২০০০ সনে এখানে ওখানে বাড়ি খুঁজতে গিয়ে শেষে এ বাড়িটি পছন্দ হয়ে যায়।
শুধু সামনের সবুজ উঠোন, নানান ফুলের গাছ আর ব্যলকনিটুকু মনে ধরে যায় ভীষণভাবে। সে রাতে কামাল কাজ শেষে ফিরলে তাঁকে বলি, এটিই কিনবো, এটাই চূড়ান্ত।সে আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়। আমি রাতভর ম্যাপ এঁকে বুঝাই ডুপ্লেক্স বাড়িটির আনাচ-কানাচ। সম্যক ধারনা দেই লিভিং রুম, বেডরুম, বেইজমেণ্ট, পার্কিং গ্যারেজ সহ চায়নিজ প্রতিবেশী সব, স-ব। উত্তেজনা আর দু’চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে রাতটুকু ভোর হয়।
সেই থেকে আমাদের টোনাটুনি’র সংসারের দ্বিতীয়বেলা এ বাড়িটিতেই। এখানেই আমাদের সন্তান রিয়াসাত, রিহানের জীবনের শুরু, এবং বেড়ে উঠা। আত্মীয়, অনাত্মীয় অনেকেরই আমেরিকা জীবনের শুরু এ বাড়িটিতে। যারা স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে এদেশে আসেন, তাঁদের একটু গুছিয়ে উঠবার আগ অবধি স্বল্পকালীন আবাসস্থল।
এখানে ব্যলকনিতে বসে শীতের আকাশ দেখা, তুলার মত তুষারের ঝরে পড়া দেখা, ঘন বর্ষণ দেখা কিংবা পূর্ণিমা রাতে উঠোন ভেসে যাওয়া জ্যোৎস্না দেখা __ এ এক অদ্ভুত ভালোলাগাময় অনুভূতি। ভরদুপুরের খাঁখাঁ রৌদ্রের সময়টুকুতে পৃথিবী যখন ক্ষণিক থেমে থাকে, ঠিক তখন সবুজ উঠোনটি হয়ে উঠে আমার পাখি দেখার দ্বিতীয়বেলা।
বছরের ছুটির সময়গুলোতে যখন নিউইয়র্কের বাইরের শহরে বেড়াতে যাই, ভালো লাগে বিকেল অবধি। কিন্তু সন্ধ্যা ঘনালেই বাড়িগুলোয় নেমে আসে মধ্যরাতের নিরবতা। ঝিঁঝিঁ ডাকে অবিরাম। আশেপাশের ঘুমন্ত বাড়িগুলো থেকে অন্ধকার ঠিকরে ঠিকরে পড়ে। রাতগুলোকে মনে হয় পৃথিবীর এক একটি দীর্ঘতম রাত। সেইসব প্রাসাদে রাতভর নির্ঘুম এপাশ এপাশ করতে করতে তীব্র ভাবে অনুভব করি, কি গভীরভাবেই না আমি আমার শহর আর বাড়িটিকে ভালোবাসি।
……
আমার ভালোবাসার আরেকটি বাড়ি ছিল, বাংলাদেশে। বাবার বাড়ি।
আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা মফঃস্বল শহরের সেই বাড়িটি। অনেক কষ্টে সৃষ্টে দু’দিকে ব্যলকনি সমেত একটি বাড়ি বানালেন বাবা। পাড়ার গণ্যমান্য মানুষ প্রিন্সিপ্যাল সাহেব আর চৌধুরী সাহেব একজোট হয়ে অভিযোগ আনলেন বাড়িটির ব্যলকনি আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। নানান টেনশন, উত্তেজনা, নির্ঘুম রাত শেষে একদিন সন্ধ্যার কিছু পরে আব্বা-আম্মা গেলেন তাঁদের বাসায়। বাড়িটির নির্মাণে যে আকাশসীমা লঙ্ঘন করা হয়নি, এর পক্ষে নিজেদের যুক্তি উপস্থাপন করলেন। চৌধুরী সাহেব কিছু জায়গা দখলে নিয়েছিলেন অনেক বছর আগে। কথা ছিল বাড়ি নির্মাণের সময় তা ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু শেষ অবধি তিনি কথা রাখেননি। এখন আমার বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। বেঁচে নেই চৌধুরী সাহেব। বেঁচে নেই প্রিন্সিপ্যাল সাহেবও। তাঁরা মিশে গেছেন পৃথিবীর গহীন মৃত্তিকায়। কিন্তু কালের সাক্ষী হয়ে বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে আজও।
প্রতিটি বাড়ি ঘিরে এমন কতশত আবেগ, স্বপ্ন কিংবা স্বপ্ন ভঙ্গের গল্প আছে। কিন্তু বেলাশেষে আমাদের খালি হাতেই ফিরে যেতে হয় একই ঠিকানায়।
কি অদ্ভুত এই জীবন এবং জীবনের গল্প, তাই না ?
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
৩২টি মন্তব্য
শুন্য শুন্যালয়
কী সুন্দর করেই না লেখেন আপু!! এই যে এত গল্প, এতো তুচ্ছ তুচ্ছ করে যত্ন নেয়া, বাড়ি কি আমাদের মনে রাখে? কি জানি! ভীষন ভাবে নাড়া দেয় এক একটি লেখা আপনার, তাইতো আমার নাম শুন্য, সারাক্ষন ভাবি কোন মায়া রাখবো না, তবুও জড়িয়েই যাই।
আপনার মতো করে কবে লিখবো?
রিমি রুম্মান
আমাদের জীবনটা কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুন্যই । সব ছেড়ে যেতে হয়, হায় !
আপনার লেখা আপনার মতোই সুন্দর। আমিও তো ওমন করে লিখতে পারি না ।
মুহাম্মদ আরিফ হোসেইন
কি অদ্ভুত এই জীবন এবং জীবনের গল্প, তাই না? -হুম! আসলেই অদ্ভুত! শুধু অদ্ভুত না! অদ্ভুত সুন্দর।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন, সুন্দর থাকুন।
শুভকামনা নিরন্তর…
জিসান শা ইকরাম
নিজের বাড়ি, নিজেদের বাড়িকে ঘিরে এমন স্বপ্নের মত আবেগ আমাদের সবার সাথে।
পৃথিবীর সর্বোত্তম স্থানের চেয়েও উত্তম থাকে নিজ নিজ বাড়ি, তাই ফিরে ফিরে আসা নিজের বাড়িতে।
একটি সময়ে আমরা চলে যাই, বাড়ি থেকে যায়, থেকে যায় স্মৃতি।
অদ্ভুত মায়া দিয়ে লেখেন আপনি।
আমেরিকার স্বল্পকালীন আবাসস্থল এর কথা জেনে গেলাম, বলা যায় না কখন কাজে লাগে 🙂
প্রবাসে ভাল থাকুন।
রিমি রুম্মান
আগাম স্বাগতম জানিয়ে রাখলাম। 🙂
নাসির সারওয়ার
শীত শহরে বারান্দাওয়ালা বাড়ি কিন্তু খুব বেশী না। এদিক থেকেতো আপনি অনেক এগুনো।
এতো মায়া দিয়ে লেখেন কেমন করে!
রিমি রুম্মান
বারান্দাওয়ালা বাড়ি খুব কমই দেখেছি। অনেক মায়া এই সবুজে জড়িয়ে রেখেছি। তাই লেখায়ও মায়া’র প্রভাব পড়েছে হয়তো। 🙂
জিসান শা ইকরাম
সামনের সবুজ উঠোন, নানান ফুলের গাছ আর ব্যলকনিযুক্ত বাড়িটির একটি ছবি কি দিয়ে দেয়া যেত না?!
আমাদের সোনেলার সোনার মেয়ের বাড়ি দেখার অধিকার আছে তো আমাদের 🙂
রিমি রুম্মান
ছবিটি দেরিতে হলেও সংযুক্ত করা হয়েছে। 🙂
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
ফেবুকেই পড়েছি সেখানে বাড়িটির ছবি ছিল এখানে দিলেন না কেনো?প্রতিটি বাড়িরই এক একটি গল্প থাকে যা স্মৃতির পটে আকাঁ হয়ে থকে আমৃত্যু। -{@
রিমি রুম্মান
বাড়ি ঘিরে আমাদের সকলেরই স্বপ্ন থাকে। স্মৃতি থাকে। শেষে একদিন এই মায়াঘেরা বাড়ি রেখে চলে যেতে হয় সবাইকে।
আবু খায়ের আনিছ
একদিকে হিংস্রতার গল্প পড়ছি, অপর দিকে শান্তির কথা শুনছি। জীবন কত অদ্ভুত হতে পারে ভাবতেই পারি না।
রিমি রুম্মান
এইসব অদ্ভুত জীবনের গল্প নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা।
ভাল থাকুন সবসময়য়।
নীলাঞ্জনা নীলা
কতো ঘটনা জীবনের পরতে পরতে ঘটে যায়। আর আমাদের সঙ্গী হয় ছোট-খাটো কিন্তু বিশাল আবেগ মেশানো সময়গুলোই।
রিমি আপু তোমার জীবনের গল্পগুলো পড়ে এমন বিশাল আবেগ ছড়ায় অনুভূতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সবাই কি আর পারে এভাবে গল্প বলতে?
তাইতো অপেক্ষায় থাকি তোমার জীবনের একেকটি গল্প শোনার জন্যে।
ফেসবুকে দেখেছি খুব সুন্দর তোমার বাড়ী। ভালো থেকো, স্বস্তিতে থেকো তোমার ওই সবুজ নীড়ে। -{@
রিমি রুম্মান
অথচ দেখো নীলা’দি, এমন গল্প কিন্তু আমাদের সকলেরই। খুব বেশি হেরফের হয় না আমাদের জীবনের গল্পগুলো।
ভাল থেকো , অনেক ভাল।
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু জীবনের গল্প কি আর ভিন্ন হয়? কখনোই না।
তুমিও ভালো থেকো।
গাজী বুরহান
সব চলে গেলেও স্মৃতিগুলো থেকে যায়। স্মৃতিরা কি রকম যেন?
রিমি রুম্মান
স্মৃতিরা কখনো আনন্দের, কখনো বেদনার।
আর এই নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা।
ইঞ্জা
বেশ সুন্দর করে লিখেন আপনি, লেখাটি ফেইসবুকে দেখেছি, সোনেলায় কমেন্ট করা ইচ্ছায় আর ফেবুতে কমেন্ট করিনি। আসলে আপনার ছোট ছোট বিষয় নিয়ে আবেগ নিয়ে এতো সুন্দর লিখেন যা মন ছুঁয়ে যায়, শুভকামনা রইল। 🙂
রিমি রুম্মান
শুভকামনা আপনার জন্যেও।
🙂
ইলিয়াস মাসুদ
আমার বাবার বাড়ির কাচারী বাড়ির একটা ঘর আমাকে নিজেস্ব করে দিয়েছিল কিশোর বয়সে,সেই ঘরটা আমার আর কোথাও হলো না…………।
খুব ভাল লাগল আপু
রিমি রুম্মান
পড়লে মনে নিজের সেই ঘর
সবকিছুই লাগে ভীষণ পর পর…
ভাল থাকুন, অনেক ভাল।
ইলিয়াস মাসুদ
🙂
আজিম
যে-স্বপ্নের কারনে মানুষ বাড়ী করে, সেই স্বপ্ন আমার নেই, আর সেজন্যই হয়ত বাড়ী হয়নি আমার। মাকে দেখি গ্রামের বাড়ীর উপর কী অপার আকর্ষণ! মাঝে মাঝে অসুস্থ হলে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। সুস্থ না হতেই বাড়ী যাওয়ার জন্য তাঁর আকাংখা দেখে তাজ্জব বনে যাই। আপনার কথার সাথে একমত “কী অদ্ভুত জীবন এবং জীবনের গল্পগুলি।”
অত্যন্ত ভাল রিখে
রিমি রুম্মান
আমার দাদুও এমনটি করত শহরে এলে। আমরা কত্ত আদর যত্ন করতাম আমাদের কাছে থাকার জন্যে, কিন্তু তবুও তিনি ফিরে যেতে চাইতেন গ্রামের মুক্ত বাতাসে, দীঘির পাড়ে, সুপারি বাগানে…
আজিম
মন্তব্যটা অসমাপ্ত থাকতেই এরকম হয়ে গেল। আসলে লিখতে চেয়েছিলাম, অত্যন্ত ভাল লিখেছেন।
রিমি রুম্মান
আমি কিন্তু ঠিকই বুঝে নিয়েছি।
ভাল থাকবেন। শুভকামনা।
মেহেরী তাজ
আমার আজকাল খুব চিন্তা হয় “আজ আমি যে ঘরে ঘুমাচ্ছি কাল সেখানে কে ঘুমাবে?বাড়ির এক একটা ইট আব্বু কি যত্নেই না সাজাচ্ছে এবাড়িতে। সেসবে ঠিক থাকবে কিন্তু আমরা এক সময় থাকবো না,আরো কত কত চিন্তা!
লেখা বরাবরের মতই সুন্দর…….
এবার বলে কেমন আছেন আপু?
রিমি রুম্মান
ভাল আছি। আমার বাবাও কি ভীষণ যত্নে, মায়ায় বাড়ি বানিয়েছেন আমাদের মফস্বল শহরে। অথচ এখন ছয় ফুট মাটির গভীরে ! 🙁
মৌনতা রিতু
আমেরিকাতে সবারই হয়ত এমন একটি স্বল্পকালিন আশ্রয় দরকার হয়। কিন্তু তা যদি এত সুন্দর বাড়ি হয় তবে তো কথাই নেই।
আমার বান্ধবী মিতুও এ বছর একটা বাড়ি কিনেছে।
আমার ছোটটা যাবার জন্য অস্থির, কিন্তু বিপু কিছুতেই যাবে না।
সত্যি আপু, আমরা যে যেখানেই যাই না কেন, নিজের বাড়ি তো নিজের বাড়িই।
এই যে যেখানে আমার সারাটা জীবন কেটেছে, সেই বাড়িতে এখন কিছুদিন থাকার পরে আমার এই ছোট সংসার ভাড়া বাড়িতে আসার জন্য মন ছটফট করে।
মানুষ চলে যায়, কিন্তু কথা থেকে যায়। তবুও মানুষ সামান্য কিছু জমির টুকরো নিয়ে কতো যে হানিহানি করে !
পোষ্টে ভাললাগা রইল।
তোমার ছেলেদের জন্য রইল ভালবাসা।
রিমি রুম্মান
আমেরিকায় আমার প্রথম আবাস ছিল একটি মাত্র রুম। বাড়ির অন্য রুমে অন্য মানুষজন থাকতো। তবুও সেই একটি ছোট্ট রুম ছেড়ে আসতেও বুকের ভেতরটা ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছিলো। এতটুকুন জীবন। যেখানে যাই সেখানেই মায়া !