শিবচর গ্রামে পৌঁছতে প্রায় ত্রিশ মিনিট লেগে গেলো। বুলবুলের ভাই আবির আর তার মা কে অনুসরণ করা লোকটা আগে থেকেই আমাদের কে বাড়ির লোকেশন জানিয়ে দিয়েছিল। বড়ইতলা থেকে রওনা দেয়ার আগেই বাড়িটাকে গোয়েন্দাদের ঘিরে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলাম। তখন থেকেই বাড়িটার উপর নজরদারি করে এসেছে গোয়েন্দারা। কাউকে ঢুকতে বা বেরোতে দেখা যায়নি। অবশ্য রাতে আশেপাশের মানুষজনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিল গোয়েন্দারা কিন্তু বাড়িটা কার বা কারা থাকে, কারা এসেছে তারা স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। বেশ ভীত ছিল তারা। উপরুন্ত পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে গোয়েন্দারা বেশি কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
বাড়িটা ঘিরে বেশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া আছে। বুঝাই যাচ্ছে বুলবুল তার মা-ভাইয়ের নিরাপত্তার জন্য কোন কমতি রাখেনি। আচ্ছা শুধুই কি মা-ভাইয়ের জন্য! বন্দুকধারী লোকেরা আগে থেকেই মনে হয় ছিল। নাহলে গ্রামের লোকেরা এত বেশি ভয় পেতো না। ছোট্ট একটা গ্রাম। গ্রামের সবাই সবাইকে চিনে। এমন জায়গায় বাইরের কেউ এসে একেবারে অপরিচিত হয়ে থাকতে পারার কথা না। হ্যাঁ, থাকতে পারবে যদি সে সেরকম ভয়ংকর কোন ইমপ্যাক্ট গ্রামবাসীর মধ্যে ফেলতে পারে। বুলবুলের এতদিন ধরে অন্তর্ধান হয়ে যাওয়ার রহস্য বুঝতে পারছি। সীমান্তবর্তী আর দূর্গম গ্রামগুলোতে সে তার সেফ হাউজ বানাতো, আর বিভিন্নভাবে গ্রামবাসীর উপর প্রভাব বিস্তার করত, ফলে সহজ সরল অশিক্ষিত মানুষগুলো ভয়ে কোন কিছু ফাঁস করত না। আর ফলাফল হচ্ছে বুলবুলের কোন হদীস থাকত না। মানুষটা যেন বেমালুম হাওয়াতে গায়েব হয়ে যেত!
যাই হোক, এ মূহুর্তে বাড়িটার উপর নজরদারি করা ছাড়া উপায় নেই। কারণ অপারেশন চালানোর মত ফোর্স নেই আমাদের সাথে! ওয়াকিটকিতে ইউনিটের অপারেশনাল ফোর্স কে আসতে বললাম। আশা করছি খুব একটা বেগ পেতে হবে না এই বাড়িটা দখলে নিতে।
ফোর্স আসতে আসতে আর তাদের ব্রিফ করতে করতে প্রায় ৪টা বেজে গেলো। প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগার কথা কিন্তু কাজের মধ্যে থাকায় ব্যাপারটা টের পাওয়া যাচ্ছে না। পরের ২০ মিনিট আরেকদফা ছোটখাটো যুদ্ধ চললো। ভোর ৪টার দিকে কোনরকম পূর্বাভাস ছাড়াই এমন গোলাগুলি গ্রামবাসীকে ব্যাপক আতঙ্কিত করে তুললেও কিছু করার নেই। গোলাগুলি থেমে যেতেই দ্রুত বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলাম। তিনজন লোকের লাশ পড়ে আছে। বেশ কয়েকজন আহত। আর বাকিরা আত্মসমার্পণ করেছে। পুলিশ দেখে তাদের স্বস্তি অনুভব করতে দেখলাম। বুঝলাম, তারা মনে করেছিল জেনারেলের লোকরা আক্রমণ চালিয়েছিল। তারা কি জানে না জেনারেল মারা গেছে! নাহ, জানার কথাও না অবশ্য!
বাড়ির ভেতরেই পাওয়া গেল বুলবুলের মা আর ভাই আবিরকে। সাথে যাদের কে আশা করেছিলাম তাদেরকেও পেয়ে গেলাম। তিথীর বাবা-মা। তাদের মুখের আতঙ্কের চাপ স্পষ্ট ছিল যেটা অবশ্য আমাকে দেখে কিছুটা স্তিমিত হলো। বুলবুলের মা জানালেন তারা ভেবেছেন যে জেনারেলের বাহিনী তাদের আক্রমণ করেছিল! তাদেরকে জানালাম জেনারেল আর বুলবুল দুইজনেই মারা গেছে। তখন তাদের সবার মুখটাই শুকিয়ে গেলো। বুলবুলকে হারানোর শোক তো আছেই আরও আছে আতঙ্ক, জেনারেল মারা গেলে কি হবে! তার সঙ্গী সাথীরা যদি প্রতিশোধ নিতে চায়! এতদিন তো বুলবুল ছিল এখন কে ঠেকাবে!
তাদের চিন্তাটা যৌক্তিক। তবে আশ্বস্ত করলাম যে পুলিশ থাকতে কোন সমস্যা হবে না। পাশাপাশি জানালাম তাদের আপাতত মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের সেফ হাউজে রাখা হবে। জেনারেলের কেস তারা হ্যান্ডেল করছে সুতরাং সাক্ষী ও অন্যান্য কিছুর জন্য আপাতত তাদেরকে কড়া নিরাপত্তা দিয়েই রাখা হবে।
ঊর্ধতন কর্মকর্তা আর মেজর আকবরের সাথে যোগাযোগ করে সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা। এরপর অতিরিক্ত ফোর্স আসার পর আমাদের গাড়িবহর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ঢাকা পৌঁছে তিথীকে দেখতে গেলাম। অবস্থার নাকি অনেক উন্নতি হয়েছে। ডাক্তারদের আশা হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই কোমা থেকে সেরে উঠবে সে। খবরটা শুনে বেশ ভাল লাগলো। তবে মনের ভিতর একটা খচখচানি রয়েই গেলো!
জেনারেল নয়, বুলবুলও না, তাহলে কে ছিল যে তিথীকে গুলি করেছিল!
ঢাকা মেডিকেল থেকে বের হয়ে ইউনিটের অফিসে যাওয়ার সময় চারুকলার সামনে দিয়ে যেতে মনে পড়লো সামনে পহেলা বৈশাখ আসছে …
এই পহেলা বৈশাখেই তো তাকে প্রপোজ করা হয়েছিল আমার!
কি অসাধারণ ছিল অনুভূতিটা …
ভাবতেই আবারও মনে হল, মেয়েটা এখনো শয্যাশয়ী অথচ তাকে হত্যা করতে চাওয়া ব্যক্তিটি এখনো বাইরে মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে …!
এডিএসইউয়ের অফিসে বসে আছি। আমাদের মিশন সফল হয়েছে। ড্রাগ মাফিয়ার প্রধান জেনারেল, তার ভয়ংকরতম সহকর্মী বুলবুল নিহত হয়েছে। আপাতত দেশে ড্রাগ সাপ্লাই আগের তুলনায় ৯০ শতাংশই কমে গেছে। একটা আধুনিক রাষ্ট্রের যুবসমাজের জন্য ড্রাগ খুবই মারাত্মক অভিশাপ! স্বাভাবিকভাবে আমার অনেক অভিনন্দন পাওয়া হয়েছে কিন্তু মনে শান্তি নেই।
অনেকটা অন্যমনষ্ক হয়েই ভাবতে লাগলাম সেদিনটার কথা …
মোবাইলটা অনবরত বেজেই চলেছে … প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করলাম।
“ হ্যালো ” – ঘুম জড়িতে কণ্ঠে বললাম।
– শুভ নববর্ষ গরু ! এখনো ঘুমাচ্ছিস ?
তিথী !! ও ছাড়া আর কেউ এভাবে বলে না। মেয়েটার কণ্ঠ শুনেই মেজাজ খিচড়ে গেলো আমার।
– হ্যা ঘুমাই। জানোসই যখন তাইলে ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করলি কেন ?
– বেশি কথা না বলে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। ধানমন্ডি লেকে চলে আয় এক ঘণ্টার মধ্যে।
– মামার বাড়ির আবদার পাইছোস ? পারতাম না। আমি এখন ঘুমাবো।
– তুই যদি না আসোস তাইলে মনে রাখিস তোর বাড়ি এসে তোরে উল্টা কইরা লটকায়া পিটামু। হুহ !
– যাহ যাহ। দূরে গিয়ে মর তুই। কাছে আইসা মরিস না। গন্ধ ছড়াবে।
– তবেরে হারামি ! আমি তোর নাক যদি আজকে না ফাটাইছি তাইলে আমার তিথী না। হুহ !
– আচ্ছা আচ্ছা দেখা যাবে নে। এখন রাখি।
– আচ্ছা। লেট করিস না আবার।
– কিসের কি ? আমি এখন ঘুমামু।
“ কুত্তা ” বলে গালিটা দিতে গিয়ে ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দেওয়ার শব্দ পেলো তিথী। ” হারামিটা আসুক খালি আজকে, একচোট দেখে নিবো। ” মনে মনে ভাবে সে।
ওদিকে আমি মনে মনে তিথীর চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে বিছানা ছাড়লাম। ঘড়িতে দেখি মাত্র সাড়ে ৯টা বাজে ! উফফফ ! মেয়েটার জন্য একটু শান্তিতে ঘুমানোর সুযোগও নাই। কিছুতেই বুঝে পাই না আমি কিভাবে এই মেয়ের প্রেমে পড়েছি।
ঠিক সাড়ে ১০টায় ধানমন্ডি লেকে গিয়ে দেখি তিথী আগে থেকেই বসে আছে।
“ ওরে হারামি, তোরে আগে আমি ৩-৪টা ঘুষি মারবো। ”
– কেন ? আমি আবার কি করলাম ?
– সকালে কি বলছোস তুই আমারে ? হুহ !
– আরে ঘুমের ঘোরে কি বলসি না বলসি তা নিয়ে এত চিল্লাপাল্লা করলে হয় ?
– এইবারের মত মাফ করলাম যা, নেক্সট টাইম কিন্তু একেবারে ঠেং ভাইঙ্গা দিমু।
– আচ্ছা দিস। এখন বল, কেন ডাকসোস এই সাত সকালে ?
– সকাল বাজে সাড়ে ১০টা। এটারে সাত সকাল বলে ?
– ওহ ! তাইলে দুপুর। সাত দুপুর !
– গরু কোথাকার। সাত দুপুর বানাইসে ! হেহেহে !
– থাপ্পড় দিয়ে সবগুলা দাঁত ফালায় দিবো
– আরে তুই আমারে সেই কখন থেকে গরু বলে যাইতেছোস আর আমি বলতেই দোষ !
“ আমি তোরে যা ইচ্ছা বলবো, তোর কি তাতে ? ”
– আজব কথাবার্তা। আমি তোর বয়ফ্রেন্ড নাকি যে যা ইচ্ছা বলবি ?
– মজা না আমি সিরিয়াস, বুদ্ধু!
“ তুই তো কাপুরুষ, নিজে জীবনে কোনদিন আগে আমারে বলতে পারবি না, জানা আছে আমার। ”
– কুত্তা এখন ভালো মত প্রপোজ কর।
– জোর করে প্রপোজের ঘটনা এই মনে হয় প্রথম হতে যাচ্ছে !
– তাড়াতাড়ি কর, নাইলে কিন্তু এক্সেপ্ট করুম না।
এই আমি কতবার সেই তোমার প্রেমে পড়েছি
আর ঠিক ততবার, বৃষ্টির গান লিখেছি, পিয়ানোতে সুর তুলেছি
আমি আবার আরেকটা বার তোমার প্রেমে পড়তে চাই
আমি আবার আরেকটা বার তোমার প্রেমে পড়তে চাই ”
– এটা কি ছিল ? তাহসানের গান দিয়ে প্রপোজ ? তাও কি গান ? তুই আর কত প্রেমে পড়বি। ব্যাটা আসল কথা বল …
– আর পারতাম না। মাফ চাই। রাজি হইলে হ নাইলে …
– নাইলে আমি পানিতে ঝাপ দিব!
– হেহেহে, এই পচা পানিতে ঝাপ তুই দিতে পারবি না জানি।
– উফফফ। আমার কপালে খারাবি আছে এই মেয়েরে নিয়ে জীবনের বাকি অংশ পাড়ি দিতে …
– না কিছু না। বললাম তুমি এত্তগুলা কিউট !
– হয়েছে আর চাপা মারতে হবে না। :/
বলেই মেয়েটা আমার কাঁধে মাথা রাখলো। দুজনে চুপচাপ উপরের বৈশাখের ঝকঝকে আকাশটা দেখতে লাগলাম।
মেয়েটা মুখে যাই বলুক, ও যে খুশি হয়েছে বুঝতে পারি আমি।
নিজেকে আজকে আমার আকাশের মতই বিশাল, সুখী মনে হচ্ছে ……
সেইদিন থেকেই আমাদের “ তুমি ” বলা শুরু …
দরজায় নকের শব্দে বাস্তবে ফেরত আসতে হলো। এসআই শহীদুল কে দেখে আসতে বললাম।
– কি আর হবে! খুনিকে তো ধরা গেল না এখনো!
“ জ্বি স্যার, আমি মনে হয় একটা ক্লু পেয়েছি! ”
“ স্যার ওইদিনের যে সন্দেহভাজন ৪ জন কে চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদের একজন ছিল বুলবুল। আর বাকি তিনজনের একজন ছিল মোখলেস, সবজি ব্যবসায়ী। ”
– হ্যাঁ। মনে আছে। কিন্তু আপনি না বলেছিলেন তাদের পক্ষে হত্যা করা সম্ভব না ?
“ সম্ভব না বলিনি স্যার, বলেছিলাম সম্ভাবনা অনেক কম। আসলে বুলবুল থাকাতে আমরা সহজেই ডাইভার্ট হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরে স্যার কি মনে করে বাকি ৩ জনের কললিস্ট চেক করলাম। আর তাতেই ঘাপলাটা টের পেলাম। ”
বলেই ফাইলটা এগিয়ে দিল সে। সেদিনের ঘটনার চারদিন আগে থেকে মোখলেসের নাম্বারে একটা নাম্বার থেকে ঘনঘন কল করা হয়েছিল। নাম্বারটা সবুজ মার্কার দিয়ে দাগ দেওয়া। আর সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে নাম্বারটা আমার পরিচিত!
প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম আমি! এই কি সেই খুনি?
কিন্তু কেন! কেন সে এই কাজ করবে? কি স্বার্থ আছে তার?
কি পাবে সে তিথীকে হত্যা করে!
আরো একটা ব্যাপার লক্ষণীয় …
নাম্বারটা সে সময় ঢাকার বাইরে অবস্থান করার কথা ছিল কিন্তু কল লোকেশন বলছে নাম্বারধারী সে সময় মোখলেসের সাথে ঢাকা থেকেই কথা বলেছিল।
“ এখন কি করবেন স্যার? আমরা অনুমান করতে পারি আসল হোতা কে। কিন্তু প্রমাণ নেই হাতে। এমনকি মোখলেসকেও দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। ”
– সেটাই সমস্যা, শহীদুল সাহেব। এখন প্রমাণ কিভাবে যোগাড় করা যায় ?
একটু চিন্তা করে নিলাম। তারপর বললাম, “ একটা কাজ করা যায়। ”
“ ধরেন তিথীকে হত্যা করতে যে গিয়েছিল তাকে তিথী দেখেছিল। কারণ সিসিটিভিতে আমরাও তাকে দেখতে পেরেছি। তাহলে এখন যদি তিথীর জ্ঞান সম্পূর্ণ ফিরে আসে তাহলে সে নিশ্চয়ই তার হত্যাচেষ্টাকারী কে শনাক্ত করতে পারবে! ”
– অবশ্যই। আর সেজন্য তার কাছে খবরটা গেলেই সে হন্যে হয়ে তিথীকে খুন করতে চাইবে। আর বুলবুল ও জেনারেল দুইজনই মারা গেছে। আপাতত তিথীর নিরাপত্তা ভয় নেই খুব একটা। যে কারণে পুলিশ বা আপনিও তাকে নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। এটাই তার জন্য মোক্ষম সুযোগ সাক্ষী মিটিয়ে দেওয়ার।
“ তাহলে এখন লোকটাকে খবর দিতে হচ্ছে যে তিথী সুস্থ হয়ে গেছে। সাথে আরও কিছু ফাঁপর ছাড়তে হবে যাতে দ্রুত হামলা করতে আসে! ”
– কাজটা আপনারই করতে হবে, স্যার।
আর কোন কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ফোনটা তুলে নিলাম।
রাত প্রায় ১২টা। ঢামেকের জরুরি বিভাগ বেশ নীরব হয়ে আছে। আগের মত নিরাপত্তা এখন আর নেই। এমন সময়েই তিথীর কেবিনের দরজাটা খুলে গেল। একটা ছায়া ভিতরে প্রবেশ করলো। প্রবেশ সন্তর্পণে এগিয়ে গেল বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে। বালিশ চাপা দিয়ে মুখ ধরে রাখলো কিছুক্ষণ। চট করেই লাইট জ্বলে উঠলো রুমের। ঘরে উদ্যত পিস্তল হাতে ঢুকলো এসআই শহীদুল আর তার দলবল। ঘরের আড়াল থেকে বের হয়ে আসলাম আমি। এতগুলো মানুষ দেখে প্রচণ্ড ভড়কে গেল লোকটা, মোখলেস। প্রথমে যে দুইজনকে সন্দেহের খাতা থেকে একেবারেই বাতিল করে দিয়েছিলাম তাদের একজন! মুখের উপর থেকে বালিশ সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো এক মহিলা কনস্টেবল, অনেকটা তিথীর মত শারীরিক গড়ন তার!
“ তারপর, তোমাকে কে এই কাজের হুকুম দিয়েছিল সেটা কি এমনি এমনি বলবা নাকি ডলা খাওয়ার পরে? ”
এসআই শহীদুলের কণ্ঠটা ভয়ংকর। মুখটা আরো শুকিয়ে গেল মোখলেসের।
“ স্যার, বিশ্বাস করেন আমার কোন দোষ নাই। আমাকে তো হুমকি দিয়ে কাজ করানো হয়েছিল, স্যার। ”
একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“ আমি আগে অবৈধ কাজ করতাম, পরে ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু উনি বললো যে যদি এই কাজ না করি তাহলে বুলবুল ভাই আমাকে ছাড়বে না। ”
“ না স্যার, উনি বললেন বুলবুল ওনার আপন ভাই। ওনার কথা না শুনলে মারাত্মক ক্ষতি হবে। বুলবুল ভাই নিজের আপন ভাইয়ের জন্য সব করবে। ”
– ভালো। আদালতেও এই সাক্ষ্যই দিবে।
“ এখনই ওয়ারেন্ট বের করে অ্যারেস্ট করুন তাকে। আর্মির সেফহাউজে আছে সে। সোজা মতিঝিল থানায় আনবেন। তার সাথে আমার কথা আছে। আর মোখলেসের কাছ থেকে তথ্য বের করুন পিস্তলটা কোথায় আছে। তার স্বীকারোক্তিই যথেষ্ঠ। ”
এসআই শহীদুলকে নির্দেশগুলো দিলাম। আমার জানতে হবে কেন করেছিল সে এই কাজ!
ঘণ্টাখানেক পরেই আবিরকে নিয়ে আসলো এসআই শহীদুল। তার একটু আগেই মতিঝিল থানার আরেক এসআই সেলিম মোখলেস কে নিয়ে পিস্তলটা উদ্ধার করে এনেছে। সেগুলো আগামীকালই ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে।
আবির থানায় ঢুকেই মোখলেসকে দেখে কুঁকড়ে গেলো। বুঝে গেছে তার খেল খতম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ কেন করলে কাজটা? তিথী তো তোমার বোন ছিল! তোমার ভাই তাকে বাচানোর জন্য জীবন দিলো আর তুমি তার জীবন নেওয়ার চেষ্টা করলে কেন? ”
এক মুহুর্ত নীরব থেকে জবাব দিতে শুরু করলো সে,
“ চাচার সম্পত্তির লোভ ছিল আমার। আমাদের অবস্থা খুব ভাল ছিল না। ভাইয়ার দয়ায় চলতাম আমরা। যেটা আমার বা আম্মার একটুও পছন্দ ছিল না। আর একটা কারণ হচ্ছে তিথীকে আমার পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু আমার প্রস্তাব সে প্রত্যাখ্যান করে দেয়। এ কারণে আমি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। তিথীর পরিবার তখন আমার ভাইয়ের আশ্রয়ে আর তারপরেও এত দেমাগ সহ্য হয় নি আমার। ”
“ সে সময় জেনারেল আর ভাইয়ার বিরোধ লাগলো তিথীর পরিবার নিয়ে। আমার মনে হলো যে ভাইয়া বুঝি তিথীকে ভালোবাসে। তাই সে এত কিছু করছে। সেজন্য আরো বেশি রাগ হয়েছিল। তাই এমনভাবে তিথীকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম যাতে করে কেউ বুঝতে না পারে। ভাইয়া সন্দেহ করত জেনারেল কে আর পুলিশ করত ভাইয়াকে। আমি সেফ থাকতাম আবার চাচার সম্পত্তিও পেতাম। ”
– তোমার চাচার সম্পত্তি তো বিক্রি করে দিয়েছিল, তাই না?
“ নাহ। ওটা ভাইয়া এক প্রবাসীর নামে চালান করে দিয়েছিল। জেনারেল থেকে নিরাপদ হলেই সেটা আবার চাচা ফিরে পেত। ভাইয়া এমনই ব্যবস্থা করে রেখেছিল। ”
আর কিছু জানার নেই। কেসটা অনেক সামান্যই ছিল। কিন্তু পারিপ্বার্শিক কিছু ব্যাপার মিলে পুরো কেসটা ঘোলাটে হয়ে যায়, কিন্তু শেষমেশ যে সবকিছু ভালোই ভালোই শেষ হলো তাতেই খুশি লাগছে।
এখন অপেক্ষার পালা! তিথী অনেকখানি সুস্থ হয়ে গেছে। বিপদ কেটে গেছে তার উপর থেকে। এখন তাকে সাধারণ কেবিনে পাঠানো হয়েছে। আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। কয়েকদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে সে। তাকে ছাড়া কাটিয়ে দিয়েছি সাড়ে ছিয়াত্তর সপ্তাহ।
কিন্তু এখন আর সহ্য হচ্ছে না …
৪টি মন্তব্য
চাটিগাঁ থেকে বাহার
আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ এত সুন্দর গল্প উপহার দেবার জন্য। -{@ (y)
আরো চাই।
ইঞ্জা
দারুণ এক গল্প উপহার দিলেন, খুব ভালো লাগলো।
নীলাঞ্জনা নীলা
সুন্দর সমাপ্তি। টানটান উত্তেজনা ছিলো প্রতিটি পর্বে।
খুবই ভালো লেগেছে ধারাবাহিক এই গল্পটি।
মেহেরী তাজ
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একই রকম উত্তেজনা নিয়ে পড়েছি।
অনেক পছন্দ হয়েছে লেখাটা।
ধন্যবাদ আপনাকে। 🙂