রাত ৮টা । স্টেশন পৌছাতে ২০ মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। তার মানে সাড়ে ৮টার মধ্যেই পৌছে যাবে। তবে সব সময় রিক্সা বা অটোরিক্সা পাওয়া যায় না। তখন হেটে যেতে ৩০-৪০ মিনিটের মত লাগবে। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তারা রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছে। রিক্সা পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও কেউ যেতে চাচ্ছে না। আকাশের অবস্থা খারাপ। যেকোন সময় ভয়াবহ বৃষ্টি নামতে পারে। অর্ক রাস্তার ওপাশের একটা দোকান থেকে এক পেকেট বেনসন কিনল। পেকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে মুখে পুরেই জোড়ে জোড়ে টানতে লাগল সে। তার নাক মুখ দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। যে কেউ দেখলে ভাববে যে, সে অনেক পুরাতন স্মোকার। কিন্তু সিগারেট খাওয়ার মত বাঝে অভ্যেসটা তার একটু আগেও ছিলনা। তবে এখন কেন খাচ্ছে তাও সে বুঝতে পারছে না। বৃষ্টি পড়ার গতি আস্তে আস্তে বেড়ে যাচ্ছে। অর্ক জলন্ত সিগারেট হাতে নিয়ে নায়লার দিকে এগিয়ে এল। নায়লা তার ব্যাগ থেকে নীল রঙের একটা ছাতা বের করল। মেয়েরা সবসময় তাদের ব্যাগের ভেতর একটা ছাতা রাখে নাকি?
অর্ক নায়লার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই নায়লা বলল, যাওয়ার কোন ব্যবস্থা হল?
না এখনো হয়নি। এই বৃষ্টির মাঝে হবে বলেও মনে হচ্ছে না।
তাহলে আমরা যাব কি করে? হেটে যাওয়া যাবে না?
আপনি যেতে পারলে যাওয়া যাবে।
তাহলে দেরী করছেন কেন? চলুন যাই…।।
অর্ক বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যাচ্ছে। নায়লা ছাতা নিয়ে তার পাশে পাশে হাটছে। আপনি বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছেন। ছাতার নিচে আসুন। হঠাৎ এ কথা বলে নায়লা বোধহয় খানিকটা লজ্জা পেল। অর্ক পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে ধরাতে ধরাতে বলল, সিগারেটের ধোয়া আপনার ভাল্লাগবে না। এইটা শেষ হোক তারপর নাহয়……
ঠোটের কোনায় সিগারেট রেখে দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে আগুন ধরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে অর্ক। কিন্তু আগুন ধরছে না। বার বার নিভে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে সব ভিজে গেছে বলেই এমন হচ্ছে। সে চেষ্টা করতে করতে সব কাঠি প্রায় শেষ করে ফেলছে। তবুও সিগারেট জ্বালাতে পারছেনা। নায়লা তার এই অবস্থা দেখে হাসতে শুরু করল। ওর হাসি আর থামতেই চায় না। অর্ক এই প্রথম নায়লার মুখের দিকে ভালো করে তাকাল। একটা মেয়ে এত সুন্দর করে হাসতে পারে নায়লাকে না দেখলে সে বিশ্বাসই করতে পারত না। সে মুগ্ধ হয়ে নায়লাকে দেখছে।
নায়লা বলল, এই যে শুনছেন আমরা সময়ের আগে পৌছাতে পারব তো? আর কতক্ষন লাগবে?
এইতো আমরা প্রায় এসে গেছি।।
রাত ৮টা ৪৬ মিনিট।
সিলেট রেলওয়ে জংশন। তারা স্টেশনের ভেতর ঢুকল। লাইনে একটাই মাত্র ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে লোকজনের ভিড় বাড়ছে। হকাররা জানালার পাশে গিয়ে ভিড় করছে- এই বাদাম, এই কাবলী বুট, হেইই চানাচুর…চানাচুর। বেশ কিছু টোকাইও দেখা যাচ্ছে। তারা এদিক সেদিক কি যেন খুজেঁ বেড়াচ্ছে।। কয়েকজন ভিক্ষুককেও দেখা যাচ্ছে তারা বিভিন্ন ভাবে লোকজনের কাছে ভিক্ষা চাচ্ছে। কেউ গান গেয়ে, কেউবা কোন একটা সুরার আয়াত তেলাওয়াত করে ভিক্ষা চাইছে। পৃথিবীতে ভিক্ষা করাটাই মনে হয় একমাত্র সহজ কাজ। এবং ছোট বড় সবাই এই কাজটা করতে পারে। মানুষের এমন কর্মকান্ড দেখতে অর্ক’র ভালো লাগছে।
নায়লা বলল টিকেট-টা আনা হয় নি। আনতে হবে।
ওহ হ্যা। আপনার মামার বন্ধুর কি নাম যেন বললেন?
আকমল হোসেন।
উনাকে কোথায় পাওয়া যাবে কিছু জানেন?
মামাতো বলল কাউন্টারে খোঁজ করলেই পাওয়া যাবে।
ঠিক আছে চলুন। আমরা তাহলে কাউন্টারেই যাই।
আকমল হোসেনকে টিকেট কাউন্টারেই পাওয়া গেল। নায়লা নিজেই উনার সাথে কথা বলছে। অর্ক একটু দূরে গিয়ে সিগারেট ধরাল। উদাস ভঙ্গিতে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছি আর মুখ ভর্তি ধোয়া উড়াচ্ছে। এই ধোয়ার মাঝেই যেন এক ধরনের প্রশান্তি, আনন্দ, উচ্ছাস সব লুকিয়ে আছে। যে কোনদিন সিগারেট খায়নি, সে কখনো এর আনন্দটা কি তা বুঝবে না। নায়লা তার পাশে এসে দাড়াল। বলল, চলুন টিকেট নেয়া হয়ে গেছে। অর্ক বলল, আপনার সিট কোন বগিতে, কত নাম্বার? নায়লা টিকেট-টা তার হাতে ধরিয়ে দিল। “ঘ” নং বগিতে ২১ নাম্বার সিট। অর্ক বলল, চলুন আপনাকে আপনার জায়গায় বসিয়ে দিয়ে আমার দায়িত্ব সম্পুর্ন করি।
২১ নাম্বার সিট জানালার পাশে। নায়লা তার জায়গায় গিয়ে বসল। তার পাশের সিটে একজন বৃদ্ধ মহিলা বসে আছে। অর্ক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক বৃদ্ধ মহিলা থাকায় ভালোই হল। নায়লা! আমার কাজতো শেষ। এখন আমাকে বিদায় দিন। নায়লা কোন উত্তর না দিয়ে অর্ক’র দিকে তাকাল। তার তাকানোর মাঝে এক ধরনের মায়া আছে। যে মায়ার বাধঁনে আটকে গেলে সেখান থেকে আর নিজেকে বের করে আনা যায়না সেরকম মায়া। অর্ক বলল, আপনার যাত্রা শুভ হোক। এই বলে সে ট্রেন থেকে নেমে যাচ্ছে। নায়লা জানালা দিয়ে মুখ বের করে তাকিয়ে আছে। অর্ক ট্রেন থেকে নামা মাত্রই সে ডাকল অর্ক। অর্ক জানালার পাশে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবেন? নায়লা হ্যা সূচক মাথা নাড়ল।
কি বলবেন বলুন?
নায়লা কিছু বলছে না। ওর চোখজোড়া ছলছল করছে। মনে হচ্ছে এখনই এই রুপবতির চোখে কাজলের প্রাচীর ভেঁঙ্গে শিশির প্লাবন ঝরে পরবে। কিন্তু অর্ক এই মুহুর্তে এমন একটা দৃশ্য দেখতে চাচ্ছে না। নায়লা! আপনি মনে হয় কিছু বলবেন না। অর্ক আবারও হাঁটতে শুরু করল।
নায়লা পেছন থেকে বলল, থ্যাংক ইয়্যু।
অর্ক’র মনে হল এবার নায়লা সত্যি সত্যি কাদঁছে। কিন্তু কেন কাদঁবে? সে শেষ বারের মত পিছনে ফিরে তাকাল। নায়লা এখন আর জানালার বাইরে মুখ বের করে বসে নেই। হঠাৎ করে একধরনের বিষন্নতা এসে ভর করল। কেন জানি নায়লা মেয়েটার জন্য তার খারাপ লাগছে। বুকের বাম পাশটায় চিনচিনে ব্যাথাও অনুভব করতে লাগল সে। তার এমন লাগছে কেন? কোন কারনে কি তার অবচেতন মন চাচ্ছে না নায়লা মেয়েটা চলে যাক?
স্টেশনের ভেতরে একটা লাইব্রেরীর মত দোকান আছে। তার সামনে একটা ব্যাঞ্চ রাখা। অর্ক সেখানে গিয়ে বসল। পকেটে হাত দিয়ে আরো একটা সিগারেট বের করে সুখটান দিচ্ছে। অর্ক যতবার সিগারেটে টান দিচ্ছে ততবারই তার মাথায় একটা কথা এসে বার বার নাড়া দিচ্ছে। কথাটা হল “টানে টানে মজা আনে। যে টানে ভাই সেই জানে“ এই কথাটা অর্ক কার কাছে যেন শুনেছিল। কিন্তু এখন মনে করতে পারছে না।
ভাইজান চা খাইবেন? গরম গরম চা আছে।
অর্ক’র চা খেতে ইচ্ছে করছে না। সে পেছনে ফিরে তাকাল। ছোট একটা ছেলে বয়স ১০ কি ১১ হবে। যার এ সময় ঘরে পড়ার টেবিলে থাকার কথা। কিংবা টেলিভিশনের সামনে বসে টম এন্ড জেরী দেখার কথা। সে এখন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করছে। এই দৃশ্যটা নতুন না। তবুও অর্ক’র মন খারাপ হল। সে বলল, দাও চা দাও। ছোট ছেলেটার ঠোঁটের কোনে হাঁসি দেখা গেল। অর্ক মনে মনে ঠিক করল অন্তত এই হাসিটার জন্য এক কাপ না দু কাপ চা খেতে হবে। তা না হলে হাসিটার মূল্যায়ন করা হবে না।
ভাইজান চা লন।
অর্ক ধোয়া উঠা গরম চায়ের কাপ হাতে নিল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একটা তৃপ্তির নিঃস্বাস ফেলল। এমন চা সে অনেক দিন খায়নি। চা টা সত্যি অসাধারন হয়েছে। পিচ্চি নাম কি তোমার?
আমারে কইতাসেন?
হুম।
আমার নাম সালমান। তয় মাইনসে সালু কয়।
সালমান তোমার চা’টা ভালো হয়েছে। আমি আরেক কাপ খেতে চাই। ভালো করে আরেক কাপ দাও।
চলবে…
১ম পর্ব পড়ুন – http://sonelablog.com/archives/14087
২য় পর্ব পড়ুন – http://sonelablog.com/archives/14136
#৫
৬টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
সুন্দর গুছানো লেখা
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষায় আছি ।
নির্বাসিত নীল
:THANK-YOU:
শুন্য শুন্যালয়
ভালো লাগছে লেখাটা বেশ, এখন অপেক্ষায় আছি কিভাবে শেষ করবেন এটা ভেবে…
চলুক 🙂
নির্বাসিত নীল
এতদুর পর্যন্ত সাথে ছিলেন ভেবে ভাল্লগাছে।
গল্পটা শেষ করে ফেলেছি…… আশা করি সময় করে দেখবেন। 🙂
পুষ্পবতী
ভালো লাগছে
নির্বাসিত নীল
ধন্যবাদ! 🙂