মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, ভালোবাসা জানবেন মা ।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জন্ম ১৯৪৭ এর ১৯ ফেব্রুয়ারী।জন্ম স্থান খুলনা। বাবা-মায়ের এগারো সন্তানের মধ্যে প্রিয়ভাষিণী সবার বড়।
নানা আব্দুল হাকিম ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের স্পিকার হলে তিনি নানার পরিবারের সাথে ঢাকায় চলে আসেন। টিকাটুলি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা, তারপর সিদ্ধেশ্বরী গার্লসে ভর্তি হন। কিন্তু বাবার ইচ্ছায় ঢাকা ছেড়ে খুলনায় চলে যেতে হয়।তারপর লেখাপড়া শেষ করেছেন খুলনা থেকে।
১৯৬৩ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে বনীবনা না হওয়ায় বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে ।
এর কিছুদিন পরেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ । যুদ্ধকালীন পুরোটা সময় জুড়ে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা তিনি নির্যাতিত হন।
নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হয়।রক্ষণশীল সমাজে তিনি তখন নানান বঞ্চনার শিকার। এই পরিস্থিতিতে আহসান উল্লাহ আহমেদ সব কিছু জেনে উনাকে জীবন সঙ্গিনী করেন। দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৭২ সালে।
একাত্তর পরবর্তী দুঃর্বিষহ জীবনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন ,
“যে খালার সাথে একই জামা পড়ে, একসাথে খেলাধুলা করে বড় হয়েছি, সেই খালা-মামারা, যারা সারা জীবন এত সংস্কৃতি চর্চা করেছেন তাঁরা আমার উপর পাক হানাদারদের নির্যাতনের কারণে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধু বড় মামা, মেজ মামা আর মা উদারভাবে কথা বলেছেন। কোন অনুষ্ঠান বা দাওয়াতে গেলে দেখা যেত সব মহিলারা একদিকে জটলা করে আমাকে নিয়ে কথা বলছে। আমি গেলেই সবাই একে একে সেখান থেকে সরে যেত। আমার দ্বিতীয় স্বামী যিনি সবকিছু জেনে বুঝেই আমাকে বিয়ে করেছেন, তিনিও একবার এই পরিস্থিতি দেখে আমাকে কোন দাওয়াতে বা অনুষ্ঠানে যেতে নিরুত্সাহিত করেছেন। আমি প্রতিবাদ করেছি, না আমি যাবই। আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। তাহলে আমি কেন যাব না? যুদ্ধ শুধু নয় মাসই আমাকে ঠেকায়নি- সারা জীবনের জন্য সংগ্রামে ফেলে গেছে।”
যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও জানান,
” ঐসময়ের কথা আমি ভাবতেও পারি না। গভীরভাবে যখন আমি উপলব্ধি করতে যাই, তখন আমার সকল স্নায়ু শিথিল হয়ে যায়। আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। আবার সুস্থ হয়ে উঠতে আমার অনেক সময় লেগে যায়। ”
পেশাগত জীবনে তিনি শিক্ষকতা করেছেন এবং বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করেছেন।
বর্তমানে ঘর সাজানোর নানান উপকরণ তৈরী করেন এবং তিনি একজন ভাষ্কর। উনার শিল্প কর্মের প্রধান উপকরণ গাছের শুকনো ডালপালা এবং গুড়ি, শেকড়-লতা, শেওলা জমা বাঁশ-কাঠ। মনের ভেতরের শিল্প ভাবনাকে তিনি রুপ দেন ভাষ্কর্যে।
প্রিয় ফেরদৌসী
প্রিয়ভাষিণী ২০১০ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। এছাড়া আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক লাভ করেন।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন, ২০০২ এর ৭ (ঝ) এর ধারা অনুযায়ী তিনি এখন থেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা। এর আগে ১২২ জন বীরাঙ্গনা মায়ের আবেদনের পর উনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সকল বীরাঙ্গনা মায়েদের জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
:: উদ্ধৃতিতে আটকে দেয়া ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কথাগুলো নেয়া হয়েছে তাঁরই দেয়া একটি সাক্ষাতকার থেকে।
২৭টি মন্তব্য
ব্লগার সজীব
মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী মা এর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। ৭১ এর পরে কত মা যে এমন সামাজিক নিগ্রহের কারনে জীবন যাপন করেছেন এর কোন হিসেব নেই। দোষ না করেও সামাজিক চাপ থাকে এনাদের উপর।
আপু আপনি এখানে নতুন। যে কোন সমস্যায় এখানে আপনার মন্তব্যের বক্সে লিখবেন। সোনেলার ব্লগারগন যে কেহ তা সমাধান করে দেবেন। আমি যখন নতুন ছিলাম, অনেক কিছুই জানতামনা। এভাবেই জেনেছি।
রুম্পা রুমানা
অনেক ধন্যবাদ ভাই। সমস্যায় পড়লে অবশ্যই বলবো। এখানে সবাই খুব আন্তরিক । ভালো লাগছে পরিবেশটা।
অপার্থিব
বাঙ্গালী সমাজের আবহমান রক্ষণশীলতা কারণে অধিকাংশ বীরঙ্গনা বা মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিত নারীরা তাদের জীবনের এই মর্মান্তিক অধ্যায়টা আড়ালে রাখতে চায়। অনেকে পারত পক্ষে নিজের বীরঙ্গনা পরিচয়টা প্রকাশই করতে চায় না । ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, একারনে ওনার জীবন ও কর্ম নিয়ে আরো বেশি আলোচনা ও প্রচার জরুরী। লেখাটা ছোট, আরো বিস্তারিত ভাবে ওনার জীবন সংগ্রাম নিয়ে আলোচনা করলে ভাল হত।
রুম্পা রুমানা
বড় করেই লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সবাই তো এত বড় লেখা পড়েন না। তাই অল্পই লিখেছি। তবে , বড় করে একটা পোস্ট দেয়ার ইচ্ছে রাখলাম।আপনাকে ধন্যবাদ।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বীরাঙ্গনা!!!! কয়জন বীরাঙ্গনা একজন ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী হয়ে উঠতে পেরেছে? এতো স্ট্রং পারসোনালিটি থাকার পরও তিনি কতো মানসিক যন্ত্রণায় ভূগেছেন আর অন্যরা?
মুক্তিযোদ্ধারা নয় মাস যুদ্ধ করেছেন বিনিময়ে বীরের মর্যাদা লাভ করেছেন।
আর ভাবো একবার,
বীরাঙ্গনারা যুদ্ধ পরবর্তী বাকি সারাটি জীবন আরো কঠিনভাবে মানসিক যুদ্ধ করেছেন। এখানেই আমার কষ্ট।
রুম্পা রুমানা
মানসিক দৃঢ়তার জন্য তিনি হয়ে থাকবেন উদাহরণ। এমন ব্যক্তিত্ব কম জনেরই থাকে। এত এত সমস্যা সামলেও তিনি পথ চলা থামান নি। স্যালুট মাকে।
মিষ্টি জিন
ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিনী মা,আপনাকে হাজার সালাম।
ভাল থাকুন সুস্হ থাকুন।
রুম্পা রুমানা
মায়ের জন্য ভালোবাসা ।
শুন্য শুন্যালয়
সংস্কৃতির চর্চা করেও তারা এইসব মানতে পারেননি, আবার এমনও হয়েছে, অনেক মুক্তিযোদ্ধাও তাদের বীরাঙ্গনা স্ত্রীকে আগের মতো মানতে পারেননি। যুদ্ধ শুধু নয় মাসের তাদের জন্য কক্ষনো ছিলোনা, তারা যুদ্ধ করেছেন এখন অব্দি। ওনার মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের জন্য শ্রদ্ধা আপনাআপনিই চলে আসে। সকল বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা মাদের’কে সালাম।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এমন পোস্ট দেবার জন্যে রূম্পা।
রুম্পা রুমানা
আপনাকেও ধন্যবাদ এতো সুন্দর করে মন্তব্য লেখার জন্য।
নীলাঞ্জনা নীলা
বীরাঙ্গনা এই মায়ের প্রতি প্রণাম।
কতোটা যুদ্ধ যে করে চলেছেন এখনও। উন্নত সমাজ ব্যবস্থা আমাদের ক্ষুদ্র মানসিকতাকে কিছুতেই উন্নত করতে পারেনি।
এমন একটি সুন্দর পোষ্টের জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
রুম্পা রুমানা
আপনাকেও ধন্যবাদ পোস্টটি পড়ার জন্য ও মন্তব্যের জন্য ।
রিমি রুম্মান
একজন প্রিয় মানুষ সম্পর্কে জানা হল অনেক কিছুই।
শুভকামনা আপনার জন্যেও …
রুম্পা রুমানা
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
ইঞ্জা
এই মহীয়সী নারীর অনেক অজানা তথ্য তুলে ধরার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ আপু।
রুম্পা রুমানা
আপনাকেও ধন্যবাদ পাঠ প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য।
ইঞ্জা
শুভকামনা
মোঃ মজিবর রহমান
স্বঘোষিত সকলের জানা তবে সরকার এই সার্টিফিকেট দিতে এতো কার্পণ্য করে কেন?
আপনাকে ধন্যবাদ উনার স্বপক্ষে জানা ছিলনা জানানর জন্য।
রুম্পা রুমানা
জানিনা এব্যাপারে। ধন্যবাদ।
মৌনতা রিতু
আমার দাদার একটা বাড়ি আছে খুলনা বসুপাড়াতে। তো ওখানে ছোটবেলায় কয়েকটা বছর কাটিয়েছি। আব্বার কাছে গল্প শুনেছি। বাগেরহাটের রাজাকার রজব আলীর কথা তো সবাই জানে।
তো প্রিয়ভাসীনি এই বীরঙ্গনা মাকে যখন নিয়ে যায় ক্যাম্পে, তার পরবর্তি যে অত্যাচার হয় তার উপর, তা আসলে সকল নির্মমতার উর্ধে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
রুম্পা রুমানা
নির্যাতন পরবর্তী সময়গুলো আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছিলো প্রতি বীরাঙ্গনা মায়ের জীবনেই। এদেশের মানুষও উনাদের যথাযথ সম্মান করেনি।
আবু খায়ের আনিছ
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, অনেক কিছু জানলাম।
রুম্পা রুমানা
আপনাকেও ধন্যবাদ।
ক্রিস্টাল শামীম
ধন্যবাদ আপনাকে এদেশের মহান নারীকে নিয়ে লেখার জন্য।
রুম্পা রুমানা
ধন্যবাদ আপনাকেও।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
অভিনন্দন প্রিয়ভাষিনীকে এতো বছর পর হলেও সে বীরাঙ্গনার সম্মান পেলেন। -{@
গাজী বুরহান
বিশ্লেশনটা ভালো লেগেছে। নাম শুনেছি অনেক, এখন জানলাম। ভালো লাগল।