গত কয়েকদিন থেকে একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করে চলেছি। ছবিটি চোখে ভাসছে, তবু কেন যে আঁকতে পারছি না! অসহ্য অসহায়বোধে কষ্ট পাচ্ছি ভীষণ। কিন্তু আঁকতে যে আমাকে হবেই। কিছুক্ষণ পর পর চোখ বুঁজে ভাসমান ছবিটি দেখার চেষ্টা করছি, ছবিটি দুলছে… দুলছে! একটা শান্ত পরিবেশ চাই, চাই একটু নিস্তব্ধতা। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমার মনের ভাবনাগুলোকে একত্রিত করাও প্রয়োজন। হচ্ছে না… কিছুই হচ্ছে না!
হিমেল রাত, আকাশে আধখাওয়া চাঁদ কুয়াশায় ঢাকা। গ্রামটা ঘুমিয়ে পড়েছে কি? কিন্তু আমরা যে এলাম! এলাম প্রায় বছরখানেক পরে! কেউ যদি জেগে না থাকে, কাকে চমকে দেবো? আমাদেরকে দেখে সীমাহীন আনন্দে আত্মহারা হয়ে জড়িয়ে ধরার মানুষগুলো জেগে নেই কেউ? আছে আছে….. ওই তো টিমটিম করে জ্বলছে হারিকেন! বৈঠকখানার দরজার ফাঁক দিয়ে সেই হারিকেনের আলো মোমের মতো গলে গলে বেরিয়ে এসে আমাকে জানান দিচ্ছে, জেগে আছে!
আলোটুকু মেখে দরজা পেরোই। টুকটুকে লাল সোয়েটার, কালো জুতো পায়ে, মাথার উলের লাল টুপি ছেড়ে বেরিয়ে আসা আমার কোঁকড়া চুলে চোখ আড়াল প্রায়। সেই আড়াল থেকেই দেখতে পাই উঠোনের ওপারে যে মস্ত দালান, তার লম্বা বারান্দায় মাদুর পেতে খেতে বসেছে মায়াময় মুখগুলো। আমি একছুটে বৈঠকখানার বারান্দা ছেড়ে উঠোনে নামি, উঠোন ছেড়ে উঠে যাই মস্ত দালানের বারান্দায়, রুদ্ধশ্বাসে। হারিকেনের আবছা রহস্যময় আলোয় খেতে বসা মুখগুলো চমকে ওঠে। কে ….…কে? খিলখিল করে হেসে উঠি আমি। মুহূর্তেই পাল্টে যায় পরিবেশ। একাধিক হাত, একাধিক বুক, একাধিক হৃদয় উন্মুখ হয়ে ছুঁয়ে দেয় আমাকে। ছুটে আসে একাধিক মুখের একটা প্রশ্ন, “কখন এসেছিস তোরা!!!” বাকিরা কোথায়? আসবে না এখনই?
একই গাঁয়ের এবাড়ি আর ওবাড়ি, আমার দাদা আর নানার বাড়ি। আমরা এসে উঠেছি দাদার বাড়িতে। ওখানে আনন্দ বিনিময়ের ফাঁক গলে সুড়ুৎ করে আমি চলে এসেছি নানার বাড়ি। তখন বোধহয় আমি ক্লাস টু কিংবা থ্রি-তে পড়ি। বার্ষিক পরীক্ষার পর লম্বা ছুটিটা কাটাতে গাঁয়ের পথ ধরতাম। আব্বা আমাদেরকে রেখে দু’তিনদিন কাটিয়ে চলে যেতেন নিজের কর্মক্ষেত্রে। ছুটি যখন শেষ হবো হবো, এমন সময় আবার আব্বা এসে নিয়ে যেতেন কিংবা মামা চাচাদের কেউ গিয়ে রেখে আসতেন আমাদের। গাঁয়ে আসার অন্তত সপ্তাহ খানেক আগে থেকে উত্তেজনায় নাওয়া খাওয়া প্রায় বন্ধ। গাঁয়ে এসেও সে উত্তেজনায় বিন্দুমাত্র ঘাটতি না হওয়ার দরুন খাওয়া-দাওয়ার অবস্থা তথৈবচ। আমরা সমবয়সী চাচাতো ফুপাতো ভাই বোনেরা মিলে যেদিন কবুতরের ছানা ধরে, ক্ষেতের সদ্য তোলা আলু দিয়ে ‘পোশালু’ মানে চড়ুইভাতি করতাম সেদিন ভাত খেতাম আগ্রহ নিয়ে। এই দেখে আমার ছোটখাট খুব সাধারণ চেহারার দাদী আহ্লাদিত হতেন ভীষণ। বলতেন, “তোরা রোজ পোশালু কর, তাও যদি ওই দুষ্টুটার (আমি) পেটে একটু ভাত পড়ে!”
একথা শুনে পোশালু করার উৎসাহ যেন উৎসবে পরিণত হতো। কবুতরের ছানা ছেড়ে চলে যেতাম বিলের ঘোলা জলে। টেংরা, পুঁটি, জিয়ল কিংবা টাকি, কিছু না কিছু ধরা পড়তোই আমাদের গামছায়। বাড়ি এসে বড়দের সাহায্যে সেগুলো সাইজ করে রান্নার আয়োজন। আহা, কী তার ঘ্রাণ… কী তার স্বাদ!
পৌষের হাড়হিম করা সেসব দিন। কুয়াশার সাদা চাদর ফুঁড়ে নরম রোদ ছড়িয়ে পড়ার আগেই কলসভর্তি হিমশীতল খেজুরের রস লেপের ওমের চেয়ে যেন আরও বেশি মায়াবী। দাদীর বিছানায় গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা আমরা হইহই করে উঠে মুখটুখ ধুয়ে চুলার পাশে বসে পড়তাম। ঝকঝকে কাঁসার বাটি তখন রসে টইটম্বুর। নতুন চালের আটা দিয়ে তৈরি ভাপা পিঠার ভাপে ছড়িয়ে পড়া খেজুর গুড়ের সুবাসে মোহিত আমরা। একে একে পিঠা ওঠে, চালান হয়ে যায় পেটে। মিঠে মিঠে রোদ তার সোনারঙে হেসে হেসে বলে, “কেবল চুলার কাছে বসে পিঠা খেলেই চলবে? পথের শিশিরভেজা ধুলো, বুনোফুল, হলুদ সর্ষে ক্ষেত প্রতীক্ষায় আছে যে! তৈরি হও!”
পথের দু’ধারের কলমিফুল হাওয়ায় দুলে দুলে যেন গেয়ে ওঠে,
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে
আয় রে চলে আয় আয় আয়…….
উতল হয়ে ছুটে বেড়াই ভেজা ধুলো পায়ে মেখে। কোথায় শীত! দুরন্ত শৈশবের কাছে অনায়াসে হার স্বীকার করে বসে থাকে সে। আমরা ছুটে বেড়াই। ছুটে ছুটে ফড়িং ধরি, ঘুড়ি ওড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে করে একটু বোধহয় ঝিমিয়ে পড়ি। বাড়ি এসে দেখি, ছোটআব্বা হাট থেকে গুড়ের জিলাপি এনে খুঁজছেন আমাদের। হাতে আকাশের চাঁদ পেয়ে যাই যেন আমরা। পদ্মপাতায় মোড়ানো সেই জিলাপি এক এক করে চলে আসে আমাদের হাতে। চোখ বুঁজে কামড় বসাই, আহা……!
কী স্বাদ…. কী স্বাদ!
সন্ধ্যা হলেই বাড়ির গলিতে খড় একত্র করে আগুন জ্বালিয়ে বৃত্তাকারে গল্পের ঝাঁপি খুলে বসে যাও। গল্প করতে করতে একসময় দুপুরবেলায় খেজুর গাছে লাগানো কলসটা নামিয়ে আনার সময় হয়ে যায়। মসজিদে তখন এশা’র আজান। কিন্তু ভোরবেলার রসের চেয়ে সন্ধ্যেবেলার রস যে আরও বেশি সুস্বাদু! খেয়ে নিয়ে তবেই সবাই যাবে নামাজে।
এশা’র নামাজ শেষে বাড়ি ফেরে সবাই। টপটপ কুয়াশা পড়ে বটপাতায়। গাঁয়ের পথে হুক্কাহুয়া ডাকে শেয়ালেরা যেন জানিয়ে দেয় ঘুমিয়ে পড়ো, এই পৌষের শীতরাতে অযথা জেগে থেকো না!
ভোরের শিশিরভেজা মটরশুঁটির লতায় বেগুনি ফুল, ঘাসের বুকে শিশির মেখে শুয়ে থাকা পাকা পাকা টমেটো, গাছে গাছে ঝুমকো বেগুন। হীরেকুঁচি রোদ গায়ে মেখে ঝাঁকা বোঝাই করে তুলতে হবে না সেগুলো? ঘুমাও……আর লেপের ওমে, স্বপ্নের সোনালী আলোয় দোলাও তোমার হৃদয়খানা!
অবশেষে ছবিটার নাগাল পেলাম কী? ধরা দিলো কি বহুবছর আগে পৌষের যে ছবিটি আমার হৃদয়ে আজও অক্ষত, তার সঠিক রূপটি দিতে? চেষ্টা করলাম। আসলে, আমরা শুধু চেষ্টাই করতে পারি। হৃদয়ে যে ছবিটি ধারণ করি, যে ছবিটিতে ধুলো জমতে দিই না, পরম মমতায় যখন তখন হাত বুলিয়ে আদর করি যে ছবিটিকে, তার পরিপূর্ণ রূপটি কি আঁকা সম্ভব? যে আবেগ, যে অসম্ভব মায়া ছবিটির ওপর তা কেমন করে ফুটিয়ে তুলবো? সম্ভব নয়….. সম্ভব নয়!
২৬টি মন্তব্য
এস.জেড বাবু
পদ্মপাতায় মোড়ানো সেই জিলাপি এক এক করে চলে আসে আমাদের হাতে। চোখ বুঁজে কামড় বসাই, আহা……!
কী স্বাদ…. কী স্বাদ!
তেমন স্বাদটা যেন বয়সের ভারে কুজো হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।
চরম সুন্দর এঁকেছেন- চোখে লেগে আছে, দেখতে পাচ্ছি ক্যানভাসের বুক চিরে আমার বিগত অতিত।
অনেক সুন্দর।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ।
পৌষ সংক্রান্তির শুভেচ্ছা রইল।
এস.জেড বাবু
আপনাকে ও আপু
মনির হোসেন মমি
আপু এই লেখায় কী মন্তব্য করব! যার তুলনাই হয় না।যেন পৌষের সব কিছুই আবারো ফিরে পেলাম।পরিশেষে আপনার লেখার সূত্র ধরেই বলছি শব্দ বাক্যের পৌষের এমন সৌন্দর্যময় কাব্যিক চয়ণ সত্যিই অসাধারন যা মন্তব্যে প্রকাশেও মন ভরবে না।
রেহানা বীথি
মমি ভাই, আপ্লুত হলাম।
পৌষ সংক্রান্তির শুভেচ্ছা রইল।
সুপায়ন বড়ুয়া
পথের দু’ধারের কলমিফুল হাওয়ায় দুলে দুলে যেন গেয়ে ওঠে,
পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে
আয় রে চলে আয় আয় আয়…….“
মনের মাধুরী মেশানো লেখা
যেন কল্পনায় ছবি আঁকা।
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ।
পৌষ সংক্রান্তির শুভেচ্ছা দাদা।
প্রদীপ চক্রবর্তী
একটাই কথা বলবো দিদি
অসাধাররণ উপস্থাপন।
.
শুভ পৌষসংক্রান্তির শুভেচ্ছা।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ।
আপনাকেও অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
নিতাই বাবু
আপনার মনের চোখে ভাসা ছবিটি কিন্তু আপনার সুন্দর লেখনীতে এঁকেই ফেলেছেন দিদি। ব্লগের পৌষ সংক্রান্তি উৎসবের শেষদিকে সুন্দর একটা মনমাতানো পোস্ট করেছেন। সত্যি দারুণ হয়েছে কিন্তু! শুভকামনা-সহ পৌষ সংক্রান্তির শুভেচ্ছা।
রেহানা বীথি
দাদা, কিছুদিন থেকে এত ব্যস্ত সময় পার করছিলাম যে, কিছু লেখার সময়ই পাচ্ছিলাম না। তারওপর গত পরশু রাত থেকে প্রচণ্ড জ্বর। গতকাল জ্বর নিয়েই লিখেছি প্রিয় ব্লগের জন্য।
অনেক ধন্যবাদ দাদা।
পৌষ সংক্রান্তির শুভেচ্ছা রইল।
সঞ্জয় মালাকার
পদ্মপাতায় মোড়ানো সেই জিলাপি এক এক করে চলে আসে আমাদের হাতে। চোখ বুঁজে কামড় বসাই, আহা……!
কী স্বাদ…. কী স্বাদ!
দিদি চমৎকার উপস্থাপন, পৌষ সংক্রান্তির প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
রেহানা বীথি
দাদা, অনেক ধন্যবাদ।
পৌষ সংক্রান্তির শুভেচ্ছা জানবেন।
সঞ্জয় মালাকার
দিদি শুভেচ্ছা অফুরন্ত।
তৌহিদ
ছবিটার নাগাল পেলাম কি বলছেন? দারুণভাবে চোখে ধরা দিলো। লেখাটি পড়ছিলাম আর হাড়িয়ে গিয়েছিলাম আমার ছোটবেলায়। পৌষ নিয়ে এমন আবেগময় লেখা আপনার পক্ষেই লেখা সম্ভব।
অনেক ধন্যবাদ আপু, পৌষ সংক্রান্তি উৎসবে আপনার লেখাটি প্রাণসঞ্চার করলো।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
পৌষ সংক্রান্তির শুভেচ্ছা রইল।
ছাইরাছ হেলাল
ফেলে আসা আ-শৈশবের সেই স্মৃতিটুকুই সম্বল, সেটির ছবি কতটুকু আঁকা গেল না গেল তাতে
কিছুই আসে যায় না, অমলিন সে স্মৃতি-ছবি হৃদয়ে গেঁথেই থাকে।
এমন সুন্দর ছবির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
রেহানা বীথি
পৌষ সংক্রান্তির শুভেচ্ছা রইল ভাইয়া।
ভালো থাকবেন সবসময়।
ফয়জুল মহী
যেদিন গেছে সেদিন কি ফিরিয়ে আনা । মন মাতানো লিখনী।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ।
পৌষ সংক্রান্তির শুভেচ্ছা রইল।
অনন্য অর্ণব
খুবই হৃদয়গ্রাহী স্মৃতিচারণ। ভালো লাগলো খুব।
রেহানা বীথি
পৌষ সংক্রান্তির শুভেচ্ছা জানবেন।
ভালো থাকুন সবসময়।
সুরাইয়া পারভীন
স্মৃতিচারণের মধ্য দিয়ে হৃদয় ক্যানভাসে আঁকা হয়ে গেলো সেই ছবি। যা হৃদয়ে করছিলো বিচরণ। দারুণ লিখেছেন আপু। চমৎকার উপস্থাপন করেছেন। শুরুটা দুর্দান্ত।
রেহানা বীথি
অনেক ভালোবাসা।
পৌষ সংক্রান্তির শুভেচ্ছা রইল।
নুরহোসেন
পৌষ নিয়ে লিখার খুব ইচ্ছা ছিলো,
আমার হাতে পায়ে ব্যস্ততার শেকল;
মৌলিক ইচ্ছাগুলো কেড়ে নিলো।
রেহানা বীথি
সময় তো বাড়ানো হয়েছে, ছোট করে হলেও কিছু একটা লিখুন। উৎসবে সামিল হওয়ার আনন্দই আলাদা।