
পর্ব -তিন
সাউন্ড সিষ্টেম ছাড়া হয়েছে। শুরু হয়েছে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান। ফরিদা ভানুই মেয়েকে মিষ্টি খাইয়ে ও হলুদ মাখিয়ে গায়ে হলুদের শুভ সূচনা করেছেন। এরপর একে একে চাচী, জেঠী, খালা, ফুফুরা হলুদ মাখিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে শেষ করলো মুরব্বিদের পর্ব।
মৃদুল বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করছে। ছেলে মেয়েরাও তাদের কথা রেখেছে। মোটামুটি সহনশীল ভলিউমেই বাজনা বাজাচ্ছে। দূরে বসে বসে মৃদুল নাসিমাকে দেখছে। এমনিতেই নাসিমার দুধে আলতা গায়ের রঙ। তার সাথে হলুদ শাড়ি, হলুদ গাদা ফুলের মালা সব কিছুই যেন হলুদে হলুদে একাকার। মনে হচ্ছে পরী রাজ্যের কোনো পরীকে ধরে এনে সবাই মিলে তার পরিসেবা করছে। এ মুহূর্তে মৃদুলের মনটা কেমন এক অজানা অনুভুতিতে নড়েচড়ে ওঠে। হৃদয়ের কোনো এক সুক্ষ্ম তন্ত্রিতে বেহালার সুর বেজে ওঠে। মৃদুল বুঝতে পারছেনা কেন তার এমনটা হচ্ছে। ওরা মামাতো ফুপাতো ভাই-বোন হলেও ওদের মধ্যে কখনো তেমন অন্য কোনো সম্পর্কের ডালপালা তো গজায়নি। তবে অন্য মামাতো ফুফাতো ভাই-বোনদের মধ্যে নাসিমাকে তার অন্যরকম ভাল লাগতো। যে ভাল লাগাটা কখনো কাউকে বুঝানো যায় না।
সেই ছোট বেলায় মৃদুলরা যখন মামার বাড়িতে বেড়াতে আসতো, তখন নাসিমা ছিল তার সার্বক্ষণিক খেলার সাথী। যখনই বউ বউ খেলা হতো, সব সময়ই নাসিমা মৃদুল বউ বর হিসাবে বেছে নিত একে অপরকে। অন্যান্যদের মধ্যে হিংসা হিংসির অন্ত থাকতো না। এই নিয়ে রাগ করে খেলা বন্ধ করে দিয়ে মা ফরিদা ভানুর কাছে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যেত নাসিমা। মায়ের কাছে অভিযোগ করে বলতো-
: মা তুমি শুনছ, ওরা না আমাকে আর মৃদুল ভাইয়াকে জামাই বউ বলে ডাকে; ওদের সাথে সাথে আমি আর খেলতে যাবনা।
মা তখন হাসতে হাসতে শান্তনা দিয়ে বলতো-
:ঠিক আছে, তুই ও হেগরে বইলা দিস, ঠিক আছে। আমরা জামাই বউ ঐ। মা বলছে বড় হইলে আমাদের বিয়া হইবই।
মামীর কথা শুনে লজ্জায় মৃদুল কেমন চুপসে যেত।
এতে মৃদুলের মন্দও লাগতো না, বরং সে বেশ উপভোগ করতো বউ বউ খেলাটা। গাছে ওঠে কাঁচা আম পেরে দেয়া, বনে বাদাড়ে ফড়িং এর পিছু পিছু ছোটা। রাতে এক বিছানায় শুতে বায়না ধরা। যদি কোনো দিন এক বিছানায় শুত, গভীর ঘুমের মধ্যে নাসিমা পা তোলে দিত মৃদুলের ওপর। এতে মৃদুল কখনো বিন্দুমাত্র বিরক্ত হতো না। তবে ঝামেলা বাঁধতো রাতে বিছানা ভিজিয়ে দেয়া নিয়ে। এই নিয়ে দোষাদুষির অন্ত থাকতো না। নাসিমা দোষতো মৃদুলকে আর মৃদুল দোষতো নাসিমাকে। তাদের এ ঝগড়াঝাটি দেখে ফরিদা ভানু মুখটিপে হাসতো। ফরিদা ভানু জানতো এটা নাসিমার কাজ, পাছে মেয়ে রাগ করে মুখ ঔ-উ-প করে বসে থাকবে তাই সত্যি কথাটি চেপে যেতেন তিনি। এই নিয়ে কিছু সময় আড়ি পেতে বসে থেকে আবার মিটমাট। এই ছিল তাদের মধুময় ছেলে বেলার দিনগুলো।
স্কুলের পড়ার পাঠ চুকিয়ে কলেজে পড়ার জন্য মৃদুল চলে গেল ঢাকা। বছর দু’য়েক পরে মামার বাড়ি এসে মৃদুল যেন আর নাসিমাকে চিনতেই পারেনা। কেমন মোটাসোটা বড়সর হয়ে গেছে। হাফপেন্ট, ফ্রক ছেড়ে সেলোয়ার কামিজ ধরেছে। ওড়না পড়াও শুরু করেছে কেমন। কাছে আসেনা, দূর থেকে শুধু লাজুক লাজুক হাসে। এর পর থেকে মামার বাড়ি বেড়াতে আসাটা মৃদুলের কাছে কেমন পানসে হয়ে যায়। ফরিদা ভানু এরপর থেকে মৃদুল বেড়াতে এলেই শুরু করলো জামাই বাবু ডাকা।
এ সব ভাবনার মাঝেই নজরে পড়ে পিউকে। সে এখন নাসিমার মুখে হলুদের প্রলেপ দিচ্ছে। তাকে ও অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। যেন বিধাতার নিজ হাতে গড়া প্রতিমা। সবাই হলুদ শাড়ি পড়লেও পিউ পড়েছে রক্তাভ লাল রঙের গর্জিয়াস কাজের একটা জামদানী । ফুল থেকে শুরু করে গলায় কানে হাতের মাটির গহনা পর্যন্ত মেচিং করা। এ’তে তার রুচি বোধের বিষয়টি বেশ ফুটে ওঠেছে। এই মুহূর্তে কা’কে বেশী সুন্দর লাগছে; নাসিমাকে না পিউকে। মিলিয়ে দেখছে মৃদুল। সব মিলিয়ে পিউকে এ প্লাস আর নাসিমাকে এ গ্রেড দেয়া যায়। এখন দু’জনের কাউকেই আর নজরে পড়ছেনা। নাসিমার পাশে আরও বেশ ক’জন সঙ্গী সাথী। তার সাথে কিছু একটা নিয়ে দুষ্টুমী হচ্ছে যেন। ওরা সবাই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এরই মধ্যে ক’জন নুতন গোঁফ গজানো ফাঁটা গলার ছেলে ছোকড়াও এসে জুটেছে। মেয়েদের সাথে শেয়ার করে উঠতি যৌবনের প্রকাশ ঘটাতে চাচ্ছে তারা। নাসিমাকে এখন আর দেখা যাচ্ছেনা সবাই তাকে ঘিরে রেখেছে। মৃদুল পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আগুন ধরিয়ে ধূয়ার কুন্ডলী পাকিয়ে উপরের কি ছাড়ছে। আবছা আলোয়ও কুন্ডলী গুলোর অস্তিত্ব চোখে ভাসছে। এই করতে করতেই কেমন এক নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে যায় মৃদুল। [চলবে…]
১৭টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
হ্যা এমন করতে করতেই নস্টাল জিয়ায় ভেসে চলি। বিয় বাড়ীরর দৃশ্য চোখে ভাসে ভাই।
মাহবুবুল আলম
অনেক ধন্যবাদ!
কামাল উদ্দিন
ছোট বেলার জামাই বউ খেলাটার কথা এখনো মনে হলে বেশ পুলকিত হই। চলুক আপনার বসন্ত………
মাহবুবুল আলম
চরম মজার খেলা ছিল এটি। ধন্যবাদ!
কামাল উদ্দিন
আপনাকেও ধন্যবাদ
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ছোট বেলার ভালো লাগা সেকি ভোলা যায়!
মাহবুবুল আলম
আসলেই ভোলা যায় না। ধন্যবাদ আপনাকে!
নুর হোসেন
ছোট বেলার বর-বৌ খেলা মানুষগুলি এখন নাতী নাতনীর বর বৌ খেলা দেখছে;
শৈশবে ফিরতে ইচ্ছে করছে আর কিছু না হোক বর-বউ খেলার জন্য হলেও।
চলতে থাকুক…
মাহবুবুল আলম
এটাই বিধির লীলাখেলা। ধন্যবাদ!
নুর হোসেন
ছোট বেলার বর-বৌ খেলা মানুষগুলি এখন নাতী নাতনীর বর বৌ খেলা দেখছে;
শৈশবে ফিরতে ইচ্ছে করছে আর কিছু না হোক বর-বউ খেলার জন্য হলেও।
চলতে থাকুক…
সুরাইয়া পারভিন
ওয়াও দারুণ লিখেছেন
চমৎকার উপন্যাস। আগের দুটো পর্ব পড়ে নেবো
মাহবুবুল আলম
পড়লে ভাল লাগবে আশা করি। শুভেচ্ছা জানবেন। আজ চতুর্থ পর্ব দিলাম।
বন্যা লিপি
কত স্মৃতী চোখে ভাসে…….ছোট্টবেলার স্মৃতী মানেই নস্টালজিক আবেশে চোখ ভিজে আসা।
সুন্দর সাবলীল গড়াচ্ছে গল্প। চলুক আরো।
মাহবুবুল আলম
পেুরনো সে দিনের কথা ভুলবে কি রে হায়…। শৈশব স্মৃতি সব মানুষকেই তাড়িয়ে বেড়ায়। ধন্যবাদ!
নিতাই বাবু
আপনার লেখা পড়তে পড়তে মুহূর্তেই হারিয়ে গিয়েছিলাম সেসব ফেলে আসা স্মৃতির মাঝে। সুন্দর একটা গল্প পড়লাম যা নিজের জীবনের গল্প।
শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় কবি দাদা।
মনির হোসেন মমি
উপন্যাসের জট খুলতে শুরু করছে। নাসিমার বিয়ে লগ্নে মৃদুলের কত স্মৃতিই না জেগে উঠছে। খুব সুন্দর উপস্থাপনা। চলুক।
এস.জেড বাবু
মৃদুলের কনফিউশান দুর হউক- সুন্দর দৃষ্টিকোন পিউ’র দিকে গেলে জমবে বেশ। ( আন্দাজ )
আমরা জামাই বউ ঐ। মা বলছে বড় হইলে আমাদের বিয়া হইবই।
“ঐ” – কুমিল্লার আশপাশের ভাষা।
চমৎকার লিখেছেন এই পর্ব।