মৃত্যুর আগে বাবা বলেছিলেন, ‘যদি পারো, ফুলের বাগানটা রেখো।’ বাবার এই কথার মূল্য দিতে গিয়ে ছেলেমেয়েরা পুরো বাড়িটাই ছেড়ে দিয়েছেন ফুলের জন্য। রাজশাহী শহরের ১৬ কাঠা জমির ওপর বাগান ও বাড়ি পুরোটাই গাছগাছালির দখলে। এই সুবাদে মিলেছে জাতীয় পুরস্কারও।
বাড়ির প্রধান ফটকের দুপাশে বড় পাতা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটি পান্থপদক—ঠিক যেন শুভেচ্ছা জানানোর ভঙ্গিতে। আর ফটকের ওপরে চালার মতো হয়ে আছে বোতলব্রাস। ফটকের ডান পাশের দেয়ালে লেখা রয়েছে, ‘আলতামাস উদ্দিন আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ ইন্সপেক্টর’। বাঁ পাশে লেখা, ‘আহমেদ ভিলা, ১৭৯, কাজীহাটা, রাজশাহী’।
গেট পার হতেই বাঁ পাশে নজরুলের নার্গিস ও ডান পাশে রবিঠাকুরের হৈমন্তী ফুটে আছে। গানের কথা আছে, ‘বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে।’ এই বাড়িতে ঢুকলে বুলবুলি নয়, মানুষও নীরব হয়ে যাবে। যেখানে তাকাবেন সেখানেই ফুলগাছ। বসার ঘরের বারান্দার একটি চেয়ারের ওপরেও হয়তো যত্নে তুলে রাখা হয়েছে একটি বিশেষ জাতের গোলাপের টব। তাতে হয়তো একটি মাত্র ফুলই ফুটে রয়েছে। একটি ফুলের জন্যও মালির যত্নের অভাব নেই।
কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ নেই। বসার ঘরের ডান দিকে গেলে দেখা যাবে দেয়াল থেকে চুপচাপ চেয়ে আছেন আলতামাস উদ্দিন আহাম্মেদ। পাশেই তাঁর স্ত্রী তাসকিনা আহাম্মেদ।
দুজনেই এখন ফ্রেমে বাঁধােনা ছবি। আলতামাস উদ্দিনের লেখা ডায়েরিসহ ব্যবহৃত জিনিস রাখা আছে যত্নে। ছেলেমেয়েরা তাঁর ডায়েরিটা জীবনীগ্রন্থ হিসেবে প্রকাশ করেছেন। নাম দিয়েছেন স্মরণের আবরণে।
বাড়িটাতে তাঁদের ব্যবহৃত খাট, সোফাসহ সব জিনিস অবিকল রেখে দেওয়া হয়েছে। বাগানের মালি ইসমাইল হোসেন ঝেড়ে-মুছে তকতকে করে রেখেছেন। বাড়িতে ছেলেমেয়েরা নিজেরাও থাকেন না, ভাড়াও দেন না। বাড়ির সবখানেই নানা জাতের গাছ আর গাছ।
বাড়িজুড়েই আছে এমন নানা জাতের গোলাপ।
বাড়ির সামনের ফুলের বাগান পার হয়েই বাড়িতে ঢুকতে হয়। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। রাস্তার দুপাশে শুধু ফুল আর ফুল। কত রকমের কত সুন্দর সুন্দর ফুল! গোলাপই রয়েছে ৭২ রকমের। গত ৪ জুন ওই বাড়িতে গিয়ে বহু জাতের গোলাপ পাওয়া গেল। ইসমাইলের হিসাবমতে, এই বাগানে বিলুপ্তপ্রায় গাছ রয়েছে ৪৫ প্রজাতির। তার মধ্যে আছে, কাঠগোলাপ, মণিরাজ, ফায়ার বল, কাঁঠালচাপা, কণ্ঠকরবী, গ্রাউন্ড অর্কিড, মহুয়া, ক্যামেলিয়া, পিপুল ও নাগেশ্বর ইত্যাদি।
শোভাবর্ধনকারী গাছ রয়েছে ১৭ প্রকারের। আছে চামেলি, বেলি, জেসমিন, মাধবীলতা, রঙ্গন, বাগানবিলাস, কামিনী গোলাপ, রাধাচূড়াও। ঔষুধি গাছ রয়েছে ২১ প্রকারের। এর মধ্যে বাসক, চন্দন অর্জুন, জাফরান, কালোমেঘ, লজ্জাবতী, হাড়জোড়, আমলকী, বহেড়া, হরীতকী, শতমূলী, তুলসী চোখে পড়ল আলাদা করে।
বনজ গাছ রয়েছে ১৫ প্রজাতির। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুন্দরী, জিলাপি, লম্বুরাজ, দেবদারু, শিমুল ইত্যাদি। বাদ পড়েনি আম, জাম, আঙুর, আপেল, কমলালেবু, লিচু, কাঁঠাল, ডালিমের মতো চেনা ফলের গাছও।
সঙ্গে আছে, বনকাঁঠাল, পিচফল, হরিফল, নাশপাতি, বইচি, বাউকুল, কতবেল, পেস্তা বাদাম, লটকন, সফেদা, আমড়া, জলপাই, আর জামরুলও।
আলতামাস উদ্দিনের তিন ছেলে ও এক মেয়ে। ছোট ছেলে আনসার উদ্দিন আহমেদ কানাডা থাকেন। মেজো ছেলে আনোয়ার উদ্দিন আহমেদও আমেরিকাপ্রবাসী। বড় ছেলে আশরাফ উদ্দিন আহমেদ ও মেয়ে মাহাবুবা আহমেদ ঢাকায় থাকেন।
খোঁজ করে বড় ছেলে আশরাফ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা গেল। তিনি প্রথম জীবনে বেতারে সংবাদ পাঠক ছিলেন। পরে চা-বাগানে চাকরি করেছেন। এখন সপরিবারে ঢাকায় থাকেন।
তিনিই বাগানের ইতিহাসটা বললেন, তাঁর বাবা ১৯৬৫ সালে বাড়িটা কিনেছিলেন। তিনি ফুল খুব ভালোবাসতেন। বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গাটায় মনের মতো করে ফুলের বাগান করেছিলেন।
২০০৯ সালে মারা যাওয়ার আগে শুধু বাগানটার কথাই বলে গিয়েছিলেন। তাঁরা সব ভাইবোন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বাবা যে ফুল ভালোবাসতেন, তাঁরা সেই ফুলের অমর্যাদা করবেন না।
তাঁরা পুরো বাড়িটাই ফুলের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। শুধু ছাদের বাগানটাই এবার ‘জাতীয় বৃক্ষরোপণ আন্দোলন ও বৃক্ষমেলা ২০১৪’-এর পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছে।
আসুন আমরা আমাদের সবার বাড়িকে ফুলময় করে ফেলি।পুরো বাড়ি না হয় না করলাম,আংগিনা,ফুলের তব,ছাদ,বারান্দায় তো ফুলকে স্থান দিতে পারি।
২৪টি মন্তব্য
রিমি রুম্মান
সুন্দর একটি লেখা … দেখার খুব আকাংখা জেগে উঠলো ভেতরে, নিজের অজান্তেই … মনে পরে গেল আমার বাবার বাসার সামনের বাসাটির কথা … দোতলার বারান্দা থেকে দেখতাম বাড়ির মালিক সারাদিনই বাগান পরিচর্যা করতেন … অদ্ভুত সুন্দর গাছ গাছালী … এবার গিয়ে দেখি তিন নেই …. মারা গেছেন … বাড়িটির বেহাল দশা … মনটা কেন যেনো খারাপ হলো খুব
আশা জাগানিয়া
আপনার বাবার কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো আপু।আল্লাহ আপনার আব্বাকে বেহেশত নসীব করুক-আমীন।
ব্লগার সজীব
জাস্ট অসাধারন একটি কাজ।রাজশাহী গেলে অবশ্যই এই ফুলের বাড়িটি দেখব।শেয়ারের জন্য ধন্যবাদ নেন।
আশা জাগানিয়া
আমারও ইচ্ছে আছে রাজশাহী গেলে অবশ্যই দেখবো এই বাড়ি।
লীলাবতী
ফুলে বাড়ি পুর্ন করে ফেলেছে।দারুন শেয়ার।
আশা জাগানিয়া
ধন্যবাদ লীলাদিদি।
জিসান শা ইকরাম
দেশের বাইরের কোন খবর ভেবেছিলাম প্রথমে।
এ যে দেখছি আমাদের দেশেই।
এই পরিবারের সবাইকে শুভেচ্ছা —
দেখার ইচ্ছে জাগলো।
ধন্যবাদ—
আশা জাগানিয়া
আমাদের দেশের বলেই শেয়ার দিলাম 🙂
অনিকেত নন্দিনী
গোলাপই রয়েছে ৭২ রকমের! ভাবতেই মন অবশ করা দারুণ সৌরভ যেনো নাকে এসে লাগলো। এমন ফুলে ফুলে ছাওয়া বাড়ির কথা ভাবতেও ভালো লাগে। যদি ওদিকে কখনো যাওয়া হয় তো অবশ্যই এক ঝলক হলেও দেখে আসবো আশা রাখি।
আশা জাগানিয়া
অবশ্যই যাবেন দেখতে আপু।
নুসরাত মৌরিন
অসাধারন।এ যে ঠিক স্বপ্নের বাড়ি।বাড়িটা দেখার খুব সাধ জাগছে।ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
আশা জাগানিয়া
আমারো দেখার খুব ইচ্ছে।কখনো রাজশাহী গেলে দেখবেন আপু।
মেহেরী তাজ
এতো দেখি “ফুলবাড়ি”। ভালো লাগার মত শেয়ার। অনেক ভালো লেগেছে।
আশা জাগানিয়া
ধন্যবাদ আপু। সবার ভালো লাগায় আমার শেয়ার সার্থক।
শুন্য শুন্যালয়
চমৎকার পোস্ট। বাড়িটা দেখবার ইচ্ছে জাগলো খুব। আলতামাস উদ্দিনের ছেলেমেয়েদের কে আমার শ্রদ্ধা, তারা তাদের বাবার একটি ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়েছেন বলে। যেমনটা খুব কমই দেখা যায় আজকাল।
অনেক ভালো লাগে এমন স্পৃহা জাগানো পোস্ট পড়লে। আশা জাগানিয়া কে অনেক ধন্যবাদ।
আশা জাগানিয়া
যেখানে পিতা মাতার মৃত্যুর পরে প্রপার্টি বিক্রী করে দেয়া হয়,সেখানে এমন ভাবে পিতার ইচ্ছেকে মুল্য দেয়া অবশ্যই প্রশংসা পাবার মত কাজ।ধন্যবাদ আপু।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সুন্দর একটি পোষ্ট নিকের নামকরন স্বার্থক।পুরো পরিবারটিকে শ্রদ্ধাও সালাম জানাই।
আশা জাগানিয়া
ধন্যবাদ মনির ভাইয়া।
খেয়ালী মেয়ে
দারুন পোস্ট….
শুধু শুনে আসছি সন্তান তার বাবামাকে ছেড়ে যায়….কিন্তু সন্তানও যে তাদের ভালোবাসায় বাবামাকে বাঁচিয়ে রাখে সে ঘটনাগুলো খুব একটা শোনা যায় না……ধন্যবাদ এমন একটি লেখা শেয়ার করার জন্য….
আশা জাগানিয়া
আমিও তা শুনে আসছি আপু।একারনেই এই ব্যাতিক্রমী পোষ্ট শেয়ার দিলাম।আমরা যেন আমাদের বাবা মায়ের ইচ্ছের মুল্য দেই।
মিথুন
এতো ফুল? শুধু ফুলের বাগানের জন্য বাড়িটা ছেড়ে দিয়েছে, এ যে অবিশ্বাস্য। বাগানের সাথে সাথে এ বাড়ির মানুষ গুলোকেও দেখার ইচ্ছে জাগলো। এমন খবর কেন আমাদের চোখে পড়েনা? নাম বদলে আশা জাগানিয়া করে ফেলবো?
আশা জাগানিয়া
নাম বদলে আশানিয়া? হা হা হা হা, করুন করুন।তবে স্বপ্ন ভাইয়া কি তা মানবে?
ছাইরাছ হেলাল
কোন দিন গেলে, অনেক্ষণ থাকব।
আশা জাগানিয়া
আমিও অনেক্ষণ থাকব।