“বাজান, ও বাজান! লাইলীরে নিয়া কই যাও? আমি লাইলীর লগে খেলুম! বাজান, লাইলীরে লইয়া যাইয়ো না! বা…জা…ন..!!”
ছেলের কান্নামাখা কথাগুলো বাবার হৃদয়ের মাঝখানটা ছিদ্র করছিল! চোখের পানি সামলানোই দায় হয়ে যাচ্ছিল। ছেলের সামনে চোখে জল এলে ছেলের কান্না আরো বাড়বে যে! ঘরের একমাত্র সম্বল, এই গরুটি! মহাজনের কাছ থেকে ধার করে একটা গরু কিনেছিল বছর খানেক আগে! সেই গরু বছরান্তেই এই লাইলীর জন্ম দেয়!
গরুর দুধ বিক্রি করে সংসারের খরচ কিছুটা চলতো। মহাজনের টাকাও কিছু কিছু করে জমা করছিল শোধ করবে বলে! কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন লাইলীর মায়ের মৃত্যু হয়। ছোট্ট বাছুরখানা দিনমান ভরে হাম্বা হাম্বা রবে গলা ফাটিয়ে সে কী কান্না!!
ছেলে রাশুরও সেই ছোটবেলা থেকে লাইলীর সাথে ভাব। সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত লাইলীকে নিয়েই তার ব্যস্ত দিন কাটে! লাইলীও রাশুর আগমনে হাম্বা রবে তাকে আমন্ত্রন জানাতো! রাশুর আদর পাবার আশায় মাথা দোলানো,লেজ নাড়ানো ইত্যাদিও রাশুর মুখস্ত ছিল। বাবার হাতে যেদিন রাশু প্রহার খেতো, সেদিন লাইলীকে কেউ খাওয়াতে পারতো না। যেন সে বন্ধুর ব্যাথায় ব্যথিত!
জীবনের অনেক হিসেব নিকেশের ভীড়ে কখন যে এই দুই প্রাণীতে বেহিসেবি ভালবাসা জন্মেছিল সেটা স্বয়ং দুজনেই জানা ছিল! ধীরে ধীরে তা সবারই জ্ঞাত হল!
ঐদিকে মহাজনের দেয়া ধার মাসের পর মাস হিসেবে সুদের লতায় পাতায় জড়িয়ে এক প্রকার আগাছায় পরিণত হয়েছিল! এই আগাছা এখন এক ভীষণ বিভীষিকা! এখন না নির্মূল করলে পরে তা শিকড় নিয়েই উৎপাটন করবে! বসত ভীটেখানিও শেষে বিক্রি করেও মহাজনের ধার শোধ করতে পারবেনা রসুল! এখন একমাত্র এই অবলা লাইলীই একমাত্র ভরসা!
লালচে রং-এর নাদুস-নুদুস প্রাণী লাইলী! চলার সময় তার পীঠের কুজোটাও স্বীয় সৌন্দর্য্যে নাচে! গলার নিচে চামড়ার পরতটিও চোখে পড়ার মত! ব্যবসায়ীর কাছে এই গরুর মূল্য লাভের চেয়েও কিছুটা বেশি! তাই অনেকেই লাইলীকে কেনার জন্যে অনেক টাকার প্রস্তাব করেছিল! রসুল মিয়া তখন বিক্রি করে নাই। বাজারে এই প্রাণীটিকে মাংসের ওজনেই মাপা হবে, কিন্তু তার বাড়ির ত্রিসীমানায় এই প্রানীটিযে একজন পারিবারিক সদস্য! ছেলে রাশুর খেলার সাথী। রাশুর লাইলী!
মহাজনের দেয়া শেষ সময় ১ মাস হতে আর বাকি ৭ দিন। এই ৭ দিনে যে করেই হোক রসুলকে ধারশোধের বন্দোবস্ত করতেই হবে! রসুলের চিন্তায় দিন যায়! চোখের পাতাও ঝাপসা হয়ে যায় নিরাশার অকুল পাথারে!
৩ দিন পর কোরবানীর ঈদ। রসুল অন্যান্য গরুব্যবসায়ীদের সাথে লাইলীকেও নিয়ে যাবে শহরের হাটে বিক্রি করতে! খুব সকালে গোয়াল ঘর থেকে লাইলীকে বের করে আনছিল। যেন ছেলে না জানতে পারে! লাইলী অবলা ছিল বটে তবে অবুঝ ছিল না! তাই রসুল মিয়ার আগমনেই সে বিচ্ছেদের টের পেয়েছিল।এই বসতভীটে থেকে বিচ্ছেদ! রাশু থেকে বিচ্ছেদ! তাই সে হাম্বা হাম্বা রবে প্রকৃতি অস্থির করে ফেলছিল! লাইলীর আওয়াজে রাশুর ঘুম ভেংগে গেল। দৌড়ে উঠোনে এসে দেখে বাপ তার লাইলীকে টেনে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে! আর তখনই রাশুর গগনবিদারী কান্না আর আকুল আবেদন “বাজান, ও বাজান..! লাইলীরে লইয়া কই যাও….!!”
রাশু-লাইলীর বিচ্ছেদের দৃশ্য খুবই স্পর্শকাতর! লাইলীকে হাজার টেনেও এক পা সামনে নেয়া যায় না, অন্যদিকে লাইলীর গলা জড়িয়ে রাশুর কান্না মাখা আর্তনাদও সহ্য করা যায় না! লাইলীও সেই যে বসে পড়লো, আর দাড়ায়ই না! অসহায় রসুল মিয়া শেষে বহু কষ্টে লাইলীকে গাড়িতে তুলেই শহরের দিকে রওনা হল!
রাশুও সেই গাড়ির পিছনে পিছনে দৌড়াতে থাকলো! শেষে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়েই মেঠোপথের ধারে বসে বসে চোখের জল ফেললো! রাশুর পিছনে পিছনে ছুটে আসা তার মা কাছে এসে ছেলেকে কোলে করে চুপ করে বসে রইলো! রাশুও কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কোলে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল সে নিজেও জানে না..!! মায়ের কানে শুধু লাইলীর করুণ হাম্বা হাম্বা রব আর ছেলের আকুতি ভরা জিজ্ঞাসাগুলো ভেসে আসছিল। যেন তিনি এখনো দেখছেন সেই দৃশ্য….
“ও বাজান, বাজানরে! আমার লাইলীরে নিও না! আমার লাইলী কী খাইবো? আমার লাইলীরে কে দেখবো..!!?? আমি খেলুম কার লগে…??ও বাজান…!!!”
৮টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
আমাদের একটা গরু ছিলো নাম লক্ষ্মীমনি। লেখাটি পড়ে ওর কথা মনে পড়ে গেলো। ওর চোখ ছলছল, গড়িয়ে পড়ছিলো জল। ওকে বাগানেই রেখে আসতে হয়েছিলো।
ভালো লিখেছেন।
সিহাব
😀
মেহেরী তাজ
আহা…. 🙁
এমন ঘটনা পড়লে মন খারাপ হয়ে যায়। 🙁
আপনার লেখা ভালো লেগেছে।
সিহাব
Thanks.. 😀
ইমন
বাহ! সুন্দর লিখেছেন 🙂
সিহাব
Thanks.. 😀
জিসান শা ইকরাম
মন ভারাক্রান্ত লেখা
ভালো লিখেছেন।
আপনি অন্যের দু একটা লেখা তো পড়লে পারেন।
শুন্য শুন্যালয়
নিয়মিত বিফ চিকেন খাই, তবু কোরবানি এলে কি কারনে যেন কষ্ট হয়, চোখের সামনে তাদের হত্যাটা দেখি বলে হয়তোবা।
মনটা খারাপ হলো পড়ে।