
এবছর বৈশাখ ছিল বর্ষার মতো। সূর্যের দেখা নেই দিনের পর দিন। যখন তখন অঝোরধারা। হিমেল পরিবেশে রোজা শুরু। চুলার পাশে দিনমান পার করলেও ঘেমে একাকার হওয়ার সম্ভাবনা না থাকায় ইফতারির আয়োজনে ছিল না কোনও ক্লান্তি। সন্ধ্যার পর যদি মেঘের গুড়ুম গাড়ুম- এর কারণে চলে গেছে বিদ্যুৎ, তো সেটা হয়েছে আমাদের কাছে বাড়তি পাওনা। লাইট, ফ্যান চললেও টিভি কম্পিউটার তো বন্ধ, অতএব বেশ একটা নিবিড় আবহাওয়ায়, ঘরের লাইট বন্ধ করে দুই মেয়েকে নিয়ে বসে পড়েছি গল্প করতে। গল্প মানে সেই সুদূর অতীতের স্মৃতিচারণ। এখনকার শিশুদের শৈশব তো বড় কঠিন। মাঠ নেই, ঘাট নেই, গাছে চড়ে পাখির বাসা চুরি করা নেই, নিঝ্ঝুম দুপুরে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে গামছা দিয়ে মাছ ধরাও নেই। আর চড়ুইভাতি? কোথায়? আছে বটে পিকনিক। সাজগোজ করে গিয়ে রান্না করা খাবার খেয়ে, ছবিটবি তুলে বাড়ি ফিরে আসা। নেই উত্তেজনা, নেই মনের আকুলিবিকুলি। রান্নার জন্য শুকনো ডালপাতা জুটলো কিনা, জনপ্রতি জোগাড় করা চাল-ডাল-ডিমে অনাহুত কেউ ভাগ বসাবে কিনা কিংবা রাঁধতে গিয়ে কারও হাত পুড়বে কিনা, এসবের কোনও বালায়ই নেই এখন। বর্তমান শৈশবে না পাওয়া সেসব সময়গুলোকে তুলে এনে মেয়েদের সামনে মেলে ধরতে আমি যতটা আনন্দিত হয়েছি, দেখেছি, মেয়েরা তার চেয়েও কয়েকগুন বেশি উৎসাহিত। মাঝে মাঝেই অনুযোগ ভরা কণ্ঠস্বর ওদের,
“আমরা কেন গরুর গাড়িতে চড়িনি? কেন আমরা সাঁতার জানি না, আর কেনই বা নৌকায় পার হইনি নদী?”
কোনও জবাব নেই আমার। আসলে কোনও জবাব দেয়ার মুখই নেই আমার। শহুরে শিশুদের শৈশব হরণে এই আমরা, এখনকার বাবা-মায়েরাও তো অনেকাংশেই দায়ী!
বর্তমান সামাজিক, পারিপার্শ্বিক অবস্থা তো তৈরি করেছি আমরাই। সেইসাথে আমরাই তো ওদেরকে করে তুলেছি জনবিচ্ছিন্ন। লেখাপড়ার চাপে ব্যতিব্যস্ত করে রাখছি সারাক্ষণ। পরীক্ষায় আরও আরও ভালো ফলাফল, অন্যকে কেবলই টপকে যাওয়ার খেলা তো আমরাই খেলতে শিখিয়েছি ওদের। আর এই খেলা শেখাতে গিয়ে ভুলে গেছি, মানুষ হতে শেখাতে হবে, শেখাতে হবে ব্যথিত হতে অপরের ব্যথায়, দেশের ব্যথায়।
দেশকে, দেশের সংস্কৃতিকে ধারণ করা পশ্চাৎপদতা, এ ধারণা কি খুব কৌশলে বুনে দিইনি আমরাই ওদের ভেতর?
বড় হও, নামের পাশে যোগ করো এত এত ডিগ্রি, আর তারপর স্থায়ী ঘাঁটি গেঁড়ে ফেলো অচেনা প্রবাসে। বিদেশ মানে সব পাওয়ার দেশ। না থাকলো আপনজনেরা, তুমি তো ভালো থাকবে! ঝকঝকে, তকতকে সেসব দেশ, তোমার দেশে তো কিলবিল করে জীবাণু। জীবাণুতে ভরেই থাক তোমার দেশ। যে অসাধারণ মেধা নিয়ে তুমি অর্জন করেছো বড় বড় ডিগ্রি, তা কেন অপচয় করবে এই পোড়া দেশে থেকে? তোমার মেধা ব্যয় করো ওসব সোনার দেশে, সঠিক মূল্যায়ন, উপযুক্ত পারিশ্রমিক ওরাই দিতে পারে তোমাকে!
এমন উচ্চাশা আমরাই বুনে দিয়েছি আমাদের সন্তানদের মধ্যে। যার ফলে দেশে আজ মেধার আকাল। একবারও কি ভেবে দেখছি আমরা, সেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, প্রফেসর আব্দুল হাই, ড. আনিসুজ্জামান প্রমুখ, তাঁদের মতো নিবেদিতপ্রাণ গবেষক, দেশপ্রেমিক এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একনিষ্ঠ সেবক এখন কয়জন আছে? তাঁদের উত্তরসূরী কেউ তৈরি হয়েছেন কি সেভাবে? অথচ আমরা একে একে হারিয়ে ফেললাম সবাইকে। তাঁদের শূন্যতাটুকু ভরবে না কোনোভাবেই, কিন্তু অন্তত যোগ্য উত্তরসূরী তাঁদের অভাববোধটা ভরাতে সাহায্য করতো অনেকটাই। সেটা হয়নি, আর দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, যেসব কথাসাহিত্যিক, কবি, কিংবা গীতিকার-সুরকার অথবা সংগীতশিল্পী, যাঁদেরকেই আমরা হারিয়েছি, একেবারে হারিয়েই ফেলেছি। তাঁদের অবর্তমানে হাল ধরার মতো তৈরি হয়েছে কয়জন?
দেশের উন্নতি হয়েছে, আক্ষরিক অর্থে দেশ এগিয়েছে অনেকটাই, যা দৃশ্যমান। কিন্তু উন্নতি মানে কি শুধুই অন্তঃসারশূন্য চাকচিক্য, বিদেশে মেধা পাচার হয়ে যাওয়া আর দেশ মেধাহীন? চিকিৎসা করতে দেশের বাইরে পাড়ি জমানো কার জন্য সম্মানের, জনগণ নাকি সরকারের?
মঙ্গলকর কার জন্যে? কারও জন্যেই নয়।
আর তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি এই ভয়াবহ দুর্যোগের কালে। এখন ওসব ঝাঁ চকচকে দেশে আর আমাদেরকে ঢুকতে দেয়া হবে না। চিকিৎসা ব্যবস্থা যেমনই হোক, আর রোগী যেই হোক, চিকিৎসা নিতে হবে নিজের দেশেই।
মুখ ফুটে বলি আর না বলি, নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারার জন্য চুপি চুপি এখন আমরা কপাল চাপড়ে চলেছি নিজেদের। মাঝ নদীতে ফুটো নৌকাটা জলে ডুবে যেতে বসেছে যখন, তখন হুশ হয়ে আর লাভ কী!
জানি লাভ নেই। স্বর্ণালী অতীতের স্মৃতিচারণই আমাদের মনে এনে দেবে বকুলের মিষ্টি সুবাস। তাই স্মৃতিচারণ করেই এ-প্রজন্মের কানে তুলে দিতে হবে ভবিষ্যতের বীজমন্ত্র। বিশ্বের উন্নত দেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের মহামারি থেকে যদি কোনোদিন সেরে ওঠে পৃথিবী, দেশকে ভালোবেসে যেন এই পোড়া দেশটাকে প্রকৃত অর্থেই সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে পারে ওরা। বিদেশে বাস করে কিংবা মেধা বিলিয়ে দিয়ে নয়, প্রয়োজনে মেধাকে ঝালাই করে ফিরে আসুক সন্তানেরা। ফিরে এসে নিজেদের কাজে লাগিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলুক সোনার বাংলাকে মেধায় মননে রুচিতে। মৃত্যু যখন দুয়ারে, এ আশাতেই বাঁধছি খেলাঘর!
২৩টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
এখনকার বাচ্চাদের , বাবা-মায়ের বিষয়টি খুব সুন্দর তুলে ধরেছেন। আপনার লেখায় , বলার ধরনে অন্যরকম ভালো লাগা থাকে। ধন্যবাদ আপনাকে
রেহানা বীথি
ভালো থাকুন আপু সবসময়।
ফয়জুল মহী
মার্জিত ভাষায় বেশ লেখা। ভালোবাসা ও শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন।
ছাইরাছ হেলাল
সকল দুর্যোগ কাটিয়ে আমাদের দেশ হোক স্বপ্নের-দেশ এ প্রত্যাশা আমাদের সবার।
আমাদের ব্যর্থতা আমাদের শিশুদের প্রকৃতির কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি।
দারুন স্মৃতি চারণ।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন ভাইয়া।
তৌহিদ
শিশুদের জন্য এ পৃথিবী বাসযোগ্য হয়ে উঠুক। আমরা যখন ছেলেবেলার গল্প বলি তখন তারা হতবাক হয় আসলে যে এমন ছেলেবেলাও ছিলো! মাঠ নেই, ঘাট নেই তাদের পৃথিবী এখন মোবাইল, ট্যাব আর বাসার ছাদের গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ। তাই তাদের চাওয়ায় আর কি দোষ!
সুন্দর একটি বিষয় লিখলেন আপু। শুভকামনা সবসময়।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন ভাই।
আরজু মুক্তা
হারিয়ে ফেলেছে শৈশব। নেই উদ্যোম উৎসাহ।
তাদেরও বন্দিদশা কাটুক। আমরাও নিজোরা চেষ্টা করি বাচ্চাদের প্রকৃতি দেখাতে।
রেহানা বীথি
ভালো থাকুন আপু।
ইঞ্জা
বাচ্চাদের জিজ্ঞাসার কি উত্তর দেবেন, আমরা ছোটো থাকতে শহরেও গরুর গাড়ী চলতে দেখেছি, এখন যা দেখা সুদূরপরাহত, অপেক্ষা করুন, করোনাকাল চলে গেলে নতুন এক পৃথীবি দেখবেন সবাই।
লেখাটি খুব ভালো লাগলো আপু।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন ভাইয়া।
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা আপু।
সুপায়ন বড়ুয়া
সুন্দর একটি বিষয় লিখলেন আপু।
শৈশব তো আর আসেনা ফিরে
নতুন পৃথিবী দেখছি এবার
এই করোনা কালে।
ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন দাদা।
হালিম নজরুল
আপনার লেখনির উপস্থাপনা চমৎকার
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন সবসময়।
প্রদীপ চক্রবর্তী
অসাধারণ প্রকাশ দিদি।
শুভকামনা অনেক।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন।
জিসান শা ইকরাম
আমাদের সন্তানদের শৈশব নেই আসলে। বাসার চার দেয়ালের মধ্যে থেকে আমাদের ছোট বেলার সেই সব মজার দিনের স্বাদ এরা কখনো পাবে না। আমরা এদের শৈশব হরণ করে চাপিয়ে দিয়েছি শিক্ষার নামে অসুস্থ প্রতিযোগিতা।
দেশকে ভালোবাসার বীজ আগামী প্রজন্মের মধ্যে অবশ্যই বপন করতে হবে।
ভালো লেগেছে লেখা আপু।
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
ভালো থাকুন ভাইয়া সবসময়।
উর্বশী
চমৎকার বিষয় নিয়ে উপস্থাপন করেছেন আপু।ইট, পাথরের বলয়ের মাঝে বাচ্চারা প্রকৃতির ছোঁয়া থেকে অনেক দূরে । অস্থিরতার মাঝে ই তো সময় পার হচ্ছে এখন।সুন্দর সবুজ পরিবেশ ফিরে আসুক। নিয়মের বেড়াজালে হয়তো শিশুদের প্রকৃতির ছোঁয়া পাওয়া বাধ্যতামূলক হতে পারে। আর এ কাজ টি হয়তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই শুরু হবে। অনেক শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন আপু।