
মাহবুবুল আলম
পলিথিনে পলিথিনে আবার সয়লাব হয়ে গেছে আমাদের হাট বাজার থেকে শুরু করে কাঁচা বাজার, পান চুনওয়ালা থেকে শুরু করে মাছ মাংস তরিতরকারী, বিপণী বিতান থেকে শুরু করে অভিজাত শপিংমল পর্যন্ত। সব ভোগ্যপণ্যের সাথেই এখন দোকানীরা পলিথিনে মালামাল গছিয়ে দিচ্ছে; আর আমরাও এ পলিথিনের কু-প্রভাবের কথা জেনেও তা গ্রহণ করতে কখনো অস্বীকার করছি না। সেই সুযোগে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হওয়া পলিথিন আবার দুর্দান্ত প্রতাপে ফিরে এসেছে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, ১৮ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে যদি গড়ে এককোটি লোকও দৈনিক বাজার করে আর জনপ্রতি যদি গড়ে ৩টি করেও পলিথিন ব্যবহার করে তা হলে এর সংখ্যা দাঁড়ায় তিন কোটি, মাসে ৯০ কোটি এবং বছরে ১ হাজার ৮ কোটি পলিথিন ব্যবহার করে থাকে। এই সুয়োগে পলিথিন তৈরীর জন্য গড়ে ওঠেছে অনেক অবৈধ পলিথিন কারখানা আর এর মাধ্যমেই এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিক্যাট হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
আমাদের ব্যবহৃত এই পলিথিনের খুব সামান্যই নিদ্দিষ্ট স্থানে ফেলা হয়। বাকিগুলো শহরের ড্রেন নর্দমা, সুয়ারেজ লাইন পড়ছে। যে কারণে শহরের পয় নিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মক হুমকীর মধ্যে পড়ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই যত্রতত্র ফেলা এই পলিথিন বন্ধ করে দিচ্ছে সুয়ারেজ ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা। এতে ওয়াটার লগিং সৃষ্টি হয়ে জনজীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। আর গ্রামে আমাদের বাড়ির আসেপাশে ফসলের জমিতে পড়ে আমাদের আবাদী ফসলের জমিকে অনুর্বর করে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পলিথিন ব্যাগ এমনই একটি বস্তু যার সৃষ্টি আছে কিন্তু ধ্বংস নেই। পলিথিন পরিবেশকে ধ্বংস করে কিন্তু নিজে ধ্বংস হয় না। এটি একটি জটিল রাসয়নিক যৌগ।
এই পলিথিন এখন পরিবেশ সন্ত্রাসির ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে করে তুলেছে বিপর্যস্ত। শুধু তা ই নয় এই পলিলিথিনের অপব্যবহার সঠিক পদ্ধতিতে রিসাইক্লিং না হয়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সনাতন পদ্ধতিতে রিসাইক্লিং এর ফলে আমাদের জনস্বাস্থ্য হুমকীর মুখে পড়ছে। পুরাতন ঢাকার বিভিন্ন এলাকা এবং দেশের অন্যান্য বড় শহরগুলোতে পুরাতন পলিথিন পুড়িয়ে মন্ড তৈরী করে এর দ্বারা জর্দ্দার কৌটা ও অন্যান প্যাকেজ উপজাত তৈরী করছে। এর ফলে পলিথিন পোড়ানো বিষাক্ত ধোঁয়া আমাদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে তুলছে। এই বিষাক্ত ধোঁয়ায় নানা ধরনের চর্মরোগ, শ্বাস কষ্ট, যক্ষা ও হাঁফানীর মতো মারাত্মক রোগে প্রতিনিয়তই আক্রান্ত হচ্ছে আমাদের দেশের মানুষ।
পলিথিন আমাদের জনজীবনকে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যাহতই করছে না সাথে সাথে আমাদের অর্থনীতিতে পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব। পলিথিনের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয় বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করে। তাছাড়াও এই পলিথিনের আগ্রাসী দখলদারিত্বে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের দেশের পাট ও কাগজজাত শিল্পের বাজার। পলিথেনের অপব্যবহারের কারণে বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকায় ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ক্ষতিকর পলিথিনের উৎপাদন বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে ৬ক ধারা সংযোজনের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত ঘোষণা বাস্তবায়ন করে।
একই বছরেরর নভেম্বরের ৮ তারিখ সরকার একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সাময়িক ভাবে বিস্কুট, চানাচুরের মোড়ক হিসাবে পলিথিনের ব্যবহার করা যাবে বলে জানানো হয়। তবে শর্ত থাকে যে সে সব পলিথিনের পুরুত্ব অবশ্যই ১০০ মাইক্রেনের উপরে হবে। এই আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়, কেউ যদি নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন আমদানি বা বাজারজাত করে কবে তার শাস্তি হবে ১০ বৎসরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা যাবে। আর কোনো ব্যক্তি যদি নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন সামগ্রী বিক্রি বা বিক্রির উদ্দেশ্যে প্রদর্শন, গুদামজাত,বিতরণ ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বানিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করে, তবে সে ক্ষেত্রে তার শাস্তি ছয় মাসের কারাদন্ড অথবা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় শাস্তিই প্রযোজ্য হবে। পলিথিন নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে এর পক্ষে ইতিবাচক সাড়া মিললেও ব্যবহার বন্ধে স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় পলিথিনের ব্যবহার আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছে। শুধু ফিরে আসা নয় একবারে প্রতাপের সঙ্গেই ফিরে এসেছে।
এভাবে পলিথিনে বাজার সয়লাব হলেও এর বিরুদ্ধে তেমন কোনো অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে বা কালেভদ্রে পলিথিনের বিরুদ্ধে দুএকটি দায়সারা গোছের অভিযান পরিচালনা করে নিজেদের দায় সারছে। যে অভিযানগুলো পরিচালনা করা হচ্ছে তাও হচ্ছে আবার একেবারে খুচরা পর্যায়ে কিন্তু উৎপাদনকারীদের টিকিটিও কেউ কোনোদিন ছুঁতে পারেনি। এর ফলে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে পলিথিনের উৎপাদন বিপণন ও বাজারজাতকরণ অবস্থা। অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট তদারকী প্রতিষ্ঠান ও পুলিশকে ম্যানেজ করেই উৎপাদন থেকে খুচরা বিক্রি পর্যন্ত চলছে এর রমরমা বাণিজ্য।
এই কথা বলেই শেষ করতে চাই যে, আমাদের পরিবেশের জন্য পলিথিন কতটা ক্ষতিকর তা ওপরের আলোচনায় কিছুটা হলেও বেরিয়ে এসেছে। কাজেই পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করতে হলে সরকারের কার্যকরী উদ্যোগের পাশাপাশি জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে। একই সাথে খুচরা থেকে বৃহদাকারের যে সব কারখানায় পলিথিন উৎপাদন হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণে বাড়াতে হবে আইন-শৃংখলা বাহিনীর তৎপরতা। তা হলেই আমাদের পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিথিন ব্যবহারে সবাই সচেতন হয়ে ওঠবে।
২৭টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পোস্ট। আমাদের সবার সচেতনতা বাড়াতে হবে। পলিথিনে বাজার সয়লাব। কঠোর আইনী ব্যবস্থা নেয়া দরকার। ধন্যবাদ ভাইয়া
মাহবুবুল আলম
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!
মনির হোসেন মমি
ময়লা নিষ্কাষনের আধুনিকতা আর দায়ীত্ববোধ না আসা পর্যন্ত এর কিঞ্চিৎ আসু সমাধান হবে না। আমরা কেবল সরকার সিটি কর্পোরেসনককে ফি দেই,নেতা বানাই সে অনুযায়ী তাদের কাজের কিছুই হয় না। চমৎকার উপস্থাপনা।
মাহবুবুল আলম
ঠিক বলেছেন মমি ভাই। ধন্যবাদ আপনাকে!
সুপায়ন বড়ুয়া
গুরুত্বপূর্ণ লেখা
কোন কিছুই ধরে রাখা যায় না।
বারে বারে আসে ফিরে
নালা নর্দমায় !
কার বা কি আসে যায় ?
শুভ কামনা।
মাহবুবুল আলম
ধন্যবাদ আপনাকে!
অনন্য অর্ণব
পলিথিনের কাঁচামাল কারা আমদানি করে ? তাদের ইমপোর্ট লাইসেন্স খুব শীঘ্রই বাতিল করে দেওয়া উচিত। আর পাট এবং পাটজাত পণ্যের ব্যবহারে মানুষকে আরো বেশি সচেতন করে তুলতে হবে।
মাহবুবুল আলম
ঠিক বলেছেন, ধন্যবাদ!
সৈকত দে
খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা পোস্ট। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ এই সমস্যা তুলে ধরার জন্য। আসুন আমরা সকলেই এই সমস্যা সমাধানের নিমিত্তে কাজ করি। পরিস্কার পরিছন্ন আগামী গড়ি।
মাহবুবুল আলম
আপনাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ!
ছাইরাছ হেলাল
আইনের সঠিক প্রয়োগ ই এই বিষবাষ্প থেকে জাতিকে বাঁচাতে পারে।
মাহবুবুল আলম
ছাইরাছ হেলাল! অনেক ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা জানবেন!
নিতাই বাবু
একবার তো পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এখন আবার শুরু হয়েছে এর কালো থাবা। আমি মনে করি এরজন্য আমরাই দায়ী। আমাদের মাঝেই কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা নিষিদ্ধ পলিথিন বাজারে ছেড়ে পরিবেশ দুষিত করছে। এদিকে সরকারের অবশ্যই নজর দেওয়া উচিৎ!
মাহবুবুল আলম
“একবার তো পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।”
কিন্তু নজরদারীর অভাবে আবারো পলিথিন সগৌরবে ফিরে এসেছে!
মোঃ মজিবর রহমান
এটা সরকারের অবহেলার জন্যই আবার পলিথিনে বাজার সয়লাব। কারণ এখন ময়মনসিংহ পোর মেয়র কয়েকদিন আগেই এটার বিরুদ্ধে কঠর হয়ে সাফল্য দেখছেন। কিন্তু বর্তমানে সরকারে কঠর না হলে কোন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কোন ব্যাবস্থা নিচ্ছে না। কারণ এরা ভোটে নির্বাচিত না এবং দায়বদ্ধও না মনে হয়। কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রীও একই অবস্থায়। তাঁর ব্যাক্তি কোন উদ্যোগ নাই।
কিন্তু শাহজাহান সিরাজ উদপাদন ও বাজার একই সঙ্গে কঠোর নিয়ন্ত্রন করে বাজার থেকে পলিথিন উধাও করেছিল।
খুব দুখের সহিত বলতে হই আমাদের মন্ত্রী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধীর দেশের প্রতি কোন দায়বদ্ধ দেখি না। তারা স্বিচ্ছায় কোন উন্নয়ন ও পরিস্কার পরিছন্ন বা সেবা মুলক কাজ করেনা। তারা গতানুগতিক অফিস করে মাত্র।
কিছু পরিবেশবাদীরা কিছু কাজ করে মাত্র।
মাহবুবুল আলম
মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!
সুরাইয়া পারভীন
চমৎকার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপন করেছেন। কঠোর আইনী ব্যবস্থায় পরিবেশ দূষণ এ পলিথিন ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা আর জনসচেতনতা সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সমাজ ও পরিবেশ রক্ষা করা যায়।
মাহবুবুল আলম
জনসচেতনতা সরকারের উদ্যোগ এবং কঠোর নজরদারীর প্রয়োজন।
ধন্যবাদ আপনাকে!
তৌহিদ
পলিথিন পরিবেশের কতটা ক্ষতি করছে সেটা বলাই বাহুল্য। আমাদের নিজেদের সচেতনতাই জরুরী। অসাধু কিছু মানুষের জন্য সরকারি উদ্যোগ কাজে আসছেনা।
সুন্দর সচেতনতামূলক পোস্টের জন্য ধন্যবাদ ভাই।
মাহবুবুল আলম
সরকারের উদ্যোগ ও কঠোর নজরদারী পাশাপাশি জনসচেতনতা খুবই জরুরী।
ধন্যবাদ আপনাকে!
কামাল উদ্দিন
পলিথিন যেহেতু এতটা সমস্যার কারণ সরকার এর কাচামাল আমদানি বন্ধ করে দিক। কাচামালের যোগান না পেলে বৈধ বা অবৈধ কেউই আর তা বানাতে পারবেনা। আর এভাবেই তা সহজে বন্ধ করা যেতে পারে।
মাহবুবুল আলম
এর জন্য প্রয়োজন জনসচেতনতা, এবং সরকারের কঠোর নজরদারী!
ধন্যবাদ আপনাকে!
কামাল উদ্দিন
হুমম, আমাদের সচেতনতাটা মনে হয় সব থেকে জরুরী।
জিসান শা ইকরাম
আইন কাগজে আছে, বাস্তব প্রয়োগ নেই,
জনগনের মধ্যে সচেতনতা নেই মোটেই।
অত্যন্ত জনসচেতনতা মুলক পোস্ট,
ধন্যবাদ আপনাকে।
মাহবুবুল আলম
“আইন কাগজে আছে, বাস্তব প্রয়োগ নেই,
জনগনের মধ্যে সচেতনতা নেই মোটেই।”
যথার্থই বলেছেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ জিসান ভাই!
রুমন আশরাফ
চমৎকার সময়োপযোগী পোস্ট। এদেশে আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নিতান্তই স্বল্প।
মাহবুবুল আলম
ঠিক বলেছেন! অনেক অনেক ধন্যবাদ!