১৯৩০ সালের আগস্ট মাসে জেলে থাকাকালে সুভাষ কলকাতা পৌর কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। এদিকে ঢাকার মিডফোর্ড মেডিকেল স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্র ও বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সদস্য বিনয় কৃষ্ণ বসু ঢাকার কুখ্যাত পুলিশ কর্মকর্তা জল পুলিশের আইজি লোম্যানকে ১৯৩০ সালের ২৯ আগস্ট মিডফোর্ডের সামনে গুলি করে হত্যা করেন এবং সেদিনই বিনয় ঢাকার পুলিশ সুপার হাডসনকে গুলি করে গুরুতরভাবে আহত করেন। এরপর বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের নির্দেশে ঢাকার তিন কৃতি সন্তান বিনয় কৃষ্ণ বসু, বাদল গুপ্ত ও দীনেশ গুপ্ত কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ করে পুলিশের আইজি সিম্পসনকে হত্যা করেন স্বরাষ্ট্র সচিব মিস্টার মার, জুডিসিয়াল সচিব নেলসন ও জুনিয়র সচিব টাইসনকে আহত করেন। অন্যদিকে ১৯৩০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সুভাষ বসু জেল থেকে মুক্তি পেলেন, ১৯৩১ সালের জানুয়ারি মাসে মালদহে গ্রেপ্তার হয়ে ৭ দিন কারাগারে ছিলেন।
১৯৩১ সালের ২৬ জানুয়ারি স্বাধীনতার জন্য শপথ গ্রহণের দিন। কলকাতা পৌর কর্পোরেশনের মেয়র সুভাষ বসু বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে চলছেন, এইসময় পুলিশের বিশাল একটি দল হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সুভাষসহ অন্যান্য বিপ্লবীদের উপর, সুভাষ গুরুতর আহত হয়ে গ্রেপ্তার হন। সেই বারে ৬ মাসের কারাদণ্ড হয় সুভাষের।
একদিন হঠাৎ করেই গান্ধীজি আন্দোলন বন্ধ করে দিলেন, তিনি নাকি বড় লাটের সদিচ্ছার প্রমাণ পেয়েছেন, তাই আন্দোলন বন্ধ করে বড় লাটের সাথে চুক্তি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তীব্র সমালোচনার মুখে পড়লেন গান্ধীজি, তবুও গান্ধী-আরউইন চুক্তি সম্পাদন হলো। গান্ধী-আরউইন চুক্তির পর ১৯৩১ সালের ৮ মার্চ সুভাষ কারামুক্ত হয়ে এই চুক্তির তীব্র প্রতিবাদ করেন। সুভাষের প্রতিবাদের মূল কারণ ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী ভগত সিংয়ের মুক্তির শর্ত এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিলো না, এমনকি ব্রিটিশ বিরোধী অন্যান্য আটক বিপ্লবীদের মুক্তির শর্তও এর অন্তর্ভুক্ত ছিলো না।
এই সময় পূর্ব বাঙলার বিপ্লবীরা সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন ভগত সিংয়ের ফাঁসি রোধ করার জন্য। চট্টগ্রাম জেলে আটক গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিং, লোকনাথ বল, অম্বিকা চক্রবর্তীসহ আটক অন্যান্য বিপ্লবীরা অতি গোপনে চিঠি পাঠালেন গান্ধীজির কাছে, তাঁরা সেই চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমরা ফাঁসির প্রতীক্ষায় দিন গুনছি। তার জন্য কোনো দুঃখ নেই আমাদের। কিন্তু আপনি ভগত সিংদের রক্ষা করুন বাপুজি। আপনিই একমাত্র লোক যিনি ওদের প্রাণ রক্ষা করতে সক্ষম।’[২৬] চরমপত্র দিলেন বক্সা দূর্গ থেকে আটক বিপ্লবী নেতৃবৃন্দ। তাঁরা চিঠি পাঠালেন গান্ধীজি, নেহেরু ও তেজ বাহাদুর শপ্রুর কাছে। চিঠিতে বক্সা দূর্গের বিপ্লবীগণ লিখেছেন, ‘আমাদের দাবী উপেক্ষা করে ভগত সিংকে ফাঁসি দিলে আমরা এর চরম প্রতিশোধ নেবো…।’[২৭]
১৯৩১ সালের ১৪ মার্চ সুভাষ বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স-এর সর্বাধিনায়ক হেমচন্দ্র ঘোষকে নিয়ে গান্ধীজির কাছে গেলেন। সুভাষ গান্ধীজিকে বললেন, ‘ওদের ফাঁসির আদেশ ফেরাতে হবে। বড় লাট রাজি না হলে চুক্তি ভেঙে দিবেন।’[২৮] গান্ধীজির সাথে শুধু তর্কই নয়, সুভাষ নিজে গান্ধীজির সাথে দিল্লি পর্যন্ত গেলেন; অনেক করে বলেও গান্ধীজিকে দিয়ে বড় লাটকে বলাতে পারেন নি সুভাষ। ভগত সিংদের ফাঁসির আদেশ বাতিল হলো না। এই বিষয়ে বিপ্লবী ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত বলেছেন, ‘চুক্তি সই করে গান্ধীজি সিমলা ছাড়ার আগে বিবৃতি দিয়ে যান; গান্ধীজি বলেন, এই চুক্তি যদি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় তাহলে তিনি আশা করেন যে, এমন সহিংস কাজের জন্য যাঁদের ফাঁসির হুকুম হয়েছে তাঁরাও মুক্তি পাবেন। বিবৃতি দিয়ে তিনি করাচি পৌঁছার আগেই ভগত সিংদের ফাঁসি হয়ে যায়।’[২৯]
ভগত সিংদের ফাঁসির জন্য একমাত্র দায়ী গান্ধীজি। ফলে গান্ধীজির বিরুদ্ধে পুরো ভারতবর্ষে অসন্তোষের আগুন জ্বলে উঠলো। এই অসন্তোষ প্রশমনের জন্য গান্ধীজি বিপ্লবীদের ভরসাস্থল সুভাষকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, সুভাষের চেষ্টায় সেই বারের মতো তিনি গণ অসন্তোষ থেকে রেহাই পান।
গান্ধীজি কখনো চান নি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী রাজনীতি গড়ে উঠুক। তিনি সর্বদাই ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র রাজনীতির ধ্বংস কামনা করেছেন। ব্রিটিশরা এই সশস্ত্র বিপ্লবীদেরই সবচেয়ে বেশি ভয় পেতো। গান্ধীজি রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেই সশস্ত্র ব্রিটিশ বিরোধীতাকে কঠোর ও কুৎসিত ভাষায় হিংসার পথ বলে অবিহিত করেন। এর সাথে অহিংসার পথই যে শ্রেষ্ঠ এই বলে নতুন রাজনৈতিক অনুশাসন তৈরি করেন। এই কারণে তিনি হিন্দু শাস্ত্র পাল্টে নতুন করে লিখেছেন। এমনকি গীতার ভাষ্যও নতুন করে ঢেলে সাজিয়েছেন।
তথ্যপঞ্জি:
২৬. বিপ্লবীদের চিঠি সমগ্র, ময়ূখ প্রকাশন, কলকাতা ১৯৭২
২৭. বিপ্লবীদের চিঠি সমগ্র, ময়ূখ প্রকাশন, কলকাতা ১৯৭২
২৮. আমি সুভাষ বলছি, শ্রী শৈলেশ দে, দে’জ পাবলিশার্স; কলকাতা ১৯৭৩
২৯. বাঙলায় বিপ্লববাদ, নলিনী কিশোর গুহ, আনন্দ পাবলিশার্স; কলকাতা ১৯৭৬
পূর্বের পর্বগুলোর লিংক:
অনন্য সুভাষ (১) http://sonelablog.com/archives/24619
অনন্য সুভাষ (২) http://sonelablog.com/archives/24727
অনন্য সুভাষ (৩) http://sonelablog.com/archives/24827
অনন্য সুভাষ (৪) http://sonelablog.com/archives/24920
অনন্য সুভাষ (৫) http://sonelablog.com/archives/25039
অনন্য সুভাষ (৬) http://sonelablog.com/archives/25609
অনন্য সুভাষ (৭) http://sonelablog.com/archives/26083