সন্ধ্যা হতে না হতে পাড়া গাঁয়ে রাত নামে। সন্ধ্যায় রাতের খাবার খেয়ে বেশির ভাগ মানুষ বিছানায় চলে যায়। মাজেদা বেগম আরো একটু আগে যাওয়ার চেষ্টা করে। কেরোসিন তেল বাঁচাতে এর কোন বিকল্প নেই। গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে শুয়ে মাজেদা বেগম তার অতীত জীবনের ছায়াছবি দেখছে। ছোট বেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে অনেক লাথি-ঝাটা খেয়ে চাচার কাছে মানুষ হয়েছিল। চাচা দায়ভার মুক্ত হওয়ার জন্য হাশেম পাগলের সাথে তার বিয়ে দিয়েছিল। পাগলের সাথে বিয়ে হওয়ায় সুজনপুর গ্রামে মাজেদা বেগম পাগলার বউ নামে পরিচিতি পেল। হাশেম পাগল হলেও সে ছিল শক্তিশালী, কর্মঠ এবং পরিশ্রমী। জনশ্রুতি আছে পাগলদের বউরা নাকি রূপবতী এবং বুদ্ধিমতী হয়। মাজেদা বেগমও এর ব্যতিক্রম নয়। হাশেম পাগলের কর্মঠ শরীর আর মাজেদা বেগমের বুদ্ধিতে তাদের সংসার-তরী ভালোই চলছিলো। বিধি বাম, হাশেম পাগল একদিন পেটের যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অকালে মারা গেল, আর মাজেদা বেগমকে অকূলে ভাসালো। অল্প বয়সে স্বামী মরলেও মাজেদা বেগম আর বাপের বাড়ি ফিরে যায়নি, কারণ সে কূলেও তো আর কেউ নেই! বাধ্য হয়ে হাশেম পাগলের এই ভিটেটা আগলে পড়ে আছে। তাদের একটা মাত্র মেয়ে, বিয়ে হয়ে যাওয়ায় মাজেদা বেগম বড় বেশি একা হয়ে গিয়েছে। এত বড় পৃথিবীর এই ছোট্ট একটা কুড়ে ঘরে একা-একা জীবন কাটানো বড় দুঃসহ মনে হয় মাজেদা বেগমের। ছোট্ট এই জীবনে কত ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই পার করতে হচ্ছে তাকে। এসব ভাবনা তাকে আছন্ন করে দু’চোখের ঘুম বহুক্রোশ দূরে পাঠিয়ে দেয়। হঠাৎ মাজেদা বেগমের তন্ময়তা ভঙ্গ করে রমজান মণ্ডল বলে, মাজু বেগম ঘুইমে পড়েচো নাকি? ও মাজু বেগম।
সিথানের দিয়াশালই আর ল্যাম্প হাতড়াতে হাতড়াতে মাজেদা বেগম বলে, ঘুম কি আর আচে দু’চোকে! শুয়ে শুয়ে ঘুমোনোর চিষ্টা করে যাচ্চি আর কি। তাছাড়া শরীলডাও ভাল না।
কি হয়েচে তুমার?
না তেরাম কিচু না, সারাদিন মাটির ঝুড়ি টানিচি তাই শরীলডা আইলে পড়েচে।
মাজু বেগম, তুমার দুঃকু-কষ্ট থেকে মুক্ত করতি চাই।
কিভাবে?
আমি তুমাকে বিয়ে করতি চাই।
আবোল-তাবোল কতা বলচো কেন মণ্ডল।
আবোল-তাবোল না, যা সত্যি তাই বলচি।
শোন মণ্ডল, এই সুমাজে তুমার মান-সনমান আচে। বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে সুকের সুংসার আচে। সেই সুংসারে আমি আগুন জ্বালাতি পারবো না।
মণ্ডল এবং পাগলার বউ যখন সংসারের দরকষাকষিতে ব্যস্ত তখন খালেক এবং দুলাল যৌবন জ্বালায় উত্তপ্ত। যৌবনের উদ্দাম ঘোড়া এখন লাগামহীন। উন্মাদের মত তারা ঢিল ছুঁড়ছে পাগলার বউর ঘরে। ঘরের চালে এবং উঠানে শিলাবৃষ্টির মত ঢিল পড়ছে। রমজান মণ্ডল ঢিলবৃষ্টি উপেক্ষা করে ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল। আর পাগলার বউ গালিবর্ষণ শুরু করলো-কোন্ খানকির ছেলে, কোন্ নটি মাগীর ছেলে, কোন্ বেশ্যের ছেলে আমার ঘরে ঢেলা মারচে? আমার ঘরে যে ঢেলা মারচে তার যেন বুকশূল হয়, তার ভিটেয় যেন ঘুঘু চরে। আমি কার বাড়া ভাতে নুন দিতি গিইলাম? এই রাত দুপোরে আমার অশান্তি ধরাতি এয়েচে। কোন মানষির চুদা না। জ্যান্ত বেজন্মা।
পাগলার বউর বাড়ির আশেপাশের বাড়িগুলো একটু দূরে থাকলেও চিৎকার-চেচামেচি যে তাদের কানে যায় না, তা নয়। কিন্তু এগুলো এখন তারা আর গায়ে মাখে না। এসব বিষয় নিয়ে কেউ নাক গলাতে আসে না। পাগলার বউর মনের আকাশের রাগের মেঘ পরিষ্কার হলে ধীরে ধীরে গালিবর্ষণ থেমে গেল। গালিবর্ষণ অতঃপর কান্নাবর্ষণ শেষে ক্লান্ত হয়ে পাগলার বউ শুয়ে পড়েছে। মনের দুঃখে এখন গুণগুণ করে গান গাচ্ছে। দুঃখেও মানুষ গান গায়। এই গানেই হয়ত দুঃখের ভার কিছুটা লাঘব করে।
পাগলার বউর গুণগুণ গানের তাল কেটে দিয়ে খালেক বলে, ও দাদী, মনের সুকে গান গাচ্চ যে। মনে রং তো ভালই আচে।
সুকে না, দুঃকে গান গাচ্চি। এই খানিক আগে-কোন্ হাটকুড়ো, ঢেলা কানা, বেজন্মার ছেলে আমার ঘরে ঢেলা মেরেচে। আমি কার পাকা ধানে মই দিতি গিইলাম? মানষি আমার সাতে ক্যান্ শত্তুরতা করে?
দাদী, জামানা বড় খারাপ হয়ে গিয়েচে।
জামানা খারাপ হয়নি বুজলি, মানুষ খারাপ হয়েচে। তোর পাশে কিডা?
দাদী, ও হচ্চে দুলাল।
অ, দুলাল। তা তুরা কি মনে করে আইচিস?
টপ করে দুলাল বলল, আমরা আইচি তো ঐ কাজে।
ঐ কাজে মানে?
আরে বুজলে না, তালি এট্টু ভেঙেই বলি। ঐ যে, রমজান মণ্ডল যে কাজে আসে আর কি?
রমজান মণ্ডল আমার কাচে কি কাজে আসে, তা তুরা কি করে জানলি? এই রাত দুপোরে আমার সাতে ইয়ার্কি মারতি আইচিস নাকি?
ইয়ার্কি না, রমজান মণ্ডল তুমার কাচে তো শুতিই আসে। আমরাও সেই কাজে আইচি। অসুবিদে নেই, দু’জনই নগত টাকা আনিচি।
এই ছুড়া, এসব কি বলচিস তুই? আমি দুকান খুলে বসিচি নাকি? তোর সাহস তো কম না, আমার মেয়ের বয়েসের চেয়েও তুই ছোট হবি। তোদের আমি হতি দেকলাম। সুবাদে দুলালের হই চাচী। তোদের গাল টিপলি একনো দুদ বের হয়। তুরা তো খুব বদ হইচিস। দাঁড়া, কালই আমি তোদের বাপের কাচে যাবো।
অ, মণ্ডলরা আসলি চুদতি দুবা, আমদের দুবা না, কেন আমরা কি মাগনা চুদতি আইচি নাকি?
বিছানার পাশ থেকে বটি নিয়ে দাঁড়িয়ে রাগে কাঁপতে-কাঁপতে পাগলার বউ বলল, ওরে হারামজাদা, বেজন্মার ছেলেরা, তুরা পাইচিসটা কি? হয় তোদের একদিন, নাই তো আমার একদিন। তুরা কি আমার ভিটেই বাস করতি দিবি নে? খানকির ছেলেরা, আমার কি যা তা পাইচিস? তোদের মাতায় যেন বাজ পড়ে। নির্বংশ হয়ে যা তুরা।
দুলাল এবং খালেক তাড়া খাওয়া চোরের মত দৌড়ে পালালো।
হাঁফাতে-হাঁফাতে দু’জন সমস্বরে নিরবছিন্নভাবে ডেকে যাচ্ছে-জবেদ আলী ভাই, ও জবেদ আলী ভাই। মরণ ঘুম ঘুইমোচো নাকি?
ধড়ফড় করে উঠে জবেদ আলী বলল, কিডা রে! এরাম হাউমাউ করচি ক্যানে, কি হয়েচে?
হাঁফাতেÑহাঁফাতে দুলাল বলল, আরে, বিরাট ঘটনা ঘটে গিয়েচে। তুমরা তো মিয়া, সন্দের আগেই খেতার নিচেই চলে যাও।
আফসোস করে খালেক বলল, তুমার বাড়ির পাশের লোক, পাগলার বউর ঘরে আজ আবার একজন ঢুকেলো। আমাদের দেকে খেচে দৌড় মারলে। আমরাও পিচে পিচে গিইলাম, ধরতি পারিনি।
তা তোরা এত রাতি এই দিকে কি করচিলি?
আমরা ভুই নিড়োনোর জন্যি জন ঠিক করে, এই দিক দিয়ে যাচ্চিলাম।
তা এ আবার নতুন কি?
রাগত্বস্বরে দুলাল বলল, নতুন পুরোনো বুজিনে। কাল বিচার ডাকপো। তুমার সাক্ষি দিতি হবেনে।
তুরা আমারে ঝামেলার মদ্যি জড়াস নে ভাই। আমি গরীব মানুষ, কোন ঝামেলার মদ্যি যাতি চাই নে।
এই কতা বললি হবে না। তুমার থাকতি হবেনে।
(চলবে…)
পূর্বের লেখা :
পাগলার বউ-১ : http://sonelablog.com/archives/4157
১৮টি মন্তব্য
সাতকাহন
পার্টির নির্বাচনী কাজে ব্যস্ততার জন্য কন্টিনিউ করা হয়নি, তাছাড়া অফিসের ঝামেলাও ছিলো। তাই সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আবারও ক্ষমা চাচ্ছি কিছু শব্দ কাহিনীর প্রয়োজনে ব্যবহার করার জন্য।
ছাইরাছ হেলাল
সাড়ে তিন মাস কিন্তু একটু বেশিই , যতই ব্যস্ততা থাকুক ।
যাক এবারের মত মেনে নিচ্ছি । এখন নিয়মিত আপনাকে এখানে চাই ।
যা এখনও ঘটে চলছে তাই তুলে ধরেছেন নিপুণতায় ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ ভাই
আদিব আদ্নান
ভিলেজ পলিটিক্সের নমুনা এমনই হয় ।
বাকিটা তাড়াতাড়ি না দিলে খেই হারিয়ে ফেলব কিন্তু ।
সাতকাহন
অবশ্যই ভাই।
"বাইরনিক শুভ্র"
ভালো লেগেছে । পরের পর্ব জন্য অপেক্ষায় থাকলাম ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ
বনলতা সেন
সুনিপুণ উপস্থাপন ।
সাতকাহন
ধন্যবাদ, বনলতা।
খসড়া
অনেকদিন পর পরের পর্ব পেলাম। লিখুন এক্টু সময় করে।
সাতকাহন
জ্বি ভাই, এখন কন্টিনিউ হবো।
নীলকন্ঠ জয়
আগের পর্ব পড়ে নেই আগে। আর শেষ পর্বে করবো মূল্যায়ন।। -{@
জিসান শা ইকরাম
পড়লাম
নিপুন উপস্থাপনা —
যেভাবে আপনি লিখেন ।
অপেক্ষা পরের পর্বের জন্য
বেশী বিলম্ব হলে আগের পর্ব মনে হতে সময় লাগে 🙂
সাতকাহন
জিসান ভাই, ধন্যবাদ।
আদিব আদ্নান
এমন একটি সুন্দর লেখা লিখে কোথায় গেলেন ?
সাতকাহন
এটা সমাজের প্রতিচ্ছবি
শুন্য শুন্যালয়
ভালো লেগেছে …এমনটাই হয়…পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম …
মোঃ মজিবর রহমান
গ্রামে এমনই ঘটে অপেক্ষায়!!!