সময়টা বড় অস্থির যাচ্ছিল আমাদের তখন। বড় তিন ভাই পালিয়ে আছেন। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট এর পর থেকে। ১৫ আগস্ট সকালে ভেবেছিলাম মেঝ ভাই হয়ত নেই। তিন দিন পরে খবর পাই- তিনি গাজীপুরে আত্মগোপন করে আছেন।
ক্লাস এইটে পড়া আমিও ‘ সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চেষ্টাকারীদের ‘ একজন হিসেবে তালিকাভুক্ত হবার পরে থানার ওসি ভাবীর দেয়া খবর পেয়ে পালাই বাসা থেকে। কিছুদিন বাগেরহাট মাজারে , এরপর খুলনার রূপসার এক আত্মীয়ের বাড়ী। থানা এবং তৎকালীন বীর ( যারা ১৯৭১ সনের ১৪ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত পালিয়ে ছিল ) , তাদের দু’একজন কে ম্যানেজ করে ফিরে আসি সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকেই। কৃতজ্ঞতা থানার তৎকালীন ওসি এবং তার স্ত্রীর প্রতি। তাঁরা ভালো ভুমিকা না নিলে এত দ্রুত ফিরে আসা সম্ভব হোত না ।
একটি দলকে শেষ করে দেয়ার জন্য যা যা কিছু করা দরকার সব কিছুই করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন নিষিদ্ধ এক নাম। এই দেশে আবার কোনদিন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হবে – তা কেউ ঐ অবস্থায় কল্পনাও করেনি।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহটা ছিল বড়ই অস্থির । হঠাৎ পত্রিকা আসেনা শহরে । ঢাকায় কিছু একটা হচ্ছে । উত্তেজনা , গুঞ্জন সর্বত্র । শহরে ফেরত আসা কিছু রাজাকারকে রাস্তায় আর দেখা যাচ্ছে না । টেলিফোনের পেটে হ্যান্ডেল ঘুড়িয়ে কিছুক্ষণ পর পর এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ঢাকায় যোগাযোগের চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না। এক্সচেঞ্জ থেকে ফোনই রিসিভ করেনা।
ভাসা ভাসা খবর পেলাম – ঢাকায় অভ্যুথান , পাল্টা অভ্যুথান হচ্ছে। কে যে ক্ষমতায় আছে বুঝা যাচ্ছেনা। অবশেষে পত্রিকা আসলো , সব খবর পেলাম। চমকে উঠলাম জেলখানায় নিহত জাতীয় চার নেতার হত্যার খবরে । মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস জাতিকে নেতৃত্ব দানকারী নেতাদের খুন করা হয়েছে জেল খানার অভ্যন্তরে। একজন তাজউদ্দীন আহমেদ না হলে আমাদের দেশটি কি স্বাধীন হোত ? যুক্তি তর্ক দিয়ে হয়ত এই প্রশ্নকে মেরে ফেলা যায়। কিন্তু প্রশ্নটি প্রশ্নই থেকে যাবে।
যে দেশটি প্রতিষ্ঠার জন্য চার নেতা নেতৃত্ব দিলেন , সেই দেশটিরই কিছু মানুষের হাতে তাঁরা জেলখানার অভ্যন্তরে খুন হলেন। কত বিশাল নির্মমতা আর বিশ্বাসঘাতকতা। অধ্যাদেশ দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হোল এই খুনের বিচার প্রক্রিয়াকে। বিশেষ বিমানে করে খুনিদের পাঠিয়ে দেয়া হোল বিদেশে । পরবর্তীতে খুনিরা হোল পুরস্কৃত । দেশ চলে গেল সেই পাকিদের মত সেনাছাউনিতে।
রায় হয়েছে এই জাতীয় চার নেতার হত্যার । ক্লাস এইটে পড়ুয়া তখনকার আমি মনে মনে চাইতাম – এই জাতীয় বীরদের হত্যাকারীদের উপযুক্ত বিচার হোক। ধন্যবাদ শেখ হাসিনা আপনাকে , আপনি এক তরুণের স্বপ্ন পূরণ করেছেন এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে গতি সঞ্চার করে।
১০টি মন্তব্য
"বাইরনিক শুভ্র"
জাতি হিসাবে কিছুটা দায় মুক্ত হয়া গেল । এখন রাজাকারগুলোর বিচার শেষ হলেই হয় ।
জিসান শা ইকরাম
এই রায়ের দ্রুত বাস্তবায়ন চাই।
আর রাজাকারদের বিচারে কোন আপোষ নাই।
ছাইরাছ হেলাল
অবশেষে শেষ হল কাঙ্খিত বিচার বেশ দেরি করে হলেও ।
জিসান শা ইকরাম
বিচার দেখে যেতে পেরেছি , এটাই ভাগ্য ।
বনলতা সেন
এতগুলো বছর লেগে গেলো চার নেতা হত্যার বিচারে। লীগ সরকার ব্যাতিত এই বিচার হতোনা ।
জিসান শা ইকরাম
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে , এই হত্যাকান্ডের বিচার হতো না ।
নীহারিকা
স্বপ্ন পুরণ। খুব ভালো লাগলো লেখাটি।
জিসান শা ইকরাম
হ্যা , স্বপ্ন পূরণ। তরুণ বয়সে এই হত্যাকান্ড ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে এনাদের কথা শুনতে শুনতে জাতির মুক্তির সেনানায়ক ভাবতে শুরু করেছিলাম। সেই সেনানায়কদের এভাবে কেউ খুন করতে পারে তা ভাবতে পারিনি। আল্লাহ্র কাছে অনেক বলেছি , এই হত্যাকারীরা যেন শাস্তি পায়।
শিশির কনা
জাতি দায় মুক্ত হলো ।
জিসান শা ইকরাম
হ্যা , এখন অপেক্ষায় আছি , রাজাকারদের সাজা কার্যকরের ।