মামনি-বাপি ছাড়া কারোরই মনে থাকেনা, আমার দুর্ঘটনার দু’ বছর হয়ে গেছে। কারণ আমি নিজেই মনে করিনা। বিষণ্ণতা নিয়ে লেখাটা লিখতে না হলে দুর্ঘটনা শব্দটাকে উচ্চারণও করতাম না। শরীরে ও মনে যে যুদ্ধ করে চলছি একা একা, আমাকে এতোটাই বদলে দিয়েছে যে আমি আসলে যেমন ছিলাম, ঠিক তেমন আর নেই। বরং এমন একটা এক্সিডেন্টের জন্য ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ। মানুষ চিনেছি, জীবনকে বুঝেছি। কে বন্ধু আর কে শত্রু সেটাও দেখেছি। দুর্ঘটনা নিয়ে তাই আমার কোনো আফসোস নেই।
আমরা প্রায় সকলেই অল্পতে ভেঙ্গে পড়ি। একাকীত্ত্বকে নিজের যন্ত্রণা ভেবে নিই। কিন্তু এটাই তো সত্যি যে, পৃথিবীতে মানুষ তাদের পাশেই থাকে যেখানে আনন্দ আছে। নিজেকে নিয়ে শুধু ভেবে দেখলেই হয়, যখন অন্য কেউ অসুস্থ, তখন কী সেখানে গিয়ে ভালো লাগে? কতোক্ষণ সেই মানুষের কাছে থাকি আমরা? অথচ সেই একই মানুষের বাসায় যদি পার্টি হয় পরপর দু’ দিন, আমাদের চেষ্টায় থাকবে দু’ দিনই সেখানে যাবার। নিজে যখন ভাবতে পারিনা, তখন অন্যের বেলায় কেন আশা করবো? কেউ নেই পাশে, পৃথিবীতে কেউই কারো পাশে থাকেনা। আমরা প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে চলি। আমি আমাকে নিয়ে বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করি। খুউব কষ্ট হতো একা, নিজের শ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কেউ নেই। হাসপাতাল থেকে যেদিন বাসায় এলাম, রাতে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে দেখি তীর্থ গভীর ঘুমে। কান্না পাচ্ছিলো। সকালে কেয়ারগিভার এলো, একঘণ্টা পর চলে গেলো। সারাদিন একা। মনে হচ্ছিলো কেন বাঁচিয়ে নিলো আমায়? মুহূর্তে চোখে ভেসে এলো মামনি-বাপির মুখটা। আমি মরে গেলে ওদের অবস্থা কতোটা খারাপ হতো! মা-বাবার কাছে সন্তান হারানোর বেদনা সহ্য করা অনেক কষ্টের। যাক এক এক করে দিন যাচ্ছিলো। বন্ধু ঊর্মী ছিলো পাশে, আমি কৃতজ্ঞ সেইসব দিনগুলোতে ও কাছে ছিলো। তারপরেও কী একাকীত্ব কাটতো? যে আমি বাসায় থাকতেই চাইতাম না, সেই আমি দিনের পর দিন বাসায়। একটা মানুষ অসুস্থ অবস্থায় একেবারে একা সাতদিন বাসায় থাকলেই স্ট্রেস অনুভব করে। যখন বুঝছিলাম আমি ডুবে যাচ্ছি, তখনই নিজেকে ওঠানোর চেষ্টা শুরু করলাম। সময়টা যেনো কাটতেই চাইতো না। লেখালেখি করবো, ল্যাপটপে বসতে পারতাম না, বই পড়ছি মাথায় অসম্ভব ব্যথা, শুধু ছিলো গান। কিন্তু গানের সুর কী আর ব্যথার যন্ত্রণা কমিয়ে দিতে পারে? তবু কেউ পাশে থাকলে দুটো কথা বললে মনটা অন্যদিকে যায়। যে আমি কথা না বলে একটা মিনিটও থাকতে পারতাম না, সেই আমি দিনের পর দিন কথা না বলে থাকা শিখে গেছি। একটুকুও কষ্ট হয়না। কে, কখন, কোন কথাতে আঘাত পেয়ে যাবে, অথবা আমি-ই আঘাত পাবো, তার চেয়ে একা থেকে স্বস্তি কুড়োনো অনেক ভালো।
কাউকে বুঝতে দিতাম না কষ্ট-যন্ত্রণার কথা। হাসিটা সবসময়ই ব্যথার সাথেই লেপ্টে থাকতো। তাই হয়তো কেউই বুঝতো না আমার যন্ত্রণাটাকে। Work Safety Insurance-এর সাথে প্রতি মাসে মিটিং হতো। প্রথম মিটিং-এ ওরা ভেবেই বসলো আমি বুঝি অভিনয় করছি। কারণ কেউ জিজ্ঞাসা করলেই আমার অভ্যাসই ছিলো হাসিমুখে ভালো আছি বলার। অবশ্য আস্তে আস্তে নিজেকে গোছানো শুরু করলাম। এই দুটো বছর কতো কী না-ই করেছি! এখনও করে যাচ্ছি। নাহ হেরে যাইনি। হুইলচেয়ার থেকে ওয়াকার, লাঠি নিয়ে চলছি। একদিন ঠিক জানি কোনো অবলম্বন ছাড়াই পেরে যাবো চলতে। এসব কথা বলা সহজ, কিন্তু করা ততোটাই কঠিন। তবে আফসোস করা শিখিনি আমি, সান্ত্বনা নেয়া এবং দেয়া দুটোই আমার অপছন্দ। আর তাই নিজেকে ভালো রাখি, ভালো থাকিও। বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য সবচেয়ে বড়ো চিকিৎসক হচ্ছে নিজের মন। আমাদের বিষণ্ণতার প্রধান কারণই হচ্ছে, চাওয়া-পাওয়ার সমীকরণ। চেয়ে না পাওয়া এবং যা চাই না, সেসব পাওয়া-ই আমাদের মনকে যন্ত্রণা দেয়। আমরা সব কথা কাউকে বলতে পারিনা, কারণ বলার মতো মানুষও পাওয়া যায়না। পৃথিবীতে সেই মানুষের পরিমাণ খুবই কম, যারা অন্যের কথাকে যত্নসহকারে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আমার মতে যে কথাগুলো কাউকে বলার দরকার, কিন্তু বলতে পারছেন না, সেসব কথা ডায়েরীতে লিখুন। নিজের মনের কথাগুলোর সাথে নিজের চোখের দেখা করিয়ে দিন। দেখবেন মন তখন অনেকটাই হাল্কা হবে। আর যখন কোনো নেগেটিভ কিছু মনের মধ্যে চলে আসে, তাকে পাত্তা দিতে যাবেন না। আমি কিন্তু কোনো নেগেটিভ ভাবনা মনের ভেতর আসতেই দিইনা। আর যদি ভুল করে চলে আসে, তাকে পাত্তা দিইনা কিন্তু! এবারে কিছু কথা বলে শেষ করতে যাচ্ছি বিষণ্ণতা নিয়ে লেখা এই পোষ্ট।
১) দুঃসময়ে কেউ পাশে নেই, তার জন্য কী কান্না করা উচিৎ? প্রশ্ন হলো কাঁদলে কী সমাধান পাওয়া যাবে? যদি পাওয়া যায়, তাহলে ঠিক আছে কান্না করা যেতেই পারে। যদি কান্নায় সমাধান নেই, তাহলে কান্না কেন? হাল্কা হতে? কান্নায় কে বলেছে হাল্কা হয়? বরং ভারী হয়ে থাকে মন। হেসে দেখুন, অভ্যেস করে ফেলুন। সমাধান পাওয়া যাবেই।
২) কেউ আপনাকে প্রচন্ড কষ্ট দিয়েছে, সেই কষ্ট তার উপরে চাপিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে। যাক চাপিয়ে দেয়া গেলো না। তাহলে কী করা উচিৎ? পাত্তা না দেওয়া। তাও পারছেন না? তাহলে অভ্যেস করে নিন। ‘ওই যে ধুর বাদ দে তো’ টাইপ বলে নিজেই নিজের মুখে ঝামা ঘসুন। এ কথা শোনার পরে কী আমার উপর মেজাজ গরম হচ্ছে, দিন কিছু রাগ উগলে এই লেখার উপর। কষ্ট কমবেই।
৩) আমাদের মধ্যে হিংসা কিংবা jealous কাজ করে। তখন আমরা অন্যকে বিদ্রূপ করি। আর ওই বিদ্রূপের ভেতর এমন একটা ক্ষোভ কাজ করে, যা মাত্রাতিরিক্ত হলে বিশাল ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। হিংসা যখনই মনে আসে, নিজের অসাধারণ দিকটির কথা ভাবা উচিৎ। প্রতিটি মানুষের মধ্যে আলাদা আলাদা বিশেষত্ব আছে, যার উপরে গুরুত্ব দিলে এগিয়ে যাওয়া যায়।
৪) যে মানুষ প্রচণ্ড বিরক্তিকর হয়ে ওঠে, তার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়া উচিৎ। তবে সেই মানুষের জন্য ক্ষতি চাইতে নেই। বরং বিপদে পাশে দাঁড়াতে হয়।
৫) প্রত্যেকের জীবনেই কেউ না কেউ শত্রু হিসেবে থাকে। তবে একটা কথা আমরা কখনো বুঝিনা। আসলে আমরা নিজেরাই কিন্তু নিজের সবচেয়ে বড়ো শত্রু।
৬) দুঃসময়কে ফেরানোর জন্য সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করা চাই। সমাধান নিজের হাতের মুঠোয়, তীক্ষ্ণভাবে ভাবুন। পাবেনই।
৭) নিজের উপর বিশ্বাস রাখা চাই, অবশ্যই সততা সহযোগে। ফলাফল দেরীতে হলেও, জয় আসবেই।
৮) সংসারে অশান্তি। আপনি চেষ্টা করে যাচ্ছেন সবকিছু সামলে নেবার। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যাচ্ছে। কী করবেন? কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না? সবসময় কী পথ খুঁজে পাওয়া যায়? যায়না! তবে এও সত্যি একটি পথ বন্ধ হলে আরেকটি পথ খুলে যাবেই।
নাহ্ এটুকুই থাক। সত্যি বলতে কী, নিজে যা যা করি, সেসবই লিখেছি। যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস আমার সবসময়ই ছিলো। আর দুর্ঘটনার পর থেকে নিজেকে অন্যভাবে তৈরী করেছি অল্প অল্প করে। কষ্ট আমারও আছে। না-পাওয়াও আছে। তবু ভেঙ্গে পড়িনি। কারণ সমস্যাহীন জীবনে কোনো আনন্দ নেই। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ওই গানটার মতো,
“খোলা আকাশ কী এতো ভালো লাগতো, যদি কিছু কিছু মেঘ নাই ভাসতো
বলো জীবন কী সুন্দর হতো, যদি একটুও ব্যথা নাই থাকতো!”
হ্যামিল্টন, কানাডা
৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ ইং।
**সমাপ্ত**
এক – জীবনে কঠিন চাপ এবং বিষণ্ণতার সাথে জয়ী হওয়া
দুই – জীবনে কঠিন চাপ এবং বিষণ্ণতার সাথে জয়ী হওয়া – পরীক্ষার ফলাফল
তিন – জীবনে কঠিন চাপ এবং বিষণ্ণতার সাথে জয়ী হওয়া – দায়িত্বশীলতা
চার – জীবনে কঠিন চাপ এবং বিষণ্ণতার সাথে জয়ী হওয়া- হ্যামিল্টনে জীবনযুদ্ধ শুরু
১৪টি মন্তব্য
ইঞ্জা
আপু বুকটা কেঁপে উঠে যখনই আপনি আপনার এক্সিডেন্ট নিয়ে লিখেন, বুঝি মামনি বাপির কষ্ট, আপনি এই যুদ্ধে জয়ি হয়েছেন, শিখছেন, চিনেছেন এ সত্যিকারের বাস্তবতা, আপনার প্রতিটি লাইনের সাথে সহমত পোষণ করছি প্রিয় আপু।
নীলাঞ্জনা নীলা
ভাইয়া মন খারাপ করবেন না। আমি কখনোই চাইনা আমার জন্য ভেবে কেউ কষ্ট পাক। আর আপনি তো আমার একমাত্র হ্যান্ডপাম্প ভাইয়া।
ভালো থাকুন সবসময় ।
ইঞ্জা
ভাই হিসাবে বোনের জন্য ভাববোনা তা কিভাবে হয়, প্রার্থনা করি বোন আমার যেন সবসময় ভালো থাকে। 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
আমার ভাইয়াও ভালো থাকুক সবসম।
ছাইরাছ হেলাল
অহেতুক বা মেকি কথায় প্রশংসা না করেই বলছি,
আপনি পেরেছেন, আবারও বলছি আপনি পারবেন-ও,
আর পারতে যে আপনাকে হবেই;
আপনার উপলব্ধির সাথে একাত্ম হয়েই বলছি— মানুষ আসলেই একা এবং একা।
নিজের যুদ্ধটুকু শুধুই নিজের, একান্তই নিজের।
নীলাঞ্জনা নীলা
ঠিক বলেছেন আমি আসলেই পেরে যাই। আমাকে কোনো কষ্টই বেশীদিন ধরে রাখতে পারেনা। এই দুর্ঘটনাও পারেনি। বরং এই কষ্টের ভেতর এতো চমৎকার একটা জীবনকে সাজিয়েছি, যা অকৃত্রিম।
যুদ্ধ নয়, আমার শান্তির জগতে আছি।
ধন্যবাদ কুবিরাজ ভাই।
জিসান শা ইকরাম
তোর এই সিরিজ লেখাটা আমাকে আরো ভালভাবে বেঁচে থাকতে প্রেরনা দেয়। যখন কিছু কিছু হতাশা এসে গ্রাস করে আমাকে, তখন তোর কথা ভাবি। শক্তি পাই।
মনের জোর যে ভালভাবে বাঁচার মুলমন্ত্র তার উদহারন তুই।
শুভ কামনা।
নীলাঞ্জনা নীলা
নানা জীবনে কোনোদিন কোনো কারণেই ভেঙ্গে পড়োনা। বরং মনে মনে নিজেকে বলো, আমি সব বাধা পার হতে পারবোই।
All is well 🙂
নীরা সাদীয়া
এরকম লেখা আরও চাই, আরো, আরো।
কিছু কথা আছে, কাওকে বলা যায় না। সেগুলো ডাইরী লিখে পরেছি আরো বিপদে। কি করবো, কোথায় রাখব এ ডাইরী? নাকি ছিঁড়ে ফেলব? এমন অবস্থা!
তবে আপনার বোল্ড করা লেখাগুলো আমার জন্য খুব দরকার ছিলো। নতুন করে অনেক কিছু শিখলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপুনি যে কষ্টের কথাগুলো ডায়েরিতে লিখেছো, কয়েকবার পড়ার পর ছিঁড়ে ফেলে দাও। তখন বেশ কষ্ট হবে। এভাবে বারবার ছিঁড়ে ফেললে ক্রমশ নিজের ভেতর একটা শক্তি জেগে উঠবে। আর মানসিক ওই শক্তিটাই আলো দেখাবে। যা আমি করি।
ভালো থেকো আপুনি।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনাটায় মনে প্রচন্ড সাহসই আপনাকে স্রষ্টা আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিয়েছেন।উপদেশময় লেখাগুলো মেনে চলতে পারেন ক’জনায় তবে মেনে চললে নিজেরই লাভ।সুন্দর সাবলিল লেখা।শুভ কামনা জানাই সুন্দর মনের বোনকে -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
মনির ভাই আমি কখনোই কোনোকিছুতেই ভেঙ্গে পড়তাম না। আর দুর্ঘটনা এসেছে আশীর্বাদস্বরূপ। মাঝেমধ্যে মন খারাপ আমাদের সকলেরই হয়, এটাই তো জীবন। ভেঙ্গে যাওয়া মানেই হেরে যাওয়া।
অনেক ভালো থাকবেন।
তৌহিদ ইসলাম
আপু আপনার লেখা পড়ে নিজের মাঝে সাহস আর উৎসাহ পেলাম। আল্লাহ আপনাকে হেফাজত করুন।
নীলাঞ্জনা নীলা
মন্তব্যের জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।