাতাস বইতো।
যখন প্রচন্ড বৃষ্টিতে চরাচর ভিজে একাকার তখন আমি বারান্দায় আমার পা ভেজাচ্ছি বৃষ্টির জলে। কারন বাগানে ঘুরে ভিজে ভিজে এক সময় তো ঘরে ফিরতেই হয়। তখন যদি মন মাতানো বৃষ্টি থাকে আমি কেমন করে রইব ঘরে। গভীর রাতে যখন আকাশ ভেঙ্গে নামে তখন আমার মন চলে যায় বারান্দায়, ধীরে ধীরে আমি নিজেই চলে যেতাম সেই বারান্দায়।
প্রবল চাঁদনী রাতে তুমি আমি খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়ে দিয়েছি। শুয়ে শুয়ে আকাশে চাঁদের আর মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমের কোলে আশ্রয় নিয়েছি তা সূর্যি এসে পরশ না বুলানো পর্যন্ত টেরই পাইনি।
একদিন ঝলমলে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে তুমি আমাকে বললে —দেখ,দেখ! দেখি দুটি চড়ুইপাখি। একটি অভিমান করেছে অন্যটি তার অভিমান ভাঙ্গাতে ব্যস্ত। ওদের দেখতে দেখতেই একসময় বৃষ্টি চলে এল আর ওরা আমাদের সাথে আমাদের ছাদের তলে এসে আশ্রয় নিল।
তোমার মনে আছে কত রাত আমরা কাটিয়েছি ঐ বারান্দায়?। কত সময় কেটেছে উদ্দাম সঙ্গীতের ছন্দে?। পূর্ণিমার কত রঙ তুমি আমি মিলে দেখেছি। মাঘী পূর্ণিমাতে চাঁদ থাকে লাল, বৌদ্ধ পূর্ণিমায় ধবধবে সাদা। আর আষঢ়ের পূর্ণিমা আমি বলি প্রচন্ড রূপালী। কেমন ঝগড়া লেগে গিয়েছিল তোমার আমার সাদা না রূপালী এই নিয়ে। আমর ঠোঁটে ঠোঁটে ছুঁইয়ে –এই যে তোমার ঠোঁট, নাক, চোখ রূপালী হয়ে গেছে বলে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিলে।
তুমি আমার জন্যই ঐ বারান্দাটা তৈরী করিয়েছিলে। যেদিন প্রথম ওবাড়িতে আমার গৃহ প্রবেশ হল তুমি চোখ বেঁধে আমাকে দোতালায় নিয়ে গেলে। সেখানে আমাদের ঘরটি দেখালে ঘরের সাথের লাগোয়া বিশাল বারান্দাটিও দেখালে। সিঁড়ির অন্য পাশের দরজা খুলে তুমি আমাকে বিস্মিত করে বললে –এইটা তোমার জন্য। আমি চমৎকৃত হয়েছিলাম। এত্ত সুন্দর সবুজ আর সবুজ। আমার শোবার ঘরের বারান্দা, মাথার উপর অর্ধেক ছাদ সবুজ টিনের –যেন বৃষ্টির শব্দ শুনি, একপাশে সবুজ নিম গাছ বারান্দা ঘেষে , টিনের ছাউনি এক সারি তারপরই খোলা নীল আকাশ, সামনে মাঠে মেহগনি, আকাশমনি ও শিশু গাছের সারি। বারান্দার কিনারায় দাঁড়ালে সমুখে সবুজের শেষে দিগন্ত দেখা যায়। আমি উপরে আকাশের দিকে তাকাতেই তুমি বললে — তোমার জন্য আকাশ, এখানে তুমি শুধু তোমার।
কত বৃষ্টি কত ঝড় কত জোছনা কত হাসি আনন্দ , আনন্দাশ্রু,ভাললাগার কষ্ট——–
এখন ঐ বারান্দায় কী তুমুল বৃষ্টি । হৈ চৈ বৃষ্টি। আমি দূর থেকে দেখি,ভাবি- অনুভব করি কিন্তু যেতে পারিনা। যাওয়া যায় না।
যখন আমাদের জগতে ছিলাম শুধু তুমি আর আমি সেই দূর্দান্ত প্রেমের সময় আমাদের একটি চুক্তি হয়েছিল—- যদি কোনদিন মন অন্য কথা বলে তবে তা আমরা দুজনই কথা বলে ঠিক করে নেব কেউ কাউকে বা নিজেকে অপমান করবো না। সে যত কষ্টই হোক সুন্দর ভাবে সমাধান করবো। কিন্তু তুমি সেই কথা রাখনি।
খুব করুনা হয় তোমার জন্য। কি হাস্যকর ব্যাক্তিত্ব !
নিজেকে নিজেই এভাবে অপমানিত করেছ আর তোমার অপমানে আমি হয়েছি লজ্জিত।
এই বৃষ্টি বারান্দার জন্য আমি ভুলেই গিয়েছিলাম মানুষের মন বড় দূর্বল যে কোন মূহুর্তেই তার রং বদলাতে পারে, চাহিদা বদলাতে পারে বা অন্য কিছুকে ভাল লাগতে পারে।
আমি সত্য বলে ধরে নিয়েছিলাম কবি জসীম উদ্দীনের সে উক্তি– মানুষের হৃদপিন্ডটা তো কুমড়ো নয় যে তা ফালি ফালি করে ভাগ করে দেয়া যাবে?।
তারপর শুধুই কষ্ট সীমাহীন কষ্ট। যতটুকু আনন্দ আমাকে দিয়েছিল বৃষ্টি বারান্দা তার সবটুকুই সেই বারান্দা সুদে আসলে শোধ করে নিয়েছে নিষ্ঠুর মহাজনের মত। আমি এতই বিভোর ছিলাম বৃষ্টি আর জোছনা নিয়ে যে বৃষ্টি জল স্রোত আর জোছনার জোয়ারে ভেসে গেছে আমার সমস্ত সবুজ । সব কেমন পঁচে, গলে গেছে। দূর্গন্ধ নাকে আসার পর দেখি শুধু গলিত লাশ পরে আছে।
২৬টি মন্তব্য
লীলাবতী
অসাধারন এক বারান্দাকে নিয়ে অসাধারন এক লেখা পড়লাম। এতদিনে আপনি নিজের খোলস ভেঙ্গে বের হলেন। পরপর তিন টি পোষ্ট আপনাকে নতুন করে চিনিয়ে দিচ্ছে।
বেশ কিছুদিন সোনেলায় আসতে পারিনি। আজ এসে মন জুড়িয়ে গেলো। এত এত ভালো মানের লেখা ! পড়ছি আর পড়ছি।
খসড়া
লীলাবতী কেমন আছ? চিঠি লেখবার অভ্যাস সেই কবেই নষ্ট হয়ে গেছে। যেদিন থেকে আকাশের চাঁদ দেখবার জন্য আমরা আকাশের দিকে না তাকিয়ে সেলুলার পর্দার দিকে তাকিয়েছি সে দিন থেকে ভুলেই গেছি চিঠির কথা। ভেবে দেখ লীলা একটা চিঠি কিভাবে ধরে রাখে আবেগ, উম্নাদনা, ভাললাগা ,ভালবাসা অভিমান, আনন্দ, মান ভাঙানিয়া গান যুগের পর যুগ।
লীলাবতী
ভালো আছি ভাইয়া, আপনি ভালো আছেন তো ? ছোট বেলার চিঠিকে মিস করি খুব। নীল খামের চিঠি। আপনার মন্তব্যের সাথে একমত।
খসড়া
এই তো মন খুলে বলা , ভাল থাক লীলাবতী।
ছাইরাছ হেলাল
পর পর আপনার লেখাগুলো নূতন মাত্রা পাচ্ছে । ভিন্ন সুন্দর অবস্থানে আপনি আপনার লেখা তুলে ধরছেন ।
দেখে ভালো লাগে ।
টানাপোড়নের জীবনে জীবন নানা রংয়ে নানা রূপে এসে উপস্থিত হয় ।
খসড়া
হ্যাঁ মানুষ বদলায় কারনে অকারনে বদলায়, যেমন আমি বদলেছি এখন আর লিখতে ইচ্ছে করে না ,বইও পড়তে ইচ্ছে করে না। ছাইরাছ ভাই আমার কি হবে?
জিসান শা ইকরাম
খুব আগ্রহ নিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম।
অগ্রসরও হচ্ছিলাম বেশ ফুরফুরে মেজাজে।
হঠাৎ লেখার বাঁক ঘুরে গেলো–
শেষে বিষাদ।
সব কিছু মিলিয়ে একটি ভালো লেখা পড়লাম।
শুভ কামনা ।
খসড়া
কেন ভাই শেষে এসে কি আগ্রহ হারিয়ে গেল। আগ্রহ হারালে রবীবাবুর সাধারণ মেয়েরা বাঁচে কি করে বলুন তো। তাদের তো তাও কল্পনার জগৎ ছিল এখনতো সেখানে শুধুই যন্ত্র।
নুসরাত মৌরিন
শুরুতে বারান্দা,বৃষ্টি,জোছনায় মাখামাখি হয়ে আমিও আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিলাম…মনে মনে ভাবছিলাম এমন একটা বারান্দা যদি আমার থাকত!! সামনে মেহগনি,আকাশমনি,শিশুমনির সারি…যে বারান্দায় টুপটাপ বৃষ্টি ঝরবে…!!কল্পনায় ভাসছি ভাসছি…… শেষে এমন দুঃখ দিয়ে মুড়ে দিলেন…!!
এত সুন্দর একটা লেখার জন্য ধন্যবাদ কথাটা খুব কম হবে… তার চেয়ে বরং একটি গোলাপ রেখে গেলাম… -{@
খসড়া
আপনাকে কষ্টদিয়ে বলছি এমন বারান্দা সত্যিই আমার আছে। যেখানে গাছেরা কানে কানে কথা বলে আমাদের যাতে কোন অসুবিধা না হয় তার দিকে খেয়াল রেখে। আমাদের ভালবাসে আমাদের ভালবাসা দেখে।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
রবল চাঁদনী রাতে তুমি আমি খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়ে দিয়েছি। শুয়ে শুয়ে আকাশে চাঁদের আর মেঘের লুকোচুরি খেলা দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমের কোলে আশ্রয় নিয়েছি তা সূর্যি এসে পরশ না বুলানো পর্যন্ত টেরই পাইনি। -{@ (y) এমনি ঘুম কত দিন হয় না।
খসড়া
আমি কান পেতে রই
ও আমার গোপন হৃদয় গহন দারে বারে বারে
কান পেতে রই।।
ভাল লাগলো মন্তব্য। সত্যিই এ আনন্দ বিরল।
বনলতা সেন
এত দিন এ বারান্দা লুকিয়ে রাখা ঠিক হয়নি । যদিও বারান্দাটি আর আগের মত নেই ।
হয়ত জীবন এমনই পাল্টে যাওয়া ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় ।
খসড়া
ছোট্টবেলায় আমার একটা ছিপছিপে নদী ছিল , নদীটির বিনিময়ে আমি এই পাহাড়টা কিনেছি ইচ্ছে করলেই আমি আর সেই দ্বীপে যেতে পারিনা।
মোঃ মজিবর রহমান
তারপর শুধুই কষ্ট সীমাহীন কষ্ট। যতটুকু আনন্দ আমাকে দিয়েছিল বৃষ্টি বারান্দা তার সবটুকুই সেই বারান্দা সুদে আসলে শোধ করে নিয়েছে নিষ্ঠুর মহাজনের মত।
কষ্ট পেতেই যে হই ভাইয়া।
খসড়া
কেঊ কেউ সুখি হয় সুখের সংগা তারা জানে, সুখের সন্ধানে ছুটে চলে না এদিক ওদিক।
ব্লগার সজীব
অদ্ভুত সুন্দর লেখা। চমৎকার লিখেছেন খসড়া ভাইয়া।
খসড়া
ধন্যবাদ। ভাল লাগলো আপনার তা শুনে ভাল লাগলো আমার।
আগুন রঙের শিমুল
হায় জীবন এত ছোট কেনে
খসড়া
জিবনটা খুব ছোট্টই কিন্তু খুব ঘটনা বহুল। ঘটনাগুলি এত্ত বড় যে জীবনটা অযথাই লম্বা হয়ে যায়।
আগুন রঙের শিমুল
🙂
স্বপ্ন নীলা
আমি কল্পনায় দেখছি যে বৃষ্টির জলে পা ভিজিয়ে দিচ্ছি —বৃষ্টি আমায় ছুঁয়ে দিচ্ছে –চমৎকার লেখনী —মুগ্ধ আমি —
খসড়া
এই তো হেথায় কুঞ্জ ছাঁয়ায় মুগ্ধ মধুর মোহে
এই জীবনে যে কটা দিন পাব
তোমায় আমায় ভালবেসে
মিথুন
অনেক অনেক ভালো লিখেছেন ভাইয়া। ভালো লেগেছে খুব ।
খসড়া
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
শুন্য শুন্যালয়
অনেকদিন অনুপস্থিত ছিলেন আপনি, অই সময়টা খুব মিস করেছি আপনাকে। ফিরে এলেন যেন নতুন একজনকে নিয়ে। চমৎকার একটি লেখা, তবে মন খারাপ হয়েছে। মানুষের মন পরিবর্তন হয়, এই সত্যটা মেনে নিলেই হয় তবে মানাটা কস্টকর। এই বারন্দাটাই হয়তো পারবে আবার আগের মতো করে ভাবাতে, চেস্টা করতে দোষ কি?